বিএনপি ক্ষমতায় গেলে প্রধানমন্ত্রীও স্বৈরাচারী হয়ে যেন ক্ষমতার অপব্যবহার করতে না পারে তা নিশ্চিত করা হবে, বলেন তিনি।
Published : 14 Nov 2024, 10:14 PM
বিএনপি ক্ষমতায় গেলে প্রধানমন্ত্রীসহ যে কেউ যাতে ক্ষমতার অপব্যবহার করতে না পারে সেই ব্যবস্থা দলের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করার কথা তুলে ধরেছেন তারেক রহমান।
বৃহস্পতিবার বিকালে রাজধানীতে এক সেমিনারে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বিএনপি ভবিষ্যতে ক্ষমতায় গেলে কী করবে সেটির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এমন একটি ব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা বলেন।
তিনি বলেন, “আমরা নিশ্চিত করতে চাই, সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে আমাদের আগামীর বাংলাদেশে আর কোনো ব্যক্তি এমনকি প্রধানমন্ত্রীও স্বৈরাচারী হয়ে যেন ক্ষমতার অপব্যবহার করতে না পারে বা পারবে না।
“রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে সরকারের প্রতিটি লেভেলে চেষ্টা করা হবে নিশ্চিত করতে কেউ জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে নয়, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। বিএনপি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেলে আমরা দলমত নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিকের মতামত স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে চাই। আমরা মানবাধিকার, মানবাধিকার কর্মী, সমাজকর্মী ও সাংবাদিকদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।”
সংবাদমাধ্যম ও মতপ্রকাশের সর্বোচ্চ স্বাধীনতা নিশ্চিত করার কথা তুলে ধরে তারেক বলেন, ‘‘আমাদের লক্ষ্য এমন একটি রাষ্ট্র কাঠামো গড়ে তোলা যেখানে ইউটিউব, ফেইসবুক এবং অনলাইন প্লাটফর্মে নিজের ভাবনা প্রকাশের কারণে কিংবা প্রধানমন্ত্রীসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির বিষয়ে মন্তব্যের দায়ে কাউকে যেন হেনস্তা করা না হয়। সত্য গোপন করতে মেইন স্ট্রিম অ্যান্ড সোশ্যাল মিডিয়া যেন বাধ্য না হয়। এমনকি মিথ্যা তথ্য দিয়ে সেটি প্রচারেও সরকার কাউকে চাপ দেবে না।
“তবে দেশ গঠনের দায়িত্ব সবার। আমরা মিডিয়ার নিউট্রাল ও অবজেক্টিভ রোল প্রত্যাশা করি।”
গত ১৬ বছরে ‘গুম ও খুনের’ মাধ্যমে দেশে ভয়ের যে সংস্কৃতি চালু করা হয়েছে তা বিএনপি নির্মূল করবে বলেও অঙ্গীকার করেন তারেক।
গুলশানে লেকশোর হোটেলের মিলনায়তনে বিএনপির উদ্যোগে ’৩১ দফা রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের রূপরেখা ও নাগরিক ভাবনা’ শীর্ষক এ সেমিনারে বক্তব্য দিচ্ছিলেন তিনি।
সেমিনারে ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাবের রূপরেখার পটভূমি তুলে ধরেন দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য ইসমাইল জবিহউল্লাহ। এরপর দলের তৈরি একটি ’পাওয়ার পয়েন্ট’ উপস্থাপনা দেওয়া হয়।
পরে তারেক রহমান বলেন, “বাংলাদেশে স্বৈরাচারী ব্যবস্থার যেন আর পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেটি নিশ্চিত করতে বিএনপি সংবিধানে এমন ব্যবস্থা রাখতে চায় যাতে কেউ পরপরের বেশি প্রধানমন্ত্রী না হতে পারে।
”আমরা আইন-বিচার ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে ভারসাম্য রাখতে চাই। রাষ্ট্র পরিচালনায় সমাজের জ্ঞানী-গুনীদের প্রতিনিধিত্ব এবং অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে দ্বি-কক্ষ বা বাই ক্যামেরাল পার্লামেন্ট সিস্টেম প্রবর্তন করতে চাই।”
তিনি তরুণ বেকারদের কর্মসংস্থান ও দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব দেওয়ার কথা তুলে ধরে বেকার ভাতা চালুর কথা বলেন।
‘সংস্কার মানে মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন’
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক বলেন, ‘‘সব আলোচিত সব সংস্কার প্রস্তাবই ৩১ দফায় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। আামি সংস্কার বলতে সেটিই বুঝি যে সংস্কারের মাধ্যমে সংবিধানের কয়েকটি বাক্যের পরিবর্তন নয় শুধু। বরং মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হবে। একজন মানুষের রোজগারের ব্যবস্থা হবে এবং তার ও পরিবারের আর্থ সামাজিক ব্যবস্থা নিশ্চিত হবে।
”আমি সংস্কার বলতে সেটিই বুঝি যা কর্মসংস্থানের মাধ্যমে প্রতিটি নারী ও পুরুষের বেকারত্বের সমস্যার সমাধান করবে; যে সংস্কার নারীদের সন্মান, স্বাধীনতা, ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করবে; যে সংস্কার সকল মানুষের জীবনের সুরক্ষা নিশ্চিত করবে; যে সংস্কার দেশের সন্তানদের আধুনিক শিক্ষা ও নৈতিক মূল্যবোধ গঠন করবে; যে সংস্কার মানুষকে কাঙ্খিত স্বাস্থ্য সেবা দেবে; যে সংস্কার বাজারে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম স্থিতিশীল রাখবে। আমি সংস্কার বলতে সেটিই বুঝি যা কৃষক-শ্রমিকসহ সকল কর্মজীবী মেহনতি মানুষের ন্যায্য ও প্রাপ্য নিশ্চিত করবে।”
বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোর সমন্বয়ে প্রণয়ন করা ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাবে সব মত ও পথের সমন্বয়ে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক-বৈষম্যহীন-সম্প্রীতিমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট সংসদ, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার নির্বাহী ক্ষমতায় ভারসাম্য, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ দুই মেয়াদ নির্ধারণ, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন, সুপ্রিম কোর্টের জন্য আলাদা সচিবালয়, ন্যায়পাল নিয়োগসহ বিভিন্ন খাতে সংস্কারের লক্ষ্যে কমিশন গঠনের অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আন্দোলনে থাকা দল ও জোটকে নিয়ে গত বছরের ১৩ জুলাই 'সংবিধান ও রাষ্ট্রব্যবস্থার গণতান্ত্রিক সংস্কার এবং অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে 'রাষ্ট্র মেরামতে ৩১ দফা' ঘোষণা করে বিএনপি।
এর আগের বছর ২০২২ সালের ১৯ ডিসেম্বর তারেক রহমান 'রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের রূপরেখা' ঘোষণা করেন।
এই সংস্কার প্রস্তাব সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পরিবর্তন করার কথা তুলে ধরে তারেক রহমান বলেন, ‘‘তা হবে স্টেকহোল্ডার কনসালটেশন এবং পাবলিক কনসেনসাসের মাধ্যমে। সময়ের সাথে এই ৩১ দফাই একদিন আমাদের দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য তথা সুখী ও স্বনির্ভর বাংলাদেশ অর্জনের দ্বার উন্মোচন করবে বলে ব্যক্তিগত ভাবে আমি বিশ্বাস করি।”
রাজনীতির উদ্দেশ্য শুধু ক্ষমতায় যাওয়া নয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, “বরং রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন এবং জনগণের অভিপ্রায় বহিপ্রকাশও এর একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমাদের গড়ে তুলতে হবে একটি লিবারেল ডেমোক্রেটিক বাংলাদেশ, আমাদের সবাইকে এক হয়ে এগিয়ে যেতে হবে বহু দূরে।”
দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সভাপতিত্বে শামা ওবায়েদ ও ফারজানা শারমিনের সঞ্চালনায় সেমিনারে জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) মোস্তফা জামাল হায়দার, নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না, জামায়াতে ইসলামীর রফিকুল ইসলাম খান, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাইফুল হক, এনডিএমের ববি হাজ্জাজ, বাংলাদেশ লেবার পার্টির মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, গণফোরামের অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, এলডিপির রেদোয়ান আহমেদ, এবি পার্টির আসাদুজ্জামান ফুয়াদ, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ, অধ্যাপক বোরহান উদ্দিন খান ও অ্যাডভোকেটে এলিনা খান বক্তব্য রাখেন।
সেমিনারে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) আন্দালিব রহমান পার্থ, জামায়াতের হামিদুর রহমান আজাদ, জাতীয় দলের সৈয়দ এহসানুল হুদা, বিকল্প ধারা বাংলাদেশের নুরুল আমিন বেপারি, গণসংহতি আন্দোলনের আবুল হাসান রুবেল, জাগপার খন্দকার লুৎফুর রহমান ও রাশেদ প্রধান, এনডিপির আবু তাহের, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মুফতি মহিউদ্দিন ইকরাম, গণতান্ত্রিক বাম ঐক্যের হারুন চৌধুরী ও আবুল কালাম আজাদ, ন্যাপ ভাসানীর আজহারুল ইসলাম, ইসলামী আন্দোলনের আশরাফ আলী আকন্দ উপস্থিত ছিলেন।
সেমিনারে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সেলিমা রহমান, সালাহউদ্দিন আহমেদ ও হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, জ্যেষ্ঠ নেতা আলতাফ হোসেন চৌধুরী, বরকত উল্লাহ বুলু, শামসুজ্জামান দুদু, আহমেদ আজম খান, নিতাই রায় চৌধুরী, আমান উল্লাহ আমান, মিজানুর রহমান মিনু, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, আফরোজা খান রীতা, আবুল খায়ের ভুঁইয়া, জহির উদ্দিন স্বপন, অধ্যাপক সুকোমল বড়ুয়া, শহিদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, আবদুস সালাম আজাদ, মাহবুবে রহমান শামীমসহ কেন্দ্রীয় ও অঙ্গ সংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
এতে আরও উপস্থিত ছিলেন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, নরওয়ে, পাকিস্তান, ভারত, জাপান, সৌদি আরব, জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশের কুটনীতিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আনোয়ার উল্লাহ চৌধুরী, অধ্যাপক নুরুল আমিন, অধ্যাপক এবিএম ওবায়দুল ইসলাম, অধ্যাপক শামসুল আলম সেলিম।