রেকর্ড স্বতন্ত্র ও সবচেয়ে ছোট বিরোধী দল নিয়ে যাত্রা করা এবারের সংসদকে জনগণের প্রত্যাশা পূরণের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে দেখতে চান স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী।
Published : 30 Jan 2024, 10:30 PM
জাতীয় সংসদকে কার্যকর করতে সব সদস্যের গঠনমূলক ভূমিকার প্রত্যাশায় শুরু দ্বাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশনে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেছেন, বাংলাদেশের গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রায় এ সংসদ এক ‘নব অধ্যায়’ যুক্ত করেছে।
মঙ্গলবার দ্বাদশ সংসদের প্রথম দিনে স্পিকারের এ বক্তব্যকে টেবিল চাপড়ে সমর্থন জানান সংসদ সদস্যরা।
এ সময় রেকর্ড স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য ও সবচেয়ে ছোট বিরোধী দল নিয়ে যাত্রা শুরু করা এবারের সংসদকে জনগণের প্রত্যাশা পূরণের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে দেখতে চাওয়ার প্রত্যাশার কথা তুলে ধরেন টানা চতুর্থবার স্পিকারের দায়িত্বে আসা শিরীন শারমিন।
তিনি বলেন, সব অর্জন ও সফলতাকে টেকসই রূপে ধরে রাখতে হলে আর্থ সামাজিক, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিতকরণে জাতীয় সংসদকে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে।
সংসদকে কার্যকর করতে সদস্যদের গঠনমূলক ভূমিকা পালনের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “সংসদীয় গণতন্ত্রের অব্যাহত চর্চাই পারে আইনের শাসন সমুন্নত রেখে মৌলিক স্বাধীনতা ও মানবাধিকার, ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার নিশ্চিতের মাধ্যমে শোষণ ও বৈষম্যমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে।
“আশা করি দ্বাদশ সংসদে সম্মিলিত প্রয়াসে আমরা স্পিরিট অব রিয়েল ডেমোক্রেসি অর্জন করতে পারব।”
ভোট বর্জন করে দ্বাদশ সংসদের বাইরেই রয়ে গেছে বিএনপি। সংসদের বাইরে দলটির কালো পতাকা দেখানোর কর্মসূচির মধ্যে এদিন বিকাল ৩টায় শুরু হয় দ্বাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশন।
অধিবেশনের শুরুতে দিনের কার্যসূচি অনুযায়ী স্পিকার নির্বাচন করা হয়। সর্বসম্মতিক্রমে শিরীন শারমিন পুনরায় স্পিকার নির্বাচিত হন।
এরপর সোয়া ৩টার দিকে সংসদের অধিবেশনে ২০ মিনিটের বিরতি দেওয়া হয়। সাড়ে ৩টার পরে স্পিকারের সভাপতিত্বে অধিবেশন আবার শুরু হয়।
সংবিধানের বিধান অনুযায়ী সংসদে প্রথম অধিবেশনে ভাষণ দেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। রাষ্ট্রপতির ভাষণের পর সংসদের অধিবেশন রোববার পর্যন্ত মূলতবি করা হয়।
দেশের বিশিষ্টজন ও ঢাকায় বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা সংসদে উপস্থিত হয়ে অধিবেশনের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করেন।
অধিবেশনের শুরুতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্মরণ করে স্পিকার শিরীন শারমিন সবাইকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, “শীতের এ প্রসন্ন বিকালে দ্বাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশনে সকল সংসদ সদস্যকে আন্তরিক স্বাগত জানাচ্ছি। ৭ জানুয়ারি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ, অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচনে জয়লাভ করে আপনারা সংসদে এসেছেন। আমি দেশের জনগণকে অভিনন্দন জানাই একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেওয়ার জন্য।”
তিনি বলেন, “বাংলাদেশের গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রায় দ্বাদশ যুক্ত করেছে এক নব অধ্যায়।”
সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়ে স্পিকার বলেন, যিনি জাতির আলোকবর্তিকা রূপে পরপর চারবার এবং সর্বমোট পাঁচবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন।
সংসদ উপনেতা, সরকারি দলের চিফ হুইপ, হুইপ, বিরোধী দলীয় নেতা ও উপনেতা, চিফ হুইপ, স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যকে অভিনন্দনও জানান শিরীন শারমিন।
সংসদ পরিচালনায় সবার সহযোগিতা চেয়ে তিনি বলেন, “স্পিকার হিসেবে পুনরায় নির্বাচিত করে আমার প্রতি আপনারা যে আস্থা রেখেছেন তার মর্যাদা অক্ষুন্ন রেখে নিষ্ঠার সাথে দায়িত্বপালনে আমি বদ্ধপরিকর। ‘তোমার পতাকা যারে দাও/তারে বহিবারে দাও শক্তি’।”
এরপর সমাজকল্যাণমন্ত্রী দীপু মনি তার বক্তব্যে সবার পক্ষ থেকে স্পিকারকে অভিনন্দন জানান।
পরে বিরোধী দলীয় নেতা জিএম কাদের বক্তব্য দেন। স্পিকার হিসেবে শিরীন শারমিনকে অভিনন্দন জানিয়ে তিনি সংসদ পরিচালনায় স্পিকারের নিরপেক্ষ ভূমিকা রাখার প্রত্যাশার কথা তুলে ধরেন।
জিএম কাদের বলেন, “আমি আপনার কাছে প্রত্যাশা করছি, আপনি নিরপেক্ষতা বজায় রাখবেন।… “বিরোধীদের মতামতকে সংসদে তোলার সুযোগ দেবেন। সংসদের ভারসাম্যের ত্রুটি কমানোর প্রচেষ্টা আমরা অব্যাহত রাখব। তাই স্পিকারের সহযোগিতা প্রত্যাশা করছি।"
এরপর আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সংসদ সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম বক্তব্য রাখেন।
দিনের কার্যসূচি অনুযায়ী ডেপুটি স্পিকার নির্বাচনের কার্যক্রমও সম্পন্ন করেন স্পিকার শিরীন শারমিন। কণ্ঠভোটে শামসুল হক টুকু ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হন।
এরপর দ্বাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশনের সভাপতিমণ্ডলী মনোনয়ন করা হয়।
সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মনোনয়ন
দ্বাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনের জন্য পাঁচ সদস্যদের সভাপতিমণ্ডলী নির্বাচন করা হয়েছে এদিন। স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের অনুপস্থিতিতে নামের অগ্রবর্তিতা অনুসারে তারা সংসদের বৈঠকে সভাপতিত্ব করবেন।
প্রথম অধিবেশন শুরুর পর নতুন স্পিকার হিসেবে দায়িত্বগ্রহণের পর শিরীন শারমিন এ অধিবেশনের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যদের নাম ঘোষণা করেন।
তারা হলেন- ক্যাপ্টেন (অব) এবি তাজুল ইসলাম, মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন, আ ফ ম রুহুল হক, হাফিজ উদ্দিন আহমেদ ও উম্মে কুলসুম স্মৃতি।
শোক প্রস্তাব
এরপর স্পিকার শোক প্রস্তাব পেশ করেন। এতে কুয়েতের আমির শেখ নাওয়াফ আল আহমদ আল জাবের আল সাবাহ’র মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করা হয়।
এছাড়া প্রস্তাবে সাবেক সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, সাবেক সংসদ সদস্য ও প্রতিমন্ত্রী জিনাতুন নেসা তালুকদার, সাবেক সংসদ সদস্য ড. মো. আকরাম হোসেন চৌধুরীসহ বিভিন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করা হয়।
পরে প্রস্তাবটি গ্রহণ করা হয় এবং সবাই দাঁড়িয়ে এক মিনিট নিরবতা পালন করেন। মোনাজাত পরিচালনা করেন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য হুছামুদ্দিন আহমেদ। এরপর আছরের নামাজের জন্য সাড়ে ৪টা পর্যন্ত বিরতি দেওয়া হয়।
রাষ্ট্রপতির ভাষণ
সাড়ে ৪টার পর ভাষণ দেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ‘গণতন্ত্রের জয় হয়েছে’ মন্তব্য করে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে ‘সহিংসতা ও নৈরাজ্যের পথ’ পরিহার করে গঠনমূলক কর্মসূচি পালনের আহ্বান করেন তিনি।
রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্দেশে রাষ্ট্রপতি বলেন, “আমি আশা করি, ভবিষ্যতে দেশের রাজনৈতিক দলসমূহ সহিংসতা ও নৈরাজ্যের পথ পরিহার করে সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং জনগণ ও গণতন্ত্রের কল্যাণে অহিংস পন্থায় গঠনমূলক কর্মসূচি পালন করবে। সরকারও এক্ষেত্রে সংযত আচরণ করবে- এটাই সকলের প্রত্যাশা।”
প্রথমবার সংসদে ভাষণ দিতে আসা সাহাবুদ্দিন প্রায় ২৫ মিনিট বক্তৃতা করেন।
তিনি বলেন, “জাতীয় সংসদ আমাদের গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের মূলভিত্তি। জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত মহান এ প্রতিষ্ঠানটি জনগণের সকল প্রত্যাশার ধারক ও বাহক। তাদের চাহিদাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে নাগরিকদের কল্যাণে জাতীয় সংসদ যথাযথ ও কার্যকর ভূমিকা পালন করবে এটাই জনগণের প্রত্যাশা।”
এরপর সংসদের বৈঠক ৪ ফেব্রুয়ারি ৪টা ৪৫ মিনিট পর্যন্ত মুলতবি করা হয়।
আসন বিন্যাস যেমন ছিল
ট্রেজারি বেঞ্চের (স্পিকারের ডান পার্শ্বে) প্রথম আসনে বরাবরের মতই সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বসেন। এর পরের আসনটি ফাঁকা রয়েছে। এর পর থেকে পর্যায়ক্রমে সংসদ উপনেতা বেগম মতিয়া চৌধুরী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, আমির হোসেন আমু, আ ক ম মোজাম্মেল হক, অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী, আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ, ওবায়দুল কাদের ও তোফায়েল আহমেদ বসেন।
মাঝের (স্পিকারের মুখোমুখি) অংশের প্রথম সারির বাম দিকের (স্পিকারকে মুখ করে) প্রথম আসনে সাবেক অর্থ মন্ত্রী আ হ ম মুস্তাফা কামাল বসেছেন। এরপর পর্যায়ক্রমে বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খান, কৃষিমন্ত্রী আব্দুস শহীদ, শিল্পমন্ত্রী ইউসুফ হোসেন হুমায়ূন, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন, মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম, রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু এবং শেষ আসনে বসছেন ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু।
বিরোধী দলীয় বেঞ্চের (স্পিকারের বাম দিকে) প্রথম আসনে বিরোধী দলীয় নেতা গোলাম মোহাম্মদ কাদের বসছেন। তার বামে বসছেন সংসদে বিরোধী দলীয় উপনেতা আনিসুল ইসলাম মাহমুদ।
পর্যায়ক্রমে বসেছেন জাতীয় পার্টির রুহুল আমিন হাওলাদার, কল্যাণ পার্টির সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, স্বতন্ত্র হুসামউদ্দিন, আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত নেতা ও স্বতন্ত্র আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, সাবেক নৌ পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান, সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান ও সাবেক মন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেন।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২২৩টি, জাতীয় পার্টি ১১টি, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ ও কল্যাণ পার্টি একটি করে এবং ৬২টি আসন পেয়েছে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা।
আরও পড়ুন
এ সংসদ নিখুঁতভাবে দায়িত্ব পালনে সক্ষম নয়: জি এম কাদের
নৈরাজ্যের রাজনীতি ছেড়ে কল্যাণের পথে আসার আহ্বান রাষ্ট্রপতির