“এদেশের ছাত্র শ্রমিক জনতা বুকের রক্ত দিয়ে স্বৈরাচারকে উচ্ছেদ করার পরও নতুন করে স্বৈরাচার চেপে বসে। আজ থেকে ৩৪ বছর আগে স্বৈরাচারী এরশাদকে উচ্ছেদ করলেও গণতন্ত্র পুরোপুরি মুক্তি পায়নি।”
Published : 10 Nov 2024, 02:11 PM
স্বৈরাচারী ব্যবস্থা উচ্ছেদ করে গণতন্ত্রকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সব শ্রেণি পেশার মানুষের ঐক্য গড়ে তুলে ‘নীতি-নিষ্ঠ রাজনৈতিক শক্তির’ পতাকাতলে সমবেত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স।
রোববার সকালে ঢাকার গুলিস্তানের জিরো পয়েন্টে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দেোলনের শহীদ নূর হোসেন ও শহীদ আমিনুল হুদা টিটোর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে এ কথা বলেন তিনি।
রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, “এদেশের ছাত্র শ্রমিক জনতা বুকের রক্ত দিয়ে স্বৈরাচারকে উচ্ছেদ করার পরও নতুন করে স্বৈরাচার চেপে বসে। আজ থেকে ৩৪ বছর আগে স্বৈরাচারী এরশাদকে উচ্ছেদ করলেও গণতন্ত্র পুরোপুরি মুক্তি পায়নি। এরপর থেকে পালাক্রমে যারা ক্ষমতায় ছিল তারা তিন জোটের রূপরেখা এবং আচরণবিধি মানেনি। উপেক্ষা করে চলেছিল। দীর্ঘদিন ধরে স্বৈরশাসন দেশবাসীর কাঁধে ভর করেছিল।
“স্বৈরাচারী ব্যবস্থা উচ্ছেদ ছাড়া গণতন্ত্রকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা যাবে না। তাই আজকের অঙ্গীকার হবে, পূর্ণ গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য স্বৈরাচারী ব্যবস্থার উচ্ছেদের সংগ্রাম বেগবান করতে হবে। এ কাজটি করতে পারে নীতিনিষ্ঠ রাজনৈতিক শক্তি। যার যার দাবিতে বিভিন্ন শ্রেণির পেশার মানুষের ঐক্য গড়ে তুলে নীতি-নিষ্ঠ রাজনৈতিক শক্তির পতাকাতলে তাদের সমবেত করতে হবে।”
জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর নূর হোসেন বুকে ও পিঠে ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ স্লোগান লিখে রাজপথে বের হয়েছিলেন।
আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের একটি মিছিল পল্টন এলাকার ‘জিরো পয়েন্ট’ অতিক্রম করার সময় পুলিশ কাঁদুনে গ্যাস ও গুলি ছুড়ে মিছিলটিকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
নূর হোসেন ছাড়াও সেই আন্দোলনে আরেক যুবলীগ নেতা নূরুল হুদা বাবুল এবং কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরের ক্ষেতমজুর নেতা আমিনুল হুদা টিটো পুলিশের গুলিতে নিহত হন।
তাদের সেই আত্মত্যাগের পর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন তীব্রতর হতে থাকলে ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে এরশাদ সরকারের পতন হয়।
মর্মান্তিক সেই ঘটনার স্মরণে এরশাদের পতনের পর থেকে প্রতি বছর ১০ নভেম্বর পালিত হচ্ছে নূর হোসেন দিবস হিসেবে। আর জিরো পয়েন্টের নাম হয়েছে ‘নূর হোসেন চত্বর’।
এবার এমন এক সময়ে নূর হোসেন দিবস পালিত হচ্ছে, যখন ছাত্রজনতার প্রবল আন্দোলনে আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটেছে। বৈষম্যবিরোধী সমাজ গড়ার স্বপ্ন দেখিয়ে নানাক্ষেত্রে সংস্কারে হাত দিয়েছেন মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার।
প্রিন্স বলেন, “এবারের জুলাই-অগাস্টের গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম আকাঙ্ক্ষা হল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও বৈষম্যমুক্ত সমাজ গড়ার পথে এগিয়ে যাওয়া। যে দাবিতে এদেশের বাম প্রগতিশীল শক্তি দীর্ঘদিন ধরে সংগ্রাম করে চলেছে।
“বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তিন মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো জনজীবনে শান্তি আসেনি। নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় মানুষের মধ্যে হতাশা কাজ করছে। পতিত স্বৈরাচার, দেশি-বিদেশি অপশক্তি নানা ধরনের অপতৎপরতা চালাচ্ছে। এই সরকারের অন্যতম করণীয় হল নির্বাচন ব্যবস্থার আমূল সংস্কার করে নির্বাচনের পথে এগিয়ে যাওয়া এবং এর জন্য রোডম্যাপ ঘোষণা করা। এ বিষয়ে সরকারের সুস্পষ্ট বক্তব্য না থাকায় মানুষের মনে নানা সন্দেহ অবিশ্বাস তৈরি হচ্ছে।”
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সমালোচনা করে প্রিন্স বলেন, “গণতন্ত্রের কথা বলা হচ্ছে, সাইবার সিকিউরিটি আইন বাতিলের কথা বলা হয়েছে, এটা খুবই ভালো পদক্ষেপ। আবার নানা ধরনের দায়মুক্তি আইন জারি করে সরকারের সব ধরনের কাজের বিষয়ে প্রশ্ন তোলাকে নিষিদ্ধ করার কথাও শোনা যাচ্ছে। একটা গণতান্ত্রিক সমাজে এটি কাম্য হতে পারে না। এ ধরনের দায়মুক্তি দেওয়ার পথ থেকে সরকারকে সরে আসতে হবে।
“স্বৈরাচারী ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের ওপরে থাকা মাফিয়া ও রাস্তার মাফিয়ারাই রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণকর্তা ছিল। দুর্বৃত্তায়িত অর্থনীতি আর দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতি দেশকে গণতন্ত্রহীন ও লুটপাটের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেছিল। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় কালক্ষেপণ হলে এরাই আবার নানা নামে তাদের রাজত্ব অব্যাহত রাখবে।”
মুক্তিযুদ্ধ, ৯০-এর গণঅভ্যুত্থান, ২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের চেতনাকে ধারণ করে পূর্ণ গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য নির্বাচন এবং ব্যবস্থা বদলের সংগ্রাম অগ্রসর করতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান সিপিবির সাধারণ সম্পাদক।
শ্রদ্ধা নিবেদনের সময় সিপিবির সম্পাদক আনোয়ার হোসেন রেজা, লূনা নুর, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য জাহিদ হোসেন খান, সংগঠক সাদেকুর রহমান শামীম, শ্রমিক নেতা আব্দুল কাদের, ক্ষেতমজুর নেতা মোতালেব হোসেন, কৃষক নেতা আলতাফ হোসেন, সাবেক ছাত্রনেতা দীপক শীল, সাংস্কৃতিক সংগঠক রতন কুমার দাস, যুবনেতা জাহাঙ্গীর আলম নান্নু, নুরুল ইসলাম গাজীসহ সিপিবি নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
পরে গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ রাশেদ খানের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল শহীদ নূর হোসেন চত্বরে শ্রদ্ধা নিবেদন করে।
রাশেদ খান বলেন, “আওয়ামী লীগ আজ গর্তের মধ্যে লুকিয়ে আছে। কাউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আওয়ামী লীগের কর্মীদের বলতে চাই, আপনারা শেখ হাসিনার ফাঁদে পা দেবেন না। শেখ হাসিনার যদি বাপের বেটি হত, প্রকৃতপক্ষে শেখ মুজিবের কন্যা হত, তাহলে এই বাংলাদেশ থেকে এভাবে পালিয়ে যেত না।
“আজকে শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছে, তার প্রেত্মাতারা বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাফেরা করছে। শ্রদ্ধা জানানোর পরে আমরা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের সামনে মিছিল করব, দেখতে চাই কোথায় আওয়ামী লীগ আছে। আওয়ামী লীগের ঠিকানা এই বাংলাদেশে হবে না। আমরা আওয়ামী লীগের প্রেতাত্মাদের ধরে ধরে জেলে ঢুকানো ব্যবস্থা গ্রহণ করব।”
নূর হোসেনের ভাই দেলোয়ার হোসেন, আনোয়ার হোসেন ও বোন শাহানারা আক্তারসহ পরিবারের সদস্যরাও সকালে নূর হোসেন চত্বরে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
গাণআন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগও এদিন ‘নূর হোসেন চত্বরে’ শ্রদ্ধা নিবেদনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল। ওই কর্মসূচি প্রতিহত করতে শনিবার মধ্যরাতেই 'ছাত্র-জনতা' ও 'গণঅধিকার পরিষদ' ব্যানারে রাজধানীর গুলিস্তান জিরো পয়েন্টে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করেন একদল মানুষ।
তাতে উত্তেজনা তৈরি হলে রোববার সকাল থেকে পুরো এলাকায় কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়।
ঢাকা মহানগর পুলিশের ( ডিএমপি) গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপ কমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, "কর্মসূচির নামে কাউকে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা করতে দেওয়া হবে না। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী, ঢাকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা সাজানো হয়েছে।"
এ পরিস্থিতিতে রোববার সকাল ৯টার পর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে জড়ো হয়ে স্লোগান দিতে থাকেন বিএনপি ও বসহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। পরে তারা সেখানে মিছিলও করেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে দুপুর ১২টার দিকে গুলিস্তানের জিরো পয়েন্টে অবস্থান নেন।
‘আমার সোনার বাংলায়, ফ্যাসিবাদের ঠাঁই নাই; ‘একটা একটা লীগ ধর, ধইরা ধইরা জবাই কর; ‘দিয়েছি তো রক্ত, আরও দেব রক্ত’ ‘উই ওয়ান্ট, জাস্টিস জাস্টিস’– এমন সব স্লোগান দিতে থাকেন তারা।
আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে ‘জয়বাংলা’ স্লোগান দেওয়ায় কয়েকজনকে মারধর করে উপস্থিত জনতা। তবে দুপুর পর্যন্ত আওয়ামী লীগের ব্যানারে কাউকে নূর হোসেন চত্বরে আসতে দেখা যায়নি।