“আমার দৃঢ় বিশ্বাস, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয় হয়েছে দেশের জনগণের, জয় হয়েছে গণতন্ত্রের,” বলেন রাষ্ট্রপ্রধান।
Published : 30 Jan 2024, 05:26 PM
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ‘গণতন্ত্রের জয় হয়েছে’ মন্তব্য করে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে ‘সহিংসতা ও নৈরাজ্যের পথ’ পরিহার করে গঠনমূলক কর্মসূচি পালনের আহ্বান জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন।
তিনি বলেছেন, “গত দেড় দশকে বাংলাদেশের অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে আমাদের আরও উন্নতি করতে হবে। ভবিষ্যতে অনেক কঠিন চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে হবে। এজন্য আমাদের সবসময় সতর্ক থাকতে হবে। ষড়যন্ত্র করে কেউ যাতে জনগণের অধিকার কেড়ে নিতে না পারে, সেদিকে সকলের সজাগ দৃষ্টি রাখার আহ্বান জানাচ্ছি।
“একইসঙ্গে, কেউ যাতে আন্দোলনের নামে অরাজকতা সৃষ্টি করে মানুষের জানমাল ও জীবিকার ক্ষতিসাধন করতে না পারে, সেদিকে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। সকল গুজব ও অপপ্রচারের বিষয়ে নজরদারি বৃদ্ধি করে জনগণকে সম্পৃক্ত রেখে যথাযথভাবে মোকাবিলা করতে হবে।”
দ্বাদশ জাতীয় সংসদের যাত্রা শুরুতে মঙ্গলবার সংসদে দেওয়া ভাষণে এ আহ্বান জানান রাষ্ট্রপ্রধান।প্রতিবারের মত এবারও মন্ত্রিসভার ঠিক করে দেওয়া ভাষণের সংক্ষিপ্তসার পড়েন রাষ্ট্রপতি।
কোনো সংসদের প্রথম এবং নতুন বছরের প্রথম অধিবেশনে রাষ্ট্রপতির ভাষণ দেওয়ার বিধান রয়েছে। অধিবেশনের পুরোটাজুড়ে এ ভাষণের ওপর আলোচনা শেষে রাষ্ট্রপতিকে ধন্যবাদ জানিয়ে সংসদে একটি প্রস্তাব গৃহীত হবে।
গত ৭ জানুয়ারির দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত এই সংসদে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রয়েছে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। ইতিহাসের সর্বোচ্চ সংখ্যক ৬২ জন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য নিয়ে মঙ্গলবার যাত্রা করেছে দ্বাদশ সংসদ।
নিয়ম অনুযায়ী, অধিবেশনের প্রথম দিন স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার নির্বাচন, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মনোনয়ন ও শোকপ্রস্তাব উত্থাপনের পর ভাষণ দিতে আসেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর এটাই সংসদে তার প্রথম ভাষণ।
স্পিকার রাষ্ট্রপতির আগমনের ঘোষণা দিলে সশস্ত্র বাহিনীর একটি বাদক দল বিউগলে ‘ফ্যানফেয়ার’ বাজিয়ে রাষ্ট্রপতিকে সম্ভাষণ জানান। তিনি ঢোকার পর নিয়ম অনুযায়ী জাতীয় সংগীত বাজানো হয়। সংসদে রাষ্ট্রপতির জন্য স্পিকারের ডান পাশে লাল রঙের গদি সম্বলিত চেয়ার রাখা হয়।
স্পিকারের অনুরোধের পর রাষ্ট্রপতি তার লিখিত ভাষণের সংক্ষিপ্তসার পড়া শুরু করেন। স্পিকারের আসনের বাম পাশে রাখা ‘রোস্ট্রামে’ দাঁড়িয়ে ভাষণ দেন তিনি।
ভাষণের শুরুতেই মো. সাহাবুদ্দিন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং দ্বাদশ জাতীয় সংসদের সদস্যদের অভিনন্দন জানান।
তিনি বলেন, “দেশের গণতন্ত্রের জন্য দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে আয়োজন অত্যন্ত যুগান্তকারী ঘটনা, যা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয় হয়েছে দেশের জনগণের, জয় হয়েছে গণতন্ত্রের।”
বিএনপির বর্জন ও হরতালের মধ্যে গত ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২২৩ আসনে জয় পায় আওয়ামী লীগ। ১১টি আসন পেয়ে টানা তৃতীয়বারের মত প্রধান বিরোধী দল হয়েছে জাতীয় পার্টি।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরিকদের মধ্যে জাসদ একটি ও ওয়ার্কার্স পার্টি একটি এবং এক সময় বিএনপির জোটে থাকা কল্যাণ পার্টি একটি আসনে জয় পেয়েছে।
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আসন পান স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। যে ৬২ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছেন, তাদের অধিকা প্রায় সবাই আওয়ামী লীগেরই নেতা।
“দেশের সংবিধান সমুন্নত এবং সংসদীয় গণতন্ত্রের ধারা অব্যাহত রেখে বিভিন্ন দেশি ও বিদেশি ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পন্ন করায়” নির্বাচন কমিশনসহ সংশ্লিষ্টদের ধন্যবাদ জানান রাষ্ট্রপতি। স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করায় সব ভোটার, বিশেষত নবীন ও নারী ভোটারদের অভিনন্দন জানান।
মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, “নির্বাচন কমিশন কর্তৃক সফলভাবে নির্বাচন পরিচালনার মাধ্যমে দেশে গণতান্ত্রিক শক্তি আরও সুদৃঢ় হয়েছে। নির্বাচনে জয়-পরাজয় থাকবেই, জনগণের রায় মেনে নিয়ে গণতন্ত্রের ধারা অব্যাহত রাখাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।”
ভোটের আগে বিএনপির হরতাল-অবরোধের মধ্যে নাশকতার ঘটনা মনে করিয়ে দিয়ে রাষ্ট্রপতি বলেন, “নির্বাচনকে ঘিরে একটি মহল সহিংসতা ও সংঘাত সৃষ্টি করে গণতন্ত্রের শান্ত-স্নিগ্ধ যাত্রাপথে বাধা সৃষ্টির অপচেষ্টা চালিয়েছিল। তাদের গণতন্ত্র বিরোধী ও সহিংস কর্মকাণ্ড সাময়িকভাবে জনগণকে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে রাখলেও গণতন্ত্রের শাণিত চেতনা ভোটারদের ভোটদান থেকে বিরত রাখতে পারেনি।
“সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ও সক্রিয় অংশগ্রহণের জন্যই সরকার ও নির্বাচন কমিশনের সকল পদক্ষেপ স্বার্থক হয়েছে। নির্বাচন বর্জনকারী দলগুলো সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করেছে।”
দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্দেশে রাষ্ট্রপতি বলেন, “আমি আশা করি, ভবিষ্যতে দেশের রাজনৈতিক দলসমূহ সহিংসতা ও নৈরাজ্যের পথ পরিহার করে সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং জনগণ ও গণতন্ত্রের কল্যাণে অহিংস পন্থায় গঠনমূলক কর্মসূচি পালন করবে। সরকারও এক্ষেত্রে সংযত আচরণ করবে- এটাই সকলের প্রত্যাশা।”
দীর্ঘ ভাষণে সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড এবং গত দেড় দশকে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অগ্রগতির তথ্য সবিস্তারে বর্ণনা করেন রাষ্ট্রপতি।
তিনি বলেন, “জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে তার সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ়, বলিষ্ঠ ও দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে গত দেড় দশকে আর্থসামাজিক খাতসহ সকল খাতে অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে। এর জন্য সমগ্র দেশবাসীর পক্ষ হতে আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।”
সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এ অর্জন সম্ভব হয়েছে মন্তব্য করে রাষ্ট্রপতি বলেন, “উন্নয়নের মূল ভিত্তি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং গণতন্ত্রের অব্যাহত চর্চা। গণতন্ত্রের স্বাভাবিক গতিপথ রুদ্ধ হলে উন্নয়নও বাধাগ্রস্ত হয়। গত দেড় দশকে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং ধারাবাহিক গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা বজায় থাকার কারণে দেশের এ উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে।
“উন্নয়ন স্থায়ী ও টেকসই করতে হলে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মজবুত, তৃণমূল পর্যায়ে গণতন্ত্রের চর্চা ছড়িয়ে দিতে হবে। উন্নয়নের এ গতিধারা অব্যাহত রাখতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হবে।”
ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা যে বাড়ছে, সে কথা তুলে ধরে রাষ্ট্রপট্রধান বলেন, “বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিলে এর প্রভাব আমাদের উপরও পড়বে। এজন্য আমাদের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি থাকতে হবে। যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য কৃষি খাতের উৎপাদন ব্যবস্থা অব্যাহত রাখতে হবে, উচ্চ-মূল্য ফসল উৎপাদনে গুরুত্ব দিয়ে রপ্তানি নিশ্চিত করার জন্য উন্নত কৃষিপ্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে।
কৃষিপণ্য সংরক্ষণাগার এবং কৃষি প্রক্রিয়াজাত শিল্প গড়ে তোলার পাশাপাশি বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি বাজারে যাতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পায়, সে লক্ষ্যে দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষর ও কার্যকর করার ব্যবস্থা নিতে নতুন সরকারকে আহ্বান জানান রাষ্ট্রপতি। জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতের লক্ষ্যে গভীর সমুদ্রে গ্যাস ও তেল অনুসন্ধান কার্যক্রম জোরদার করারও তাগিদ দেন।
রাষ্ট্রপতি বলেন, “দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির পাশাপাশি নতুন নতুন শ্রমবাজারের অনুসন্ধান করতে হবে যাতে দক্ষ শ্রমশক্তি রপ্তানি সম্ভব হয়। আর্থিক খাতের সংস্কার এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ও কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।”
প্রথমবার সংসদে ভাষণ দিতে আসা মো, সাহাবুদ্দিন বলেন, “জাতীয় সংসদ আমাদের গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের মূলভিত্তি। জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত মহান এ প্রতিষ্ঠানটি জনগণের সকল প্রত্যাশার ধারক ও বাহক। তাদের চাহিদাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে নাগরিকদের কল্যাণে জাতীয় সংসদ যথাযথ ও কার্যকর ভূমিকা পালন করবে এটাই জনগণের প্রত্যাশা।”
নতুন সংসদের আইনপ্রণেতাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “জনগণ অনেক আশা নিয়ে তাদের সেবা করার সুযোগ দিয়েছে যাতে তাদের চাওয়া-পাওয়া আপনারা সংসদে তুলে ধরেন। এটাই সংসদ-সদস্য হিসেবে আপনাদের মূল দায়িত্ব ও কর্তব্য।”
তার ভাষ্য, সমাজের সকল নাগরিকের আশা-আকাঙ্ক্ষা, বিভিন্ন গোষ্ঠী, দল ও সংগঠনের চাওয়া-পাওয়া গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সমন্বয়সাধন করতে হয় জাতীয় সংসদকে। সংসদের গুরুত্বপূর্ণ দুটি কাজ- আইন প্রণয়ন এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানসমূহের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। সেজন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটিগুলোকেও গঠনমূলক ভূমিকা রাখার জন্য তিনি আহ্বান জানান, যাতে সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।
বিরোধী দলের উদ্দেশে রাষ্ট্রপতি বলেন, “স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, পরমতসহিষ্ণুতা, মানবাধিকার ও আইনের শাসন সুসংহতকরণ এবং জাতির অগ্রযাত্রার স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষার সফল বাস্তবায়নে সরকারি দলের পাশাপাশি বিরোধী দলকেও গঠনমূলক ভূমিকা পালন করতে হবে। রাজনৈতিক নীতি-আদর্শ, মত-পথের ভিন্নতা থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সংসদকে গণতন্ত্র ও উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করার ক্ষেত্রে কোনো মতদ্বৈততা জনগণ প্রত্যাশা করে না। তাই সংসদকে আরও কার্যকর ও গতিশীল করতে সকলের প্রতি আমি আন্তরিক আহ্বান জানাচ্ছি।”
ভাষণের শেষ অংশে বাঙালি জাতির সংগ্রামের ইতিহাস তুলে ধরে মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, “যে জাতি ভাষার জন্য রক্ত দেয়, স্বাধীনতার জন্য বিসর্জন দেয় ত্রিশ লক্ষ প্রাণ, যে জাতি গণতন্ত্রের জন্য রাজপথ রঞ্জিত করে, অসীম ধৈর্যে অতিক্রম করে বন্ধুর পথ, সেই অমিত সম্ভাবনাময় জাতি নিশ্চয় পারবে সকল বাধা-বিঘ্ন অতিক্রম করে বিশ্ব-দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে।
“আমি আশা করি, সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা গড়ে তুলতে পারব বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা।”