দ্বিতীয় দফায় ৪৮ ঘণ্টা অবরোধের প্রথম দিন ঢাকায় পুড়েছে ৮টি গাড়ি; এর মধ্যে সাতটি বাস।
Published : 05 Nov 2023, 11:43 PM
বিএনপি-জামায়াতের ডাকা অবরোধে দিনের বেলায় ঢাকায় পিকেটারদের কোনো তৎপরতা থাকছে না। তবে সন্ধ্যার পর থেকেই নগরীর এখানে ওখানে যানবাহনে আগুনের খবর আসছে। ভোরে পার্ক করে রাখা বাসগুলোও জ্বালিয়ে দিচ্ছে দুর্বৃত্তরা।
এমন অবস্থার মধ্যে রাজধানী ঢাকায় সড়কে নামছে মানুষ; কর্মস্থলে যাচ্ছেন। তবে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে মানুষের চলাচল কমেছে। এতে যানজটের নগরীর সেই কোলাহল চোখে পড়ছে না। সড়কে গণপরিবহন কম চলতে দেখা গেছে। তবে ব্যক্তিগত গাড়ি এবং সিএনজি অটোরিকশা ও রিকশা চলেছে বেশি।
এর মধ্যেই থেমে থেমে বিভিন্ন সময় আগুনের খবর এসেছে। তবে অন্য কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার সংবাদ মেলেনি।
ফায়ার সার্ভিসের তথ্য বলছে, রোববার অবরোধের প্রথম দিনে ঢাকায় আটটি যানবাহনে আগুন দেওয়া হয়েছে। ভোর, সকাল ও সন্ধ্যার পর থেকে রাত পর্যন্ত এসব ঘটনা ঘটেছে।
গত সপ্তাহে এক দিন হরতাল ও তিন দিন অবরোধ করার পর চলতি সপ্তাহে আবার ডাকা ৪৮ ঘণ্টা অবরোধের প্রথম দিন ঢাকায় মোট সাতটি বাস ও একটি জিপে আগুন দেওয়া হয়।
এর মধ্যে তিনটি বাসে আগুন দেওয়া হয় ভোরে, সন্ধ্যায় আগুন দেওয়া হয় দুটি গাড়িতে। অন্য তিনটি গাড়িতে আগুনের একটি দেওয়া হয় সকালে, একটি বিকেলে ও একটি রাতে।
হরতাল-অবরোধের দিনগুলোতে আগের মতো এদিনও কথার লড়াই চলেছে দুই পক্ষে। তবে বিএনপির নেতারা আছেন আত্মগোপনে। তাদের হয়ে ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য তুলে ধরছেন সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
আগের কয়েক দিনের মতো চলছে গ্রেপ্তার অভিযান। এদিন আটক হয়েছেন বিএনপির একজন ভাইস চেয়ারম্যান। দলটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, সারা দেশে তাদের শতাধিক নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
নগরীতে এদিনও যান চলাচল ছিল তুলনামূলক কম। তবে মতিঝিলের পথে প্রথমবারের মতো যাত্রী নিয়ে ছুটেছে ট্রেন। এই রুটে বেলা ১১টা পর্যন্ত নিরাপদে ও নির্বিঘ্নে যাতায়াত করেছেন যাত্রীরা।
অবরোধের ভোর চারটার দিকে ডেমরা ও জুরাইনে একই সময়ে দুটি পার্ক করে রাখা বাসে আগুন দেওয়ার কথা জানায় ফায়ার সার্ভিস। ভোর সোয়া ৫টায় মিরপুর এলাকায় পার্ক করে রাখা আরেকটি বাসে আগুন দেওয়া হয়।
সকাল সাড়ে ৭টার দিকে বনশ্রীর মেরাদিয়া বাঁশপট্টি এলাকায় চলন্ত অছিম পরিবহনের একটি বাসে আগুন দেয় যাত্রীবেশী দুর্বৃত্ত। এ সময় চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাছে ধাক্কা দিয়ে রাস্তার পাশে খালে নামিয়ে দেন বাসটি।
এ সময় নামতে গিয়ে ওই বাসের যাত্রী আরেকটি বাসের চালক মো. সবুজ দগ্ধ হন। তাকে উদ্ধার করে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়।
খিলগাঁও থানার পরিদর্শক (অপারেশন) এম এ হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সকালে অছিম পরিবহনের ওই বাসে কয়েকজন দুর্বৃত্ত আগুন দেয়। তবে কাউকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি।“
সবুজের অবস্থা ‘আশঙ্কাজনক’ জানিয়ে বার্ন ইনস্টিটিউটের আবাসিক চিকিৎসক তরিকুল ইসলাম বলেন, "তার (সবুজ) তার শ্বাসনালী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, শরীরের শতকরা ২৮ শতাংশ শতাংশ পুড়ে গেছে।“
মেরুল বাড্ডার আনন্দনগরে পরিবার নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকেন সবুজ। তার গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহয়ের ফুলপুর উপজেলার গোদারিয়ায়।
বিকাল পৌনে ৪টার দিকে মিরপুর বাঙলা কলেজের সামনে বিআরটিসির একটি দ্বিতল বাসে আগুন দেওয়া হয়। বাসটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আনা নেওয়ার কাজে ব্যবহার করা হয়। এটি শিক্ষার্থীদের নামিয়ে ফিরছিল।
সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে ঢাকার বাংলামোটর মোড়ে এয়ারপোর্ট পরিবহনের একটি বাসে আগুন ধরিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা।
ফায়ার সার্ভিসের কেন্দ্রীয় মিডিয়া সেলের কর্মকর্তা তালহা বিন জসীম জানান, সিদ্দিক বাজার ফায়ার স্টেশনের দুটি ইউনিট গিয়ে সেই আগুন নেভায়।
এক কিছুক্ষণ পরে ৭টার দিকে আগুন দেওয়া হয় মিরপুর সাড়ে ১১ নম্বর এলাকায় শিকড় পরিবহনের একটি বাসে।
রাত সোয়া ৮টার দিকে নিউমার্কেটের উল্টোপাশে নীলক্ষেতের সড়কে একটি জিপে আগুন দেওয়া হয়। আগুনে নিসান পাথফাইন্ডার জিপ গাড়িটি পুড়ে যায়।
গ্রেপ্তার কত
একদিকে নাশকতা, অন্যদিকে চলছে পুলিশের গ্রেপ্তার অভিযানও। বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর ভাষায়, “সারা দেশে চলছে ‘গ্রেপ্তার ঝড়’”।
তার দাবি, গত ২৮ অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তারের সংখ্যা ৭ হাজার ৯৭৪ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় আটক করা হয়েছে ২৬১ জনকে।
এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে রোববার ঢাকা মহানগর পুলিশ জানিয়েছে, গত ২১ অক্টোবর থেকে ৪ নভেম্বর পর্যন্ত ১৫ দিনে ২ হাজার ১৭২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আর সাম্প্রতিক সহিংস ঘটনায় মামলা হয়েছে ৮৯টি।
সর্বশেষ রোববার ভোরে, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আলতাফ হোসেন চৌধুরীকে আটকের তথ্য জানায় র্যাব।
এরপর গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির সমাবেশের দিন প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলার ঘটনায় করা মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে তাকে আদালতে পাঠানো হয়। জামিন আবেদন নাকচ করে কারাগারে পাঠিয়েছে আদালত।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সচিবালয়ে বলেছেন, “উনাদেরকে (বিএনপি নেতা) রাজনৈতিক কারণে ধরা হয়নি, উনাদেরকে অপরাধজনিত সংশ্লিষ্টতায় ধরা হয়েছে, রাজনীতির সঙ্গে এটার কোনো কানেকশন নেই।”
‘গুহা থেকে ব্রিফিং’ নিয়ে পাল্টাপাল্টি
গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপি-পুলিশ সংঘর্ষের পর হরতাল ডাকেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এরপর অবরোধের যে ঘোষণাগুলো এসেছে, তা ভার্চুয়াল ব্রিফিংয়ে দিয়েছেন আত্মগোপনে থাকা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
এ ঘটনাকে গুহা থেকে ব্রিফিং বলে টিপ্পনী কেটেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তার জবাবে রোববারের ভার্চুয়াল ব্রিফিংয়ে রিজভী বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিকামীরা আত্মগোপনে যেতে বাধ্য হয়েছে। তখন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল টিক্কা খান এই ধরনের ‘হুঙ্কার’ দিতেন।
রিজভী বলেন, “সারা দেশে চলছে ‘গ্রেপ্তার ঝড়’। সেই গ্রেপ্তারে তৃণমূল থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত কাউকে আপনারা (ওবায়দুল কাদের) রেহাই দিচ্ছেন না। আর ওবায়দুল কাদের সাহেব মুচকি হাসি দেন, অট্টহাসি দেন যে, ‘কোথায় বিএনপির নেতারা?’, আর গুহা থেকে নাকি আমরা প্রেস বিফ্রিং করি।”
‘এই ধরনের কথা তো টিক্কা খানেরা বলতেন’ উল্লেখ করে রিজভী বলেন, “অপারেশন সার্চ লাইট যখন তারা করল ২৫ মার্চ, করার পরে তারা যখন দখল নিয়ে নিল, তখন দেশের লোক তো আর প্রতিবাদ করতে পারেনি সামনাসামনি। তাদেরকে সরে যেতে হয়েছে নিজের বাসা থেকে, বাড়ি থেকে।
“গ্রামে যেতে হয়েছে, না হলে দেশের সীমানা পার হতে হয়েছে। তখন এই টিক্কা খান, নিয়াজিরা ঠিক একই ধরনের কথা বলেছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের তারা দুষ্কৃতিকারী বলেছেন।”
বিএনপির অবরোধ কর্মসূচি মঙ্গলবার সকালে শেষ হলে সেদিন পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে বলেও জানান তিনি।
কারাবন্দি বিএনপি নেতাদের সঙ্গে সংলাপ নয়
গ্রেপ্তার হওয়া বিএনপি নেতাদের সঙ্গে কারাগারে সংলাপের সম্ভাবনা নাকচ করেছেন তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ।
রোববার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের এ সংক্রান্ত প্রশ্নে তিনি বলেন, “নৈরাজ্যের হুকুমদাতা, অর্থদাতা ও হোতা হিসেবে তারা (বিএনপি নেতা) গ্রেপ্তার হয়েছেন, তাদের সঙ্গে আলোচনার প্রশ্নই আসে না।”
অন্য এক প্রশ্নে মন্ত্রী বলেন, “অবরোধ ডেকে দেশকে অস্থিতিশীল করা হলে জনগণই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, সরকারের কিছু করতে হবে না। আমরা জনগণের সঙ্গে থাকব।”
একই দিন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, “তারা (বিএনপি) আগুন সন্ত্রাসী দল, এই দলের সঙ্গে সংলাপ হতে পারে না। সংলাপের পাট শেষ। এক সময় বলেছিলাম কন্ডিশন তুলে নাও, আমরা ভেবে দেখব। এখন তারা যা করেছে, সংলাপের কোনো পরিবেশ নেই।"