গত ১৫ নভেম্বর ছিল কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী।
Published : 17 Nov 2022, 03:48 PM
হাসান আজিজুল হকের কোন পরিচয়টি সবচেয়ে বড়, সেই প্রশ্ন আমার মাথায় কখনো আসেনি। তবে তিনি একজন বড়মাপের লেখক এটা জেনেছিলাম বহু বছর আগেই। তিনি যে বছর পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলাদেশে আসেন, ওই বছরই আমার জন্ম। আবার আমি যখন স্কুলের শেষ দিকের ছাত্র তখনই সম্ভবত তার লেখা ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ গল্পটি প্রথম পড়েছিলাম। প্রথম পাঠেই লেখকের প্রতি যে গভীর মুগ্ধতা ও আকর্ষণ তৈরি হয়েছিল তা আজও অটুট আছে।
‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’-এর পর কত বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। হাসান আজিজুল হক সম্পর্কে ধীরে ধীরে কত কিছু জেনেছি। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন শাস্ত্রের অধ্যাপক। তিনি গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধ লেখেন। বাংলা গদ্য সাহিত্যের তিনি এক ব্যতিক্রমী প্রাণ পুরুষ। তার জন্ম পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানের যবগ্রামে। প্রাথমিক শিক্ষা লাভ ওখানেই। তারপর ১৯৫৪ সালে চলে আসেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের খুলনা জেলায়। তিনি হয়ে গেলেন আমাদের দেশের মানুষ। দেশ ভাগ দেখেছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দেখেছেন, দাঙ্গা দেখেছেন, নিষ্ঠুরতা ও নৃশংসতা দেখেছেন, মানুষের শক্তি এবং দু্র্বলতাও দেখেছেন। সংঘাত দেখেছেন, আবার সম্প্রীতিও দেখেছেন তিনি।
এক সাক্ষাৎকারে হাসান আজিজুল হক বলেছেন, “দেশভাগ হয় ১৯৪৭ সালে, তার ৭ বছর পর ১৯৫৪-তে আমি এখনকার বাংলাদেশে আসি। খুলনায়। কারণ খুবই আপতিক। স্কুল ফাইনাল পাস করার পর কোথাও না কোথাও তো ভর্তি হতে হবে – সেটা বর্ধমান কিংবা মাদ্রাজেও হতে পারতো। আমার বেলায় হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের খুলনায়। বাড়ি থেকে খুব যে একটা দূর তাও নয়। বৃহদায়তন উপমহাদেশ মাথায় রাখলে সত্যি খুব একটা দূরে আমার দেশান্তর ঘটেনি।”
এরপর তিনি বলছেন, “দাঙ্গার কথা, কোলকাতার দাঙ্গার কথা, নোয়াখালী-বিহারে সাম্প্রদায়িক হত্যার কাহিনী খুব ছোটবেলায় অল্পবিস্তর শুনেছি বটে – আশেপাশের অঞ্চলে দু’একটি ছোটখাটো দাঙ্গা, খুন – তা-ও দেখেছি। কিন্তু এরচেয়ে মনের ওপর প্রভাব ফেলেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং পঞ্চাশের মন্বন্তর। এসবই দেশভাগের তুলনায় মনকে অনেক বেশি গ্রাস করেছিল।”
তিনি যখন লিখতে শুরু করেন তখন স্বাভাবিকভাবেই এমন সব বিষয় গল্পে উঠে আসে যেগুলো তার অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারে জমা ছিল। তিনি বলেছেন, “ভাণ্ডার শূন্য থাকলে তো কিছু বের হবে না। যদি পকেট ফাঁকা থাকে এবং আমি দান করতে চাই – সেটা কি সম্ভব হবে?” না, তাই তো হাসান আজিজুল হক দু-হাতে অবিরল লেখেননি, কম লিখেছেন। তবে যা লিখেছেন তা-ই মানুষের মনে দাগ কেটেছে, পাঠকের মনে আলোড়ন তৈরি করেছে। লেখালেখির ক্ষেত্রে তিনি কাউকে অনুসরণ করেননি, বিশেষ কারও দ্বারা প্রভাবিত হননি। নিজেই বলেছেন, লিখতে গিয়ে কোনো সংজ্ঞা মানেননি, তার কোনো দীক্ষাগুরুও ছিল না। নিজেই নিজের পথ তৈরি করেছেন। তার গদ্যভাষাও যেন কবিতার মতো। কারও কাছে একটু কঠিন মনে হতে পারে। কিন্তু মনোযোগ দিয়ে পড়লেই ভেতরের সুধারস ঠিকই পাঠকের মনকে প্লাবিত করে। ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’ গল্পের শুরুটা দেখুন, “এখন নির্দয় শীতকাল, ঠাণ্ডা নামছে হিম, চাঁদ ফুটে আছে নারকেল গাছের মাথায়। অল্প বাতাসে একটা বড় কলার পাতা একবার বুক দেখায় একবার পিঠ দেখায়। ওদিকে গঞ্জের রাস্তার মোড়ে রাহাত খানের বাড়ির টিনের চাল হিম-ঝকঝক করে একসময় কানুর মায়ের কুঁড়েঘরের পৈঠায় সামনের পা তুলে দিয়ে শিয়াল ডেকে ওঠে।” এমন গদ্য কবিতার চেয়ে কম কিসে! তিনি গদ্যের জন্য তার মতো করে ভাষা নির্মাণ করেছেন। বলেছেন, “জোরজবরদস্তি করে কিছুই হবার নয়। ভাষা হচ্ছে নদীর তীব্র স্রোতের মতো, ভেতর থেকে বদলে যাবে। মনে রাখতে হবে, এ হচ্ছে জীবনের রসায়ন যন্ত্রের ফ্যাক্টরি নয়।”
হাসান আজিজুল হক সম্পর্কে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেছেন, “তাঁর দৃষ্টি অন্তর্ভেদী। সে দৃষ্টি শাণিত হয়েছিল তাঁর বামপন্থী বোধের দ্বারা।” তিনি কি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন? আমি সঠিক জানি না। কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য না হয়েও কিন্তু কমিউনিস্ট হওয়া যায়। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির তাত্ত্বিক নেতা প্রয়াত অনিল মুখার্জি একদিন আমাকে বলেছিলেন, “শুধু মিছিল মিটিং করলে, স্লোগান দিলেই কমিউনিস্ট হওয়া যায় না। তিনিই কমিউনিস্ট যিনি ভালো মানুষ, যে কাজ করেন তা নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা ও দক্ষতার সঙ্গে করেন এবং যিনি শুধু নিজের কথা না ভেবে সমষ্টির কথা ভাবেন।”
অনিল মুখার্জির সংজ্ঞা অনুযায়ী হাসান আজিজুল হক অবশ্যই কমিউনিস্ট ছিলেন। তিনি ছিলেন সেরাদের মধ্যে সেরা।
তার মতো মুক্ত মনের উদার মানুষ আর কজন আছেন আমাদের দেশে? বড় মানুষের একটি বড় গুণ হলো, তারা কাউকে উপেক্ষা করেন না। অতি উঁচু মাপের ও মনের মানুষ বলেই হাসান আজিজুল হক বরাবর সেই মানুষের জয়গান গেয়েছেন যারা অক্ষর না চিনলেও আলো-মাটি-আকাশ-নক্ষত্র-নদী-জল চেনেন।
তিনি উচ্চ শিক্ষিত এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। কিন্তু তার যাপিত জীবন ছিল সাধারণ। তিনি কখনো নিজেকে ‘এলিট শ্রেণির’ প্রতিনিধি ভাবতেন না। চলনে-বলনে সাদাসিধে ছিলেন। প্রান্তিক মানুষের প্রতি ছিল তার অকৃত্রিম ভালোবাসা। তিনি লিখেছেনও মূলত প্রান্তিক মানুষের কথাই। তিনি নিজেই বলেছেন, “আমি এলিট শ্রেণির মধ্যে নেই। বাংলাদেশের অই শ্রেণিকে আমি ‘রিফিউট’ করি। পাশাপাশি মধ্যবিত্তের তেলতেলে সুবিধাবাদকেও ঘৃণা করি। আমি মনে করি, বাংলাদেশের সমগ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই দুই শ্রেণি তুলনামূলকভাবে অত্যন্ত ক্ষুদ্র। পশ্চিমের স্বাধীন বুর্জোয়া সভ্যতা-সংস্কৃতির মধ্যে না গিয়ে তাকে পুরোপুরি ডিঙ্গিয়ে এসে উপনিবেশ এবং তাঁবেদার সামন্ত শ্রেণিভুক্ত হয়ে আজ এই এলিট ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি, এক রকম ভালো অর্থে বলছি, শুয়োরের মতো। শুয়োর দেখে কেউ একজন নাকি জিজ্ঞেস করেছিল – একি ইঁদুর বড় হয়ে হয়ে হয়েছে, নাকি হাতি ছোট হয়ে হয়ে হয়েছে?”
সত্য উচ্চারণে এমন অকপট এবং সাহসী ছিলেন হাসান আজিজুল হক।
নিজে যে বাম চিন্তায় বিশ্বাসী ছিলেন সেটাও স্পষ্ট হয় তার এই কথায়, “পুঁজিবাদী সমাজে ব্যক্তি সর্বেসর্বা। সমাজের ধনসম্পদ কুক্ষিগত হয়ে যায় ব্যক্তির কাছে।” সেজন্য তিনি তার লেখায় ব্যক্তির চেয়ে সমষ্টির দ্রোহকে উজ্জ্বল করে এঁকেছেন। কিছু একটা পাল্টাতে গেলে একা পারা যায় না, সমষ্টির প্রয়োজন হয়। প্রচলিত গণতন্ত্র নিয়ে যে তাঁর খুব উচ্ছ্বাস ছিল তা নয়। বরং তিনি বলেছেন, “পাঁচ বছর পর পর নির্বাচন হয়, আর পাঁচ বছর করে গণতন্ত্র কুক্ষিগত হয়।”
আবার মার্কসবাদী দর্শন নিয়েও তিনি বড় আশাবাদী ছিলেন না। তিনি বলেছেন, “আমি মনে করি, মার্কসবাদ নিয়ে এদেশে স্তুতি অথবা নিন্দা – এই দুটি অনর্গল আউড়ে যাওয়া প্রায় একমাত্র কাজ যা আমরা করতে পেরেছি। এতে মার্কসবাদ বোঝার ক্ষেত্রে ক্ষতি হয়েছে, কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে আরও ক্ষতি হয়েছে। দীক্ষিতদের জন্য মার্কসবাদ শাস্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে, অদীক্ষিতদের জন্য অস্পৃশ্য ব্যাপার। মূল্যায়ন করার কাজ অবশ্যই করা উচিত – যেহেতু মার্কসীয় দর্শন মৃত নয়, কেবলমাত্র দর্শনও নয়।”
হাসান আজিজুল হক আমার সরাসরি শিক্ষক ছিলেন না। কিন্তু ছিলেন আমার মতো আরও অনেকের জীবন-পাঠের শিক্ষক। তার সঙ্গে খুব বেশি দেখাসাক্ষাৎ না হলেও অন্তত বার চারেক বেশ সময় নিয়ে আন্তরিক পরিবেশে কথা হয়েছে। তিনি ছিলেন ভালো কথক। এত সুন্দর করে কথা বলতেন, শুনতেও ভালো লাগত। পাণ্ডিত্য ফলাতেন না, কিন্তু আলাভোলার মতো এমন সব কথা বলতেন যা সচরাচর অনেক পণ্ডিতের মুখ থেকেও বের হওয়া সহজ নয়।
তিনি জানতেন, আমি রাজনীতি নিয়ে লেখালেখি করি। তাই রাজনৈতিক আলোচনাই করতেন আমার সঙ্গে। বছর কয়েক আগে এক অনুষ্ঠান শেষে জিজ্ঞেস করেছিলাম, স্যার, আমরা কি এগিয়ে যাচ্ছি, নাকি– আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই তিনি শুরু করেন, “মানুষ পিছনে হাঁটতে পারে না। হাঁটতে হয় সামনের দিকেই। অবশ্য সদরঘাটে যাওয়ার পথে কেউ গুলিস্তানে ঘুরপাক খায় না, তা তো নয়। ক্রমাগত হারানো এবং ক্রমাগত পাওয়ার মধ্য দিয়ে আমাদের যে অর্জন তা অবিনাশী। তবে হারানোকে বড় করে দেখা, আর পাওয়াকে ছোট করে দেখা মানুষের সহজাত প্রবণতা। বড়শি দিয়ে মাছ ধরতে গেলে যে মাছটা ধরা যায় না, তাকে বড়ই মনে হয়, আর যেটা বড়শিতে ধরা পড়ে সেটা ছোট মনে হয়। আমাদের এই জীবনকালে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা আমাদের জন্য আকাশতুল্য অর্জন। আবার বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির প্রতিষ্ঠাকালীন অঙ্গীকার থেকে ক্রমাগত সরে যেতে দেখাটাও কম বেদনার নয়। এটা অবশ্য রাষ্ট্রের দোষ নয়। দোষ সেই মানুষদের যারা রাষ্ট্র পরিচালনার ভার পায় বা নেয়।”
আমার জন্য এটা খুবই কষ্টের যে তার একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নেওয়ার ইচ্ছে পূরণ হওয়ার আগেই তিনি ২০২১ সালের ১৫ নভেম্বর ৮৩ বছর বয়সে চলে যান পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে।
শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে পাঠ দেওয়ার বাইরেও তিনি তাদের জন্য প্রচুর সময় দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে তার ছিল নিবিড় সম্পর্ক। শিল্প-সাহিত্যের সৃজনভুবনে অসংখ্য তরুণের উৎসাহী পদচারণাকে তিনি উৎসাহিত করতেন। একা নয়, অনেকে মিলে এগিয়ে যাওয়ার সাধনায় তিনি কত সময় যে ব্যয় করেছেন! একে তিনি অপচয় মনে করতেন না, মনে করতেন বিনিয়োগ।
এর বাইরে তিনি নানা বিষয়ে লেখালেখি করেছেন। কারও কারও মতো তিনি অনেক লেখেননি, এক বসায় তিনি কয়েক হাজার শব্দের মালা গেঁথে গল্প-উপন্যাস লিখে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছেননি। তিনি অল্প লিখেছেন, তবে যা লিখেছেন তা বোদ্ধা পাঠকদের মনে নাড়া দিয়েছে, সাড়া দিয়েছে ভাবনার কেন্দ্রে। তিনি দেখেছেন অনেক, ভেবেছেন তারচেয়ে বেশি। আর লিখেছেন তার তুলনায় কম।
তবে হাসান আজিজুল হক একজনই। তিনি ছিলেন মুক্ত মনের মুক্তচিন্তার মানুষ। আড়াল পছন্দ করতেন না। খোলা মনের এই মানুষটি যতটুকু মনোযোগ পাওয়ার দরকার ছিল, ততটুকু পেয়েছেন? তিনি রাজধানীবাসী হননি। কোলাহল থেকে দূরে থাকার জন্যই কি পদ্মাপাড়ের রাজশাহীতে স্থায়ী নিবাস গড়েছিলেন? তার বাড়ির নাম রেখেছিলেন ‘উজান’। উজানস্রোতে দাড় টানতে হয়েছে বলেই কি? রাজশাহীতে বাড়ি করার সময় তিনি স্থপতিকে বলেছিলেন, “নেহাত দেয়াল না দিলে তো ঘর হয় না। কাজেই দেয়াল আপনি দেন – আপত্তি করবো না, তবে যত কম পারেন।”
হাসান আজিজুল হককে বিস্মৃতির দেয়াল চাপা দেওয়ার নির্বুদ্ধিতা যেন কাউকে পেয়ে না বসে।