এই কমিশন বাতিলসহ কয়েকটি দাবিতে সরকারকে ৩ মে পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছে হেফাজতে ইসলাম।
Published : 20 Apr 2025, 11:48 PM
দেশের ইসলামপন্থীদের অন্যতম প্ল্যাটফরম ‘হেফাজতে ইসলামে’র নারী সংস্কার কমিশন বাতিলের দাবি তোলার পর জামায়াতে ইসলামও কমিশনের দেওয়া প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত নারী সংস্কার কমিশন গত শনিবার প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদনটি জমা দেওয়ার পর ধর্মীয় নেতাদের মধ্যে এ নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়।
ইসলামি উত্তরাধিকার আইন ও ইসলামি পারিবারিক আইন নিয়ে যে পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ কমিশন দিয়েছে, হেফাজতের আপত্তি মূলত সেই জায়গায়।
এই কমিশন বাতিলসহ কয়েকটি দাবিতে সরকারকে ৩ মে পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছে হেফাজতে ইসলাম। এই সময়ের মধ্যে তাদের দাবি পূরণ না হলে ৩ মের মহাসমাবেশে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণার কথা বলছে তারা।
জামায়াতে ইসলামী কোন সুপারিশ নিয়ে তাদের আপত্তি তা স্পষ্ট করে না বললেও কিছু সুপারিশকে ‘গর্হিত’ আখ্যা দিয়ে বলেছে, এসব বিষয় সমাজকে ‘চরম অস্থিতিশীলতার’ দিকে ঠেলে দেবে।
রোববার রাতে জামায়াতে ইসলামের ফেইসবুক পেইজে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে বলা হয়, দলটির আমির শফিকুর রহমান ওই প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেছেন।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “গতকাল (শনিবার) অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ইউনূসের কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন। তাদের সুপারিশকৃত রিপোর্ট দেখে বিস্মিত!”
“দেশে যখন নৈতিকতার অভাবে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক এবং পারিবারিক সমস্যা দেখা দিচ্ছে, সেই প্রেক্ষাপটে নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের ভিত্তিতে সামাজিক শৃঙ্খলা ও সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনার পরিবর্তে ওই সুপারিশমালায় এমন কিছু গর্হিত বিষয় নিয়ে আসা হয়েছে তা সমাজকে অনিশ্চয়তা ও চরম অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দেবে।
“কতিপয় সুপারিশ কোরআন এবং হাদিসের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। পাশাপাশি সকল ধর্মের মূল্যবোধকে তছনছ করে দেবে। বাংলাদেশের জনগণ এক বাক্যে তা প্রত্যাখ্যান করবে।”
বেসরকারি সংস্থা ‘নারীপক্ষ’র প্রতিষ্ঠাতা সদস্য শিরীন পারভীন হককে প্রধান করে গত ১৮ নভেম্বর নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার।
কমিটি শনিবার সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন জমা দেয়। সেখানে ৪৩৩টি সুপারিশ করা হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা ওই কমিশনের কিছু সুপারিশ দ্রুত বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়েছেন বলে শনিবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।
কমিশন মোটা দাগে সংবিধান, আইন ও নারীর অধিকার— এ তিন বিষয়ে সুপারিশ করেছে, যেখানে সমতা ও সুরক্ষার ভিত্তি জোরালো করার কথা বলা হয়েছে। নারীর অগ্রগতির জন্য আছে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও জাতীয় সংস্থাগুলোর দক্ষতা বাড়ানোর সুপারিশও এসেছে।
গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলো হল–
• অভিন্ন পারিবারিক আইনের মাধ্যমে সব ধর্মের নারীদের জন্য বিয়ে, তালাক, উত্তরাধিকার ও ভরণপোষণে সমান অধিকার নিশ্চিত করা।
• অভিভাবক ও প্রতিপাল্য আইন, ১৮৯০ সংশোধন করে সন্তানের ওপর নারীর জন্য সমান অধিকার নিশ্চিত করা।
• পরবর্তী সময়ে নির্বাচিত সরকারের জন্য বিভিন্ন ধর্মের পারিবারিক আইন সংশোধন করা এবং মুসলিম ও অন্যান্য ধর্মীয় উত্তরাধিকার আইন সংশোধন করে নারীদের সম্পত্তিতে ৫০–৫০ ভাগ নিশ্চিত করা।
• সংসদীয় আসন বাড়িয়ে ৬০০ করে সেই আসন থেকে ৩০০ আসন নারীর জন্য সংরক্ষিত রেখে সরাসরি নির্বাচন।
• বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ককে ধর্ষণ হিসেবে ফৌজদারি আইনে অন্তর্ভুক্ত করা।
• যে কোনো উপস্থাপনায় অহেতুক নারীর প্রসঙ্গ টেনে নারীবিদ্বেষী বয়ান, বক্তব্য ও ছবি পরিবেশন থেকে বিরত থাকা।
• শ্রম আইন সংশোধন করে যৌনকর্মীদের মর্যাদা ও শ্রম অধিকার নিশ্চিত করা।
জামায়াতে ইসলাম এই প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যানের কথা বললেও হেফাজতে ইসলাম এই কমিশনটিকেই বাতিলের দাবি জানিয়েছে।
রোববার রাজধানীর কাকরাইলের ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে হেফাজতের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদের এক জরুরি বৈঠক শেষে এসব দাবি ও কর্মসূচির বিষয়ে জানানো হয়।
ওই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের আমির শাহ মহীবুল্লাহ বাবুনগরী। সেখানে সংগঠনের মহাসচিব সাজিদুর রহমানসহ জ্যেষ্ঠ নেতারা কথা বলেন।
পরে সেখানে দাবিগুলো তুলে ধরে হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক বলেন, “আমাদের প্রথম দাবি, ফ্যাসিবাদী আমলে হেফাজতে ইসলামের নেতাদের নামে অসংখ্য মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে, তা প্রত্যাহার করে ২০১৩ সালে শাপলা চত্বরে এবং ২০২১ সালের মোদিবিরোধী আন্দোলনে হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মীদের হত্যাকাণ্ডসহ সকল হত্যাকাণ্ডের দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
“দ্বিতীয় দাবি হচ্ছে, বাংলাদেশের সংবিধান সংস্কার কমিশনে যে প্রস্তাব আনা হয়েছে, তার মধ্যে অত্যন্ত বিতর্কিত এবং শঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে একটা প্রস্তাব, তা হল ‘বহুত্ববাদ’। আমরা বহুত্ববাদের প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করছি। বহুত্ববাদের প্রস্তাব বাতিল করে মহান আল্লাহর ওপর অবিচল আস্থা ও বিশ্বাসের ধারা পুনর্বহাল করতে হবে।”
নারী সংস্কার কমিশন বাতিলের দাবি জানিয়ে মামুনুল হক বলেন, “গতকাল (শনিবার) নারী অধিকার সংস্কার কমিশন কর্তৃক যে প্রস্তাব তৈরি করা হয়েছে, সেটি ঐকমত্য কমিশনে উপস্থাপন করা হয়েছে, সেখানে অত্যন্ত আপত্তিকরভাবে ধর্মীয় বিধিবিধান, বিশেষ করে ইসলামি উত্তরাধিকার আইন ও ইসলামি পারিবারিক আইনকে নারীর প্রতি বৈষম্যের কারণ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। আমরা এই প্রস্তাবনা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান এবং বাতিলের দাবি করছি।
“এই ধরনের বিতর্কিত, ইসলামবিদ্বেষী, ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতকারী, সরাসরি ইসলামবিরোধী, কোরআন-সুন্নাহর সঙ্গে সাংঘর্ষিক, ন্যক্কারজনক কটাক্ষপূর্ণ প্রস্তাব দেওয়ার কারণে এই কমিশন বাতিলের দাবি করছি। প্রধান উপদেষ্টার ফেসবুক পেইজ থেকে এই প্রস্তাব প্রচার এবং সেটি এই সরকারের আমলে বাস্তবায়নের প্রত্যয় করা হয়েছে। আমরা এই ঘোষণা প্রত্যাহারেরও দাবি জানাচ্ছি।”
সরকারকে ৩ মে পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়ে মামুনুল বলেন, “৩ তারিখের আগে প্রধান উপদেষ্টার কার্যলয় থেকে ঘোষণা প্রত্যাহার এবং নারী অধিকার সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবনাকে প্রত্যাহার এবং ইসলামকে কটাক্ষ করে প্রস্তাবনা দেওয়ার দায়ে এই কমিশনকে বাতিল করা না হলে- ৩ মের মহাসমাবেশ থেকে হেফাজতে ইসলাম পরবর্তী কর্মসূচি গ্রহণ করবে।”
পুরনো খবর
নারীর জন্য ‘সমতা ও সুরক্ষার’ সুপারিশ
নারী বিষয়ক সংস্কার: সুপারিশ বাস্তবায়নে ‘সদিচ্ছার’ চ্যালেঞ্জ সরকারের