“এই পদ্ধতিটা তারাই নষ্ট করেছে, সেটাকে আবার তারা ফেরত চাচ্ছে।…নাকি আবার সেই ২০০৭-এর মত তত্ত্বাবধায়ক সরকার, আবার সেই ইমার্জেন্সি, আবার সেই ধরপাকড় সেইগুলি চায়?”
Published : 21 Jun 2023, 05:34 PM
বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ‘নষ্ট’ করার জন্য এই সরকার ব্যবস্থা ফেরানোর দাবিতে আন্দোলন করা বিএনপিকে দায়ী করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেছেন, উচ্চ আদালতের রায়ের আলোকে সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে। এখন নির্বাচন তার আলোকেই হবে।
বিএনপি ও সমমনা দলগুলো গণতান্ত্রিক ধারাকে ‘নষ্ট করার জন্য’ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তুলছে বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি। বিরোধী দলগুলো ২০০৭ সালে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের ‘ধরপাকড়’ ও জরুরি অবস্থায় ফিরে যেতে চায় কি না, সে প্রশ্নও তিনি রেখেছেন।
সুইজারল্যান্ড সফরের অভিজ্ঞতা জানাতে বুধবার গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে এসে নির্বাচনকালীন সরকার এবং বিরোধীদের আন্দোলন নিয়ে এভাবেই নিজের অবস্থান তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
বিদেশে সফর শেষে সরকারপ্রধান সব সময় গণমাধ্যমকর্মীদের ডাকেন। তাতে সফরের একটি লিখিত বিবরণ যেমন থাকে, তেমনি প্রশ্নোত্তরে উঠে আসে সাম্প্রতিক আর্থ সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা। জানা যায় সরকারের অবস্থান, উঠে আসে তাদের পরিকল্পনা, বিরোধী দলের সম্পর্কে মনোভাব।
সাংবাদিকদের একটি প্রশ্ন ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে বিএনপির দাবির বিষয়ে। এ সরকার ব্যবস্থা ছাড়া দলটি ভোটে অংশ না নেওয়ার, এমনকি ভোট হতে না দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে।
জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “নির্বাচনকালীন সময়ে আমাদের বিরোধী দল থেকে নানা রকম প্রস্তাব… এখন আবার তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায়, যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্পর্কে খালেদা জিয়ারই উক্তি ছিল যে, ‘পাগল আর শিশু ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ নয়।
“একবার যেটা তারাই বাদ দিয়েছে, এই পদ্ধতিটা তারাই নষ্ট করেছে, তারাই কিন্তু এটা রাখেনি, সেটাকে আবার তারা ফেরত চাচ্ছে।”
তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে আদালতের রায়ের কথাও স্মরণ করিয়ে দেন আওয়ামী লীগ প্রধান। তিনি বলেন, “উচ্চ আদালতের রায় আছে এবং সেই মোতাবেক আমাদের সংবিধানও সংশোধন করা হয়েছে যে, একজন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী বা সরকার প্রধান আরেকজন নির্বাচিত সরকার প্রধান দ্বারাই প্রতিস্থাপিত হবেন। এর বাইরে অনির্বাচিত কেউ আসতে পারবে না।”
বিরোধী দলগুলোকে উদ্দেশ করে শেখ হাসিনা বলেন, “তারা (বিএনপি) কি গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা চান? অর্থনৈতিক উন্নতি চান? দেশের মানুষের কল্যাণ হোক সেটা চান?
“নাকি আবার সেই ২০০৭-এর মত তত্ত্বাবধায়ক সরকার, আবার সেই ইমার্জেন্সি, আবার সেই ধরপাকড় সেইগুলি চায়? এটা তো দেশের মানুষকে বিবেচনা করতে হবে।”
তত্ত্বাবধায়ক নিয়ে বিতর্ক
আওয়ামী লীগের আন্দোলনের মুখেই ১৯৯৬ সালে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংযোজন করে বিএনপি। তখন সিদ্ধান্ত হয়, সবশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি হবেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান। তিনি রাজি না হলে সব দলের মতৈক্যের ভিত্তিতে একজন হবেন এই সরকারের প্রধান। আর আলোচনায় কাউকে পাওয়া না গেলে হবেন রাষ্ট্রপতি।
১৯৯৬ সালের ১২ জুন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ভোটে জিতে ২১ বছর পর ক্ষমতায় ফেরে আওয়ামী লীগ। সেই মেয়াদ শেষে ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে জিতে বিএনপি-জামায়াত জোট আসে ক্ষমতায়। তবে সেই সরকারের আমলে বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা দুই বছর বাড়ানো নিয়ে তৈরি হয় রাজনৈতিক বিরোধ।
সরকারের এই সিদ্ধান্তের ফলে ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হওয়ার কথা হয় অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানের। তিনি এককালে বিএনপির আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। ফলে তাকে মেনে নিতে রাজি ছিল না আওয়ামী লীগ।
আন্দোলনের একপর্যায়ে কে এম হাসান জানান, তিনি ওই পদের জন্য আগ্রহী নন। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধানের পদে কে আসবেন, এ নিয়ে বিরোধের মধ্যেই বিএনপির মনোনয়নে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধানের দায়িত্ব নেন।
তখন ইয়াজউদ্দিনের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট যায় আন্দোলনে। একবার পিছিয়ে ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি নির্বাচনের তারিখ ঘোষিত হয়।
একতরফা নির্বাচনের দিকে দেশ যখন এগিয়ে যাচ্ছিল, তখন ভোটের ১১ দিন আগে হস্তক্ষেপ করে সেনাবাহিনী। ইয়াজউদ্দিন আহমেদ জরুরি অবস্থা জারি করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানের পদ ছেড়ে দেন। দায়িত্ব নেন ফখরুদ্দীন আহমেদ।
সেই সরকার প্রায় দুই বছর ক্ষমতায় থাকার পর ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর ভোট দেয়। সেই নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জিতে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে সংবিধানের যে সংশোধনীর মাধ্যমে এই সরকারব্যবস্থা চালু হয়েছিল, সেই ত্রয়োদশ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আইনজীবী এম সলিম উল্লাহসহ কয়েকজন রিট আবেদন করেছিলেন। শুনানি নিয়ে ২০০৪ সালে হাই কোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে বৈধ বলে ঘোষণা করে।
ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগের রায় যায় রিট আবেদনকারী পক্ষ। ২০১০ সালের ১১ মে আপিল বিভাগ হাই কোর্টের রায় পাল্টে এই সরকারব্যবস্থাকে অবৈধ ঘোষণা করে।
আপিল বিভাগের সেই আদেশের ওপর ভিত্তি করে ২০১১ সালের ৩০ জুন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হয়। এতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপের পাশাপাশি অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা দখলের জন্য রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ বিবেচনায় সর্বোচ্চ দণ্ডের বিধান রাখার প্রস্তাব করা হয়। পাশাপাশি নির্বাচিত সরকারের অধীনে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত হয়।
সংবিধানের এই সংশোধনী মেনে না নিয়ে ২০১৪ সালেরর ৫ জানুয়ারি দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করে আন্দোলনে যায় বিএনপি। তবে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে তারা অংশ নেয় নির্বাচিত সরকারের অধীনেই। সেই নির্বাচনে আগের রাতেই ভোট হয়ে যাওয়ার অভিযোগ এনে এখন আবার পুরনো দাবিতে ফিরে গেছে দলটি।
‘সব জেনেও সংবিধানের ধারাবাহিকতা নষ্টের চেষ্টা’
প্রধানমন্ত্রীর ভাষায়, উচ্চ আদালতের রায়ের বিষয়টি জেনেও বিএনপির আন্দোলনের উদ্দেশ্যটা হল ‘অসাংবিধানিক সরকার’ আনা।
তিনি বলেন, “যেহেতু আমাদের গণতন্ত্রটা ওয়েস্ট মিনস্টার টাইপ অব ডেমোক্রেসি, ঠিক ইংল্যান্ডের মত জায়গায় যেভাবে নির্বাচনটা হয়, ঠিক সেভাবে আমাদের এখানে নির্বাচন হবে।
“এটা যেমন উচ্চ আদালতের রায় আছে, আবার আমাদের সংবিধানেও কিন্তু সেটা আছে। তো, যতক্ষণ পর্যন্ত আরেকজন নির্বাচিত সরকারপ্রধান ক্ষমতা না নেবে, সেটা পরিবর্তন হবে না। একজন নির্বাচিতর জায়গায় আরেকজন নির্বাচিতই আসতে হবে। এটাও সকলেই জানে। জানার পরেও, আমি জানি না কেন এই সাংবিধানিক জটিলতা সৃষ্টির চেষ্টা করা হচ্ছে? উদ্দেশ্যটা কী?”
পরে নিজেই প্রশ্নের জবাব দিয়ে তিনি বলেন, “তার মানে এই গণতান্ত্রিক ধারাটাকে নষ্ট করা। এই যে দীর্ঘ সাড়ে ১৪ বছরের বাংলাদেশটা যে সুষ্ঠুভাবে চলছে, আর্থ সামাজিক উন্নতি করছে সেটাকে নষ্ট করা। তো, দেশবাসী এটা কীভাবে সেটাই আমার প্রশ্ন।”
মূল্যস্ফীতিতেও অভাব নেই
নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি এবং এ নিয়ে সরকারের চেষ্টা নিয়েও কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, “মানুষ দুবেলা পেট ভরে ভাত খাচ্ছে। এত ইনফ্লেশনের মধ্যেও মানুষের খাবারের অভাব তো ওভাবে হচ্ছে না।
“হ্যাঁ, একটু চাপে আছে মানুষ, আমি জানি। সেই কষ্টটা আমি বুঝি। বুঝি বলেই আমাদের প্রচেষ্টা আছে, মানুষের দুঃখকষ্ট সহজ করার চেষ্টা করছি।”
শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে এগিয়ে যাওয়ার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “এই সাড়ে ১৪ বছর আমরা এই অগ্নিসন্ত্রাস, মানুষ খুন, যত রকমের অপপ্রচার- এই সবগুলো মোকাবেলা করেই কিন্তু দেশটাকে আমরা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।
“তো, সেটাই মানুষ চাইবে, না আবার সেই সন্ত্রাস যুগে প্রবেশ করবে, ভোট চুরির, ভোট ডাকাতির যুগে প্রবেশ করবে, জনগণের উপর ছেড়ে দিচ্ছি। জনগণের উপর ছেড়ে দিচ্ছি, তারা ঠিক করুক কী করবে।”