বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ২০১৮ সালে দুর্নীতির মামলায় কারাগারে যাওয়ার পর এই প্রথম কোনো অনুষ্ঠানে যোগ দিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন।
Published : 21 Nov 2024, 06:14 PM
ছয় বছর পর প্রকাশ্যে কোনো অনুষ্ঠানে দেখা গেল বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে; সেনাকুঞ্জে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের পাশের আসনে বসে তিনি উপভোগ করলেন সশস্ত্র বাহিনী দিবসের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান।
বৃহস্পতিবার বেলা ৩টা ৫০ মিনিটে ঢাকা সেনানিবাসের সেনাকুঞ্জে পৌঁছান খালেদা জিয়া। গত এক যুগের মধ্যে এই প্রথম সেনাকুঞ্জের বার্ষিক এ আয়োজনে এলেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী।
সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, নৌবাহিনীর প্রধান অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ নাজমুল হাসান এবং বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁন সেনাকুঞ্জে খালেদা জিয়াকে অভ্যর্থনা জানান। গাড়ি থেকে নেমে হুইল চেয়ারে বসে অনুষ্ঠানস্থলে যান তিনি।
মিনিট পাঁচেক পর অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছান অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। ঠিক ৪টায় জাতীয় সংগীতের মধ্য দিয়ে সংবর্ধনা অনুষ্ঠান শুরু হয়। তারপর প্রধান উপদেষ্টা বক্তব্য দেন।
বক্তব্যের শুরুতে তিনি সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের অভিনন্দন জানান এবং মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন।
এরপর প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এখানে এসেছেন। একযুগ তিনি আসার সুযোগ পাননি। আমরা গর্বিত এই সুযোগ দিতে পেরে।”
দীর্ঘদিনের অসুস্থতার পরও বিশেষ দিনে সবার সঙ্গে শরিক হওয়ায় খালেদা জিয়াকে ধন্যবাদ জানিয়ে তার আশু রোগমুক্তি কামনা করেন প্রধান উপদেষ্টা।
ল্যাভেন্ডার রঙের শাড়ি পরিহিত খালেদা জিয়ার বসার ব্যবস্থা হয়েছিল প্রধান উপদেষ্টার পাশের আসনে। বক্তব্য দেওয়ার পর আসনে বসে প্রধান উপদেষ্টা খালেদা জিয়ার সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। এ সময় তাদের হাস্যোজ্জ্বল দেখাচ্ছিল।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও তার স্ত্রী রাহাত আরা বেগম দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, সেলিমা রহমান, হাফিজ উদ্দিন আহমেদসহ আমন্ত্রিত জ্যেষ্ঠ নেতারাও উপস্থিত ছিলেন অনুষ্ঠানে।
গণফোরামের প্রতিষ্ঠাতা কামাল হোসেন, জেএসডির আসম আবদুর রব, জামায়াতে ইসলামীর শফিকুর রহমানসহ বিভিন্ন জনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারাও অনুষ্ঠানে এসেছিলেন।
এর আগে বিকালে সাড়ে ৩টায় গুলশানের বাসা ‘ফিরোজা’ থেকে নিজের সাদা গাড়িতে চড়ে সেনানিবাসের উদ্দেশে রওনা হন খালেদা জিয়া। গাড়িতে তার পাশে ছিলেন ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শর্মিলা রহমান।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও চেয়ারপারসনের ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক এজেডএম জাহিদ হোসেনও ছিলেন গাড়িবহরে। খালেদার গাড়ির সামনে ছিল মিলিটারি পুলিশের (এমপি) পাইলট কার, পেছনে সেনাবাহিনীর একটি অ্যাম্বুলেন্স।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ২০১৮ সালে দুর্নীতির মামলায় কারাগারে যাওয়ার পর এই প্রথম কোনো অনুষ্ঠানে যোগ দিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন।
দুই বছর কারাগারে থাকার পর ২০২০ সালের মার্চে সরকারের নির্বাহী আদেশে সাময়িক মুক্তি পান খালেদা জিয়া। গত ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাষ্ট্রপতি দণ্ড মওকুফ করে তাকে মুক্তি দেন।
সাময়িক মুক্তির পর থেকে তিনি কয়েক দফা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর বাইরে কখনো বাসা থেকে বের হননি। রাজনৈতিক কর্মসূচি বা কোনো ধরনের অনুষ্ঠানেও তাকে দেখা যায়নি।
খালেদা জিয়া এদিন বাসা থেকে বেরিয়ে গাড়িতে ওঠার সময় রাস্তায় জড়ো হওয়া বিএনপিকর্মীরা পুরো এলাকা স্লোগানে স্লোগানে মুখর করে তোলেন।
সেনাকুঞ্জের অনুষ্ঠান শেষে বিকালে ৫টা ২৫ মিনিটে বাসায় ফেরেন খালেদা জিয়া। পরে সেখানে সংক্ষিপ্ত ব্রিফিঙে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, খালেদা জিয়ার সেনাকুঞ্জে যাওয়ার এই ঘটনা গণতন্ত্র ফেরানোর আন্দোলনে ‘ইতিবাচক ভূমিকা’ রাখবে।
“আমি আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানাতে চাই, বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বাহিনীকে… সেনা বাহিনী, নৌ বাহিনী, বিমান বাহিনীর যারা প্রধান আছেন তাদেরকে, যারা অধিকর্তা আছেন তাদেরকে। ধন্যবাদ জানাতে চাই প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে… আজকে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে আমন্ত্রণ জানানো জন্য।”
ফখরুল বলেন, “প্রধান উপদেষ্টাকে ধন্যবাদ জানাতে চাই এজন্য যে, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান যে স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছিলেন, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল, সেই ঘোষণাকে তিনি স্বীকৃতি দিয়েছেন এবং সেই সঙ্গে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার যে আপসহীন সংগ্রাম, এই দীর্ঘ বছর বছর ধরে নিরন্তর সংগ্রাম, সেই সংগ্রামকে তিনি স্বীকৃতি দিয়েছেন।
“একই সঙ্গে দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে এদেশের মানুষ যে সংগ্রাম করেছে, আত্মত্যাগ করেছে, প্রাণ দিয়েছে, তাকে তিনি স্বীকৃতি দিয়েছেন। তিনি স্বীকৃতি দিয়েছেন ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে প্রাণগুলো চলে গেল, তাকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। আমরা নিঃসন্দেহে এই কথায় স্মরণ করতে চাই, আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান আমাদের থেকে অনেক দূরে আছেন, আজকে তিনিও সবচেয়ে বেশি আনন্দিত, দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে যে আজকে তাদের সবচেয়ে প্রিয় মানুষটি (খালেদা জিয়া) তার যে জায়গা, সেই জায়গা তিনি যেতে পেরেছেন।”
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্যরা সম্মিলিতভাবে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সমন্বিত আক্রমণের সূচনা করে। দিনব্যাপী অনুষ্ঠানে প্রতিবছর দিনটি ‘সশস্ত্র বাহিনী দিবস’ হিসেবে পালন করে বাংলাদেশ।
দিনের কর্মসূচির অংশ হিসেবেই সেনাকুঞ্জে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়, যাতে রাজনৈতিক নেতা, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, কূটনীতিক ও সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ জানানো হয়।
সর্বশেষ ২০১২ সালে সশস্ত্র বাহিনী দিবসের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন খালেদা জিয়া, তখন তিনি বিরোধী দলীয় নেতা। এরপর আর কখনো তাকে সেনাকুঞ্জের এ আয়োজনে দেখা যায়নি।
এক সময় সেনাকুঞ্জের এ অনুষ্ঠান আলোচনায় থাকত অন্য রাজনৈতিক কারণে। দেশের দুই বড় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতা হিসেবে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া দুজনেই এ অনুষ্ঠানে যেতেন। চির বৈরী এ দুই নেতার সারা বছর দেখা না হলেও সেনাকুঞ্জে তাদের সাক্ষৎ হওয়ার সম্ভাবনা থাকত।
সর্বশেষ ২০১২ সালে নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থা নিয়ে মুখোমুখি অবস্থানের মধ্যেও সশস্ত্র বাহিনী দিবসের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন দুই নেত্রী। তবে সেদিন তাদের কথা হয়নি।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর সর্বশেষ ২০০৯ সালে সেনাকুঞ্জের অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে একসঙ্গে দেখা গিয়েছিল।
গণ অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের সরকার সরকার পতনের পর গত ৫ অগাস্ট পালিয়ে ভারতে চলে যান শেখ হাসিনা। জুলাই-অগাস্টের ‘গণহত্যার’ মামলায় তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।