হিন্দি সিনেমার গুজব র‍্যাকেটটিকে থামাবেন কে?

এ পর্যন্ত হিন্দি চলচ্চিত্র মুক্তির দিন হিসেবে তারা দাবি করেছেন ২৫ জানুয়ারি, ৩ ফেব্রুয়ারি, ২৪ ফেব্রুয়ারি ও সর্বশেষ ৩ মার্চকে। এই যে সিরিয়াল গুজব, তার একটি মানচিত্র আঁকা জরুরি বলে মনে করছি।

আশফাক আনুপআশফাক আনুপ
Published : 22 March 2023, 08:48 AM
Updated : 22 March 2023, 08:48 AM

কিছুদিন পূর্বে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর মতামত বিভাগে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে সম্প্রতি বাংলাদেশে হিন্দিভাষার চলচ্চিত্র আমদানি প্রচেষ্টা বিষয়ক কিছু উপাত্ত ও বিশ্লেষণ উপস্থাপন করা হয়েছিল। নিবন্ধটিতে কয়েকটি ব্যাপার প্রামাণ্যভাবে দেখানো হয়েছিল–

  • হিন্দি ভাষা সরাসরি একটি ভূরাজনৈতিক ও কৌশলগত উপাদান হিসেবে ভারত মহাদেশে ব্যবহার করা হয় ও হচ্ছে।

  • বাংলাদেশের ঐতিহাসিক ও বিদ্যমান আইনি বিধি এবং রাষ্ট্রীয় নীতি অনুসারে বাংলাদেশে এখনও পর্যন্ত হিন্দিভাষী চলচ্চিত্র আমদানির আইনি উপায় নেই। এমনকি বহুপাক্ষিক SAFTA বাণিজ্যচুক্তির আওতায়ও তা সম্ভব নয়, যদি না বিদ্যমান আইনি বিধিতে কোনো পরিবর্তন আনা হয়।

  • ঐতিহাসিক উপাত্ত থেকে দৃশ্যমান যে, বাংলাদেশের সিনেমা হল ব্যবসার সবথেকে লাভজনক সময়টি ছিল বাংলা চলচ্চিত্রের অন্ধকারতম সময়। সুতরাং, ‘হল ব্যবসা বাঁচলে বাংলা চলচ্চিত্র বাঁচবে’ শীর্ষক দাবিটি নির্জলা মিথ্যাচার।

  • SAFTA-এর মতো আঞ্চলিক বাণিজ্য চুক্তিসমূহ তুলনামূলক ক্ষুদ্র অর্থনীতির ক্ষয়িষ্ণু ভাষার চলচ্চিত্র শিল্পকে নিশ্চিতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে থাকে। উত্তর আমেরিকার NAFTA চুক্তি প্রয়োগের ফলাফলে মেক্সিকোর স্প্যানিশভাষী চলচ্চিত্র শিল্পের পতন একটি দৃশ্যমান উদাহরণ।

  • হল সংখ্যা ও চলচ্চিত্র সংখ্যার অবনতি সংক্রান্ত যেসব দাবি হল মালিকগণ এ যাবত করেছেন তার শতভাগই উদ্দেশ্যমূলক অর্ধসত্য বা ক্ষেত্রবিশেষে মিথ্যা।

ভাষার মাসে হিন্দি সিনেমা: নিছকই ব্যবসা?

এই বিষয়গুলো প্রামাণ্যরূপে দেখাবার একটি পরোক্ষ উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোতে যেসব গুজব ডালপালা মেলেছে, তা যাতে বাংলা চলচ্চিত্র শিল্পের শুভানুধ্যায়ী ও নীতিনির্ধারকগণকে প্রভাবিত না করে। যে বিষয়টি খুবই আশ্চর্যজনক তা হলো, কোনোপ্রকার বিস্তারিত জরিপ বা বিশ্লেষণ ব্যতিরেকেই গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমভিত্তিক গুজব অভিযান চলেছে বাংলাদেশে হিন্দি চলচ্চিত্র আমদানির সর্বশেষ এই প্রচেষ্টাটি চলমান থাকাকালীন সময়ে। এই প্রবণতা এখনও পূর্ণরূপে চলমান। অথচ এই লেখাটি যখন লেখা হচ্ছে তখন পর্যন্তও বিদ্যমান আমদানি নীতি আদেশের কোনোরূপ পরিবর্তন হয়নি।

বিনোদন সাংবাদিকতার এই চেহারাটি একটি বেশ ধাঁধার সৃষ্টি করেছে। যেখানে রাষ্ট্রের বিদ্যমান আইনি কাঠামোতে হিন্দি চলচ্চিত্র আমদানির ব্যাপারে বাধা রয়েছে, ওই লিখিত নীতির কোনো সুনির্দিষ্ট পরিবর্তন আসবার আগেই গণমাধ্যমগুলো একের পর এক হিন্দি চলচ্চিত্র মুক্তির তারিখ ঘোষণা করেছে। এ পর্যন্ত হিন্দি চলচ্চিত্র মুক্তির দিন হিসেবে তারা দাবি করেছেন, ২৫ জানুয়ারি, ৩ ফেব্রুয়ারি, ২৪ ফেব্রুয়ারি ও সর্বশেষ ৩ মার্চকে। এই যে সিরিয়াল গুজব, তার একটি মানচিত্র আঁকা জরুরি বলে মনে করছি।

দেশের একটি সংবাদপত্র ‘পাঠান’ নামক হিন্দিভাষী চলচ্চিত্রটিকে সংবাদ শিরোনাম করেছে সর্বমোট ৫০ বার। অন্যদিকে, বাংলাদেশের বিপুল দর্শক নন্দিত বাংলা চলচ্চিত্র ‘হাওয়া’ মুক্তির পর থেকে প্রায় ছয় মাসে ওই গণমাধ্যমটির অনলাইন পোর্টালে শিরোনাম হয়েছে ৪৯ বার আর ‘পরাণ’ শিরোনাম পেয়েছে মোটে ২১ বার! দেশের বেশিরভাগ গণমাধ্যমের অবস্থাই কমবেশি একইরকম!

গত বেশ কয়েক বছর যাবত নানান সময়ে নিয়ম করে হিন্দিভাষী চলচ্চিত্র আমদানির আবদার করা হয়ে আসছে। সাধারণত এই দাবিগুলো হল মালিকদের কাছ থেকেই আমরা লক্ষ্য করেছি। এবারই প্রথম এই প্রচেষ্টার নামভূমিকায় দেশে-বিদেশে নানান অপরাধকর্মে একাধিকবার অভিযুক্ত একজন মধ্যস্বত্বলোভী আমদানিইচ্ছুকের দেখা মেলে। SAFTA চুক্তির একটি মনগড়া ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে ‘অ্যাকশন কাট এন্টারটেইনমেন্ট’-এর ব্যানারে হিন্দি চলচ্চিত্র আমদানির ফ্লাডগেটটি খোলার তোড়জোড় শুরু হয়। ‘পাঠান’ আমদানির আবেদনের প্রেক্ষিতে গত ২৩ জানুয়ারি ২০২৩ তথ্যমন্ত্রীর সাথে এই প্রচেষ্টাকারী দলের প্রতিনিধি ও অন্যান্যদের আলোচনা হয়। সেখানে যুক্তিসঙ্গতভাবেই ‘আমদানি নীতি আদেশ’ জনিত আইনি বাধার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে প্রস্তাবটি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। আজ পর্যন্ত, বাংলাদেশের কোনো গণমাধ্যমে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এই বিষয়ক ব্যাখ্যা বা তথ্য মন্ত্রণালয়ের অনুরোধের আর কোনো ফলোআপ প্রকাশিত হয়নি। উল্লেখিত দুই মন্ত্রণালয়ের এ সংক্রান্ত কোনো সংশোধন বা প্রজ্ঞাপনও প্রকাশিত হয়নি।

নামভূমিকায় না থাকলেও, ২৩ জানুয়ারির বৈঠকে আশানুরূপ ফল না পাওয়ার তিন দিনের মাথায় ২৭ তারিখেই ঢাকার মধুমিতা হল নিজেদের কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করে ও সংবাদমাধ্যমে জানায় যে, হিন্দি সিনেমা আনার অনুমতি না পেলে তারা হল খুলবে না। ওইসময় চলমান বাংলা সিনেমা ‘ব্ল্যাক ওয়ার’ ও ‘অ্যাডভেঞ্চার সুন্দরবন’ হল থেকে নামিয়ে দেয়া হয়। এই হলটির মালিক চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির প্রধান বক্তিদের একজন। উল্লেখ্য যে, এই সমিতির পক্ষ থেকে পূর্বে কোভিডের অজুহাতে হিন্দি চলচ্চিত্র আমদানির দাবিতে দেশজুড়ে সিনেমা হল বন্ধের হুমকি দেয়া হয়েছিল। এদিকে ‘পাঠান’-এর আমদানিইচ্ছুক প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে অনবরত নানান গণমাধ্যমে আজ নয় তো কাল, কাল নয় তো পরশু– এ ধরনের তারিখ ঘোষিত হতে থাকে। প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধারকে ফেব্রুয়ারি মাসের ১ তারিখ থেকেই মুম্বাইয়ে অবস্থানরত দেখা যায়। ঠিক একই সময়ে ভারতীয় গণমাধ্যমে শতদীপ সাহা নামক একজন ভারতীয় চলচ্চিত্র পরিবেশকের সূত্র ধরে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে “বাংলাদেশ থেকে লোকজন ‘পাঠান’ দেখতে ভারতে পাড়ি জমাচ্ছে”। যদিও পরে টুইটার সূত্রে জানা যায় যে, যাদের ছবি শেয়ার দেয়া হয়েছিল তারা বাংলাদেশে কর্মসূত্রে বসবাসরত ভারতীয় নাগরিক!

চলমান এই গুজব অভিযানের মধ্যেই দেখা যায় খোদ শাহরুখ খান টুইটারে একজন ভক্তের প্রশ্নের জবাবে জানান যে, তাকে জানানো হয়েছে, বাংলাদেশে শীঘ্রই হিন্দি চলচ্চিত্র মুক্তি পাবে। যদিও, পরবর্তীতে বাংলাদেশের বিদ্যমান আইনের বিধান বিষয়ক অন্যান্যদের সুনির্দিষ্ট প্রশ্নের উত্তরে উনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। সাথে আরও বেশ চতুর একটি প্রবণতা দেখা যায়, যা এখনো চলমান আছে বেশকিছু গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে। তা হলো, হিন্দি চলচ্চিত্র আমদানির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়াদের মধ্যে থেকে বেছে বেছে ডিপজল, জায়েদ খান, হিরো আলমসহ কয়েকজন বিতর্কিত ব্যক্তিবর্গকে ফলাও করে প্রচার করা। হিন্দি চলচ্চিত্রের আমদানির বিরূদ্ধে বিশ্লেষণমূলক এবং তথ্যভিত্তিক বিরোধিতাসমূহ বেশ চাতূর্যের সাথেই ঢেকে দেয়া হয় গণপরিসরে। এর মধ্যেই আমদানিইচ্ছুক মধ্যস্বত্বলোভী সংস্থাটির সূত্রে কিছুদিন পরপরই হিন্দি চলচ্চিত্র মুক্তিলাভের নতুন নতুন তারিখ গণমাধ্যমে আসতে থাকে। মাঝে এমনকি নিজেদের গুজবের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে এমনও বক্তব্যও ছড়ানো হয়েছে যে, ‘ভাষার মাস’ ফেব্রুয়ারি মাস বিধায় হিন্দি চলচ্চিত্র আমদানি থেকে সরকার বিরত থাকছে! ‘ভাষা’ নামক প্রপঞ্চটিকে নিয়ে এমন মানের কৌতুক মনে হয় না খুব বেশি হয়েছে।

কৌতুকটি আরও স্পষ্ট হবে আরেকটি ব্যাপার জানলে। হিন্দি চলচ্চিত্র আমদানিইচ্ছুক সংস্থাটির প্রধানের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ধারাবাহিকতা থেকে দেখা যায় যে, আমদানির ক্ষেত্রে তাদের সুনির্দিষ্ট আবদার এই যে, বাংলাদেশে বিনা ডাবিংয়ে হিন্দিভাষী চলচ্চিত্র আমদানি করতে দিতে হবে! অথচ, এই ব্যক্তিই ভারতে বাংলাদেশের বাংলা চলচ্চিত্র/সিরিজ হিন্দি/অন্যান্য ভাষায় ডাব করে প্রচার করার ব্যাপারে ব্যবসায়িক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে বলে জানাচ্ছে। আবার এই পরিকল্পনাকালীন সময়ের আগে-পরে পশ্চিমবঙ্গভিত্তিক যে পরিবেশনা সংস্থাটিতে আনাগোনা করছে সে, তার নাম ‘SSR Cinemas Pvt. Ltd.’ যার প্রধানের নাম শতদীপ সাহা! নামটা কি পরিচিত লাগছে কিছুটা? হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন! “বাংলাদেশ থেকে সীমানা পেরিয়ে লোকে পাঠান দেখতে পাড়ি জমাচ্ছে” শীর্ষক গল্পটি যার হাত ধরে ছড়িয়েছে ইনিই তিনি।

এই ঘটনা প্রবাহটিতে মধ্যে আরও বেশকিছু ঘটনা ঘটেছে। যেমন চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট ১৯ সংগঠনের নেতাগণ সাক্ষরিত একটি চিঠিতে হিন্দি চলচ্চিত্র আমদানির ব্যাপারে নিজেদের অনাপত্তি জানিয়েছেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে প্রস্তাবটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছোনোর কথা জানানো হয়েছে। সে বিষয়ক কোনো সিদ্ধান্তের আগেই, সিনেমা হল মালিকদের আশানুরূপ বাংলাদেশে হিন্দি চলচ্চিত্র প্রদর্শনের অনুমতি না মেলায়, তারা গত ৩ মার্চ ২০২৩ সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে নীতিনির্ধারকগণকে ‘প্রভাবিত’ করার উদ্দেশ্যে সেই পুরোনো ঐতিহ্য অনুসারে ‘হিন্দি চলচ্চিত্র আমদানির অনুমতি না দিলে সকল হল বন্ধ ঘোষণা করা হবে’ মর্মে হুমকি দেয়া হয়। এরই ফাঁকে হিন্দি চলচ্চিত্রের আমদানিলিপ্সু কুশীলবটি তার সামাজিক  যোগাযোগমাধ্যমে ক্রমাগত নানান সংবাদ তৈরি করে চলেছে। সর্বশেষ সে জানিয়েছে যে, আসন্ন ২১ মার্চ সে ‘পাঠান’ বিষয়ক ‘ছক্কা’ পেটাতে চলেছে। যথারীতি এই ভবিষ্যদ্বাণীটিও সংবাদ শিরোনাম হয়েছে।

তবে, এই গোটা ঘটনা প্রবাহে একটিবারও সেই ২৩ জানুয়ারিতে চাওয়া বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যার ব্যাপারটি কোনো গণমাধ্যমেই জিজ্ঞাস্য বা আলোচিত হয়নি। অথচ, এটিই হবার কথা ছিল সাংবাদিকসুলভ প্রথম অনুসন্ধান। আমাদের দুর্ভাগ্য যে সেই ব্যাখ্যাগুলো আমাদের জানা হয়ে ওঠেনি। ওঠেনি বলেই একটা পরিকল্পিত গুজব র‍্যাকেট নীতিনির্ধারক থেকে শুরু করে গণ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি গণদ্বিধার সূত্রপাত করতে পেরেছে। কেউ একে বিনোদন, কেউ একে ব্যবসা ভেবে হালকা চালে নিচ্ছেন বটে, কিন্তু গোটা এলোমেলো ব্যাপারটি যে ভূরাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে একটি গণমনস্তাত্বিক পরাজয়কে বর্শার ফলায় গেঁথে রাষ্ট্র করছে এতদঞ্চলে তা কি বুঝতে পারছেন? সংবাদকর্মীগণ, নীতিনির্ধারকগণ, রাজনীতিকগণ– আপনাদের সবাইকে বলছি।