“এখন আর অস্বীকার করার উপায় নাই যে, সাবেক পুলিশপ্রধান ও সেনাপ্রধানের দুর্নীতির চিত্র হিমশৈলের ক্ষুদ্র উপরিভাগ মাত্র,” বলেন তিনি।
Published : 25 Jun 2024, 12:51 AM
দেশে ‘দুর্নীতির মচ্ছব’ চলছে মন্তব্য করে তা বন্ধ করতে এখনই ‘বিশেষ কমিশন’ গঠন করার পাশাপাশি ঋণখেলাপিদের বিচারে ‘বিশেষ ট্রাইব্যুনাল’ গঠনের দাবি তুলেছেন ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন।
সোমবার ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে এ দাবি করেন তিনি।
রাশেদ খান মেনন বলেন, “এ কথা এখন আর অস্বীকার করার উপায় নাই যে, সাবেক পুলিশপ্রধান (বেনজীর আহমেদ) ও সেনাপ্রধানের (আজিজ আহমেদ) দুর্নীতির চিত্র হিমশৈলের ক্ষুদ্র উপরিভাগ মাত্র। এখনই বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করে দুর্নীতির এই বিস্তার রোধ করা না গেলে হিমশৈলের ধাক্কায় দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতির সলিল সমাধি হবে।
“কিন্তু দুর্ভাগ্য, আমরা এখানে দেখলাম পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন থেকে দুর্নীতির খবর প্রকাশ করার জন্য সাংবাদিকদের ধমক দেওয়া হয়েছে। অনেক মন্ত্রী এ তথ্যকে অনুমানভিত্তিক বলে অভিহিত করছেন।”
যুক্তরাষ্ট্রের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি ইনস্টিটিউশন ‘বছরে ৭ বিলিয়ন ডলার বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়ে যাচ্ছে’ বলে যে তথ্য দিয়েছে, সেটি তুলে ধরে মেমন দাবি করেন, এ অর্থ বিনিয়োগ হচ্ছে কানাডার বেগমপাড়ায়, মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোমে, সিঙ্গাপুর-দুবাইয়ের আধুনিক শপিংমল, রিয়েল এস্টেট ও হুন্ডি ব্যবসায়।
“এ টাকার লভ্যাংশও দেশে আসছে না। পাচারকৃত টাকা ফিরিয়ে আনার কোনো উদ্যোগ নাই। অথচ প্রবাসীরা বিদেশে হাড়ভাঙা খাটুনির মাধ্যমে যে আয় দেশে পাঠান, তার ওপর কর বসানো হচ্ছে। তাদের বিদেশযাত্রা নিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে।”
মেনন মনে করেন, এসব সম্পদের অন্যতম উৎস হচ্ছে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়া টাকা।
“ব্যাংক লুট করা হচ্ছে ও দুর্নীতি হচ্ছে। ২০০৯ সালে ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকার ঋণ এখন ১ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। পুনঃতফসিলীকরণ ও অবলোপন ধরলে এর পরিমাণ ৪ থেকে ৫ লাখ হাজার কোটি টাকা দাঁড়াবে।”
কালো টাকা সাদা করার সুযোগের বিরোধিতা করে মেনন বলেন, “লুটের টাকাকে যখন সাদা করার জন্য সৎ উপায়ে অর্জিত অর্থের চেয়ে অর্ধেক কর দিয়ে সাদা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়, তখন সেটা সততার জন্য তিরস্কার ও অসততার জন্য পুরস্কারের শামিল হয়ে দাঁড়ায়। এ সম্পর্কে যে সব যুক্তি দেওয়া হচ্ছে, তা কেবল অসাড়ই নয়, এ প্রসঙ্গে সরকারের অতীত অবস্থানের বিপরীত।
“খালেদা জিয়ার জন্য যেটা অনৈতিক, বর্তমানেও সেটা অনৈতিক। আশা করি অর্থমন্ত্রী এই প্রস্তাব প্রত্যাহার করে সংসদকে এর দায়ভার থেকে রেহাই দেবেন।”
সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার খুনের ঘটনা প্রসঙ্গে মেনন বলেন, এই ‘দুঃখজনক’ ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের স্বর্ণ-মাদক চোরাচালান ও অপরাধ জগতের যে চিত্র বেরিয়ে আসছে, যে খবর প্রকাশিত হচ্ছে, তাতে সংসদের ‘ভাবমূর্তি নষ্ট’ হচ্ছে। বিষয়টি আরও খতিয়ে দেখা দরকার। ‘আত্মসমালোচনা’ দরকার।
‘নিষ্ঠুর অলিগার্করা’ দেশের অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে বলে মন্তব্য করে ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা বলেন, “অলিগার্কির স্বার্থ রক্ষার্থে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা যায়নি। দ্রব্যমূল্যের ক্রমবর্ধমান ঊর্ধ্বগতি, দুর্নীতি, অর্থ পাচার, ব্যাংকিং খাতে লুট ও নৈরাজ্য, খেলাপি ঋণের বিশাল পাহাড় দেশের অর্থনীতিকে ভঙ্গুর অবস্থায় উপনীত করেছে।
“এর থেকে অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার, জন ও রাষ্ট্রীয় জীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনাই ছিল বর্তমান সময়ের জরুরি কর্তব্য। কিন্তু সেই লক্ষ্যে বাজেটে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা দেখা যায় না। আওয়ামী লীগের যে নির্বাচনী ইশতেহারের কথা বাজেটে উল্লেখ করা হয়েছে, বাজেট প্রস্তাবনা সেখান থেকে যোজন যোজন দূরে, সাংঘর্ষিক।”
সরকারের উচ্চপর্যায়ে আঁতাত করে সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক বনে যাওয়া প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের বলা হয় অলিগার্ক।
প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি না হওয়ার প্রসঙ্গ টেনে রাশেদ খান মেনন বলেন, “প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফরে ভারত তিস্তার পানি প্রবাহ বৃদ্ধি ও সংরক্ষণের ব্যবস্থাপনায় সহযোগিতার কথা বলেছে। কিন্তু তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি কোথায় গেল আমরা জানি না। তিস্তার পানি চুক্তি না করে এ সহযোগিতা গাছের গোড়া কেটে ওপর দিয়ে পানি ঢালার শামিল।
“এ সফরে গঙ্গা চুক্তি নবায়নের কথা এসেছে। তার জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু ওই চুক্তিতে গঙ্গার পানি প্রবাহ বৃদ্ধির জন্য খাল কেটে গঙ্গার পানি প্রবাহ বৃদ্ধির যে বিষয়টি ছিল, তা ৩০ বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি। বরং এখন ফারাক্কার ওপরে আরেকটি ব্যারেজ তৈরির কথা এসেছে।”
সরকারি দলের সংসদ সদস্য শ ম রেজাউল করিম মামলা জট নিরসনের উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান রেখে এ জন্য নতুন বিচারক নিয়োগ, উচ্চ ও নিম্ন আদালতে বিচারকদের বেতন-ভাতা বাড়ানো, বিচার বিভাগকে আরও শক্তিশালী করার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, বিচার বিভাগ শক্তিশালী হলে গণতন্ত্রও শক্তিশালী হবে।
ঝিনাইদহ-৩ আসনের সরকার দলীয় সংসদ সদস্য সালাহ উদ্দিন মিয়াজী বলেন, “আমার নির্বাচনী এলাকা সীমান্তবর্তী এলাকা। কাঁটাবিহীন প্রায় ১৭ কিলোমিটার সীমান্ত স্বর্ণ চোরাচালান, নারী-শিশু পাচার ও মাদক দ্রব্যের চোরাচালানের নিরাপদ রুটে পরিণত হয়েছে। জনগণকে নিয়ে প্রশাসন ও নিরাপত্তা বাহিনী, গোয়েন্দা বাহিনীকে সমন্বয় করে একটি স্পেশাল টাস্কফোর্স গঠন এবং রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করার জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।”
বাজেট আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রবাসী কল্যাণ প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী বলেন, যাদের কাছে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র থাকার পরেও মালয়েশিয়ায় যেতে পারেনি তাদের তদন্ত কমিটির কাছে অভিযোগ করতে বলা হয়েছে। এরই মধ্যে ৩ হাজারেরও বেশি অভিযোগ গ্রহণ করা হয়েছে। মালয়েশিয়া কর্মী পাঠানো নিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে ৬ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে, যারা সব যাচাই-বাছাই করবে।
কক্সবাজার-১ আসনের সদস্য ও কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহম্মদ ইবরাহিম বলেন, “উন্নয়নের পথে বাধা হচ্ছে মাদক, দুর্নীতি ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের অপব্যবহার। শুধু কমান্ড দিয়ে, দুর্নীতি দমন কমিশন দিয়ে দুর্নীতি কমানো যাবে না। এ জন্য মহা কর্মপরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।”
কক্সবাজারের মিয়ানমার সীমান্তে মানুষের মনের আতঙ্ক দূর করতে বিজিবি, স্থানীয় পুলিশ-প্রশাসন, স্থানীয় সামরিক কর্তৃপক্ষকে আরও শক্তিশালী করার দাবি জানান সৈয়দ মুহম্মদ ইবরাহিম।
তিনি বলেন, “সেন্ট মার্টিন দ্বীপ কক্সবাজার সীমান্ত থেকে একটু দূরে। সমগ্র জাতি ও বিশ্ব সেন্ট মার্টিনের দিকে তাকিয়ে আছে। আমরা আশা করি, এ নিয়ে সংসদে কেউ না কেউ কিছু বলবেন। সেন্ট মার্টিন দ্বীপের মানুষের আতঙ্ক দূর করবেন।”
বাজেট আলোচনায় অংশ নিয়ে হবিগঞ্জ-৪ (চুনারুঘাট-মাধবপুর) আসনের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন বলেন, বাজেটের আকার ও প্রকার নিয়ে আমার বিশ্বাসের ঘাটতি আছে। কিন্তু এ বাজেট বাস্তবায়নে যিনি নেতৃত্ব দিচ্ছেন- প্রধানমন্ত্রী তার প্রতি বিশ্বাসের ঘাটতি নেই।
“যে ধরনের বাজেট হোক না কেন তিনি কোনো না কোনোভাবে আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন এই বিশ্বাস আছে।”
তিনি বলেন, “টাকা পাচার এই সরকারের সব থেকে বড় সমস্যা। টাকা পাচার ঠেকানো যাচ্ছে না। টাকা পাচার হয়ে যে দেশে যায়, তা দিয়ে সেই দেশের বাজেট হয়। আমরা বঙ্গবন্ধুর খুনিকে আনতে পারি না; পাচারের টাকা ফেরত আনব কীভাবে? টাকা পাচারের কারণে বাজেট সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে।”
‘রাসেলস ভাইপার সাপ সরকারে চলে আসছে’ মন্তব্য করে সুমন বলেন, “যখন সাপ আসে প্রকৃতিতে বেজি থাকে। এই বেজি সাপকে নিয়ন্ত্রণ করে। তবে এই সরকারের বিভিন্ন জায়গায় রাসেলস ভাইপার আছে কিন্তু বেজি ওই পরিমাণ নেই যে সাপ ধরবে।”
তিনি বলেন, “আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়ে গেছে। একজন ভদ্রলোককে দুদক ধরতে পারেনি, এনবিআর পারেনি, বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটও পারেনি। অথচ এনবিআরের মতিউর রহমানকে ধরল একটা ছাগল। ছাগল না এলে এই লোককে আর জানতে পারতেন না।”
সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের প্রসঙ্গ ধরে এ সংসদ সদস্য বলেন, “তিনি কত বড় হয়ে গেলেন অথচ মন্ত্রণালয় জানল না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানলেন না। আর কিছুদিন সুযোগ পেলে পুরো গোপালগঞ্জ কিনে ফেলতেন। তারপরও বলব, এর দায় এই মন্ত্রণালয় এড়াতে পারে না।
“কালো টাকা সাদা করবেন অসুবিধা নেই। কিন্তু এই সাদা করার মধ্য দিয়ে বেনজীর আর মতিউরের টাকা সাদা হয়ে যায়, আর তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ও আদর্শের উত্তরাধিকারদের টাকা সাদা হয়ে যায়।”
গত অধিবেশনে দেওয়া জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য মুজিবুল হক চুন্নুর বক্তব্যের জবাবে সুমন বলেন, “এই সংসদে আমার বিরুদ্ধে একজন মাননীয় সংসদ সদস্য অভিযোগ দিয়েছেন। আমি বরাদ্দের তথ্য ফেইসবুক দিয়ে দিয়েছি। ২৫ কোটি টাকার কথা বলা হয়েছে। আমি যত বরাদ্দ পেয়েছি এমপি হিসেবে তার ট্রাস্টি আমি। এই টাকা জনগণের। এর বিষয়ে জানার অধিকার আছে তাদের।
“আপনি যে বরাদ্দ পাবেন নতুন প্রজন্ম তা জানতে চায়। সেটা জানার অধিকার জনগণের আছে। এই স্বচ্ছতা আমার মধ্যে থাকতে হবে।”