নাম পরিবর্তনকারীদের কথা তারা নাকি রাজনৈতিক কারণে ভয়ের বশবর্তী হয়ে এই নামগুলো দিয়েছিলেন। এতদিন পরে বোঝা গেল জগদীশচন্দ্র, সত্যেন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, প্রফুল্ল চন্দ্র গোপনে গোপনে পতিত স্বৈরাচারের দল করতেন!
Published : 04 Mar 2025, 07:19 PM
কিছুদিন আগে এক বন্ধুর সঙ্গে বাজি ধরে আমি এক হাজার টাকা হেরেছি। এ জন্য প্রথমত দায়ী করতে চাই মহান খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়কে, দ্বিতীয়ত দায়ী আমি নিজে– চলমান ঘটনা থেকে আমার বিচ্ছিন্নতা। আমার বন্ধুটি যখন এক চায়ের আড্ডায় বলল, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় সত্যেন্দ্রনাথ বসু, জগদীশচন্দ্র বসু, জীবনানন্দ দাশ এর মত অন্যদের নামে রাখা সেখানকার অ্যাকাডেমিক ভবনগুলোর নাম পালটে ১, ২, ৩ ইত্যাদি রেখেছে, বিশ্বাস হয়নি। চলতি ঘটনা থেকে চিরবচ্ছিন্ন আমি নির্বোধ অহঙ্কারে ফুলে তখনই বললাম, এটা খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা নয়, কোনো একটা ক্লাবের ঘটনা। সে তার বক্তব্যে অনড় থাকলে আমি আরও নির্বুদ্ধিতার সঙ্গে এক হাজার টাকা বাজি ধরে বসলাম। দোকান থেকে একটা পত্রিকা এনে সে আমায় ধরিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে গচ্চা দিলাম মাসের শেষ সম্বল এক হাজার টাকার একটি নোট। এই নির্বুদ্ধিতার কথা আমার আরেক বন্ধুকে বলতেই সে বলে উঠল, বিশ্ববিদ্যালয়ে এটা ঘটেনি, এতে অন্ধবিশ্বাস করলেও, কোনো ক্লাবে যে এমনটা ঘটতে পারে এ উদ্ভট চিন্তাও মাথায় এল কী করে। ঠিক।
আবার দেখুন, অনেক ইতিহাস বিশারদ বলেন পশ্চিমের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মাদ্রাসার মডেলেই তৈরি। ভাবছি, পশ্চিমে তো যথেষ্ট মাদ্রাসা নেই, তবু তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের এত নামডাক, আর আমাদের দেশে এত মাদ্রাসা তবু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এমন করুণ দশা কেন। মাদ্রাসার পজিটিভ দিকটা হলো যে, তারা তাদের কোনো অ্যাকাডেমিক ভবনের নামই ওই রকম ব্যক্তিদের নামে রাখবে না যাদের নাম আবার হাওয়া বুঝে পালটে দিতে হয়। অবশ্যই খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো হল ও ভবনের নামই ওই সব জগদ্বিখ্যাত ব্যক্তির নামে রাখা ঠিক হয়নি। তারা যে সুযোগমত পালটে ফেলেছে এই দূরদৃষ্টির জন্য তারা সারা দেশের প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য!
এ হলো সেই কংসরাজের বংশধর হওয়ার মত বড়াই করে বেড়ানো। বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে কিছু না জেনে না বুঝেই অলঙ্কার হিসেবে তাদের নাম ব্যবহার করে নিজেকে জাতে তুলবার এই চতুরতা কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের মানায় না। ইচ্ছেমত এসব বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিদের নাম ব্যবহার করবেন আবার ইচ্ছে হলেই ছুঁড়ে ফেলবেন– এত বুদ্ধিবৃত্তিক দারিদ্র্য নিয়ে এরা বিশ্ববিদ্যালয়ের হর্তাকর্তা হন কী করে? বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ জ্ঞান সৃষ্টি করা, সেভাবেই তাকে বিশ্বে নিজের নাম প্রতিষ্ঠা করতে হয়, যেসব মনীষী জ্ঞান সৃষ্টি করেছেন তাদের নাম ভাঙিয়ে নয়।
এই নাম ভাঙানোর চেষ্টা করেছিলো খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তারা। রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী আবার নিজের নামটাই পাল্টানোর দাবি তুলেছে। অবশ্য তাদের দাবি হচ্ছে পূর্বেরটাই নাকি আসল নাম। স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার সরকার নাকি ওটাকে বাদ দিয়ে রোকেয়ার নাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ঝুলিয়ে কৃতিত্বটা নিজের থলিতে ভরতে চেয়েছে। নিজে নতুন কিছু করার মুরোদ নেই, যা আছে সেটারই নাম বদলে কৃতিত্ব বাগানোর এই ধান্দাবাজি লজ্জার ও নিন্দনীয়। গত স্বৈরাচারী সরকারের আমলে এটা অনেক প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনার ক্ষেত্রেই হয়েছে। সুতরাং রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দাবির যৌক্তিকতা আছে।
তবে নাম বদলে ফেলার চেয়ে উত্তম হচ্ছে রংপুর বিশ্ববিদ্যালয় নামে আরেকটা বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির আকাঙ্ক্ষা। কেননা স্বৈরাচারের ইচ্ছায় হলেও রোকেয়ার নামে বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ায় রংপুরবাসীর মান বাড়ে বই কমে না। রোকেয়া কত বড় একজন আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব তা জানলে তার নামের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে আমরা বিব্রত হতাম না, বরং গর্বিত হতাম।
রোকেয়ার ‘সুলতানার স্বপ্ন’ উপন্যাস কেবল একটি নারীবাদী ইউটোপিয়া নয়, একটি সফল বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিও। বিজ্ঞান-লেখক থমাস লিউটন ২০১৯-এ ইংরেজি ফেমিনিস্ট ভিশনস অব সায়েন্স অ্যান্ড ইউটোপিয়া ইন রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন’স সুলতানা’স ড্রিম শীর্ষক প্রবন্ধে একে বলেছেন “এটি বিশ্বে প্রথম দিককার নারীরচিত বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিগুলোর একটি।” তার মতে রোকেয়া তার সমকালের চেয়ে কয়েক দশক এগিয়ে ছিলেন। এ নারীবাদী বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিটিতে তিনি কেবল বিজ্ঞান ও পুরুষতান্ত্রিকতার যোগসাজশের সমালোচনা করেননি, সমালোচনা করেছেন বিজ্ঞান ও ঔপনিবেশিক আধিপত্যবাদী শক্তির যোগসাজশেরও। নারী-অধিকারের জন্য রোকেয়ার জীবনব্যাপী সংগ্রাম ও লেখালেখি বাংলার রাজনৈতিক অগ্রগতি ও ঔপনিবেশিক শক্তির হাত থেকে মুক্তির বার্তা বহন করেছে বলেও মনে করেন লিউটন।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তনের ঘটনাটি অন্তবর্তী সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদকেও আহত করেছে। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পূর্বাচলে বাংলাদেশ-চীন ফ্রেন্ডশিপ এক্সিবিশন সেন্টারে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৬তম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “আমরা ছোটবেলা থেকে জগদীশ বসুর গল্প শুনেছি। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে জগদীশচন্দ্র বসু, তাঁর মতো বিজ্ঞানীর নামে করা ভবন-স্থাপনা ছিল, সেগুলোর নাম পরিবর্তন করেছে। আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্রের নামে স্থাপনা ছিল। তাঁর পাশাপাশি আরও কয়েকজনের নামে করা স্থাপনার নামও বদলানো হয়েছে। এটি আমাকে মর্মাহত করেছে।”
উল্লেখ্য, প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রশাসনিক ভবনের নাম পরিবর্তন করে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য গোলাম রহমানের নামে করা করেছে। মুক্তিযুদ্ধকালীন এই ভবনটি ছিল রেডিও সেন্টার।
এছাড়া জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের নাম বীরশ্রেষ্ঠ মোহাম্মদ রুহুল আমিন হল, বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের নাম বিজয় ২৪ হল, সত্যেন্দ্র নাথ বসু অ্যাকাডেমিক ভবনের নাম অ্যাকাডেমিক ভবন ১, জগদীশ চন্দ্র বসু অ্যাকাডেমিক ভবনের নাম অ্যাকাডেমিক ভবন ২, কবি জীবনানন্দ দাশ অ্যাকাডেমিক ভবনের নাম অ্যাকাডেমিক ভবন ৩, জয় বাংলা ভবনের নাম অ্যাকাডেমিক ভবন ৪ করা হয়েছে।
শহীদ তাজউদ্দিন আহমদ প্রশাসনিক ভবনের নাম প্রশাসনিক ভবন, শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আলীম চৌধুরী চিকিৎসা কেন্দ্রের নাম খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টার, সুলতানা কামাল জিমনেসিয়ামের নাম খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় জিমনেসিয়াম, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় কেন্দ্রীয় গবেষণাগারের নাম খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় গবেষণাগার করা হয়েছে।
এছাড়া শিক্ষকদের তিনটি কোয়ার্টারের নামও পরিবর্তন করা হয়েছে।
কেউই মর্মাহত হতেন না যদি এই নামগুলো দেয়াই না হতো, একইভাবে নামপরিবর্তনকারীদের বুদ্ধিবৃত্তিক দেউলিয়াত্বও ফাঁস হয়ে যেত না, তাদের এই দুর্দশা দেখে তারা নিজেরা না হলেও অনেকেই লজ্জিত। বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর জন্ম বাংলাদেশের ময়মনসিংহে, পড়ালেখা ফরিদপুরের একটি স্কুলে আর পৈতৃক নিবাস বিক্রমপুরে। মাতৃভূমির প্রতি জগদীশচন্দ্রের ভালবাসা কেমন ছিল বোঝা যায় ১৯১১ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য-সম্মিলনীর ময়মনসিংহ অধিবেশনে প্রদত্ত সভাপতির অভিভাষণে। ‘বিজ্ঞানে সাহিত্য’ শীর্ষক এ ভাষণে তিনি বলেন, “মাধ্যাকর্ষণ শক্তি কেহ এড়াইতে পারে না। সেই অদৃশ্য শক্তিবলে বহু বৎসর পরে আজ আমি আমার জন্মস্থানে উপনীত হইয়াছি। ... এই সাহিত্য-সম্মিলন বাঙ্গালীর মনের এক ঘনীভূত চেতনাকে বাংলা দেশের এক সীমা হইতে অন্য সীমায় বহন করিয়া চলিয়াছে এবং সফলতার চেষ্টাকে সর্বত্র গভীরভাবে জাগাইয়া তুলিতেছে।”
আবার ১৯১৫ সালে মাতৃক্রোড়তুল্য বিক্রমপুরে ‘বোধন’ শীর্ষক প্রদত্ত ভাষণে তিনি বলেন, “এই বিক্রমপুর বিক্রমশালী সন্তানের জন্মভূমি, মনুষ্যত্বহীন দুর্ব্বলের নহে। আমার পূজা হয়ত তিনি গ্রহণ করিয়াছেন, এই সাহসে ভর করিয়া আমি বহুদিন বিদেশে যাপন করিয়া জননীর স্নেহময় ক্রোড়ে ফিরিয়া আসিয়াছি। হে জননী, তোমারই আশীর্ব্বাদে আমি বঙ্গভূমি এবং ভারতের সেবকরূপে গৃহীত হইয়াছি।”
অবশ্য নামপরিবর্তনকারীদের কথা তারা নাকি রাজনৈতিক কারণে ভয়ের বশবর্তী হয়ে এই নামগুলো দিয়েছিলেন। এতদিন পরে বোঝা গেল জগদীশচন্দ্র, সত্যেন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, প্রফুল্ল চন্দ্র প্রমুখ গোপনে গোপনে পতিত স্বৈরাচারের দল করতেন! যে জগদীশচন্দ্র বসু নিজে কখনো শক্তিমান ব্রিটিশের সঙ্গেও আপস করেননি, তারা ক্ষমতার তোষণ করতে গিয়ে জগদীশচন্দ্রকেও টেনে আনলেন। তারা জানেন কি, প্রেসিডেন্সি কলেজে শিক্ষকতার চাকরিতে ইংরেজ শিক্ষকদের সঙ্গে তার বেতনের বৈষম্য দেখে প্রতিবাদে বৈষম্য দূর না হওয়া পর্যন্ত এই মুন্সিগঞ্জের জগদীশচন্দ্র বিনা বেতনে পড়িয়েছিলেন তিন বছর? জগদীশচন্দ্র বসু ছিলেন নীরব বিদ্রোহের আরেক নাম।
এভাবে অন্যদের কথাও একে একে বলা যায়। মোদ্দা কথা হলো, জগদীশচন্দ্র, সত্যেন বসু, রোকেয়া কিংবা জগদ্বিখ্যাত কোনো বাঙালি মনীষীর নামে কোনো কিছুর নাম দিতে চাইলেও তার অনুমতি দেয়া ঠিক না। কর্তৃপক্ষের উচিত যারা এসব নাম দিতে চান, তারা সত্যি তাদেরকে বোঝেন কিনা, তাদের সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা আছে কিনা, নাকি সবটাই গুগল থেকে জেনে সস্তা বাহবা নেয়ার জন্য। তেমনটা হলে এই মনীষীদের নাম নিয়ে ছেলেখেলা করার অনুমতি দেয়া ঠিক না।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে সম্ভব হলো এরা ‘বোসন কণা’র নামও পালটে দিত– সত্যেন বসু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চব্বিশ বছর ধরে পড়িয়েছেন তাতে কী আসে যায়! খুঁজলে বোসন কণার চেয়ে আরও হাজারটা ভাল নাম কি পাওয়া যাবে না? নতুন একটা নাম ঠিক করে ফেইসবুকে ঘেরাও বা সড়ক অবরোধের একটা ঘোষণা দিয়ে দেয়া যাক– তারপর বোঝো ঠেলা!
আরও পড়ুন-