গণপরিষদের বৈঠকে নুরুল ইসলাম চৌধুরী শুধু খসড়া সংবিধানের বিভিন্ন বিষয়ে নিজের মতামত ও অবস্থান স্পষ্ট করাই নয়, বরং পরিষদের কাজের শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য অনেক সময় স্পিকারের দৃষ্টি আকর্ষণও করেছেন।
Published : 27 Aug 2023, 06:44 PM
১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট যখন সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হন—তখন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী নুরুল ইসলাম চৌধুরী। ঘটনা শোনার সঙ্গে সঙ্গে তিনি তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহকে টেলিফোন করে বিদ্রোহ দমনের নির্দেশ দিয়েছিলেন। সফিউল্লাহ তাঁকে আশ্বস্ত করেছিলেন যে, আধা ঘণ্টার মধ্যে বিদ্রোহ দমন হয়ে যাবে। কিন্তু তারপর কী হলো? ওই নৃশংস হত্যাকাণ্ড কেন ঠেকানো গেল না? মৃত্যুর আগের বছর ১৯৯৪ সালে পত্রিকায় ওই ঘটনার বিস্তারিত লিখে গেছেন নুরুল ইসলাম চৌধুরী। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের ইতিহাসে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী জাতীয় পরিষদ (চট্টগ্রাম-৬) সদস্য নুরুল ইসলাম চৌধুরী ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক এবং বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য। ১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে তৎকালীন চট্টগ্রাম-১১ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত তিনি বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় প্রথমে শিল্প প্রতিমন্ত্রী এবং পরে প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
জন্ম ও শিক্ষা
নুরুল ইসলাম চৌধুরী ১৯২৭ সালের ১৩ জানুয়ারি চট্টগ্রামের পটিয়ায় গোবিন্দরখীল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা আবদুস ছমদ চৌধুরী ছিলেন ব্রিটিশ আমলের পুলিশের দারোগা। বাবার সরকারি চাকরির সুবাদে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণ ও লেখাপড়া করতে হয়েছে নুরুল ইসলাম চৌধুরীকে।
তিনি ১৯৪২ সালে বরিশাল জিলা স্কুল থেকে এন্ট্রান্স, ১৯৪৪ সালে কলকাতা স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে আই.এ এবং ১৯৪৭ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে বি.এ পাস করেন। ১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এম.এ এবং ১৯৫৪ সালে এল.এল.বি ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম সিটি কলেজসহ একাধিক প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেছিলেন। এই সময়ও আইন প্র্যাকটিস করতেন। পরে পুরোপুরি আইন পেশায় নিয়োজিত হয়ে যান। আমৃত্যু বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
রাজনৈতিক জীবন
নুরুল ইসলাম চৌধুরী ছাত্রজীবনেই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৪৬ থেকে ১৯৪৭ মেয়াদে তিনি তৎকালীন বঙ্গীয় মুসলিম ছাত্রলীগের চট্টগ্রাম শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারীদের ধর্মঘটের সময় সলিমুল্লাহ মুসলিম ছাত্রাবাস থেকে বহিষ্কৃত হন।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে নুরুল ইসলাম চৌধুরীর পরিচয় কলকাতায়। তখন তিনি বেকার হোস্টেলে থেকে ইসলামিয়া কলেজে পড়তেন আর নুরুল ইসলাম চৌধুরী থাকতেন কারমাইকেল হোস্টেলে।
১৯৫২ সালে তিনি যখন চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার কানুনগোপাড়া স্যার আশুতোষ কলেজে অধ্যাপনা করছেন, তখন একদিন বেঙ্গুরা রেলস্টেশন থেকে ট্রেনে পটিয়ায় যাচ্ছিলেন। ট্রেনের কামরায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা। তাঁর সঙ্গে ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওর্দী ও জহুর আহমদ চৌধুরী। শেখ মোজাফ্ফর আহমদসহ আওয়ামী মুসলিম লীগের স্থানীয় নেতৃবৃন্দও ছিলেন। তাঁরা যাচ্ছিলেন সাতকানিয়ায়, একটি জনসভা করতে।
নুরুল ইসলাম চৌধুরীকে যেহেতু ছাত্রজীবন থেকেই বঙ্গবন্ধু চিনতেন এবং পছন্দ করতেন, তাই জিজ্ঞেস করলেন: ‘তুমি এখন কী করছ? কোন রাজনৈতিক দলে আছ?’ নুরুল ইসলাম চৌধুরী বললেন, ‘কলেজে শিক্ষকতা করি এবং সদ্য প্রতিষ্ঠিত যুবলীগ চট্টগ্রাম জেলার সভাপতি হিসেবে আছি। তিনি তখন তাকে আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগদানের জন্য আহ্বান জানান এবং চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ আজিজকে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন। আওয়ামী লীগে যোগদানের পর নুরুল ইসলাম চৌধুরীকে সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়।
পারিবারিক সূত্র এবং জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত সংসদ সদস্যদের জীবনী থেকে জানা যায়, ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৮ মেয়াদে চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক, ১৯৫৫ থেকে ১৯৫৮ মেয়াদে চট্টগ্রাম সদর মহকুমা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
নুরুল ইসলাম চৌধুরী লিখেছেন, ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং বঙ্গবন্ধু দুবার তাঁকে প্রাদেশিক সদস্য পদের জন্য মনোনয়ন দেন। কিন্তু শেরে বাংলার অপছন্দের কারণে দুবারই তাঁর মনোনয়ন বাতিল করা হয় বলে ১৯৯৪ সালের ১৭ অগাস্ট দৈনিক ‘ভোরের কাগজ’ পত্রিকায় নুরুল ইসলাম চৌধুরীর ‘১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড: ঘটনার আগে, ঘটনার পরে’ লেখা থেকে জানা যায়।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে তিনি চট্টগ্রাম-৬ আসন থেকে জাতীয় পরিষদ সদস্য (নং ১৫৮) নির্বাচিত হন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়নে যে ৩৪ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়, তিনি ছিলেন এই কমিটির অন্যতম সদস্য।
নুরুল ইসলাম চৌধুরী ভাষা আন্দোলন থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণসহ তৎকালীন সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। রাজনৈতিক কারণে তিনি কারাবরণও করেন। ভাষা আন্দোলনের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ধর্মঘট সমর্থন করলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয় এবং কারাবরণে বাধ্য হন। আইয়ুব খানের আমলেও কারাবরণ করতে হয়েছিল তাঁকে। জিয়াউর রহমানের আমলেও তাঁকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু পরে গ্রেপ্তার না করে তাকে পর্যবেক্ষণে রাখার নির্দেশ দেয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাকিস্তান সরকার চট্টগ্রামে সামরিক ট্রাইব্যুনালে তাঁকে ১৪ বছরের সাজা দেয় এবং তাঁর জাতীয় পরিষদ সদস্যপদ বাতিল করে সেখানে উপনির্বাচনের উদ্যোগ নেয়।
তিনি আমৃত্যু আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে ছিলেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের জাতীয় কমিটির সদস্য এবং চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন। আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে জোহরা তাজউদ্দিনের সঙ্গে আওয়ামী লীগ পুনর্গঠনেও ভূমিকা রাখেন।
চট্টগ্রামের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ ও সাবেক সিটি মেয়র মহিউদ্দিন আহমেদ ছিলেন নুরুল ইসলাম চৌধুরীর ছাত্র। আরেক রাজনীতিবিদ আক্তারুজ্জামান বাবুও রাজনীতিতে এসেছিলেন নুরুল ইসলাম চৌধুরীর হাত ধরে।
মুক্তিযুদ্ধে অবদান
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনী বাঙালিদের ওপর গণহত্যা শুরুর প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করলে ২৬ মার্চ পটিয়ায় গঠিত স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদের উপদেষ্টা হন নুরুল ইসলাম চৌধুরী এবং স্থানীয় তরুণ-যুবকদের সংগঠিত করে প্রশিক্ষণের জন্য ভারতে পাঠানোর উদ্যোগ নেন। পরে মুক্তিযুদ্ধকালীন পূর্বাঞ্চলীয় এক নম্বর জোনাল কাউন্সিলের চেয়ারম্যান এবং পূর্বাঞ্চল যুব শিবিরের এক নম্বর সেক্টরের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
নিজের স্মৃতিকথায় লিখেছেন: ‘১৩ এপ্রিল ১৯৭১ আমি এবং আমার ছোট বোনের স্বামী, গণপরিষদ সদস্য, মুক্তিযোদ্ধা মরহুম এম.এ মন্নানসহ আমার শ্বশুরবাড়ি পটিয়া থানার হাশিমপুর থেকে রাউজান, ফটিকছড়ি হয়ে রামগড় রওনা হয়ে যাই। এর আগে মুক্তিযুদ্ধে গুরুতরভাবে আহত সামরিক অফিসার, তৎকালীন ক্যাপ্টেন হারুণের চিকিৎসা ব্যবস্থা বিশিষ্ট চক্ষু চিকিৎসক প্রয়াত তড়িৎ কান্তি চৌধুরীর সহায়তায় পটিয়া হাসপাতালে করে দেওয়া হয়। আমি দক্ষিণ চট্টগ্রাম বিপ্লবী কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ছিলাম। এ ছাড়া স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র জনাব বেলাল মোহাম্মদের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম থেকে সরিয়ে পটিয়ার মধ্য দিয়ে ভারতে নিয়ে যাওয়ার সময় পটিয়াতে আমার সহযোগিতার কথা পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী জানত। এসব কারণে আমার জীবন বিপন্ন হবে আশঙ্কায় মীর শওকাত আলী আমাকে চলে যেতে বলেছিলেন।
১৯৭১ সালের সে মাসের প্রথম দিকে রামগড়ের পতনের পর ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সাবরুমে আমি, জনাব এম, এ, ওহাব (উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি) এবং অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ একসাথে কয়েকদিন ছিলাম। আমাদের হাতে টাকা ছিল না। মরহুম এম. আর সিদ্দিকী এ কথা জেনে আগরতলা থেকে আমাদের তিনজনের প্রত্যেকের জন্য দু’শ টাকা করে মোট ছ’শ টাকা পাঠিয়ে উপোস করা থেকে বাঁচিয়ে ছিলেন। এরপর প্রফেসর অনুপম সেনের স্ত্রী (আমার ছাত্রী) আমাকে কিছু টাকা দিয়েছিলেন।’
প্রসঙ্গত, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি এবং মুক্তিযোদ্ধা হওয়ায় চট্টগ্রামের পটিয়ায় নুরুল ইসলাম চৌধুরীর পৈতৃক বাড়িটি জ্বালিয়ে দেয় পাকিস্তানি আর্মিরা।
গণপরিষদে নুরুল ইসলাম চৌধুরী
গণপরিষদের বৈঠকে নুরুল ইসলাম চৌধুরী শুধু খসড়া সংবিধানের বিভিন্ন বিষয়ে নিজের মতামত ও অবস্থান স্পষ্ট করাই নয়, বরং পরিষদের কাজের শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য অনেক সময় স্পিকারের দৃষ্টি আকর্ষণও করেছেন। যেমন পরিষদে লাঠি নিয়ে ঢোকা, বৈঠক চলাকালীন মনোযোগী থাকা ইত্যাদি। যদিও বিভিন্ন বিষয়ে পয়েন্ট অব অর্ডারে তাঁর এরকম বক্তব্যের কারণে একবার স্পিকার তাঁকে বলেছিলেন যে, বারবার এরকম বিষয় উত্থাপন করলে তাতে পরিষদের সময় নষ্ট হয়। কিন্তু নুরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, পরিষদের কাজ যাতে সুষ্ঠুভাবে চলতে পারে, সেজন্য তিনি স্পিকারকে সাহায্য করছেন।
১৯৭২ সালের ৩-৪ অক্টোবরের বৈঠকে সুরঞ্জিৎ সেনগুপ্ত ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনাররা অবশ্যই হাইকোর্টের বিচারপতি হবেন’ বলে সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদে সংশোধনী প্রস্তাব আনলে নুরুল ইসলাম চৌধুরী পয়েন্ট অব অর্ডারে বলেন, মি. সেনগুপ্তর এই প্রস্তাব বিধিসম্মত নয়। এটা সম্পূর্ণ অর্থহীন। এই বিতর্কে সুরঞ্জিৎ সেনগুপ্ত বলেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ, যাঁর ওপর নির্বাচনের সব দায়িত্ব বর্তায় এবং নির্বাচন কমিশনকে সামনে রেখে এ দেশের রাজনৈতিক দলগুলো গণতান্ত্রিক পথে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। এ সময় ড. কামাল হোসেন ফ্লোর নিয়ে বলেন, এখানে নির্বাচন কমিশন যেটা করা হয়েছে, সেটা স্বাধীন থাকবে এবং স্বাধীনভাবে কাজ করার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। এবং আমার মনে হয়, এই অনুচ্ছেদ করে আমরা শুধু জজ সাহেবদের মধ্যেই এই পদটা সীমাবদ্ধ করে দিইনি।
৩-৪ অক্টোবরের বৈঠকে বারবার পয়েন্ট অব অর্ডারে বক্তব্য রাখায় নুরুল ইসলাম চৌধুরীকে উদ্দেশ করে স্পিকার বলেন, এতে পরিষদের মূল্যবান সময় নষ্ট হচ্ছে। মেহেরবানি করে বসুন। কিন্তু নুরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন: আমি পরিষদের সময় নষ্ট করছি না, পরিষদের কার্য যাতে সুষ্ঠুভাবে চলতে পারে, সেজন্য আপনাকে সাহায্য করছি। আমি বৈধতার প্রশ্ন উত্থাপন করেছি। এটার উপর আপনার রুলিং প্রয়োজন। পরিষদের কার্য-পরিচালনার জন্য আমাদের পরিষদের বিধি-পদ্ধতি অনুযায়ী চলা উচিত।
২৩ অক্টোবরের বৈঠকে রাফিয়া আখতার ডলী (জাতীয় পরিষদ ১৬৪, নারী আসন ২) বক্তব্য রাখার পরে পরিষদে কেউ হয়তো লাঠি নিয়ে প্রবেশ করেছিলেন। এ সময় নুরুল ইসলাম চৌধুরী স্পিকারকে উদ্দেশ করে বলেন, জনাব স্পিকার সাহেব, কোনো মাননীয় সদস্য লাঠি নিয়ে পরিষদে প্রবেশ করতে পারেন কি না? জবাবে স্পিকার বলেন, লাঠি নিয়ে পরিষদে প্রবেশ করার কোনো রীতি নেই। এ সময় সংবিধান প্রণয়ন কমিটির আরেক সদস্য মুহাম্মদ আবদুর রশীদ পাল্টা প্রশ্ন করেন, অসুস্থতাবশত কেউ যদি পরিষদে লাঠি নিয়ে আসেন? তখন স্পিকার জানান, দৈহিক বা স্বাস্থ্যগত কারণে লঠি ব্যবহার করা যাবে। কিন্তু সুস্থ শরীরে ব্যবহার করা যাবে না।
পরদিন ২৪ অক্টোবরের বৈঠকে নুরুল ইসলাম চৌধুরী পয়েন্ট অব অর্ডারে বলেন, জনাব স্পিকার সাহেব, যখন কোনো মাননীয় সদস্য বক্তৃতা করতে যান, তখন তাঁকে দেখতে হবে তাঁর বক্তৃতা প্রাসঙ্গিক হচ্ছে কি না। আমার মনে হয়, মাননীয় সদস্য যখন বক্তৃতা করেন তখন আমাদের বিধি-পদ্ধতির ৫৭ ও ৫৯ বিধি তাঁর মেনে চলা উচিত। তিনি ৫৯ বিধি উল্লেখ করে বলেন, উত্তরদানের অধিকার প্রয়োগ এবং স্পিকারের অনুমতিক্রমে নতুন কোনো বিতর্কমূলক বিষয়ের অবতারণা না করে ব্যক্তিগত কৈফিয়ত দান ছাড়া কোনো সদস্য কোনো প্রস্তাবের ওপর একাধিকবার বক্তৃতা করবেন না।
২৫ অক্টোবরের বৈঠকেও নুরুল ইসলাম চৌধুরী আরেকটি বিষয়ে স্পিকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। পরিষদের বৈঠক চলাকালীন বই বা সংবাদপত্র পাঠের প্রসঙ্গে তিনি গণপরিষদের বিধি-পদ্ধতির (পরবর্তীতে যেটি সংসদের কার্যপ্রণালি বিধি) ৫২ (ক) বিধির উল্লে করে বলেন, পরিষদের কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়, এমন কোনো পুস্তক, সংবাদপত্র বা পত্র পাঠ করতে পারবেন না। কিন্তু যদি পরিষদের কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়, তাহলে সেই সংবাদপত্র পাঠ করতে পারবেন।
এদিনের বৈঠকে নুরুল ইসলাম চৌধুরী সংসদীয় ভাষা সম্পর্কিত একটি বিতর্কে বলেন, এখানে সদস্যরা বারবার প্রশ্ন করছেন, কোন্ শব্দ ‘পার্লামেন্টারি’ এবং কোনটা ‘আনপার্লামেন্টারি’। আমার মতে, আমরা বাংলাতে ব্যবহার করে বলতে পারি, কোনটা ‘সাংবিধানিক’ এবং কোন্টা ‘অসাংবিধানিক’। আমার বন্ধু খাজা আহমদ ‘গ্যাঞ্জাম’ শব্দ বলেছিলেন এবং সেটা তিনি প্রত্যাহার করেছেন।
৩১ অক্টোবরের বৈঠকে সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদের (৩) দফার শেষে অবস্থিত ‘সেমিকোলন’ চিহ্নটির পরিবর্তে ‘দাড়ি’ চিহ্ন সন্নিবেশ করা এবং ওই দফার পরে অবস্থিত শর্ত দফাটি বাদ দিয়ে (৫) দফার পরে নতুন (৬) দফা যোগ করার প্রস্তাব করেন নুরুল ইসলাম চৌধুরী। তার প্রস্তাবিত সংশোধনী অনুযায়ী ৩৫ অনুচ্ছেদের (৬) দফাটি ছিল এরকম: ‘প্রচলিত আইনে নির্দিষ্ট কোনো দণ্ড বা বিচারপদ্ধতি সম্পর্কিত কোনো বিধানের প্রয়োগকে এই অনুচ্ছেদের (৩) বা (৫) দফার কোনো কিছুই প্রভাবিত করিবে না।’ এদিনের বৈঠকে জনাব চৌধুরী বলেন, আলোচনার পরে কোনো প্রস্তাব বিধিবহির্ভূত হতে পারে না। বিধিবহির্ভূত যদি করতে হয়, তাহলে সেটা প্রথমেই আপনাকে বলতে হবে। এখন এটা বিধিবহির্ভূত হতে পারে না।
নুরুল ইসলাম চৌধুরী সংবিধানে স্বাক্ষর করেন ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭২। স্বাক্ষরে তিনি নিজের নামের বানানে ‘ইছলাম’ লিখেছেন। অর্থাৎ ‘ছ’ দিয়ে।
নুরুল ইসলাম চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় প্রথমে শিল্প প্রতিমন্ত্রী এবং পরে প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের একমাত্র রাজনীতিবিদ, যিনি প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। কেননা বরাবরই প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী এবং নুরুল ইসলাম চৌধুরীর পরে আর কেউ এই মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বও পাননি।
নিজের স্মৃতিকথা তিনি লিখেছেন: ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট নৃশংস হত্যাকাণ্ডের আড়াই মাস আগে ২৫ মে বঙ্গবন্ধু তাঁর বাসায় ডেকে নিয়ে নুরুল ইসলাম চৌধুরীকে প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব নেয়ার কথা বলেন। তিনি আরও বলেন যে, এ ব্যাপারে তিনি আর কারও সঙ্গে কথা বলেননি বা পরামর্শও করেননি। ‘বঙ্গবন্ধু আমাকে বলেছিলেন, সময়ের অভাবে তিনি প্রতিরক্ষার অনেক সমস্যা ও অভিযোগের প্রতি যথার্থ মনোযোগ দিতে পারেননি। তাই আমাকে সশস্ত্র বাহিনীর সমস্যা ও তাদের সাংগঠনিক কাঠামো তিন বাহিনীর প্রধানদের সাথে কথা বলে ঠিক করতে হবে এবং ছয় মাস পরে আমাকে প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দিয়ে তিনি রাষ্ট্রপতি হিসাবে সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক থাকবেন। আমার এই নিযুক্তিতে তখন সশস্ত্র বাহিনীর সবাই আনন্দিত হয়েছিলেন এই ভেবে যে, তাদের অভাব অভিযোগ ও অন্যান্য বিষয়ে আমার সাথে আলাপ আলোচনা করতে পারবেন এবং আমি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সব সমস্যা সাধ্য অনুযায়ী সমাধান করতে পারব।’
অগাস্ট ট্র্যাজেডি ও নুরুল ইসলাম চৌধুরী
নুরুল ইসলাম চৌধুরী প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী থাকাকালীন সপরিবারে নিহত হন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এই ঘটনাকে তিনি তার ‘দুর্ভাগ্য’ হিসেবে মনে করতেন। লিখেছেন: ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাকে বিশ্বাস করে যে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রী করেছিলেন, জীবন দিয়ে সে দায়িত্ব আমার ভীরুতার জন্য পালন করতে না পেরে আজ বিবেকের দংশনে আমি জর্জরিত হচ্ছি।’ বঙ্গবন্ধুকে বাঁচাতে না পারার এই আক্ষেপ ছিল তাঁর আমৃত্যু। কিন্তু তিনি কি চেষ্টা করেছিলেন?
নুরুল ইসলাম চৌধুরী নিজেই এর জবাব দিয়ে গেছেন। মৃত্যুর আগের বছর ১৯৯৪ সালে দৈনিক ‘ভোরের কাগজ’ এবং চট্টগ্রামের পত্রিকা দৈনিক ‘আজাদী’তে দুটি লেখায় তিনি এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়ে গেছেন। তিনি লিখেছেন: ‘১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট ভোরে আমার স্ত্রী হঠাৎ গোলাগুলির শব্দ শুনে আমাকে জাগিয়ে দিয়েছিলেন কী ঘটনা জানার জন্য। এ সময় উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের টেলিফোন পাই। তিনি আমাকে ‘চৌধুরী সাহেব’ বলে সম্বোধন করতেন। ফোনে তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন ‘চৌধুরী সাহেব আপনি কি জানেন বঙ্গবন্ধুর বাসায় কী ঘটনা হয়েছে?’ উত্তর আমি বললাম ‘না’। তিনি বললেন, বঙ্গবন্ধুকে নাকি হত্যা করা হয়েছে। আপনি আপনার বাহিনী প্রধানদের সাথে যোগাযোগ করে সঠিক সংবাদ জানান। এ কথা বলেই তিনি টেলিফোন রেখে দেন।
আমি লাল টেলিফোনযোগে বঙ্গবন্ধুর বাসায় ফোন করি। শুধু রিংয়ের শব্দ পাই। কেউ ধরেনি। প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী হিসেবে সামরিক বাহিনীর প্রধানদের সাথে যোগাযোগ করার জন্য বিশেষ টেলিফোনে সেনা প্রধান জনাব সফিউল্লাহর সাথে কথা বললে তিনি জানালেন, স্যার সর্বনাশ হয়ে গেছে। সামরিক বাহিনীর কিছু বিদ্রোহী সদস্য বঙ্গবন্ধুর বাসায় ট্যাঙ্ক নিয়ে আক্রমণ করে তাঁকে হত্যা করেছে। বঙ্গবন্ধু নাকি তাঁর সাথে কথাও বলেছিলেন। কিন্তু তিনি (সফিউল্লাহ) কিছু করার আগে সব শেষ হয়ে গেছে। আমি বললাম আপনি অন্যান্য বাহিনীর প্রধানদের নিয়ে কী করছেন? আপনি কি বিদ্রোহ নির্মূল করবেন না? বিদ্রোহ নির্মূল করুন। তিনি তখন বললেন, আধা ঘণ্টার মধ্যে তিনি বিদ্রোহ নির্মূল করে দেবেন। অন্য দুই বাহিনীর (নৌ ও বিমান) প্রধানও নাকি তার সাথে এই বিষয়ে আলোচনা করতে বসেছেন।
এরপরে আমি যোগাযোগ করি মন্ত্রী আবুল মোমেন সাহেবের সাথে। আমার আশ্বাস বাণী শুনে তিনি বললেন, আপনি কোথায় আছেন, আপনার বাহিনীর প্রধানগণ খুনীদের দ্বারা মনোনীত প্রেসিডেন্ট মোশতাকের পক্ষে আনুগত্য প্রকাশ করেছে।’
নুরুল ইসলাম চৌধুরী জানাচ্ছেন, ‘সেনাপ্রধান সফিউল্লাহ সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে কিছু ষড়যন্ত্র ও বেআইনী প্রচেষ্টা দেখে তাঁকে বলেছিলেন যেন আমি বিষয়টি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সাথে আলোচনা করি। তিনিও (বঙ্গবন্ধু) বোধ হয় তৎকালীন ডিজিএফআই প্রধানের কাছ থেকে কিছুটা আভাস পেয়েছিলেন।বঙ্গবন্ধু জনাব সফিউল্লাহকে বলেছিলেন তিনি যেন ডিজিএফআই প্রধান এবং আমার সাথে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেন। কিন্তু এর দুই তিন দিন পরেই বাংলার ইতিহাসের কলঙ্কময় নারকীয় হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়।’
নুরুল ইসলাম চৌধুরীর মেয়ে নাসরিন ইসলাম বলছেন, ‘যারা এতদিন আব্বার নিরাপত্তা প্রহরী ছিলেন, ১৫ অগাস্ট সকাল থেকে তারা আমাদেরকে হাউস অ্যারেস্ট করে রাখেন। ফলে আমরা কোথাও যেতে পারছিলাম না। আব্বা কৌশলে আত্মগোপনে চলে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার আগেই তাঁকেসহ আমাদের পুরো পরিবারকে আটকে দেয়া হয়। নিরাপত্তা প্রহরীরা সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে, কোনোভাবে যেন আমরা পালানোর চেষ্টা না করি। তাহলে আমাদের অবস্থাও বঙ্গবন্ধুর মতো হবে। পরিবারের সবাইকে নির্বিচারে হত্যা করা হবে। আমরা অত্যন্ত ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ি।’
মোশতাকের মন্ত্রিসভায়
১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্টের হত্যাকাণ্ডের পরে এই নৃশংস ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রপতি মোশতাক আহমদের মন্ত্রিসভায় যোগ দেন নুরুল ইসলাম চৌধুরী—যা নিয়ে তিনি আমৃত্যু অনুশোচনায় ভোগেন। তার ভাষায়: ‘আমরা বেসামরিক নাগরিক, মৃত্যুকে ভয় পাই না একথা বলা মিথ্যা হবে। কিন্তু যারা রাষ্ট্রের বা নিরাপত্তা বাহিনী প্রধান ও সদস্য, তাদের প্রয়োজনবোধে মৃত্যুকে ভয় না পেয়ে সিদ্ধান্তে দৃঢ় থেকে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার মানসিকতা থাকার কথা।’ তিনি লিখেছেন: ‘মোশতাক আহমদের মন্ত্রিসভায় শপথ গ্রহণের পরে ব্যক্তিগতভাবে আমি অত্যন্ত অসহায় ও মানসিকভাবে বিপর্যন্ত অবস্থায় ছিলাম এবং সেদিন সন্ধ্যায় বন্দুকের নলের মুখে আমাকেও অন্যান্যদের সাথে মোশতাক আহমদের মন্ত্রিসভায় শপথ গ্রহণ করতে বাধ্য করা হয়েছিল। আমি নিজেকে আজও অপরাধী মনে করি। কারণ, সেদিন আমি মৃত্যু ভয়ে ভীত ছিলাম এবং মৃত্যুকে মাথা পেতে নিতে পারিনি। আমি ভয় পেয়েছিলাম কারণ যারা নারী, শিশু, এমনকি অন্তঃস্বত্ত্বা মহিলাকে নিষ্ঠুর পরিকল্পিতভাবে হত্যা করতে পারে, তারা হালাকু ও চেঙ্গিস খানের মতো কাউকে রেহাই দেবে না এবং তাদেরকে রক্ষা করার জন্য রাষ্ট্রের কোনো বাহিনীও এগিয়ে আসবে না। এ কথা জেনেই সেদিন অনেকেই হয়তো চুপ করেছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাকে বিশ্বাস করে যে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রী করেছিলেন, জীবন দিয়ে সে দায়িত্ব আমার ভীরুতার জন্য পালন করতে না পেরে আজ বিবেকের দংশনে আমি জর্জরিত হচ্ছি।’
জিয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান
ক্ষমতার পালাবদলে সেনাপ্রধান থেকে রাষ্ট্রপতি হন জিয়াউর রহমান। তিনিও নুরুল ইসলাম চৌধুরীকে তাঁর মন্ত্রিসভায় যোগ দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর মেয়ে নাসরিন ইসলাম বলছেন, ‘শত আর্থিক কষ্টের পরেও আব্বা জিয়ার মন্ত্রিসভায় যোগদানের প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন।’
জিয়ার কাছ থেকে মন্ত্রিসভায় যোগদানের প্রস্তাব বিষয়ে নুরুল ইসলাম চৌধুরী লিখেছেন: ‘নভেম্বর মাসের তৃতীয় সপ্তাহের প্রথম দিকে আমার পরিবারের চাপে ঢাকায় ফিরে আসি। আমি আসার পর আমার স্ত্রীর নিকট জানলাম জেনারেল জিয়া আমার খোঁজ নিয়ে বলেছিলেন, ভারতে বেশিদিন থাকলে ভুল বোঝাবুঝি হবে। আমি যেন তাড়াতাড়ি চলে আসি। আমার আসার কয়েকদিন পর হঠাৎ এক রাত্রে কারফিউ চলাকালীন অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল অলি সাহেব, তাকে আমি চট্টগ্রামের স্বাধীনতা সংগ্রামে শুরু থেকেই জানতাম ও চিনতাম, আমার সরকারি ভবন থেকে সদ্য স্থানান্তরিত মগবাজার বাসায় এসে তিনি জানালেন জেনারেল জিয়া আমার সাথে কথা বলার জন্য ক্যান্টনম্যান্টের বাসায় যেতে বলেছেন। প্রথমে একটু ভয় পেলেও অলি সাহেবকে দেখে ভরসা পেলাম। জনাব অলি সাহেব জেনারেল জিয়ার বাসায় আমাকে পৌঁছে দিয়ে চলে গেলেন এবং কিছুক্ষণ পর এসে আমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়েছিলেন। জিয়া সাহেব আমাকে আলিঙ্গন করে বলেছিলেন তিনি ভাগ্যের ও আল্লাহর রহমতে বেঁচে গেছেন। আমি তাকে চার জাতীয় নেতার কথা জিজ্ঞেস করাতে তিনি বলেছিলেন, তার অবরুদ্ধ থাকাকালেই মোশতাকের পরামর্শে তাদেরকে খুন করা হয়েছে। তার কিছুই করার ছিল না। জিয়া তার ড্রয়িংরুমে বঙ্গবন্ধুর ছবি দেখিয়ে আমাকে বলেছিলেন, তিনি তাকে শ্রদ্ধা করেন। কিন্তু তিনি কমিউনিস্ট ও তথাকথিত প্রগতিবাদীদের কথা শুনে বিপথে চালিত হয়েছিলেন।’
জিয়াকে ‘উচ্চাভিলাষী’ উল্লেখ করে নুরুল ইসলাম চৌধুরী লিখেছেন, ‘জানি না ইতিহাসে মরহুম জিয়ার কার্যকলাপ কী দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা হবে। তিনি উচ্চাভিলাষী ছিলেন এবং ব্যক্তিগতভাবে সৎ বলে তার গর্বও ছিল। কিন্তু আমার মনে হয় তিনি মনের দিক থেকে সম্পূর্ণ বিবেকবান ছিলেন না।’
আইনজীবী নুরুল ইসলাম চৌধুরী
নুরুল ইসলাম চৌধুরীর মেয়ে নাসরিন ইসলাম বলছেন, ‘আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে দলের অসংখ্য নেতাকর্মীর পক্ষে বিনা পারিশ্রমিকে তার বাবা আইনি সহায়তা দিয়েছেন। আইনি লড়াই করে তাদের জামিনের ব্যবস্থা করেছেন। মিথ্যা মামলা থেকে মুক্ত করেছেন।’
সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সভাপতি ড. কামাল হোসেনও তাঁর সহকর্মী ও সহযোদ্ধা নুরুল ইসলাম চৌধুরীর সম্পর্কে একই কথা লিখেছেন। ২০২৩ সালের ১২ জুন স্বাক্ষর করা একটি ট্রিবিউটে ড. কামাল লিখেছেন: ‘নুরুল ইসলাম চৌধুরী ছিলেন একজন ত্যাগী, সৎ ও নিষ্ঠাবান আওয়ামী লীগ নেতা। তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। জাতি তাঁর এই অবদান চিরদিন মনে রাখবে। তিনি আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে দলের কারাবন্দি নেতাকর্মীদের জামিন ও মুক্তির জন্য বিনা পারিশ্রমিকে আইনি লড়াই করেছেন—যারা ১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনের পরে বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন।’
ব্যক্তিজীবন
নুরুল ইসলাম চৌধুরীকে কাছে থেকে দেখা রাজনীতিক, শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ শায়েস্তা খানের ভাষায়: ‘তিনি ছিলেন অত্যন্ত ভদ্র, যুক্তিবাদী ও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে বিশ্বাসী এবং নিঃস্বার্থ আওয়ামী লীগার।’ মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক কাজী শামসুল ইসলাম বলছেন: ‘নুরুল ইসলাম চৌধুরীকে আমি কাছে থেকে দেখেছি সিটি কলেজের শিক্ষক হিসেবে, রাজনীতির মাঠে এবং মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে। শঠতা, মিথ্যা, অহংকার ইত্যাদি তাঁর চরিত্রে দেখিনি।’
নুরুল ইসলাম চৌধুরী ছাত্র জীবন থেকেই সমাজসেবা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। পরবর্তীকালেও বিভিন্ন পেশাজীবী ও সমাজসেবামূলক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু পরিষদ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী শাখার সহ-সভাপতি, ঢাকাস্থ পটিয়া সমিতির সভাপতি এবং চট্টগ্রাম সিটি কলেজ, পটিয়া কলেজ, আইন কলেজ ও আর্য সংগীত বিদ্যালয় পরিচালনায় সম্পৃক্ত ছিলেন। ‘পটিয়ার ইতিহাস ও ঐতিহ্য’ গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসব কমিটিরও চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি।
বৈবাহিক ও পারিবারিক জীবন
নুরুল ইসলাম চৌধুরীর শ্বশুর বাড়ি চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার হাশিমপুরে। পরে শহরের আন্দরকিল্লায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন তাঁরা। তাঁর শ্বশুর মোক্তার আহমদ চৌধুরী ডেপুটি কাস্টমস অফিসার ছিলেন।
নুরুল ইসলাম চৌধুরীর স্ত্রী মর্জিয়া ইসলাম ১৯৭১ পরবর্তী সময়ে চট্টগ্রাম মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ছিলেন। তিনি চট্টগ্রাম কলেজ থেকে বি.এ পাস করেন। ১৯৭৩ সালে তাঁর স্বামী বঙ্গবন্ধু সরকারের মন্ত্রী হওয়ার পরে সপরিবারে ঢাকায় চলে আসেন এবং মর্জিয়া ইসলাম আর রাজনীতিতে সক্রিয় থাকেননি। তিনি কবিতা আবৃত্তি করতে পছন্দ করতেন।
নুরুল ইসলাম চৌধুরীর মৃত্যুর চার বছর পরে ১৯৯৯ সালের ২ মে মৃত্যুবরণ করেন। চট্টগ্রামের জামালখানের বাসায় স্ট্রোক করেন মর্জিয়া ইসলাম। হাসপাতালে মৃত্যু হয়। চট্টগ্রামের মিসকিন সাহেব দরগায় তাকে দাফন করা হয়।
সন্তানদের পরিচয়
নুরুল ইসলাম চৌধুরীর তিন সন্তান। বড় মেয়ে ইয়াসমিন ইসলাম শারজায় বঙ্গবন্ধু পরিষদের সঙ্গে জড়িত। রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী। শারজায় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত। ছেলে ডা. মঈনুল ইসলাম চট্টগ্রামের স্থানীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত। বর্তমানে (অগাস্ট ২০২৩) জামালখান ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক। স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের আজীবন সদস্য। ছোট মেয়ে নাসরিন ইসলাম অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের অনুসারী ছিলেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংরক্ষিত নারী আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন।
অসুস্থতা ও মৃত্যু
১৯৯৫ সালে ৩ অক্টোবর সকাল সাড়ে সাতটায় চট্টগ্রাম নগরীর উপশম ক্লিনিকে মারা যান নুরুল ইসলাম চৌধুরী। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৮ বছর। তাকে চট্টগ্রামের পটিয়ায় হাদু চৌধুরী জামে মসজিদ সংলগ্ন কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।
নুরুল ইসলাম চৌধুরীর মৃত্যুর পরে ১৯৯৫ সালের ৩০ নভেম্বর শোকাহত পরিবারকে সমবেদনা জানাতে চট্টগ্রামের জামালখানে তাঁর বাসায় যান তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় তিনি শোক বইতে স্বাক্ষর করেন। সেখানে তিনি নুরুল ইসলাম চৌধুরীকে ‘জাতির পিতার ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধা’ উল্লেখ করে লেখেন: ‘তাঁর মতো ত্যাগী নেতার অক্লান্ত পরিশ্রমেই আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি।’
এর আগে ওই বছরের ২২ অক্টোবর নুরুল ইসলাম চৌধুরীর বাসায় যান আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা ও সাবেক সংসদ উপনেতা সাজেদা চৌধুরী। শোক বইতে তিনি লিখেন: ‘আওয়ামী লীগের জন্মলগ্ন থেকেই নুরুল ইসলাম চৌধুরী আওয়ামী লীগের প্রতি নিষ্ঠাবান ছিলেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে দেশ গড়ার কাজে তার অবদান চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ৭৫-এর ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে দল পুনর্গঠনেও তার ভূমিকা ছিল আপোসহীন।’
সন্তানের মূল্যায়ন
বাবার সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে নুরুল ইসলাম চৌধুরীর মেয়ে নাসরিন ইসলাম বলেন: ‘আব্বা ছিলেন সহজ সরল ও নিরহঙ্কারী একজন রাজনীতিবিদ। দারিদ্রমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক, শোষণমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখতেন। তখনকার সময়ে আওয়ামী লীগের মন্ত্রিসভায় যারা ছিলেন, বেশির ভাগই ছিলেন সৎ, একনিষ্ঠ ও দেশপ্রেমিক।’
বাবার সততার উদাহরণ দিতে গিয়ে নাসরিন ইসলাম বলেন, ‘আব্বা এতই সৎ ছিলেন যে, গ্রামে ওনার পৈতৃক বাড়িটা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। গ্রামের ওই দোতলা বাড়ির একতলা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী জ্বালিয়ে দেয়। কারণ আব্বা আওয়ামী লীগের সক্রিয় রাজনীতিবিদ ও মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তিনি এমপি ও মন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু তারপরও কোনো সম্পদ গড়ে তোলেননি। তাঁর বিরুদ্ধে কোনো দুর্নীতির অভিযোগ ছিল না। তিনি অত্যন্ত সাদাসিধে জীবনযাপন করতেন।’
অগাস্ট ট্র্যাজেডির পরে নুরুল ইসলাম চৌধুরী পুনরায় আইন পেশায় নিয়োজিত হন। তখন তাঁরা দারুণ আর্থিক কষ্টে দিন কাটান। ‘বঙ্গবন্ধু সরকারের মন্ত্রী ছিলেন বলে কেউ তখন আমাদের বাসা ভাড়াও দিতে চাইতো না। ভয় পেতো। কয়েক বছর ওকালতি করার পরে তিনি আর্থিকভাবে একটু গুছিয়ে উঠতে পারেন। আমাদের অবস্থা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু করে।’
রাষ্ট্রের কাছে আপনাদের প্রত্যাশা কী? নাসরিন ইসলাম বলেন, ‘খুব বেশি কিছু প্রত্যাশা নেই। আমার আব্বা একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির একজন সম্মানিত সদস্য ছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে তিনি দল পুনর্গঠনে কাজ করেছেন। দলের কারাবন্দি নেতাকর্মীদের মুক্ত করতে বিনা পারিশ্রমিকে আইনি লড়াই করেছেন। সারা জীবন সততা ও ন্যায়ের পথে থেকেছেন। ক্ষমতার কেন্দ্রে থেকেও কোনো ধরনের দুর্নীতির আশ্রয় নেননি। আমরা চাই রাষ্ট্র এরকম একজন মানুষকে সম্মানিত করুক। শুধু আমার আব্বা একা নন, যাঁরা সংবিধান প্রণয়ন কমিটিতে ছিলেন, সবাইকেই সম্মানিত করা উচিত। স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার পরেও সংবিধান প্রণেতাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। আমরা চাই ওনাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মানিত করা হোক। পাঠ্যপুস্তকে ওনাদের জীবনী অন্তর্ভুক্ত হোক। যাতে পরবর্তী প্রজন্ম বাংলাদেশের সংবিধান প্রণেতাদের সম্পর্কে জানতে পারে। আমাদের এর চেয়ে বেশি কোনো প্রত্যাশা নেই।’