'শিরীষের ডালপালা' মূলত হাজার বছরের যে পথ চলা, তার রহস্যময় সৌন্দর্য আর রসায়নের ঐশ্বর্য।
Published : 11 Apr 2025, 06:56 PM
শিরীষের ডালপালা লেগে আছে বিকেলের মেঘে,
পিপুলের ভরা বুকে চিল নেমে এসেছে এখন;
বিকেলের শিশুসূর্যকে ঘিরে মায়ের আবেগে
করুণ হয়েছে ঝাউবন।
নদীর উজ্জ্বল জল কোরালের মত কলরবে
ভেসে নারকেলবনে কেড়ে নেয় কোরালীর ভ্রুণ;
বিকেল বলেছে এই নদীটিকে: 'শান্ত হতে হবে-'
অকূল সুপুরিবন স্থির জলে ছায়া ফেলে এক মাইল শান্তি কল্যাণ
হয়ে আছে তার মুখ মনে পড়ে এ-রকম স্নিগ্ধ পৃথিবীর
পাতা পতঙ্গের কাছে চলে এলে; চারি দিকে রাত্রি নক্ষত্রের আলোড়ন
এখন দয়ার মতো; তবু দয়ার মানে মৃত্যুতে স্থির
হয়ে থাকে ভুলে যাওয়া মানুষের সনাতন মন।
(শিরীষের ডালপালা- জীবনানন্দ দাশ)
ঊনবিংশ ও বিংশ শতকের প্রথমার্ধে এক অদ্ভুত পেশার উদ্ভব হয়েছিলো। তখনো এলার্ম ক্লক আবিষ্কার হয়নি বা আবিষ্কার হলেও সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে ছিলো না। শিল্প বিপ্লবের পরে যখন কলকারখানা তৈরি হল তখন মানুষের সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে কাজে বেরিয়ে পড়তে হত। ইংল্যান্ডের ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় সকালে সহসা ঘুম ভাঙতে চাইতো না মানুষের। ফলে পাড়াপড়শিকে না জাগিয়ে খুব সাবধানে ঘুম ভাঙাতেন 'নকার আপার্স'। অন্যভাবে বললে বলা যায় জ্যান্ত এলার্ম ক্লক। প্রশ্ন হতে পারে জীবনানন্দের সাথে অথবা তার কবিতার সাথে এই নকার আপার্সের কী সম্পর্ক। আছে হে ভায়া, আছে। কেন, জীবনানন্দকে ওরকমই একজন নকার আপার্স মনে হয় না আপনার? যে তার কবিতা দিয়ে খুব সাবধানে কিছু পাঠককে জাগিয়ে দিয়ে গেছেন। শুধু জাগিয়ে নয়, এক ধরনের অভ্যস্ততাও তৈরি করেছেন যেন এমন নকার আপার্সরা চলে যাবার পরও সেই অভ্যস্ততা সঙ্গে করে নিয়ে পথ চলতে পারেন তারই পাঠককুল। আর এই স্বতন্ত্র পেশার মত কবিতার পৃথিবীতে জীবনানন্দ কি তৈরি করেননি এক স্বতন্ত্র কাব্যভাষা? এ কারণে বুদ্ধদেব বসু তাকে বলেছেন 'নির্জনতম কবি' আর অন্নদাশঙ্কর রায় তাকে ডেকেছেন 'শুদ্ধতম কবি'। কারো কাছে তিনি পরাবাস্তব কবি, কারো কাছে ইতিহাস চেতনায় নিমগ্ন কবি। কারো কাছে নৈরাশ্যবাদী তো কারো কাছে প্রকৃতিবাদী। সমালোচকদের কাছে তিনি 'কবিদের কবি'।
প্রকৃতির অনুষঙ্গ দিয়ে যিনি কবিতার ক্ষেত ও জমিন সাজিয়েছেন তাকে আর যে যাই বলুক, আমার চোখে তিনি প্রকৃতির কবি। চিল শালিক এমনকি কাক কিংবা মৌমাছিও যার কবিতার শব্দ সাজায় নদী ও জোছনার প্রান্তরে, শিশির বা সমুদ্র দিয়ে যে পা ধুয়ে দেয় পৃথিবীর তাকে প্রকৃতির কবি বলা ছাড়া গত্যন্তর থাকে কি! অন্তরের চোখে তিনি ছুঁয়েছেন বাইরের চিত্র। তাঁর কবিতার ছত্রে ছত্রে আমরা প্রকৃতিকে পাই। সুখে ও শোকে, ব্যথা ও বিলাপে, করুণা ও কামনায় কবি প্রকৃতিকে দেখেছেন ব্যথাবিনাশী এক মন্ত্রের মতো। ধ্যানে ও নীরবতায় তিনি প্রকৃতির কাছেই আশ্রয় খুঁজেছেন। ক্লিনটন বি. সিলির ভাষায়, 'জীবনানন্দ নিঃসন্দেহে সাধারণ ছিলেন না, কবি হিসেবে নন বা মানুষ হিসেবে নন। তিনি সোজা কথায় অসাধারণ নির্জনতম একজন কবি।'
জীবনান্দের অন্যতম কাব্যগ্রন্থ 'বনলতা সেন'। এই কাব্যগ্রন্থে এমন কোন কবিতা নেই যা পাঠক হৃদয়কে তোলপাড় করে না। ত্রিশোত্তর আধুনিক বাংলা কবিতায় প্রাণসঞ্চারী এই কবি 'বনলতা সেন' কাব্যগ্রন্থে যে উপমা, ছন্দ, শব্দ নিয়ে খেলেছেন তা বিস্ময়কর। ভারতীয় পুরাণের বিদিশা, শ্রাবস্তী থেকে শুরু করে সামান্য বেতফলও এক অনন্যসাধারণ রূপমাধুরী নিয়ে হাজির হয়েছে পাঠকের সামনে। প্রেম ও প্রকৃতিকে তিনি আলাদা করে ভাবেননি কখনোই। দুটোকেই চিত্রায়িত করেছেন শব্দে ও কথায়। 'শিরীষের ডালপালা' কবিতার প্রথম চার লাইন -
'শিরীষের ডালপালা লেগে আছে বিকেলের মেঘে
পিপুলের ভরা বুকে চিল নেমে এসেছে এখন;
বিকেলের সূর্যশিশুকে ঘিরে মায়ের আবেগে
করুণ হয়েছে ঝাউবন।'
এই লাইন ক'টি পড়ার পরে কেন যেন মনে হয় হৃদয়ে কোথাও মেঘ জমে আছে। মনে হয় মহাপরাক্রমশালী সূর্য শিশুটি হয়ে মায়ের কোমলতায় মিশে যাবার আকুল আকুতি নিয়ে ঝাউবনে পা ছড়িয়ে বসেছেন সকরুণ নয়নে। কী মায়াময় চিত্রকর ছিলেন তিনি! মুহুর্মুহু জীবন পিয়াসী কবি তার চিত্রকল্পের ক্রমাগত আঁচড় কেটে গেছেন যেন। কোথাও কী এজরা পাউন্ডকে মনে পড়ে? ইমেজিস্ট কবি এজরা পাউন্ড ১৯১৩ সালে পোয়েট্রি পত্রিকায় লিখেছিলেন "An 'Image' is that which presents an intelectual and emotional complex in an instant of time. I use the term 'complex' rather in the technical sense employed by the newer psychologists, such as hurt, though we might not agree abosolutely in our application.'
এবার মিলিয়ে নেবার দায়িত্ব আপনাদের।
পুরো কবিতায় খণ্ডে খণ্ডে ছড়িয়ে আছে ছায়াবাজির খেলা। সব জড়ো করলে যে নকশা আমাদের সামনে আঁকা হয় তাতে সুররিয়ালিজমের রূপ সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। চলুন দেখি স্ট্যান্ডার্ড লিটারারি ডিকশনারী সুররিয়ালিজমের কী ব্যাখ্যা দাঁড় করান।
'A movement in the 20th century literature and art which attempts to express and exhibit the workings of the sub-concious mind especially as manifested in dreams and uncontrolled by reason or any conscious prices, characterized by the incongruous and startling arrangement and presentation of subject matter.' আমার তো এই লাইনগুলো মাথায় এলেই জীবন বাবু সামনে এসে দাঁড়ান। সুররিয়ালিস্ট কবির কবিতায় যুক্তি যতটা তার চেয়ে আবেগমথিত চিত্রকল্পের ব্যবহার তাঁর কবিতাকে প্রকটভাবে প্রাকৃতিক করে তোলে ৷ মগ্নচৈতন্যের কবি জীবনানন্দ 'শিরীষের ডালপালায় ঘোর ও কল্পনাকে মিশেল করে প্রেম ও প্রকৃতিকে দাঁড় করিয়েছেন অভিন্ন অবচেতনে।
শিরীষের ডালপালার কাব্যভাষা যেন অরণ্যাশ্রিত। তার উপমা ও বিন্যাস যেন পর্বতাশ্রিত। তাঁর প্রতীকি ব্যঞ্জনা যেন জলের প্রবাহ মিশ্রিত। মানুষের চিরন্তন সংগ্রামকে তিনি চিত্রায়িত করেছেন ঐন্দ্রজালিক সুরে ও সম্মোহনে। প্রকৃতির কত অনুষঙ্গই যে খুঁজে পাওয়া যায় এই কবিতাটিতে। শিরীষ, চিল, ঝাউবন, নদী, কোরাল, সুপুরিবন, পাতা, পতঙ্গ, নক্ষত্র, দেবদারু, জোনাকি আরো যে কত কী! প্রকৃতি ও ঐতিহ্যের অলকানন্দা তিনি এক অদ্ভুত নীরবতায় তুলে এনেছেন। উপমায় তিনি অনবদ্য ছিলেন। 'কোরালের মত কলরব' কিংবা 'নক্ষত্রের আলোড়ন এখন দয়ার মতো।' অথবা 'এক মাইল শান্তি কল্যান' সহ আরো উজ্জ্বল উদাহরণ রয়েছে। 'শিরীষের ডালপালা' মূলত হাজার বছরের যে পথ চলা, তার রহস্যময় সৌন্দর্য আর রসায়নের ঐশ্বর্য। কোথাও কোন নীরবতায় তলিয়ে যেতে যেতে ফের ফিরে আসা নিজস্ব নদীর কাছে। বনলতার কাছে।
'নদীর উজ্জ্বল জল কোরালের মত কলরবে
ভেসে নারকেলবনে কেড়ে নেয় কোরালীর ভ্রুণ;
বিকেল বলেছে এই নদীটিকে: 'শান্ত হতে হবে-''
এই নদী মূলত নদী নয়। নদীর অন্তরালে মানবাত্মার স্বরূপ সন্ধানে ব্যপৃত এক অতৃপ্ত কবি৷ কী অনন্যসাধারণ উপমা! কী জীবনবোধের গভীরতা!
তার বলার ভঙ্গিমা কোন এক ঐশ্বরিক সুরে ও স্বরে আমাদের বাঁধে শান্তি ও সাম্যের কিনারায়। জীবনের গভীরতর সুকুমার বৃত্তি যে নির্জলা সত্য উদঘাটনে তৎপর থাকে আমরা তার ধারক ও বাহক হয়ে গড়তে থাকি ইতিহাস, প্রেম, পরিণয়, সময়, সমাজ চেতনার চারুবাক ৷ জীবনানন্দের এই মহাজাগতিক স্বপ্ন বোনার কৌশল আমরা কেমন করে রপ্ত করবো?