আবার নাটকীয় ঘটনায় শিরোনামে জাতীয় পার্টি।
Published : 22 Aug 2023, 10:12 PM
নিজেকে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ঘোষণা করে রওশন এরশাদের নামে যে বিজ্ঞপ্তি এসেছে, তার সত্যতা নাকচ করেছেন তার রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহ।
তিনি বলেছেন, এ বিষয়ে রওশন এরশাদ কিছুই জানেন না। এটা একটা চক্রান্ত এবং এর প্রতিবাদ তারা জানাবেন।
সেনা শাসক এইচ এম এরশাদের মৃত্যুর পর জাতীয় পার্টির কর্তৃত্ব নিয়ে তার স্ত্রী রওশন এরশাদ এবং ভাই জি এম কাদেরের বিরোধ দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচিত বিষয়।
তখন জাতীয় পার্টির নেতাদের উদ্যোগে সমঝোতায় রওশন সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা এবং দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হন, আর জি এম কাদের হন দলের চেয়ারম্যান ও সংসদে বিরোধীদলীয় উপনেতা।
তারপরও নেতৃত্ব নিয়ে টানাপড়েন চলছিল। তার মধ্যেই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের কয়েক মাস আগে মঙ্গলবার রওশানের নামে বিজ্ঞপ্তি আসে সংবাদ মাধ্যমে, যেখানে তিনি নিজেকে চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন।
জি এম কাদেরকে ‘অব্যাহতি’ দিয়ে ‘চেয়ার’ নিলেন রওশন
মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি, নানা ধরনের মামলা-মোকদ্দমা এবং দল পরিচালনায় ‘অযোগ্যতা ও অসাংগঠনিক আচরণের কারণে’ কাদেরকে অব্যাহতি দেওয়ার কথা বলা হয় তাতে।
রওশন লেখেন, “আমি বেগম রওশন এরশাদ, এমপি জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা কো–চেয়ারম্যান এই মর্মে ঘোষণা করছি যে পার্টির সিনিয়র নেতাদের পরামর্শে ও সিদ্ধান্তক্রমে দলের গতিশীলতা বজায় রাখার স্বার্থে দলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ করলাম।”
এই বিজ্ঞপ্তি ‘ভুয়া’ বলে তখনই দাবি করেছিলেন জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু, যিনি দলে কাদেরের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত।
এই বিজ্ঞপ্তির সত্যতা জানতে চাইলে পরে রওশন এরশাদের রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার কাছে যখন ইনফর্মেশনটা এসেছে, তখন আমি ম্যাডামকে (রওশন) বিষয়টা জিজ্ঞাস করেছি, ম্যাডাম বলেছেন, ‘বিষয়টা আমি জানিই না, কারা করেছে, এটা বের কর’। আমি তো জানিই না, ম্যাডামও জানেন না।”
সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা রওশনের পক্ষে বিবৃতি-বিজ্ঞপ্তি এতদিন ধরে সৌদি আরবে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত গোলাম মসীহর মাধ্যমেই আসছে।
এবারের বিজ্ঞপ্তি নিয়ে তিনি বলেন, “এটা একচুয়ালি চক্রান্ত হয়েছে, কন্সপিরেসি হয়েছে।”
কারা করেছে, জানতে পেরেছেন- এ প্রশ্নে গোলাম মসীহ বলেন, “পার্টির কিছু অতি উৎসাহী লোক থাকে না? কে করেছে, আমরা এটা বের করার চেষ্টা করছি।”
বিজ্ঞপ্তিটি আসার পর তার কোনো ‘ভিত্তি নেই’ বলে চুন্নু দাবি করলেও বিপরীত বক্তব্য এসেছিল সাবেক মহাসচিব ও সংসদে বিরোধীদলীয় প্রধান হুইপ মশিউর রহমান রাঙ্গাঁর। জাতীয় পার্টি থেকে বহিষ্কৃত এই নেতা বলেছিলেন, এই সিদ্ধান্ত না মানলে চুন্নুরা রাস্তায় নামতে পারেন।
জাতীয় পার্টিতে নেতৃত্ব নিয়ে প্রতিযোগিতা থাকতে পারে, তবে দল ঐক্যবদ্ধ রয়েছে বলে দাবি করেন গোলাম মসীহ।
তিনি বলেন, “আমরা মনে করি, জাতীয় পার্টি একই আছে। ম্যাডাম রওশন এরশাদও মনে করেন পার্টি একই আছে। এখানে নেতৃত্বের হয়ত কিছু প্রতিযোগিতা আছে, পার্টি তো একটাই।”
এভাবে চেয়ারম্যান হওয়ার কোনো সুযোগ নেই জানিয়ে মসীহ বলেন, “চেয়ারম্যান হওয়ার একটা নিয়ম আছে, চেয়াম্যান যে কেউ চাইলেই তো হতে পারে না। আমাদের গঠনতন্ত্র আছে, গঠনতন্ত্রে একটা নিয়ম আছে।
“চিঠি-টিঠি, কই থেকে আসছে? অনেক প্রেসিডিয়াম মেম্বারের সই পাইছেন, সেটা তো তারা বলল তাদের না। বাবলা ভাইও (সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা) বলল, এটা উনার না। কীভাবে আসল, সেটা আমরা বুঝে উঠতে পারছি না।”
এখন পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমরা মিটিংয়ে বসছি, সিদ্ধান্ত নিয়ে কালকে একটা রিজয়েন্ডার আমরা দিতে পারব।”
ভারত সফররত জি এম কাদেরের সঙ্গে এনিয়ে আলোচনা হয়েছে কি না- প্রশ্নে মসীহ বলেন, “তিনি দেশের বাইরে। আমাদের দলের লোকজন ক্ষুব্ধ, এটা কীভাবে হল? আমরা বিব্রত।”
জাতীয় পার্টিতেবিবাদের জেরে গত বছরের ৩১ অগাস্ট হঠাৎ করেই এক চিঠিতে দলের কাউন্সিল আহ্বান করেছিলেন রওশন। তখন জিএম কাদেরের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, এই পদক্ষেপ ‘অবৈধ’, কারণ, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কাউন্সিল আহ্বানের ক্ষমতা আছে কেবল তার।
এরপর জাতীয় পার্টির নেতৃত্ব নিয়ে আদালতেও মামলা করা হয়। দুই পক্ষের দ্বন্দ্বের মধ্যে গত ১৩ ডিসেম্বর জাতীয় পার্টির দুই নেতা একসঙ্গে গিয়ে দেখা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে। সে সময় দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতার কথাও জানানো হয়।
গত কয়েক মাস ধরেই জি এম কাদের আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচনা করে বক্তব্য দিয়ে আসছেন। আগামী জাতীয় নির্বাচন এককভাবে করার কথাও বলে আসছেন তিনি।
১৯৯৯ সালে জাতীয় পার্টি বিএনপির সঙ্গে জোটে গেলেও ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে সে জোট থেকে বের হয়ে আসে। এ নিয়ে তখন দলে ভাঙন ধরে। বিজেপি নামে দল গঠন করে বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে জোটে থেকে যায় একটি অংশ।
২০০৬ সালে বিএনপিবিরোধী আন্দোলনের সময় আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয় জাতীয় পার্টি। ২০০৮ সালে জোটবদ্ধ হয়েই তারা যায় ভোটে।
২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনের আগে এরশাদ একেক সময় একেক অবস্থান নেন। তবে ভোটের আগে আগে তার অসুস্থতার কথা বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করে। বেগম রওশন এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির একাংশ যায় ভোটে।
সে সময় জি এম কাদের তার ভাইয়ের পক্ষে অবস্থান নিয়ে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নেন। এরশাদও মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের আবেদন করেন। তবে নির্ধারিত সময় শেষ হয়ে যাওয়ায় ব্যালটে নাম নাম থেকে যায়। রংপুর সদর আসন থেকে সংসদ সদস্যও নির্বাচিত হন তিনি।
২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে আবার আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির মধ্যে সমঝোতা হয়। আগের বার দুই দল একসঙ্গে সরকার গঠন করলেও এবার জাতীয় পার্টিকে আর মন্ত্রিত্ব দেওয়া হয়নি।
আগামী জাতীয় নির্বাচনে জাতীয় পার্টি কী করবে, এই আলোচনার মধ্যে গত ২০ আগস্ট ভারতের আমন্ত্রণে নয়াদিল্লি যান জি এম কাদের। এর আগের দিন গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন রওশন।
এর তিন দিন পরেই রওশনের দলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেওয়ার কথা জানিয়ে বিজ্ঞপ্তিটি আসে, যার সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।