“মূল সমস্যা হল যে, আমাদের ইনস্টিটিউশনগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে”, বলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর।
Published : 29 Apr 2024, 10:23 AM
দেশের রাজনীতি ‘ঠিক নেই’ বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ। তার মতে, রাজনীতি ‘ঠিক না হলে’ ঠিক হবে না অর্থনীতিও।
শনিবার দুপুরে জাতীয় প্রেস ক্লাবের এক অনুষ্ঠানে তিনি এই কথা বলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহর লেখা আত্মজীবনী গ্রন্থ ‘আমার জীবন আমার সংগ্রাম’ এর প্রকাশনা উপলক্ষে এই আলোচনা সভা হয়। ৫৯২ পৃষ্ঠার বইটি প্রকাশ করেছে ‘বাঙ্গালা গবেষণা’।
সালেহউদ্দিনের বক্তব্যে উঠে আসে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির প্রসঙ্গ। তিনি বলেন, “শুধু অর্থনীতির বিষয়ে কথা বললে বাংলাদেশের সমস্যার সমাধান হবে না। এখানে রাজনীতির বিষয়টা সবচেয়ে বড়।
“রাজনীতি ঠিক না হলে অর্থনীতি ঠিক হবে না… এটা তো আপনারা দেখতেই পারছেন... ভয়ংকর অবস্থা। রাজনীতিটা মেইন।”
বিএনপির সবশেষ শাসনামলে ২০০৫ সালের ১ মে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন সালেহউদ্দিন। পদে থাকেন ২০০৯ সালের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত।
তিনি বলেন, “অর্থনীতির এই টেকনিক্যাল কথাবার্তা, গ্রোথ রেইট ৫ পয়েন্ট ৫ হল না ৫ পয়েন্ট ৭ হল, ইনফ্লেশন (মূল্যস্ফীতি) ৮ দশমিক ২ হল না ৮ দশমিক ৩ হল, এগুলো কচকচালি করলে তো সমস্যার সমাধান হবে না।
“মূল সমস্যা হল যে, আমাদের ইনস্টিটিউশনগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে, রাজনীতিটাও অনেকটা ধ্বংসের পথে, সেখানে অর্থনীতি কীভাবে ঠিক থাকবে?”
ছাত্র জীবন মানুষের কল্যাণে ইতিবাচক ও ভালো রাজনীতি না করলে ভবিষ্যতে ভালো মানুষও হওয়া যাবে না বলেও মনে করেন সাবেক গভর্নর। বলেন, “ভ্যালুজ (মূল্যবোধ) কিছু থাকতে হয়। আমাদের সময়ে কিছু ভ্যালুজ ছিল। মাহবুব উল্লাহ ভাইয়ের তো ছিলই। সৎভাবে জীবন-যাপন করেছেন, অনেক কিছু হতে পারতেন।”
অনুষ্ঠানে দর্শক সারিতে বসে আলোচনা শোনেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
বিএনপি নেতার প্রতি ইঙ্গিত করে সালেহউদ্দিন বলেন, “আমরাও (রাজনীতি) করেছি, আমার বন্ধু আলমগীর সৎভাবে জীবন-যাপন করেছেন। আমাদের মধ্যে ভ্যালুজগুলো বারে বারে তাড়া করত, এখনো আমাদেরকে এটা তাড়িত করে; সাধারণ মানুষের জন্য চিন্তা, এসব চিন্তা এখনো আমাদের তাড়িত করে।”
অনুষ্ঠানের শুরুতে লেখক মাহবুব উল্লাহর ছোট ভাই সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহর আত্মার শান্তি কামনা করে মোনাজাত করা হয়। ২০১৯ সালের আজকের দিনে তিনি মারা যান।
‘একটা গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ চাই’
অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ বলেন, “দেশ আজকে একটা কঠিন সংকটে পড়েছে। এই সংকট থেকে উত্তরণ কীভাবে হবে সেটা নিঃসন্দেহে ৮/১০টা দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলন দেখে আমরা নিরূপণ করতে পারব না। আমাদেরকেই আমাদের পথ চয়ন করতে হবে।”
রুশ বিপ্লবের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, “১৯০৫ সালে রাশিয়াতে যে পাঠ্য বিপ্লব হয়, সেই বিপ্লবের পরে লেলিন বলেছিলেন, ‘এখন প্রয়োজনে প্রতিক্রিয়াশীলদের মধ্যে ঢুকেও আমাদেরকে কাজ করতে হবে।’
“ওই সময়ের জন্য ওটা ছিল একটা মোক্ষম একটা কৌশল, যে কারণে ১০১৭ সাল (রুশ বিপ্লব) হতে পেরেছে। এগুলো আমাদের বুঝতে হবে।”
এই মুহূর্তে লক্ষ্য ‘খুব সীমিত’ জানিয়ে তিনি বলেন, “লক্ষ্যটা হচ্ছে একটা গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ চাই, যে বাংলাদেশে আমরা কথা বলতে পারব, মুক্তভাবে আমাদের মত প্রকাশ করতে পারব।“
দেশের সার্বভৌমত্ব নিয়ে আপস হচ্ছে দাবি করে মাহবুব উল্লাহ বলেন, “এই অবস্থা থেকে কীভাবে মুক্তি পাব, এসব কিছু নিয়ে আমাদেরকে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে।
“শুধু চিন্তার মধ্যেই নিবিষ্ট থাকলে হবে না আমাদেরকে পথ বের করে নিতে হবে, সেই পথে চলতে হবে। সেই পথ হচ্ছে সংগ্রামের, সেই পথ হচ্ছে আত্মদানের, সেই পথ হচ্ছে মানুষকে ভালোবাসার, দেশকে ভালোবাসার।”
‘ভোটের উৎসব কীভাবে হারিয়ে গেল’
ব্যাংককের এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির এমিরেটাস অধ্যাপক নুরুল আমিন দেশের নির্বাচন পদ্ধতির প্রসঙ্গ টেনে বলেন, “ছোট বেলা থেকে দেখছি ভোটের দিনটা ছিল উৎসবের। ইউনিয়ন পর্যায় থেকে জাতীয় পর্যায়ে এটা যে কীভাবে হারিয়ে গেল!“
“আমি নিজে ২০১৮ সালে ভোট দিতে সেন্টারে ঢুকতে ছিলাম। আমার স্ত্রীও সঙ্গে ছিলেন। বলে যে, ‘বিএনপিকে যদি ভোট দিতে চান তাহলে, ভোট কেন্দ্রে ঢুকবেন না।’
“এটা আমাদের সবচেয়ে বড় লস। আমাদের সংগ্রাম, আমাদের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ আজকে কোথায়?”
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করার ফলেই এই সমস্যা তৈরি হচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন এই অধ্যাপক।
সভাপতির বক্তব্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বলেন, “মাহবুব উল্লাহ ভাইয়ের বইটি একটা রাজনৈতিক দলিল। সাধারণ মানুষের চাওয়া-পাওয়া, আশা-আকাঙ্ক্ষা এই বইতে আছে। আমি মনে করি এই বইটা লেখকের একটা বিরাট অবদান।”
কবি আবদুল হাই শিকদারের সঞ্চালনায় আলোচনায় জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার, নারী নেত্রী শিরীন হক, নিউ এজের সম্পাদক নুরুল কবির, প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান এবং বাঙ্গালা গবেষণার প্রকাশক আফজালুল বাসারও বক্তব্য রাখেন।