হালকা প্রকৌশল শিল্প বিশ্ববাজারে ৭ ট্রিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করতে পারলেও আমরা কিন্তু ওই বাজারের এক শতাংশও দখল করতে পারিনি। বিশ্ববাজারের এক শতাংশ দখল করতে পারলে আমাদের রপ্তানি আয়কে ৭০ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ বৃদ্ধি করা সম্ভব হতো।
Published : 08 Nov 2023, 04:10 PM
বাংলাদেশে কুটির শিল্পের সঙ্গে বৃহৎ শিল্পের কোনো সম্পর্ক আজ পর্যন্ত তৈরি হয়নি। আর এই সম্পর্ক তৈরি করতে না পারার কারণেই দেশে শিল্পের কাঙ্ক্ষিত বিকাশ সম্ভব হয়নি আজও। বাস্তবতা এই যে দেশের বৃহৎ শিল্পগুলোকে একের পর এক লোকসানের অজুহাতে বন্ধ করতে হয়েছে, বিক্রি করে দিতে হয়েছে। বিপরীতে কুটির শিল্পের প্রতি অবহেলা শিল্পের অগ্রযাত্রার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সত্যি বলতে কি সম্মিলিত পরিকল্পনার অভাবে দেশের সামগ্রিক শিল্প ব্যবস্থাপনা আজ বেহাল দশার মধ্যে দিয়ে চলছে। বিশ্ববাজারে জায়গা করে নিতে মুক্তবাজার অর্থনীতির সঙ্গে পাল্লা দেবার পরিকল্পনা নিয়ে বৃহৎ শিল্পের জন্য ইপিজেড তৈরি করে বিনিয়োগের উদ্যোগ সৃষ্টির প্রচেষ্টা চলছে। অপরদিকে এসএমই প্রকল্প করে কুটির শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা করার চেষ্টাও চলমান। কিন্তু সবমিলিয়ে এসব উদ্যোগের যে সমন্বিত কোনো ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে, তেমনটা দৃশ্যমান না। ফলে দেশের বৃহৎ ও কুটির শিল্প পরস্পর রেললাইনের মতো এগিয়ে চলেছে তবে কোনটা থেকে কোনটার অবস্থা ভালো তার বিচার-বিশ্লেষণ করা খুব কঠিন।
হালকা প্রকৌশল শিল্প দেশের বিভিন্ন কুটির শিল্পের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই শিল্পের মাধ্যমে দেশের বস্ত্র, পাট, চিনি, কাগজ, সিমেন্ট, রেল, জাহাজ, প্লাস্টিক, সার, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ. কৃষিখাতের যন্ত্র ইত্যাদি সব সেক্টরের যন্ত্রাংশ সরবরাহ ও মেরামতসহ কিছু কিছু ক্ষেত্রে মূলধনী যন্ত্র তৈরি করা হয়ে থাকে। সে কারণে হালকা প্রকৌশল শিল্প সব শিল্পের সূতিকাগার হিসেবে স্বীকৃত। দেশের এই শিল্পগুলোতে আজও তুলনামূলক অল্প বিনিয়োগের সঙ্গে আধা স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র ম্যানুয়ালি ব্যবহার করে বিভিন্ন যন্ত্রাংশ তৈরি ও মেরামত করা হয়ে থাকে। হালকা প্রকৌশল শিল্পের ছোট ও মাঝারি উদ্যোগের সাধারণ উদ্যোক্তারা স্বশিক্ষিত, তাঁরা তাদের অভিজ্ঞতাকে মূলধন করে এগিয়ে চলেছেন। বিভিন্ন শিল্প পণ্য উৎপাদন ও সেবা দিয়ে জাতীয় অর্থনেতিক উন্নয়নে একান্ত নিজেদের মতো করে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। যদিও এ অবদান বিশ্ব অর্থনীতির খুবই নগণ্য এক অংশ মাত্র।
হালকা প্রকৌশল শিল্প বিশ্ববাজারে ৭ ট্রিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করতে পারলেও আমরা কিন্তু ওই বাজারের এক শতাংশও দখল করতে পারিনি। বিশ্ববাজারের এক শতাংশ দখল করতে পারলে আমাদের রপ্তানি আয়কে ৭০ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ বৃদ্ধি করা সম্ভব হতো। কিন্তু আমাদের এই শিল্পে বিনিয়োগ মাত্র ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আর সেখানে সরকারি বিনিয়োগ উল্লেখ করার মতোই নয়। বর্তমান সময়ে বিশ্বব্যাপী এ শিল্পের যে সুযোগ ও চাহিদা রয়েছে তা গ্রহণ করতে না পারলে সার্বিক পরিস্থিতির উন্নয়ন শুধু কাগজে কলমেই থেকে যাবে। বিশ্লেষণে দেখা যায়; এখন হালকা প্রকৌশল শিল্পের সামনে যেসব চ্যালেঞ্জ তার মধ্যে রয়েছে পুঁজি, প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ এবং সরকারি পরিকল্পনা ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাব। দেশের বিদ্যমান ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলো পুঁজির অভাবে আজও নিজেদের অভিজ্ঞতার সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে পারে না। বিশ্বব্যাপী নতুন নতুন যেসব প্রযুক্তির আগমন ঘটেছে তার ছিটেফোঁটা ব্যবহার করার সামর্থ্য ও পরিবেশ এখানে নেই। শিল্পগুলোর পরিবেশ ও পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখলে প্রশিক্ষণ এবং সরকারি পরিকল্পনা ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাব স্পষ্টতই ফুটে ওঠে। এই সমস্যার উত্তরণ ঘটাতে না পারলে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হবে না।
হালকা প্রকৌশল শিল্প শুধুমাত্র যন্ত্রাংশ তৈরি ও মেরামতের সেবা দিয়েই নিজেদের অভিজ্ঞতাকে সীমাবদ্ধ রাখেনি। নানারকম প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও দেশের প্রকৌশল পণ্যের আভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদা পূরণ করে চলেছে। এ শিল্পের উদ্যোক্তারা সাধারণ মানুষের জীবনকে সহজ করার জন্য গ্রাম-বাংলার পরিবহন নসিমন-করিমন-আলম সাধু তৈরি করে বিপ্লব সাধন করেছেন। রিকশা-ভ্যান-নৌকায় গতি এনেছে। মাছের পোনা পরিবহনকে নিরাপদ করার যন্ত্র তৈরি করেছে, কাঠ কাটার করাত কল, ইট ভাঙ্গার কল, মুড়ি ও চিড়া ভাজার কল, মশলা তৈরির কল, গ্রামে ধান ঝাড়া থেকে চাল তৈরির কল, তেল-মসলা ভাঙ্গানোর বহনযোগ্য কল, নানাবিধ আসবাবপত্রসহ আরও কত রকমের নিত্যপ্রয়োজনীয় ছোট-বড় যন্ত্র তৈরি করে চলেছে। এসব যন্ত্রের নিরাপত্তা নিয়ে অনেক শিক্ষিতজনের সন্দেহ থাকলেও গ্রামীণ জীবন শুধু নয় সাধারণ মানুষের জীবনকে আরও সহজ করেছে এহেন উদ্ভাবন।
মজার বিষয় এই যে, এসব যন্ত্রকে অনিরাপদ আখ্যায়িত করলেও তাকে নিরাপদ করার জন্য দেশের শিক্ষিত সমাজ এগিয়ে আসেনি। তাই এখানে দেশের প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভূমিকা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন থেকেই যায়। সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় সংশ্লিষ্ট মানুষেরা তাই বিশ্বাস করে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও সহযোগিতা বৃদ্ধি পেলে শুধু জনজীবনকে সহজ করা নয়, অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ করে বিদেশে রপ্তানি বৃদ্ধির ধারাকে আরও অনেক গতিশীল করতে সক্ষম হতো হালকা প্রকৌশল শিল্প।
যশোর একসময় দেশের পরিবহন সেক্টরের বাস-ট্রাক তৈরির প্রধান কেন্দ্র হিসেবে সারাদেশে সমাদৃত ছিল। নিজস্ব উদ্যোগে বিশাল এলাকাজুড়ে আজও এ কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। আধুনিকতার ছোঁয়া বঞ্চিত এসব কারখানাগুলোতে এখনও সনাতনী পদ্ধতির ব্যবহার চলমান। তবে নিজেদের কাজের সুবিধার জন্য এই শিল্পের সংশ্লিষ্টরা নিজেরাই কিছু কিছু ব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন। বাস-ট্রাক তৈরির এই সেক্টরকে কেন্দ্র করেই যশোরে হালকা প্রকৌশল শিল্পের সূচনা। অনেকেই দাবি করে থাকেন শহরের মাইকপট্টি এলাকার এক ছোট্ট কারখানায় বাস-ট্রাক তৈরির যন্ত্রাংশের পাশাপাশি মেরামতের কাজ করেই আজকের যশোরের হালকা প্রকৌশল শিল্পের যাত্রাকে পথ দেখানো হয়েছে। এখন প্রায় দুই শতাধিকের বেশি কারখানা চলমান। তবে তার বেশিরভাগই ধুঁকে ধুঁকে চলছে। গত শতকের আশির দশকের শেষভাগে সরকার সাব-কন্ট্রাকটিং বিধিমালা প্রণয়ন করে দেশের হালকা প্রকৌশল শিল্পের একটা সুন্দর বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু এই সুযোগ ক্ষুদ্র ও মাঝারি হালকা প্রকৌশল শিল্পের ভাগ্য পরিবর্তনে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। কারখানাবিহীন কিছু বিত্তশালী ঠিকাদাররা প্রকৌশল প্রতিষ্ঠানগুলোর সহযোগিতায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প মালিকদের সুবিধাবঞ্চিত করেছে এবং এখনও করছে।
শিল্পসংশ্লিষ্ট মানুষেরা এলাকাভিত্তিক সম্ভাবনাময় সেক্টর বিবেচনায় বিভিন্ন এলাকায় এক-একটা শিল্প-পার্ক প্রতিষ্ঠার দাবি দীর্ঘদিন ধরেই করে চলেছেন। সম্ভাবনাময় শিল্প-পার্ক তৈরি করার জন্য শিল্প মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নিয়েছিল অন্যান্য জেলার মধ্যে যশোরেও একটা পার্ক হবে। কবে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হবে তা কেউ বলতে না পারলে কি হবে সংশ্লিষ্টরা কিন্তু আশায় বুক বেঁধে আছেন যে, হালকা প্রকৌশল শিল্পের মান উন্নত হবে। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের ব্যবস্থা হবে, পরিবেশগত সমস্যার সমাধান হবে, সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সহযোগিতা বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি শিল্প-পার্কে দক্ষ জনশক্তি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হালকা প্রকৌশল প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার সরকারি আশ্বাসও রয়েছে। দেশের জনসংখ্যা এবং শিল্পের বর্তমান অবস্থা বিবেচনা করে দক্ষ জনশক্তির প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার কোনো পথ নেই। বরং জরুরিভিত্তিতে সরকারি উদ্যোগ দরকার।
৮ নভেম্বর গণপ্রকৌশল দিবস। ‘গণপ্রকৌশল দিবস ২০২৩’ উপলক্ষে দেশের কর্ণধার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতোমধ্যেই দেশের জনমানুষের জন্য কর্মরত মানুষগুলোকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেছেন, “টেকসই জাতীয় উন্নয়নের জন্য নাগরিকদের উদ্ভাবনী শক্তির বিকাশ ও প্রয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সর্বক্ষেত্রে গবেষণার মধ্য দিয়েই আমাদের মেধা মননের দক্ষতা বিশ্বকে জানান দিতে হবে।” এ বছরের গণপ্রকৌশল দিবসে দেশের সাধারণ মানুষ এবং শিল্প সংশ্লিষ্ট স্বপ্নবান মানুষেরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বার্তাকে হৃদয়ে ধারণ করে বলতে চায়, হালকা প্রকৌশল শিল্পকে গুরুত্ব দিয়ে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া হলে টেকসই উন্নয়ন শুধু নয় সরকারের রূপকল্প বাস্তবায়নও সহজ হয়ে যাবে। আকাশ ছোঁয়া বৈষম্য কমে আসবে, বেকারত্ব কমবে, সরকারের চাহিদা মতো জাতীয় উন্নয়নে অবদান রাখা সম্ভব হবে। দেশের অভ্যন্তরীণ পণ্যের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানির সুযোগ সৃষ্টি হবে। বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে, আধুনিক প্রযুক্তির ওপর বিপুল দক্ষ জনশক্তি গড়ে উঠবে, বিভিন্ন দেশে দক্ষ জনশক্তি পাঠিয়ে রেমিটেন্স বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে।
তাই শিল্পনীতি ২০১৬-তে হালকা প্রকৌশল শিল্পকে অগ্রাধিকার খাত হিসেবে ঘোষণা দিয়েই দায়িত্ব শেষ করলে হবে না। এই সেক্টরের সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে পরিকল্পিতভাবে। মৌলিক কাঁচামাল সহজলভ্য করতে হবে, লাগসই আধুনিক প্রযুক্তির নিশ্চয়তার উদ্যোগ নিতে হবে। সাব-কন্ট্রাকটিং বিধিমালার বাস্তবায়ন করে ঋণের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করতে হবে, শিল্প পার্ক ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট করে যুগোপযোগী প্রশিক্ষিত দক্ষ জনশক্তি সরবরাহের পাশাপাশি গবেষণার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। তবেই সফল হবে টেকসই উন্নয়নের রূপকল্প।