Published : 15 May 2020, 09:59 PM
আমার অনুজতুল্য কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার রাজীব ফোনে অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামানের আকস্মিক মৃত্যুর খবরটি দিতেই অজান্তেই চোখের পাতা ভিজে এলো। মুহূর্তেই মনের পর্দায় ভেসে উঠলো আনিস চাচার ধারালো চেহারা আর অজস্র্র স্মৃতির ঘেরাটোপে অনেকক্ষণ ধরে বন্দি হয়ে রইল মন। খবরটি শোনা অবধি যেদিক পানে তাকাচ্ছি সেদিকেই যেন আনিস চাচার মায়াভরা মুখটি ভেসে উঠছে। এই নিষ্ঠুর সংবাদে ভারাক্রান্ত আমার মন বেদনার ভার থেকে অব্যাহতি লাভের আশায় কলম ও কাগজের কাছে আশ্রয় চাইছে। চাচার স্মৃতির ভারে আমি এমনি জর্জরিত যে এই মুহূর্তে কোনটি রেখে কোনটি বলি সেটিই বুঝে উঠা দায়!
এইতো মাত্র মাস দেড়েক আগে তিনি অসুস্থ শরীর নিয়েও প্রেসক্লাবে এলেন আমার পিতা দৈনিক ইত্তেফাকের সাবেক বার্তা ও কার্যনির্বাহী সম্পাদক ও মহান মুক্তিযুদ্ধে ঘৃণ্য আলবদরদের হাতে নির্মমভাবে নিহত সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের দুটি বই প্রকাশনা অনুষ্ঠানে পৌরহিত্য করতে। আমি কানাডায় চিকিৎসাধীন থাকায় সে অনুষ্ঠানে শারীরিকভাবে উপস্থিত থাকতে পারিনি বটে, তবে পুরো অনুষ্ঠানটিই আমার এক ছোট ভাই- প্রথম আলো পত্রিকার ডেপুটি ফিচার এডিটর জাহিদ রেজা নূর প্রেরিত ভিডিও ক্লিপে দেখেছি এই বিদেশ-বিভুঁইয়ে বসে। কাকা আব্বাকে ক্ষণজন্মা সাংবাদিক হিসেবে অভিহিত করে এক চমৎকার ও সত্যধর্মী বক্তৃতা করলেন ওই অনুষ্ঠানে।
সেই ১৯৪৪-৪৫ সালে আব্বা লেখাপড়ার উদ্দেশ্যে যশোর থেকে যখন কলকাতার মতো বিশাল নগরীতে উপস্থিত হন তখন সেখানে তার বলতে গেলে পরিচিত জন ছিল না কেউই। দুরুদুরু বুকে দরিদ্র ঘরের সন্তান সিরাজুদ্দীন হোসেন শুধু উচ্চ শিক্ষালাভ ও জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবার দুরন্ত বাসনা নিয়ে সেদিন অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমিয়েছিলেন এবং ঘটনা চক্রে আনিস চাচার পিতা ও বিশিষ্ট হোমিওপ্যাথ চিকিৎসক মোয়াজ্জেম হোসেনের সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছিল। মোয়াজ্জেম দাদা আব্বার মুখেই তার মত দরিদ্র তরুণের সংকল্প ও প্রত্যয়ের কথা জেনে এতটাই অভিভূত হন যে তাৎক্ষণিকভাবেই তাকে নিজ বাসায় নিয়ে যান। দুই বেলা খাবারের ব্যবস্থাসহ তদীয় পুত্র আনিস চাচার প্রাইভেট টিউটর হিসেবে নিযুক্তি দেন (আনিস চাচা তখন ক্লাস সেভেন বা এইটের ছাত্র)।
ইতোপূর্বে আনিস চাচার জন্য একজন মাস্টার রাখা হয়েছিল আর তাই এই নিয়োগের দরুণ সে বাসায় আব্বার পরিচিতি দাঁড়ায় 'ছোট মাস্টার' (এই কথাগুলি আনিস চাচা আব্বার উপর তার নিজের রচিত নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন)। এরপর ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি, বেকার হোস্টেলে থাকার সুযোগলাভ এবং একই সঙ্গে দৈনিক আজাদ পত্রিকায় খণ্ডকালীন চাকরি প্রাপ্তিতে আব্বার জন্য ছাত্র পড়ানোর দায় আর রইলোনা, কিন্ত আনিস চাচাদের সঙ্গে আব্বার তথা আমাদের পরিবারের আজীবন সংযোগ সৃষ্টি হল, যা উভয়ের ক্ষেত্রেই আমৃত্যু সমান তালে বলবৎ থেকেছে। এই হচ্ছে সূচনাপর্ব।
এরপর কত হাজারো স্মৃতি একের পর এক যুক্ত হতে থাকল আমাদের সকলের স্মৃতির ভাণ্ডারে যে তার কোন হিসেবে নেই। আনিস চাচারা সাতচল্লিশে পাকিস্তান কায়েম হবার পর খুলনায় এসে বসত গেড়েছিলেন এবং এরপর ঢাকায়। ঢাকার ফুলবাড়ীয়া রেল স্টেশনের ঠিক উল্টোদিকে একটি পাকা ছোট্ট দালান ঘরের একটি কক্ষে ছিল মোয়াজ্জেম দাদার ডিসপেনসারি বা ডাক্তার খানা। আমরা তখন আব্বা-আম্মার সঙ্গে দাদার চেম্বারে যেতাম অসুখ-বিসুখ হলেই। আর অ্যালোপ্যাথি ডাক্তার হিসেবে আমাদের জন্য ছিলেন নৃপেন বাবু, সকলের- 'নৃপেন দা' আর তিনি বসতেন মদন মোহন বসাক লেনে।
আমরা অনেক কাল মোয়াজ্জেম দাদাকেই আব্বার আপন চাচা হিসেবেই জেনে এসেছিলাম অর্থাৎ, সম্পর্কটি এতটাই গভীরে প্রোথিত ছিল যে এঁদের মধ্যে কোনও রক্তের বন্ধন নেই তা ভাবাই যেতনা। যায় হোক, দাদার চেম্বারে গেলে তিনি ওষুধের পুরিয়া আমাদের মুখে গুঁজে দিতেন আর ডান হাতের মধ্যমা ও অনামিকাকে একত্রে ভাঁজ করে সাঁড়াশির মতো আমাদের নাক চেপে ধরতেন আর বলতেন, 'এই বল, তুই আমাকে ক'টা বৌ দিবি ?'
আমরা ভাইরা সব ছিলাম পিঠে-পিঠি সুতরাং, তিনি এমনিভাবে ঠাট্টাচ্ছলে এক এক জনের নাক টিপে ধরে নাতিদের কাছ থেকে কে ক'টা বৌ দেবে সে বিষয়ে প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিতেন। ওই চেম্বারের খুব কাছেই ছিল দাদার বাসা। চিকিৎসা ও ওষুধ সেবনের পর তার বাসায় গিয়ে চলত এক প্রস্থ খাওয়া-দাওয়া ও গল্প-গুজব। কতদিন যে এমনটা হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।আবার দাদা-দাদি এবং চাচা, ফুফুরাও আসতেন আমাদের বাসায় বেড়াতে।
বেশ মনে আছে, আনিস চাচা যখন বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে লেখা-পড়া করতে মনস্থ করেন তখন আব্বার সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনা করেছিলেন এবং উচ্চ শিক্ষার্থে তার আমেরিকা যাবার দিন-ক্ষণ ঠিক হবার সংবাদটি শাহবাগ হোটেলে (কি একটা অনুষ্ঠানে আব্বার সঙ্গে আমরা গিয়েছিলাম সেখানে সেদিন তা আজ আর মনে নেই) আব্বাকে দেখে আনিস চাচা ছুটতে ছুটতে এসে দিয়েছিলেন এবং আব্বা ভীষণ খুশি হয়েছিলেন সে সংবাদ শুনে।
এরপর বেশ কয়েক বছর তিনি আমেরিকাতেই কাটানোর ফলে কাকার সঙ্গে দেখা না হলেও দাদা ও অন্যান্যের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎআমাদের জন্য ছিল বলতে গেলে এক প্রকার নিয়মিত বিষয়। ষাটের দশকের প্রথম দিকে আইয়ুব-মোনেম যখন রবীন্দ্রনাথকে বর্জনের নক্সা বাতলাচ্ছিলেন এবং সে মোতাবেক চেষ্টা নিয়েছিলেন সে সময় এর প্রতিবাদে আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তরুণ আনিস চাচা সাহসী ভূমিকা পালন করেছিলেন। ইত্তেফাক সম্পাদক মানিক চাচা ও আব্বা ইত্তেফাকের পাতায় প্রতিদিন জনমত গঠনকল্পে একের পর এক যুক্তির ইমারত খাড়া করে চলেছিলেন।
আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা-ভাষা ও সাহিত্যে বিষয়ে অনার্সে ভর্তি হয় ১৯৭৩ এ, কিন্ত আনিস চাচা তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, তাই তার কাছ থেকে সরাসরি পাঠ নেওয়া আমার হয়নি। তবে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তার উপস্থিতি, বক্তব্য ও বিভিন্ন প্রগতিবাদী জনমুখী বিষয়ে তার বলিষ্ঠ ভূমিকার ক্ষেত্রে তার সঙ্গে থেকেছি বরাবরই। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রশ্নে তিনি আমার সক্রিয়তায় একবার খানিক উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছিলেন, 'দ্যাখ সিরাজ ভাইকে যেভাবে ওই মানবরূপী হায়েনারা হত্যা করল তাতে তোর ব্যাপারে উদ্বিগ্ন থাকি। গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করে তারপর সিদ্ধান্ত নিবি, নচেৎ আমাদেরকে তো বটেই ভাবীকেও আবার সংকটে পড়তে না হয়!"
আমি দু' দিন বাদে চাচার সঙ্গে দেখা করে বললাম, 'আমি গভীরভাবে ভেবে দেখেছি যে, এই মুহূর্তে সময়ের দাবি পূরণ করাটাই আমার জন্য একমাত্র কর্তব্য হওয়া উচিত। তাই আমি এই কাজটির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকাকেই শ্রেয়তর জ্ঞান করছি।' চাচা আমার উত্তরে খুশি হয়েছিলেন এবং আশীর্বাদ করেছিলেন অন্তর থেকে।
বছর কয়েক আগে একরাতে আনিস চাচা তার গুলশানের বাসায় আমাদের গোটা পরিবারকে নিমন্ত্রণ করলেন। আম্মা তখন বেঁচে আছেন। আমরা সকলেই (আম্মাসহ) বৌ ও সন্তান-সন্ততিদের নিয়ে সে নিমন্ত্রণ রক্ষা করলাম। অনেক রাত পর্যন্ত কাকা, কাকী এবং তাদের পুত্র আনন্দ এবং তার স্ত্রীর সঙ্গে নানা বিষয়ে গল্প-গুজব চললো, যা ছিল পরম আনন্দময়। কাচ্চি বিরিয়ানিসহ নানা ধরনের খাবারের আয়োজন করেছিলেন চাচা- যা অত্যন্ত তৃপ্তি সহকারে আমরা খেয়েছি সে রাতে। 'সে সকল দিন সেও চলে যায়' বটে, কিন্ত স্মৃতিপটে আজও তা কত ভাস্বর হয়ে রয়েছে।
আমার বড় মামা ও শ্বশুর, বঙ্গবন্ধুর বন্ধু ও বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতা শামসুদ্দিন মোল্লার উপর একটি বই প্রকাশিত হলে আনিস চাচা বইটির উপর আয়োজিত এক আলোচনা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ফরিদপুর পর্যন্ত যেতেও দ্বিধা করেননি, বরং গিয়েছিলেন ভীষণ আগ্রহভরে আর এ থেকেই চাচার কর্তব্যবোধের বিষয়টি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে বৈকি !
আজ আনিস চাচা পরপারের বাসিন্দা অথচ এ সময়ে তার উপস্থিতি দেশ ও জাতির জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ছিল।
চাচার তিরোধানের খবর শোনার পর মনের মধ্যে তাৎক্ষণিকভাবে যে গুটিকয় বিক্ষিপ্ত ঘটনা অনুরণন তুললো সেগুলিকেই ভাষায় পুরে দিয়ে তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদনের চেষ্টা করলাম এই লেখায়।