“ভারতের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী আমাদের হাই কমিশনের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশ মিশনের কর্মকর্তা কর্মচারীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।”
Published : 03 Dec 2024, 05:01 PM
ভারতে বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিরাপত্তায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনীর সহায়তা নিতে অন্তর্বতী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বিএনপি।
ভারতের আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাই কমিশনের ওপর হামলার প্রসঙ্গ টেনে মঙ্গলবার নয়া পল্টনে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এই আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, “উগ্রবাদী সন্ত্রাসীরা ভারতের বিজেপি সরকারের উসকানিতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের নিস্ক্রিয় উপস্থিতিতে আগরতলার কুঞ্জবনে বাংলাদেশের সহকারী হাই কমিশনে নারকীয় হামলা, জাতীয় পতাকা ছিঁড়ে আগুন, পতাকার খুঁটি ভাঙচুর, সহকারী হাই কমিশনের অভ্যন্তরের সম্পত্তি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
“ভারতের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী আমাদের হাই কমিশনের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশ মিশনের কর্মকর্তা কর্মচারীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। এই অবস্থায় বাংলাদেশ সরকারের উচিত হবে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনীর সহায়তা চাওয়া, সেখানে আমাদের মানুষদের নিরাপত্তার জন্যে ব্যবস্থা নেওয়া।”
রিজভী বলেন, “আগরতলায় কূটনৈতিক মিশনের ওপর এহেন নজিরবিহীন হামলা ভিয়েনা কনভেনশন অন ডিপ্লোমেটিক রিলেশন, ১৯৬১ এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। ভারতীয় সরকার হামলার জন্য দুঃখ প্রকাশ নাটক করলেও, অতীতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারতের আগ্রাসী হস্তক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে, যা আরও ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে।
“আমরা ভারতের উগ্রবাদী হিন্দুদের বলব, আপনাদের বন্ধুত্ব তো শেখ হাসিনার সাথে। সেই বন্ধুত্ব রক্ষায় বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে যে প্রকাশ্যে শত্রুতায় নেমেছেন, সেটা সৎ প্রতিবেশীসূলভ আচরণ নয়। হাজার হাজার মানুষ হত্যা করে আপনাদের বন্ধু হাসিনা আপনাদের কাছে আশ্রয় পেয়েছে। তাকে নিয়ে সন্তুষ্ট থাকুন। মনে রাখবেন, বাংলাদেশ লাখো প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীন হয়েছে দিল্লীর দাসত্ব করতে নয়। যে সেবাদাসী হতে চেয়েছিলেন, সেই দাসী এখন আপনাদের পদতলে।”
ভারতের বিজেপি সরকার ও ‘উগ্রবাদীরা’ এখন ক্ষমতাহারা শেখ হাসিনার চেয়েও ‘বেশি পাগল’ হয়ে গেছে মন্তব্য করে রিজভী বলেন, “মরিয়া হয়ে প্রপাগান্ডা ছড়ানো হচ্ছে। হিন্দুত্ববাদীদের আরেক ছদ্মবেশী শিখণ্ডি মমতা ব্যানার্জি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী পাঠাতে বলছে।
“ভারতেই তো বাংলাদেশের মিশনগুলো অরক্ষিত, নিরাপত্তাহীন। মিশনের একজনকে আমরা ভিডিওতে ভাইরাল হতে দেখেছি, কি বেদম প্রহার করা হচ্ছে! তারপরেও মমতা ব্যানার্জি বলবেন… বাংলাদেশে শান্তিরক্ষী বাহিনী দরকার না ভারতে শান্তিরক্ষী বাহিনী দরকার?”
একই সঙ্গে কাশ্মীর, আসাম ও মনিপুরেও জাতীয় সংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনী পাঠানো প্রযোজন বলে মনে করেন রিজভী।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্দেশে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব বলেন, “আগে নিজের দেশ সামলান। শান্তিরক্ষী বাহিনী আপনার দেশ ইন্ডিয়াতে মোতায়েন করেন। খুব দরকার, বিশেষ করে কাশ্মীরে আর আসামে ও মনিপুরে। ভারতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর এক দশকের শাসনামলে ধর্মীয় সংখ্যালঘু মুসলিমদের অধিকার ক্রমশ কমে আসছে। সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) মুসলিমবিরোধী বলে অভিযোগ রয়েছে।
“ভারতে একমাত্র মুসলিম অধ্যুষিত জম্মু ও কাশ্মিরের বিশেষ রাজ্যের মর্যাদা বাতিল করেছে মোদী সরকার। অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের স্থানে নির্মিত হয়েছে রামমন্দির। একাধিক রাজ্যে গরুর মাংস বিক্রি করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। মুছে ফেলার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে মুঘল আমলের বিভিন্ন নাম ও স্মৃতিচিহ্ন।”
যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার প্রতিবেদনেও ভারতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার লঙ্ঘিত হওয়ার চিত্র এসেছে মন্তব্য করে রিজভী বলেন, “সব মিলিয়ে ধর্মীয় জনগোষ্ঠী হিসেবে সেখানকার মুসলিমরা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন নিপীড়ণের শিকার হচ্ছেন।”
ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগগুলো তদন্ত করতে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রতি আহ্বান জানান এই বিএনপি নেতা।
‘ভারতের পরিকল্পনা বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল রাখা’
রিজভী বলেন, “ভারতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর অসংখ্য নির্মমতার ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। সেসব নিয়ে দেশটির কোনো সংকোচ বা অনুশোচনা নেই। কিন্তু বাংলাদেশে তাদের মাস্টারপ্ল্যানের পরিস্থিতিতে তারা অযাচিত উদ্বেগ-উগ্রতা প্রকাশ করছে। সেই পরিস্থিতি কিছুই না … দুয়েকটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। কিন্তু ভারতের মাস্টারপ্ল্যানের অংশ হচ্ছে, বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করো, বাংলাদেশ যাতে সঠিকভাবে চলতে না পারে– এটাই হচ্ছে তাদের আন্তর্জাতিক মাস্টারপ্ল্যান এবং এখানে বাইরের একটি দেশ এর মধ্যে জড়িত বলে বাংলাদেশের জনগণ মনে করে।”
ভারতকে ‘বিশ্বের ১ নম্বর বর্ণবাদী দেশ’ আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, “যে ভারত সংখ্যালঘু নির্যাতন রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্পন্ন করতে অভ্যস্ত, তারা বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের কাল্পনিক অভিযোগ তুলেছে।”
বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাশকে যে ইসকন থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে, সে কথা তুলে ধরে রিজভী বলেন, “চিন্ময়কে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে হিন্দুত্ববাদী ভারত। রাষ্ট্র হিসেবে ভারত কি শিশুর ওপর অত্যাচারকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়? এটা তো বড় প্রশ্ন দেশের মানুষের? চিন্ময়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ ইসকনই করেছে।”
বাংলাদেশের সকল সম্প্রদায়ের উদ্দেশে তিনি বলেন, “মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান যারাই নিরাপত্তাহীন মনে করেন, তারা সরকারকে জানান সরকার উপযুক্ত ব্যবস্থা নেবে।কিন্তু ভারতের দৃস্টি আকর্ষণ করে লাভ নেই। জন্মভূমির প্রতি অনুগত থাকুন। এই মৃত্তিকায় যদি আপনার জন্ম হয় এই মৃত্তিকার প্রতি এই মাটির প্রতি আপনি ভালোবাসা প্রকাশ করুন। বিজেপি ভারতকে ধর্মীয় উগ্রবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। বাংলাদেশ ভারতের মত উগ্রবাদী কোনো ধর্মীয় রাষ্ট্র নয়। বাংলাদেশ ভারতকে বন্ধু রাষ্ট্র ভেবে কত কিছু দিয়েছে, কিন্তু ভারত সরকার সীমান্তে রক্ত, লাশ আর আগ্রাসন ছাড়া কিছু দেয়নি।”
কিছু ধর্মীয় উগ্রবাদী ক্ষুদ্র গোষ্ঠী ভারতের বিজেপি সরকারের ‘প্রত্যক্ষ মদদে বাংলাদেশে অস্থিরতা সৃষ্টির অপচেষ্টা’ চালাচ্ছে বলে অভিযোগ করেন এই বিএনপি নেতা।
তিনি বলেন, “অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রতি আমাদের আহ্বান, এই উগ্রবাদীদের নিয়ন্ত্রণ করুন। ভারতের সাধারণ জনগণের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের কোনো শত্রুতা নেই। কিন্তু চরম উগ্রবাদী বিজেপি যদি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে চায়, তাহলে বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক প্রতিটা মানুষ এদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব-সম্মান আত্মমর্যাদা রক্ষায় রুখে দাঁড়াবে। দুর্জয় এ বাংলাদেশ কখনোই মাথা নোয়াবে না।”
ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের সমালোচনা করে রিজভী বলেন, “আপনি ভারতীয় মিডিয়াগুলো দেখবেন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অবিরত তারা কোরাস গাইছে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে, অপপ্রচার করছে। বাংলাদেশে একটি মৃত্তিকা কাঁপানো যে বিপ্লব ঘটে গেছে ৫ অগাস্ট, সেটা নিয়ে তারা কুৎসা করছে, এদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ছাত্র-জনতার যে আত্মহুতি, তাদের যে আত্মদান সেটা নিয়ে তারা কুৎসা করছে। তাদের একমাত্র আরাধ্য হচ্ছে শেখ হাসিনা।”
ভারতের ‘রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়’ বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে অভিযোগ করে তিনি বলেন, “ভারত কখনোই সহাবস্থানের লিটারেসি আয়ত্ত করেনি।… নেপালের জনগণ কি চায়, বাংলাদেশের জনগণ কি চায়, এখানকার প্রকৃতি, মৃত্তিকা, বৃক্ষ, গাছ-পালা, পাখি… সর্বোপরি জনগণ কি চায় এটাকে তারা গুরুত্ব দেয় না।তারা তাদের একেবারে পুরনো ডকট্রিন অনুযায়ী পরিকল্পিত আগ্রাসনের পথে হাঁটতে চায়।”
অন্যদের মধ্যে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য আবুল খায়ের ভুঁইয়া, তাহমিনা রুশদীর লুনা, যুগ্ম মহাসচিব আবদুস সালাম আজাদ, কেন্দ্রীয় নেতা মীর সরাফত আলী সপু, আসাদুল করীম শাহিন, বেলাল আহমেদ সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনের পরে দুপুরে নয়া পল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে কয়েকশ নেতা-কর্মী বিক্ষোভ মিছিল বের করে। রিজভী সেই মিছিলের নেতৃত্ব দেন।