ভালোবাসা আছে ভালোবাসাতেই

ভালোবাসা প্রকাশের ভাষা ও উপায় বদলে গেছে। লোকশিল্পীর একটা গান আছে এরকম ‘দেশে মোবাইল এসেছে, চিঠি বন্ধ হয়েছে, ভালোবাসার কথা এখন আসে বাতাসে।’

মুস্তাফিজুর রহমান রূপমমুস্তাফিজুর রহমান রূপম
Published : 14 Feb 2024, 11:01 AM
Updated : 14 Feb 2024, 11:01 AM

‍“ভালোবাসা সব সময় ধৈর্য ধরে। কখনো ঈর্ষা করে না, গর্ব করে না, অহংকার করে না, দুর্ব্যবহার করে না, সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করে না, রাগ করে না, খোঁটা দেওয়ার জন্য ভুলের তালিকা তৈরি করে না। ভালোবাসার অধার্মিকতায় আনন্দ পায় না, সত্যে আনন্দিত হয়। ভালোবাসা সহ্য করে, বিশ্বাস করে, প্রত্যাশা রাখে এবং সব অবস্থায় স্থির থাকে।" (১ করিস্থীয় ১৩:৪-৭)

বাইবেলে এমনটাই বলা হয়েছে ভালোবাসা নিয়ে। এই কথাগুলোকে কি ভালোবাসার সংজ্ঞা বলা যায়? বোধ করি সংজ্ঞা না বলে ভালোবাসার বৈশিষ্ট্য বলাই যথার্থ হবে। ভালোবাসার আরো অনেক বৈশিষ্ট্য বলা যেতে পারে, তবে কোথাও কি নির্দিষ্টভাবে ভালোবাসার সংজ্ঞা পাওয়া যায়, কোথাও কি লেখা আছে এমন কিছু? জানা নেই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার গানে ভাবনা, যাতনা কি সেই সব প্রশ্ন করে জানতে চেয়েছেন 'ভালোবাসা কারে কয়?' সেই সঙ্গে এই সংশয় ব্যক্ত করেছেন 'সে কি কেবলই যাতনাময়?’ বাংলা ভাষায় রচিত সর্বাধিক গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাসের মূল উপজীব্য ‘ভালোবাসা'। এক অর্থে প্রেম। বোধ হয়, সব ভাষার সব সাহিত্যে এমনটাই হবে।

পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় বহুল ব্যবহৃত শব্দের মধ্যে অন্যতম হলো ভালোবাসা, ইংরেজিতে LOVE।

এখন থেকে দুই দশক আগে ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশে ১৪ ফেব্রুয়ারি ভালোবাসা দিবস উদযাপন করা শুরু হয়েছে। সেই সময় ‘যায়যায়দিন’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বেশ জনপ্রিয় ছিল পাঠকমহলে। সম্পাদনা করতেন শফিক রেহমান। পত্রিকার শেষ দুই পাতায়। মইন আর মিলার ফোনালাপের ছলে, অনেকটা সংলাপ আকারে তিনি লিখতেন বিভিন্ন সমসাময়িক আলোচিত বিষয় নিয়ে। এভাবেই শফিক রেহমানের লেখায় মইন আর মিলার সংলাপে উঠে আসে ভ্যালেন্টাইন ডের সূত্র ধরে ভালোবাসা দিবস। পরে ১৯৯৬-৯৭ সালের দিকে ভালোবাসা দিবস জনপ্রিয় হতে থাকে। ‘যায়যায়দিন’ যখন দৈনিক পত্রিকা হিসেবে প্রকাশ পায় এবং অফিস চলে আসে রাজধানীর তেজগাঁও এলাকায়, তখন অফিসের সামনের রাস্তাটির LOVE ROAD নামকরণ করা হয় মূলত শফিক রেহমানের উদ্যোগেই। সড়কটির অবস্থান তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের আহছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে থেকে বিজয়সরণি ফ্লাইওভারটি তেজগাঁওয়ে যেখানটায় এসে নেমেছে সেই পর্যন্ত ধরা যেতে পারে। যদিও এখন যায়যায়দিনের সাইনবোর্ড বা ঠিকানার জায়গাটি ছাড়া অন্য কোথাও LOVE ROAD লেখা চোখে পড়ে না।

১৪ ফেব্রুয়ারি দিনটি আমাদের ঋতুকাল অনুযায়ী ফাল্গুন তথা বসন্তের প্রথম অথবা দ্বিতীয় দিন হয়। ফলে বসন্তবরণ আর ভালোবাসা দিবস মিলে মিশে বাসন্তী রং শাড়ি-পাঞ্জাবি পরে ' ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে' মৃদু বায়, বহিয়া যায়।

ভ্যালেন্টাইন ডে বা সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন্স ডে যাকে অন্যভাবে সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন উৎসবও বলা হয়ে থাকে। দিনটি খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের একটি বার্ষিক উৎসবের দিন— ১৪ ফেব্রুয়ারি ভালোবাসা এবং অনুরাগের মধ্যে দিয়ে উদযাপিত হয়। প্রথমদিকে এটি সেন্ট ভ্যালেন্টাইন নামক একজন অথবা দুজন খ্রিষ্টান শহীদকে সম্মান জানাতে খ্রিস্ট ধর্মীয় উৎসব হিসাবে পালিত হয়ে আসছিল, পরবর্তীকালে লোক ঐতিহ্যের ছোঁয়া পেয়ে দিবসটি ধীরে ধীরে, প্রেম ও ভালোবাসার সংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও বাণিজ্যিক একটি আনুষ্ঠানিক দিবসে পরিণত হয়। যদিও এই দিবসটি পালন করা না করা বিষয়ে খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের মাঝেও মতভেদ রয়েছে। ১৪ ফেব্রুয়ারী ভ্যালেন্টাইন ডের পূর্বের ছয়দিন ধরে আরো ছয়টি দিবস রয়েছে। রোজ ডে দিয়ে শুরু এরপর প্রপোস ডে, চকলেট ডে, টেডি ডে, প্রমিস ডে, হাগ ডে, কিস ডের পর ভ্যালেন্টাইন ডে। পণ্য দাসত্বের এই যুগে যত দিবস তত বিপণন। আর এই দিবসগুলোকে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে বিপণন সংস্থাগুলো বোধ করি সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে।

সেন্ট ভ্যালেন্টাইন ডে বা উৎসব সমন্ধেও দুই ধরনের গল্প, মতবাদ প্রচলিত আছে। প্রথমত, তৃতীয় শতাব্দীর সময় রোমে একজন পুরোহিত ও চিকিৎসক সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের আত্মত্যাগের স্মরণে দিনটি উদযাপন শুরু হয়। তিনি একজন ধর্মপ্রচারকও ছিলেন। পাশাপাশি তিনি রোমান সৈন্যদের বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে উদ্বুদ্ধ এবং পৌরহিত্য করতেন। রোমান সম্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়াস বিশ্বাস করতেন যে, অবিবাহিত সৈন্যরা বিবাহিতদের চেয়ে বেশি দক্ষ, তাই চাকরিরত সৈন্যদের জন্য তিনি বিবাহ নিষিদ্ধ করে আইন জারি করেন। ধর্মযাজক সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন এই আইন সম্পর্কে জানতে পেরে সেটি অন্যায় মনে করেন এবং বিয়ে করতে ইচ্ছুক সৈন্যদের গোপনে বিয়ে পড়াতে থাকেন, সেই সঙ্গে অন্যান্য মানুষের ভালোবাসা উজ্জীবিত করতে প্রচার শুরু করেন। খুব শিগগির দ্বিতীয় ক্লাডিয়াস ভ্যালেন্টাইনের এই কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানতে পারেন এবং ভ্যালেন্টাইনকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন। প্রেমের জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করার কারণেই সেই সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনকে স্মরণ করে সেখানকার মানুষেরা তার জন্য একটি দিন উৎসর্গ করে।

অন্য গল্পটিতে বলা হয়েছে যে, সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনকে ধর্ম প্রচারের অভিযোগে অভিযুক্ত করে কারাবন্দি করা হয়। কারাবাসের সময় একজন কারারক্ষকের অন্ধ মেয়ে তার জাদুকরি চিকিৎসায় দৃষ্টি ফিরে পায়। অতঃপর ভ্যালেন্টাইনের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে মেয়েটির পরিবারসহ অনেকেই খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করে এবং মেয়েটির সঙ্গে ভ্যালেন্টাইনের প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয়। এই সংবাদ সম্রাটের কাছে আসা মাত্রই ধর্ম প্রচারের অপরাধে তার মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়। সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুর দণ্ডাদেশ কার্যকর হওয়ার পূর্বে তিনি মেয়েটিকে শেষ একটি চিঠি লেখেন। ওই চিঠির শেষে লেখা ছিল ‘লাভ ফ্রম ইউর ভ্যালেন্টাইন’। সেই থেকে মানুষ তার নামটিকে ভালোবাসার প্রতীক হিসাবে বিবেচনা করে। পরবর্তীকালে পঞ্চম শতাব্দীতে পোপ গ্লোসিয়াস প্রথম এই দিনটিকে ভ্যালেন্টাইন ডে হিসাবে ঘোষণা করেন। অবশ্য ইংরেজিতে লেখা ভালোবাসা দিবসের প্রাচীনতম যে বার্তাটি পাওয়া যায়, সেটি ১৪৭৭ সালের। সেই বার্তাতেও ‘লাভ ফ্রম ইউর ভ্যালেন্টাইন’ লেখা ছিল।

প্রথম ভ্যালেন্টাইনস ডে ৪৯৬ সালে পালিত হয়েছিল মনে করা হয়। তবে দিনটি যে ধর্মযাজক সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের নামেই প্রবর্তিত হয়েছে এই নিয়ে কোথাও কোনো সংশয় প্রকাশ করা হয় না।

সে গেল ভ্যালেন্টাইন ডের কথা। যদি শুধু ভালোবাসার কথা বলা যায় তবে ভালোবাসা আর প্রেম কি এক। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি উপন্যাসের নাম ‘ভালোবাসা প্রেম নয়’। সচরাচর আমরা দেশের প্রতি ভালোবাসাকে দেশপ্রেম, স্রষ্টার প্রতি ভালোবাসাকে খোদার প্রেম তার নবীর প্রেম ইত্যাদি নানান কথায় প্রকাশ করে থাকি। কেউবা প্রকৃতি প্রেমিক রয়েছে। ইংরেজি শব্দ LOVE বাংলায় ভালোবাসা, প্রেমের পাশাপাশি চলে আসে স্নেহ, মায়া, মমতা। বাংলাতেই এর আরো অনেক সমার্থক শব্দ থাকতে পারে। ইংরেজি ভাষায় অবশ্য ভালোবাসা তৈরিও করা যায় ‘Making Love’ বলে বহুল প্রচলিত একটি বাক্য রয়েছে।

লেখাপড়া জানা মানুষের ভালবাসার সঙ্গে একটি বিষয় খুবই ওতপ্রোতভাবে যুক্ত ছিল সেটি হলো চিঠি, প্রেমপত্র। প্রেমপত্র নিয়ে অনেক ঘটনা, গল্প আছে। ডাকযোগে প্রেমপত্র প্রেরণ, বাহক মারফত প্রেরণ, আবার সেই বাহককে তুষ্ট রাখা। প্রেমপত্র ধরা পড়ে যাওয়া, এমনকি পোষা পায়রার ডানায় বেঁধে প্রেমপত্র পাঠানোর গল্প, চলচ্চিত্রেও এরকম দৃশ্য দেখা গেছে। সে সকল এখন অতীতের কথা। ভালোবাসা প্রকাশের ভাষা ও উপায় বদলে গেছে। লোকশিল্পীর একটা গান আছে এরকম ‘দেশে মোবাইল এসেছে, চিঠি বন্ধ হয়েছে, ভালোবাসার কথা এখন আসে বাতাসে।’ মুঠোফোনে, দুরালাপনে অনেক অনেক কথার সঙ্গে ভালোবাসার কথাও বলা যায় কানে কানে। দিন্তা দিস্তা কাগজে প্রেমপত্রের জায়গায় চালু হয়েছে ভেতর বাক্স (In Box) ভরা চ্যাটিং। প্রেমের বার্তার আদান-প্রদান কতই না সহজ হয়ে গেছে এই কালে। সেই সঙ্গে কি সস্তাও হয়ে গেছে অনেকাংশে? কেউ কেউ মনে করেন প্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে প্রেমের মাত্রাও অনেকখানি বদলে গেছে। প্রযুক্তি মূলত গণিতনির্ভর। ভালোবাসার ক্ষেত্রেও গাণিতিক বিচার চলে আসছে অবলীলায়। ও আমার ধরনের না অতএব সম্পর্কের ইতি ( Break up)। যেন মোবাইলের চার্জারের মতো, বি-টাইপ চার্জার, সি-টাইপ চার্জার ইত্যাদি। আমার ফোনের সঙ্গে প্রযোজ্য (Match) না হলেই কিছু পরিবর্তন(Modify) করার কোন প্রশ্ন নেই শুধু বদলে ফেললেই হলো। সহ্য করার ক্ষমতা, মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা দিন দিন কমে আসছে। বিবাহ-বিচ্ছেদের হার যে অনেক বেড়ে গেছে তা তো খালি চোখেই দেখা যাচ্ছে। বিপরীতে দেখা যায় কিছু তরুণী দূরদেশে থেকে পরিবার-পরিজন ছেড়ে এসে বাংলাদেশের কোনো প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাঙালি তরুণকে বিয়ে করছেন প্রেমের টানে।

ভালোবাসা সম্বন্ধে এক তরুণের বক্তব্য এমন যে, একজনের সাথে প্রেমের সম্পর্ক ভেঙে গেলে নতুন আরেকজনের সাথে সম্পর্ক তৈরি হওয়ার মাঝের সময়টা এত কম যে সেখানে বিরহের তেমন কোন অবকাশ থাকে না। সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের জন্য সময় বা প্রচেষ্টা থাকে খুব কম। অবশ্য এর ব্যতিক্রমও আছে নিশ্চয়ই।

এই সমস্ত কিছুর পরও রবীন্দ্রনাথের ভাষা অনুকরণ করে বলা যেতে পারে ভালোবাসা আছে ভালোবাসাতেই। আর কৃষণ চন্দরের কথা দিয়ে শেষ করা যায়, ‘একমাত্র ভালোবাসাই পারে পৃথিবীকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের (ধ্বংশের) হাত থেকে রক্ষা করতে।’