‘বিদায় রানা’

আহসান কবিরআহসান কবির
Published : 21 Jan 2022, 08:25 AM
Updated : 21 Jan 2022, 08:25 AM

'একদিন ছাড়াছাড়ি হবে। তখন যেন আমার কথা ভুলে যেও না। একসময় থেমে যাবে সমস্ত কোলাহল, ঘুমিয়ে পড়বে ধরণী। আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারাটা মিটমিট করলে বুঝবে আমি তোমায় ডাকছি। সে রাতে তুমি জেগে থেকো বন্ধু, ঘুমিয়ে পড়ো না। আর হ্যাঁ ফুলের গন্ধ পেলে বুঝে নিও আমি আসছি। আর যদি কোকিল ডাকে, ভেবো আমি আর বেশি দূরে নেই। তারপর হঠাৎ ফুরফুরে বাতাস এসে তোমার গায়ে লুটিয়ে পড়লে বুঝবে আমি এসেছি। সে রাতে তুমি জেগে থেকো বন্ধু, ঘুমিয়ে পড়ো না!' –অগ্নিপুরুষ, কাজী আনোয়ার হোসেন

ঘুমিয়ে না পড়ার এমন বুকভাঙ্গা আকুতির পর তিনি নিজেই ঘুমুলেন। কাজী আনোয়ার হোসেনের মাসুদ রানা সিরিজের 'অগ্নিপুরুষ' লেখা হয়েছিল বিখ্যাত উপন্যাস 'ম্যান অন ফায়ার' এর ছায়া অবলম্বনে। উপন্যাসটি ১৯৮০ সনে লিখেছিলেন ইংরেজ লেখক ফিলিপ নিকোলসন যিনি 'এ জে কুইন্যাল' নামে লিখতেন। চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে এই গল্প নিয়ে। একই উপন্যাসের ছায়া অবলম্বনে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ লিখেছিলেন 'অমানুষ' (যেটি প্রথম ছাপা হয়েছিল কাজী আনোয়ার হোসেন সম্পাদিত রহস্য পত্রিকায়) যার উৎসর্গপত্রে লেখা ছিল– 'তাকে একটু শান্তিতে ঘুমুতে দাও'!

কাজীদা দয়া করে একটু শান্তিতে ঘুমান। যেখানে গিয়েছেন সেখানে কী হুমায়ূন আহমেদ বা শেখ আবদুল হাকিমের সঙ্গে দেখা হবে? দেখা হলে কী বলবেন, আমি এসেছি! তোমরা কি ঘুমিয়ে পড়েছিলে?

তার রুটিনে 'ঘুমের' সময়টাই তুলনামূলক কম ছিল! বেশি সময় ছিল পড়া আর প্রকাশনার জন্য। অথচ কাজী আনোয়ার হোসেন গায়ক ছিলেন, সেটা নিয়েই জীবন কাটাতে পারতেন। বেতার (১৯৫৮ থেকে ১৯৬৮) এবং পরবর্তীতে টেলিভিশনে গেয়েছেন নজরুল গীতি, পল্লীগীতি, আধুনিক এমনকি উর্দু গানও। সিনেমায় প্লেব্যাক করেছেন। তার তিন বোন সনজিদা খাতুন, ফাহমিদা খাতুন, মাহমুদা খাতুন সঙ্গীত শিল্পী ছিলেন। নীলুফার ইয়াসমীন ও সাবিনা ইয়াসমীনের বোন ফরিদা ইয়াসমীনকে বিয়ে করে তিনি জীবন পাড়ি দিয়েছেন। তবু সংগীত তাকে বেঁধে রাখতে পারেনি! তার পারিবারিক আবহে রবীন্দ্রসঙ্গীতের চর্চাই বেশি হতো। এমন পরিবারের সন্তান হয়ে আধুনিক বা পল্লীগীতি গাওয়াটা ছিল এক ধরনের প্রতিবাদ কিংবা সাহসী সিদ্ধান্তের ব্যাপার। সুভাষ দত্তের প্রথম চলচ্চিত্র 'সুতরাং'-এ গান গেয়েছিলেন কাজী আনোয়ার হোসেন। 'তালাশ' ছবিতে তার গাওয়া গান-রিক্সাওয়ালা মাতোয়ালা' খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। জনপ্রিয় হয়েছিল 'এই যে আকাশ এই যে মাটি' গানটিও। হয়তো মাটির টানেই ফিরলেন শেষমেষ। বন্দী হওয়ার পর রানার বন্ধু 'গগল' তার কাছে সাহায্য চেয়েছিল। মাসুদ রানা জীবনবাজি রেখে বাঁচিয়েছিল বন্ধু গগলকে। কাজীদা তার 'ক্যান্সার' হওয়ার খবর গগলকে জানাতে চাননি। গগল জানলে যে কোনও মূল্যে হয়তো তাকে জীবিত উদ্ধার করত!

জীবন কিংবা মৃত্যু নিয়ে তিনি সহসা কথা বলতেন না। জীবনের বেশিরভাগ সময় তিনি কম কথা বলেছেন। রহস্যে ঢাকা ছিল তার নিজের জীবনও! বাসায় একগাদা বইয়ের স্তুপের ভেতর যেখানে বসতেন সেই টেবিলে শোভা পেত তার লাইসেন্স করা পিস্তল। পত্রিকার সাথে সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, "আমি যা হতে চেয়ে পারিনি তা-ই মাসুদ রানা।" গান ছেড়ে দেওয়ার পর তিনি ঝুঁকলেন রহস্যোপন্যাসের দিকে। প্রথম যাত্রা শুরু করলেন 'কুয়াশা' সিরিজের রহস্যোপন্যাস দিয়ে। এরপর প্রেসনির্ভর বাণিজ্য। সেখানেও আধুনিকতা এনেছিলেন তিনি। বাংলাদেশে প্রথম 'পেপারব্যাকে'র যাত্রা তার হাত ধরেই। বাবার কাছ থেকে দশ হাজার টাকা নিয়ে প্রেস কিনে এই যাত্রা শুরু করেছিলেন, নাম ছিল সেগুনবাগান প্রেস। কুয়াশা ও মাসুদ রানা ধুন্দুমার জনপ্রিয় হওয়ার পর এটা হয়ে যায় 'সেবা প্রকাশনী'। এদেশে বই পড়তে জানা এমন কোনও মানুষ হয়তো পাওয়া যাবে না যিনি অন্তত একটা মাসুদ রানা পড়ে দেখেননি। একসময়ে গর্ব করে এদেশের কেউ কেউ বলত কলকাতায় সুনীল, শীর্ষেন্দু, বুদ্ধদেব, শক্তি বা সমরেশের মতো অনেকেই দোর্দণ্ডপ্রতাপে আছেন কিন্তু সেখানে কোন মাসুদ রানা নেই!

আজীবন মাসুদ রানা হয়েই ছিলেন কাজী আনোয়ার হোসেন। 'মাসুদ রানা'র প্রভাব এত বেশি যে এদেশে কয়েক লাখ ছেলের নাম আছে 'মাসুদ রানা'! মাসুদ রানার মতো গোয়েন্দা হতে চেয়ে কত কিশোর বা যুবক যে স্বপ্নে দেখেছে। নাটক বা সিনেমাতেও এর প্রভাব পড়েছিল যা এখনও আছে। আগে দেখানো হতো মুক্তিযোদ্ধা মানেই পঙ্গু! বিটিভির এক সময়ের জনপ্রিয় নাটক 'ফেরা'তে আসাদুজ্জামান নূরের ডায়ালগ, 'আপনারা আর কতদিন অবক্ষয় নিয়ে সাহিত্য রচনা করবেন? কেন মাসুদ রানার মতো একজন মুক্তিযোদ্ধা সৃষ্টি করা যায় না? যার উচ্চতা ৫ ফুট ১১ ইঞ্চি, বুকের ছাতি ৪৪, ব্যাকব্রাশ করা চুল, যার বাম বগলে পোলিশ সাবমেরিন, ডান বগলে ব্রিটিশ কারবাইন, দুই পকেটে ওয়ালথার পিপিকে আর একে ৪৭! যার একটাই কাজ মিশন টু কিল, দেশের বিরুদ্ধে যারা ষড়যন্ত্র করে তাদের হত্যা করা!' (রচনা ও নির্দেশনা: ফেরদৌস হাসান) এদেশে ছবি হয়েছে মাসুদ রানা নামে, একেবারে নতুন করে মুক্তির অপেক্ষায় আছে দুটি চলচ্চিত্র। কাজী আনোয়ার হোসেন চিত্রনাট্য লিখে বাচসাস পুরস্কার জিতেছিলেন প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে। রানার নামে জনপ্রিয় গানও আছে এমন– ও রানা/ও সোনা/জানি না তো/মানি না তো সীমানা/ও রানা…

গানের জীবন ছেড়ে সীমানা অতিক্রম করার কাজটাই নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন কাজী আনোয়ার হোসেন। কুয়াশা ও মাসুদ রানার পর তিন গোয়েন্দা, কিশোর ক্লাসিক, সেবা রোমান্টিক আর বেস্ট ওয়েস্টার্ন এর মতো বুনো পশ্চিমের কাউবয় কাহিনীগুলো বাংলায় রূপান্তরের দায়িত্ব তুলে নিয়েছিলেন নিভৃতে। বিশ্ব সাহিত্যের ক্লাসিক লেখাগুলো এত সহজ সুন্দর আর সাবলীল ভাবে আগে কেউ উপস্থাপন করেনি। কখনো কম দামে পেপারব্যাকে আগে মেলেনি এসব বই। বই যে ভাড়া নিয়ে পড়া যায় সেটাও শিখিয়েছিল সেবা প্রকাশনী। প্রতিটি বইয়ের শেষে প্রশ্নোত্তর পর্ব থাকত যেখানে কাজীদা নিজেই সেই সব প্রশ্নের উত্তর দিতেন! অন্তত চারটে প্রজন্মকে বই পড়াতে উদ্বুদ্ধ করেছে সেবা প্রকাশনী আর সবটার দেখভাল করেছেন কাজী আনোয়ার হোসেন।

দেখভাল করতেন সেবা প্রকাশনীর নিজস্ব লেখকদেরও। সেবার মাধ্যমেই আমরা প্রথম জানলাম 'ঘোস্ট লেখক' বলে বাংলাদেশেও একদল লেখকের অস্তিত্ব আছে। ঘোস্ট বা ভূত লেখকদের লেখা নিজের নামে ছাপা হয় না, ছাপা হয় অন্যের নামে। কিন্তু বই বিক্রির অনুপাতে তারা টাকা পান। নিজের নামেও বই আছে আবার ঘোস্ট লেখক হিসেবেও লিখেছেন সেবায় এমন অনেক লেখক বলতেন যে সেবা প্রকাশনী থেকে লেখালেখির টাকা 'রিলিজিয়াসলি' দেওয়া হয়। এ কারণে তারা বেশিরভাগ সময়ে সেবা প্রকাশনীর সঙ্গেই থাকেন। তারপর একদিন এলো সেই মামলার দিন। শেখ আবদুল হাকিম প্রথমে সেবা প্রকাশনীর লেখা ছাড়লেন পরে মামলা করলেন। সেই মামলা গড়াল হাইকোর্ট পর্যন্ত, কুয়াশাসহ পঞ্চাশ আর মাসুদ রানার ২৬০টি বইয়ের লেখকস্বত্ত্ব শেখ আবদুল হাকিমকে দেওয়ার রায় পাওয়া গেল! বিতর্ক কিংবা মানুষের রায়ও কি বিভাজিত হয়েছিল? বাংলাদেশে অনেক কিছুর প্রথম পরিচিতি বা প্রচলন যেমন করেছিল সেবা, লেখকস্বত্ত্ব নিয়ে মামলার শুরুটাও হলো এখানে।

কাজী আনোয়ার হোসেনকে ঘিরে অনেকের লেখালেখি ও জীবনের প্রথম পাঠ্যবইয়ের বাইরের পড়া যেমন শুরু হয়েছিল, শুরু হয়েছিল কারো কারো জীবনের দুরন্ত শৈশব। মাসুদ রানার সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল অনেক কিছু বা ঘটনা। কিশোর-তরুণ বয়সে প্রেমিকাকে নিয়ে মোটর সাইকেলে ঘোরা কিংবা ভাংচুর প্রেমের নাম হয়ে যায় 'মাসুদ রানা প্রেম'। প্রেমের চিঠি আদান-প্রদানের টিমের নাম হয়ে যায় 'গিলটি মিঞার টিম'। মাসুদ রানার গিলটি মিঞাও এক আজব চরিত্র। যেন বাংলা ছবির কোনও বুদ্ধিদীপ্ত হাসির মানুষ। মনে রাখার মতো আরেক চরিত্র সোহানা। রাস্তা-ঘাটে অপরিচিত কোনও মেয়েদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বলা হতো, 'হ্যালো সোহানা'! সোহানা এখনও প্রেমিকা হিসেবে দারুণ স্মার্ট। প্রেম পরিণতি চায় অর্থাৎ বিয়ে হতে পারে সেই পরিণতি কিন্তু রানা আজীবন থেকে গেল একা!

কাজীদার সব ছিল। ছিল গান আর সাহিত্যের গতিশীল যাত্রা। কিন্তু এই যাত্রায় কি তিনি একা ছিলেন? তার গায়ক জীবন নিয়ে কেউ তেমন আলোচনাই করেনি কিন্তু রহস্য সাহিত্যকে কেউ গোনায় ধরতে চায়নি। কেউ এটাকে লঘু কিংবা হালকা জ্ঞান করেছে। বাংলাদেশে 'পপ' গান জনপ্রিয় হওয়ার পরে বহু মানুষ এটাকে অপসংস্কৃতি বলেছে। কিন্তু বিশ্ব সাহিত্যের প্রায় সব শাখাকে তিনি সহজ আর সাধ্যের ভেতর এনে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। এত সহজে কেউ পড়ার অভ্যাস তৈরি করতে পারেনি এদেশে। সম্ভবতঃ শুরু থেকেই এই যাত্রায় তিনি ছিলেন একবারেই একা! মানুষকে শেষ যাত্রায়ও একা ফিরতে হয়। তাই লেখার শুরুতেই প্রশ্ন রেখেছিলাম যেখানে যাচ্ছে সেখানে কী শেখ আবদুল হাকিমের সঙ্গে দেখা হবে? উনি কী জানতে চাইবেন, রানা এখন কেমন আছে? নাকি হ্যামিলনের বংশীবাদকের মতো যে বাঁশি বাজিয়েছিলেন, যে বাঁশি শুনে আপনার পেছনে সমবেত হয়েছিল লাখো পাঠক, তারা আপনাকে মিস করবে দারুণভাবে?

বিশেষ দ্রষ্টব্য: সেন্ট গ্রেগরি স্কুলে পড়ার সময়ে শিক্ষক তার কাছে তার পিতা সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন। পিতা কাজী মোতাহার হোসেন সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন– বাবা আসলে 'নির্বোধ'। স্যার অবাক হয়ে জানতে চেয়েছিলেন নির্বোধ মানে বোকা? কাজী আনোয়ার হোসেনের উত্তর ছিল, হ্যাঁ! মা তো বাবাকে তেমনই বলে! মাসুদ রানার এই দীর্ঘযাত্রায় রানা শুধু দেশের জন্য করেই গেছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশের পক্ষেই কাজ করেছে। বিয়ে করার সময় হয়নি তার। রানা কি কাজী আনোয়ার হোসেনের সঙ্গেই চলে গেছে অন্য কোথাও, অন্য কোনও খানে?

রানা হারতে শেখেনি। রানার মতো দেশপ্রেম যার সে কখনো হারতে পারে না। রানা কাঁদতে শেখেনি। সোহানার বুকে মাথা রেখে কাঁদলেও রানার চোখে সহসা জল দেখা যায়নি।

প্রিয় কাজীদা আপনার শেষযাত্রায় কি রানা কাঁদবে? নাকি আর কখনো রানার সঙ্গে এদেশের পাঠকের দেখা হবে না?