বিনিময়ের বিকল্প মাধ্যম: বিটকয়েন কিংবা ক্রিপ্টোকারেন্সি

পৃথিবীর অন্তত একটি দেশ, মধ্য আমেরিকার এল সালভাদর বিটকয়েনকে ‘লিগ্যাল টেন্ডার’ বা বৈধ মুদ্রা হিসেবে ঘোষণা করেছে।

শিশির ভট্টাচার্য্যশিশির ভট্টাচার্য্য
Published : 3 Dec 2022, 03:10 PM
Updated : 3 Dec 2022, 03:10 PM

অর্থনীতিতে কমবেশি ওয়াকিবহাল ব্যক্তিমাত্রই জানেন, মুদ্রার ভালো-মন্দ আছে এবং মুদ্রার দাম বাড়ে-কমে। বাজারে যদি প্রয়োজনের তুলনায় কোনো মুদ্রার পরিমাণ বেড়ে যায়, তবে ওই মুদ্রার দাম কমে গিয়ে মুদ্রাটি ‘মন্দ’ হতে শুরু করবে। কাগজ, রূপা, তামা, দস্তা ইত্যাদি বস্তু সহজেই পাওয়া যায় বলে এসব বস্তু দিয়ে তৈরি মুদ্রার পরিমাণ সরকার আইনসঙ্গতভাবে বাড়াতে পারে। বেআইনিভাবে, শাস্তির ঝুঁকি নিয়ে, দুষ্ট লোকেরাও মুদ্রার পরিমাণ বাড়াতে পারে, মুদ্রা নকল করে। সুতরাং এসব উপাদান দিয়ে তৈরি মুদ্রা মন্দ হয়ে যাবার একটা সম্ভাবনা সবসময় থাকে।

মুদ্রা তৈরির উপাদানগুলোর মধ্যে স্বর্ণ ব্যতিক্রম, কারণ প্রকৃতি থেকে স্বর্ণসংগ্রহ কঠিন বলে স্বর্ণের পরিমাণ ইচ্ছামতো বাড়ানো যায় না। অন্য ধাতুর ভেজাল দেওয়া ছাড়া স্বর্ণমুদ্রা সাধারণত মন্দ হয় না। সমস্যা হচ্ছে, স্বর্ণের সরবরাহ সসীম হলেও খননের ফলে বছরে স্বর্ণের পরিমাণ কমবেশি শতকরা দুই ভাগের মতো বৃদ্ধি পায়ই। প্রতি পঞ্চাশ-একশ বছরে কোনো দেশের বাজারে স্বর্ণমুদ্রার পরিমাণ দ্বিগুণ হয়ে এর মূল্যও অর্ধেক হয়ে যাবার কথা।

এমন একটি মুদ্রা কি সৃষ্টি করা যায়, যার সরবরাহ চিরকালের মতো সসীম হবে? পৃথিবীর প্রথম ক্রিপ্টোমুদ্রা ‘বিটকয়েন’ তেমন একটি মুদ্রা। এর সরবরাহ চিরকালের মতো স্থির।

বিটকয়েনের বয়স বেশি নয়। ২০০৮ সালে কল্পিত এক ব্যক্তি সাতোশি নাকামোতো যখন ব্লকচেইন প্রশাসনের প্রস্তাব করেছিলেন, তখন ডেটা মাইনিং অর্থাৎ ক্রিপ্টোগ্র্যাফি বা বিশেষ সাংকেতিক ভাষায় লেনদেনের তথ্য লিপিবদ্ধ করার পারিশ্রমিক হিসেবে তিনি বিটকয়েন দেবার কথা বলেছিলেন।

বিটকয়েন একটি ডিজিটাল বা ‘সাংখ্য’ মুদ্রা। এটি একটি গুপ্ত বা ক্রিপ্টোমুদ্রাও বটে। প্রতিটি ক্রিপ্টোমুদ্রা একটি কম্পিউটার প্রোগ্রাম দিয়ে তৈরি। বাজারে বিখ্যাত ক্রিপ্টো বা গুপ্তমুদ্রা আছে ৫০টির বেশি: বিটকয়েন, ইথেরিয়ামের মতো বিখ্যাত মুদ্রা তো আছেই, এছাড়াও আছে BNB, Terra, Cardano, Solana, Avalanche, Dogecon, Shiba Inu, Polygon, Cronos, Dai, Cosmos, Tron, Hedera, Fantom, Sandbox... একের পর এক নতুন গুপ্তমুদ্রা চালু হচ্ছে বাজারে। কোনোটির দাম কমছে, কোনোটির বাড়ছে, ফিয়াট মানি বা শেয়ারের মতোই। কোনো কোনোটি অবশ্য বাতিলও হয়ে যাচ্ছে, বাজারে টিকতে না পেরে। গুপ্তমুদ্রাগুলো ভিন্ন ভিন্ন প্রোগ্রাম অনুসারে চললেও, সব মুদ্রাই সাতোশি নাকামোতোর মূলনীতিগুলো কমবেশি অনুসরণ করার চেষ্টা করে।

বাংলাদেশে যদি ‘টাকা’ নামে একটি গুপ্তমুদ্রা চালু হয়, ক্ষতি কী? এই ‘টাকা’ বর্তমানে প্রচলিত টাকার ভিত্তিমুদ্রা বা রিজার্ভ মানিও হতে পারে। এই টাকা কে চালু করবে, সরকার না জনগণ? একটি দেশে সবকিছু সরকার চালায় না, আবার অনেক কিছু যে চালায়, সেটাও মিথ্যা নয়।

সাতোশি নাকামোতো বিটকয়েনের প্রোগ্রামটা এমনভাবে লিখেছিলেন যাতে বাজারে বিটকয়েন থাকে সর্বোচ্চ ২১ মিলিয়ন। (বিশ্ব) অর্থনীতিতে অধিকতর বিটকয়েনের প্রয়োজন হলে প্রতিটি বিটকয়েন সর্বোচ্চ ১০ কোটি সাতোশিতে বিভাজনযোগ্য হবে।

শুরুতে প্রতিটি ব্লক ক্রিপ্টোগ্র্যাফিতে লেখার জন্য পারিশ্রমিক ছিল ৫০ বিটকয়েন। যত দিন যাচ্ছে, এই পারিশ্রমিক কমছে, কারণ ব্লকের সংখ্যা বাড়ছে বলে মাইনিং বা খনন দিনকে দিন জটিলতর হচ্ছে, মাইনারদের মধ্যে প্রতিযোগিতাও বাড়ছে। ২০১২ সালে পারিশ্রমিক কমে অর্ধেক হয়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল ২৫ বিটকয়েন। ২০২০ সালে প্রতি ১০ মিনিটে নতুন একটি ব্লক ব্লকচেইনে যুক্ত হতো, প্রতিদিন নতুন ব্লক হতো কমবেশি ১৪৪টি এবং এর পারিশ্রমিক দাঁড়াত ১৮০০ বিটকয়েন, যার মানে ব্লকপ্রতি ১০ বিটকয়েনের কিছু বেশি।

কখন, কীভাবে, কী পরিমাণ বিটকয়েন সৃষ্টি হবার পর মাইনিংয়ের পারিশ্রমিক কমবে বা অর্ধেক হবে, তা বিটকয়েন প্রোগ্রামেই লিপিবদ্ধ আছে। খননের পারিশ্রমিক অর্ধেক হয়ে যাওয়াকে বলে (ইংরেজি ‘হাফ’ বা অর্ধেক থেকে গঠিত শব্দ) ‘হালভিং’। এ পর্যন্ত দু-বার হালভিং হয়েছে, একবার ২০১২ সালে এবং আরেকবার ২০১৬ সালে। ২০২০ সালের জুলাই মাস থেকে প্রতি ব্লকের জন্যে পারিশ্রমিক ধার্য হয়েছে ৬ বিটকয়েন।

পারিশ্রমিক অনেক কমে গিয়ে এবং ব্লকের সংখ্যা ও প্রতিটি ব্লকের আকার বেড়ে গিয়ে মাইনিং জটিল হবার কারণে দিন দিন সংখ্যা বা পরিমাণে বিটকয়েনও কম সৃষ্টি হচ্ছে। ২০২০ সালে বিটকয়েনের পরিমাণ ছিল ১৮ মিলিয়ন। বিটকয়েনের সংখ্যা বর্তমান গতিতে বাড়তে থাকলে, ধারণা করা হয় যে ২১৪০ সালের মধ্যেই ২১ মিলিয়ন বিটকয়েন সৃষ্টি হয়ে যাবে এবং এর পর থেকে বিটকয়েনের সংখ্যা আর বাড়বে না।

বিটকয়েন মাইনিং করে উপার্জন করা যায় অথবা অন্যের কাছ থেকে কেনা যায়। তবে বিটকয়েনের মালিক হতে হলে প্রথমে একটি বিটকয়েন মানিব্যাগ থাকতে হবে এবং একটি গোপন ‘বিটকয়েন ঠিকানা’ থাকতে হবে। এই মানিব্যাগকে বলে ‘বিটকয়েন ওয়ালেট’। এই ঠিকানা ও মানিব্যাগ আন্তর্জালে সংগ্রহ করা যেতে পারে। ঠিকানাটি হারালে আপনি আপনার ওয়ালেটের সব বিটকয়েন হারিয়ে ফেলবেন, রাস্তায় মানিব্যাগ হারানোর মতোই। সুতরাং ঠিকানাটি খুব সাবধানে নিরাপদ জায়গায় সংরক্ষণ করতে হবে। একটাই সুবিধা, সরকারের ফিয়াট মানির মতো বিটকয়েন জাল করা সম্ভব নয়, কারণ এটা যেহেতু ব্লকচেইনে চলে, সেহেতু জাল যা কিছু অবিলম্বে বাতিল হবার কথা।

১৮ মিলিয়ন বিটকয়েনের মধ্যে ৪ মিলিয়ন বিভিন্নভাবে হারিয়ে গেছে গত ১৪ বছরে। হয় ঠিকানা হারিয়েছে কিংবা মালিক ঠিকানা ভুলে গিয়েছেন কিংবা মালিক মারা যাবার আগে কাউকে বলে যেতে পারেননি কোথায় কত বিটকয়েন তার আছে। ১ মিলিয়ন বিটকয়েন হ্যাক বা চুরি হয়েছে, মালিকদের অসতর্কতার কারণে।

বাকি ১৩ মিলিয়ন বিটকয়েনের মধ্যে ৫ মিলিয়ন আছে রাঘব-বোয়ালদের হাতে। এদের বলা হয় ‘হোয়েল’ বা তিমি, ‘বিটতিমি’, বাংলায় যেমন বলা হয় ‘টাকার কুমির’। এই বিটতিমিরা তাদের বিটকয়েন কখনোই বিক্রি করে না, কারণ প্রথমত, তারা এত বড়লোক যে বিক্রি করার প্রয়োজনই তাদের হয় না এবং দ্বিতীয়ত, বিটকয়েনের দাম আরও বাড়ার অপেক্ষায় থাকে তারা। অজ্ঞাতনামা নাকামোতো নিজেও বৃহত্তম বিটতিমিদের একজন, যার ওয়ালেটে ৭৫ লক্ষ থেকে ১ কোটি বিটকয়েন আছে যার বাজারমূল্য ৭৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই হিসাবে তিনি পৃথিবীর পঞ্চদশতম ধনী, অথচ তার পরিচয়ই কেউ জানে না।

সাধারণ ক্রেতার নাগালের বাইরে থাকা ৫ মিলিয়ন বিটকয়েন বাদ দিলে বাজারে চলমান থাকে মাত্র ৮ মিলিয়ন বিটকয়েন, এ পর্যন্ত সৃষ্টি হওয়া মোট বিটকয়েনের অর্ধেকেরও কম। বিটকয়েনের চাহিদা প্রচুর, সুতরাং দাম তো বাড়বেই। ৮ মার্চ, ২০২২ তারিখে বাজারে ১টি বিটকয়েনের দাম ছিল ৩৮,০০০ মার্কিন ডলার। আজ ৩০ নভেম্বর ২০২২ তারিখে একটি বিটকয়েনের দাম ১৭,০০০ মার্কিন ডলারের কিছু কম। অথচ এক যুগ বা বারো বছর আগে ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে ১ বিটকয়েনের দাম ছিল মাত্র ৩০ সেন্ট এবং একই বছরের ডিসেম্বর মাসে এর দাম উঠে গিয়েছিল ৫০০ ডলারে। অন্য যে কোনো মুদ্রার মতোই বিটকয়েনের দামের ওঠানামা আছে।

এখন বিটকয়েনের দাম কমছে দুটি কারণে: ১) মানুষ সম্ভবত স্বর্ণ ছাড়া আর কোনোকিছুতে নিজের সঞ্চয় রাখতে চাইছে না এবং ২) (সম্ভবত) কৃত্রিমভাবে ডলারের মূল্য বাড়িয়ে রাখা হয়েছে। বিটকয়েনের দাম এর আগেও কয়েকবার অনেক কমে গিয়ে আবার অনেক বেড়ে গিয়েছিল। প্রথমে করোনা মহামারী এবং তারপর ইউক্রেইন যুদ্ধের কারণে এখন অবশ্য বিশ্ব অর্থনীতিতে অনেক রকম টানাপোড়েন চলছে এবং পণ্যের দাম বাড়া কিংবা কমা, কোনোটাই ঠিক স্বাভাবিকভাবে ঘটছে না।

বিটকয়েনের দাম যখন বাড়ে, এক বছরে কীভাবে একটি বিটকয়েনের মূল্য ৫০০ গুণ বৃদ্ধি পেতে পারে? স্বর্ণের দাম এক বছরে কখনোই ৫০০ গুণ বাড়তে দেখা যায়নি। এর অন্যতম কারণ, চাহিদা অনুসারে বিটকয়েনের সরবরাহ বাড়ানো যায় না, কেউ বাড়াতে পারে না, প্রোগ্রামটাই সেভাবে করা। বিটকয়েন মাইনিং স্বর্ণখননের চেয়েও কঠিন এবং এই কাজ দিনকে দিন কঠিনতর হচ্ছে। বিটকয়েনের চাহিদা আছে বাজারে, কিন্তু সরবরাহ নেই। সুতরাং এমন জিনিসের দাম তো বাড়বেই, ঠিক যে কারণে স্বর্ণের দাম বাড়ে।

স্বর্ণের দাম আদৌ কেন বাড়ে? মানুষ স্বর্ণ সংগ্রহ করে, তামা সংগ্রহ করে না কেন? কারণ, মানুষ ভাবে, স্বর্ণের দাম আরও বাড়বে, অন্ততপক্ষে কমবে না। টাকার কুমির যারা, তারা বাংলা টাকা না কিনে ডলার বা ইউরো কিনে রাখে কেন? এর কারণ, তারা ভাবে, ডলার বা ইউরোর অন্ততপক্ষে টাকার মতো অবমূল্যায়ন হবে না। একটি বিটকয়েনের দাম আজকের বাজারে প্রায় ১৭ ভরি স্বর্ণের সমান, এক বছর আগেই এটা ৫০ ভরি স্বর্ণের সমান ছিল, কারণ বিটকয়েন যারা কিনেছে, কিনতে চায়, তারা বিটকয়েনকে স্বর্ণের চেয়ে ১৭ গুণ বা ৫০ গুণ বেশি দামি বলে মনে করে। তারা দেখেছে, বিটকয়েনের দাম যত দ্রুত এবং যত বেশি বাড়ে, স্বর্ণের মূল্য তত দ্রুত এবং তত বেশি বাড়ে না। এটাকে বলা হয় ‘অনুমিত মূল্য’ বা ইংরেজিতে বললে ‘পার্সিভড ভ্যালু’। ক্রেতাদের কাছে বিটকয়েনের অনুমিত মূল্য বেশি বলেই এর দাম বেশি।

২১৪০ সাল থেকে, অর্থাৎ আজ থেকে ১২০ বছর পর থেকে নতুন বিটকয়েন আর বাজারে আসবে না। তখন মাইনিংয়ের পারিশ্রমিক কীভাবে দেওয়া হবে? বিটকয়েন বিশেষজ্ঞরা বলেন, তখন লেনদেনের ফি দিয়েই মাইনিংয়ের পারিশ্রমিক দিতে হবে। আমরা বলেছি, বিটকয়েনের সংখ্যা বাড়ানো যাবে না, কিন্তু ধরা যাক, আগামি এক শ বছরে আরও একাধিক মিলিয়ন বিটকয়েন হারিয়ে গেল বা চুরি হলো। হারিয়ে যাওয়া বিটকয়েনগুলো বিটকয়েন মালিকদের সর্বসম্মতিক্রমে পুনরুজ্জীবিত করা যেতে পারে কি? চুরি হওয়া বিটকয়েনের মালিকানা বাতিল হওয়ার ব্যবস্থাও থাকতে পারে। তখন ওইসব বিটকয়েন দিয়ে মাইনিংয়ের খরচ মেটানো যাবে আরও কয়েক শ বছর।

বিশেষজ্ঞ অভিমত হচ্ছে, বিটকয়েনের বিশেষ প্রোগ্রামিংয়ের কারণে এটা বাস্তবায়নযোগ্য হবে না। তা যদি নাও হয়, অন্য ক্রিপ্টোমুদ্রায় পুনরুজ্জীবন কিংবা মুদ্রাবাতিলের এই ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে, অবশ্যই সর্বসম্মতির ভিত্তিতে। এটাও ঠিক যে আগামী এক শ বছরে প্রযুক্তি আরও অনেক এগিয়ে যাবে। আমরা যা কিছু বলছি, বর্তমানের নিরিখেই বলছি। তখন গুপ্তমুদ্রার বিচিত্র সব সমস্যার অধিকতর কার্যকর ও সহজ সমাধান নিশ্চয়ই বের হবে।

ক্রিপ্টোমুদ্রাগুলো একেকটি ডিজিটাল বা সাংখ্য মুদ্রা, বলেছি ওপরে। ডিজিটাল মুদ্রা আর ক্রিপ্টোমুদ্রার পার্থক্য আছে। সব ক্রিপ্টোমুদ্রাই ডিজিটাল মুদ্রা কিন্তু সব ডিজিটাল বা সাংখ্যমুদ্রাই গুপ্ত বা ক্রিপ্টোমুদ্রা নয়। ডিজিটাল মুদ্রা অবশ্য নতুন কিছু নয়, আপনার টাকা ব্যাংকে যতক্ষণ আছে ততক্ষণ সেটা ডিজিটাল অবস্থাতেই আছে। ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ড দিয়ে আপনি যখন কোনোকিছুর মূল্য পরিশোধ করছেন, তখন ডিজিটাল মুদ্রাতেই পরিশোধ করছেন। তবে ব্যাংকে জমা থাকা ডিজিটাল এম-২ আপনি চাইলে এটিএম বুথ থেকে এম-১ (কাগজের টাকা, ধাতব মুদ্রা) হিসেবে তুলতে পারেন, ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড দিয়ে।

বিটকয়েনের আপাতত কোনো এম-১ নেই। তবে বিটকয়েনকে এম-১-এ ভাঙানো যেতেই পারে, এটিএম থেকেও বিটকয়েনের সমপরিমাণ ফিয়াট মুদ্রা তোলার ব্যবস্থা করা কঠিন নয়। বিটকয়েনের ধাতব বা কাগুজে মুদ্রাও থাকতে পারে কি? সমস্যা হচ্ছে, সেক্ষেত্রে মুদ্রা জাল হবার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। যদিও জালমুদ্রা ধরা কঠিন হবে না কিন্তু ততক্ষণে ক্ষতি যা হবার হয়েই যাবে। ক্ষতিটা হবে দুইভাবে, প্রথমত মুদ্রার পরিমাণ বেড়ে গিয়ে মুদ্রার দাম কমবে এবং মুদ্রা জাল হওয়ার খবর রটে গেলেও মুদ্রার দাম কমবে। কার্ড বা মোবাইল দিয়ে লেনদেন করলে অবশ্য এম-১ এর দরকার হয় না। চীনে লোকজনকে বেশিরভাগ লেনদেন মোবাইল দিয়েই করতে দেখেছি। মোবাইল ছোঁয়ানো মাত্র লেনদেন হয়ে যায় এবং মুহূর্তে মোবাইলে লেনদেনের বিবরণ এসে যায়।

সরবরাহ সীমিত, এমন কোনো মুদ্রা যদি আদর্শ মুদ্রা হয়ে থাকে তবে বিটকয়েন আদর্শতম মুদ্রা। এই মুদ্রার ওপর পৃথিবীর কোনো সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই। কোনো সরকার এই মুদ্রা সৃষ্টি করে না, এর সরবরাহ বাড়াতে কিংবা কমাতে পারে না। পৃথিবীর যে কেউ মাইনিং করে বিটকয়েনের মালিক হতে পারে, কিনতে তো পারেই। অনেক দেশের সরকারের তহবিলেই বিটকয়েন আছে, যদিও অনেক সরকার প্রকাশ্যে বিটকয়েনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। চীন প্রচুর বিটকয়েনের মালিক, তবু চীন সরকার প্রকাশ্যে বিটকয়েনবিরোধী। বিখ্যাত ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারী ইলন মাস্ক বিটকয়েনের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। তার সমর্থনের কারণে বিটকয়েনের মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছিল, মাস ছয়েক আগে।

পৃথিবীর অন্তত একটি দেশ মধ্য আমেরিকার এল সালভাদর বিটকয়েনকে ‘লিগ্যাল টেন্ডার’ বা বৈধ মুদ্রা হিসেবে ঘোষণা করেছে। একটি জীবন্ত আগ্নেয়গিরির তাপ দিয়ে টারবাইন ঘুরিয়ে তৈরি করা বিদ্যুৎ দিয়ে সালভাদর সরকার সুপার কম্পিউটার চালাচ্ছে বিটকয়েন মাইনিং করার জন্যে। সালভাদর সরকার প্রত্যেক নাগরিককে একটি করে গুপ্তমুদ্রা ওয়ালেট উপহার দিয়েছে যাতে ২৫ ইউরোর সমপরিমাণ বিটকয়েন আছে। এই ওয়ালেট মূলত একটি প্রোগ্রাম যা ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করতে হয়। তবে সালভাদরেও সবাই বিটকয়েনকে মেনে নিচ্ছে না। বিটকয়েনকে অনেকে দুর্নীতির আকর বলছেন। বিটকয়েনের বিরুদ্ধে সালভাদরে মিছিল-প্রতিবাদও হয়েছে। আইএমএফ সালভাদরকে তার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে বলেছে এবং নির্দেশ না মানলে নতুন ঋণ না দেবার হুমকি দিয়েছে।

২০১০ সালের মে মাসে বিটকয়েনের এক মালিক প্রতি বিটকয়েন ২৫ সেন্ট হিসেবে ১০ হাজার বিটকয়েন দিয়ে দুই স্লাইস পিজ্জা কিনেছিল। আজকের বাজারে সেই দুই স্নাইস পিজ্জার দাম হবে ৩৮,০০০ গুণ ১০,০০০ = ৩৮ কোটি ডলার! মানব-ইতিহাসে এর চেয়ে বেশি দামে পিজ্জা কেন, কোনো খাবারই হয়তো কখনো কেনা হয়নি। গত ১০ বছরে দিনকে দিন অনেক বেশি মানুষ বিটকয়েনে আগ্রহী হয়েছে এবং বিটকয়েনের দামও বেড়েছে।

অর্থনীতির দুটি ধারা আছে: ১) আমাদের সবার পরিচিত, পঠিত, অধীত কিনসীয়ান ধারা এবং ২) অস্ট্রীয় ধারা। অস্ট্রীয় ধারার অর্থনীতিবিদদের দাবি, বিটকয়েন বা অনুরূপ একটি ডিজিটাল মুদ্রাকে একটি দেশের কিংবা সারা পৃথিবীর মুদ্রা করা যেতে পারে। শর্ত হচ্ছে, বিটকয়েনের মতো এই মুদ্রার সরবরাহ সব সময়ের জন্যে স্থির হতে হবে এবং মুদ্রাটি ক্ষুদ্রতর মুদ্রায় বিভাজ্য হতে হবে।

যে টাকা আমরা হরহামেশা ব্যবহার করি, তার নাম ‘ফিয়াট মানি’। প্রতিটি ফিয়াট মুদ্রার বিপরীতে (সাধারণত) ৩০ ভাগ স্বর্ণ বা বৈদেশিক মুদ্রা জমা/রিজার্ভ রাখার একটা বিধান এক সময় ছিল। ১৯৭১ সাল থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে এই বিধান বাতিল হয়েছে। এখন আমেরিকায় ‘ইন গড উই ট্রাস্ট’ এবং বাংলাদেশে ‘ইন সরকার উই ট্রাস্ট’ বলে আমরা ডলার কিংবা টাকার মতো ফিয়াট মানি নিশ্চিন্তমনে ব্যবহার করে চলেছি। কিন্তু নিঃশ্বাসের যেমন বিশ্বাস সেই, ফিয়াট মানিও তথৈবচ।

হিন্দিতে একটা প্রবাদ আছে: ‘মেরা কুত্তা কুত্তা, ঔর সাড্ডা কুত্তা জনি!’– অর্থাৎ আমি গরীব বলে আমার কুকুরকে তুচ্ছার্থক ‘কুত্তা’ বলে ডাকা হবে, আর তুমি বড়লোক বলে তোমার কুকুরের (ইংরেজি) নাম হবে ‘জনি’। ফিয়াট মানি বা সরকারের কাগুজে টাকার ওপর আমরা এত ভরসা করে আসছি গত ছয় দশক ধরে সেটা শুধু সরকার চালু করেছে বলে। পক্ষান্তরে সরকার নয়, জনগণ বিটকয়েন বা ক্রিপ্টোমুদ্রা চালু করেছে।

হিন্দু ধর্মে বলা হয়: ‘মানলে ভগবান, না মানলে শিলা’। জনগণ মেনে নিচ্ছে বলেই নিব দিয়ে কালি বেরুনো একটি লিখন যন্ত্রের নাম আগে ছিল ‘লেখনি’, এখন কলম। ঐতিহাসিক কারণে জনগণ মানছে না বলেই মিশরীয় দেবতা ‘রা’ কিংবা ‘আনুবিস’ মিশরে তাদের দেবত্ব হারিয়েছে। জনগণ মেনে নিলে যদি যেকোনো বস্তু ‘মুদ্রা’ বলে বিবেচিত হতে পারে, তবে বিটকয়েন বা গুপ্তমুদ্রার ক্ষেত্রে কেন তা হবে না? এক যাত্রায় কেন পৃথক ফল হবে?

কাগুজে টাকা বা ফিয়াট মানির একটি দোষও বিটকয়েনে নেই। ফিয়াট মানির তুলনায় স্বর্ণমুদ্রা উন্নততর বটে কিন্তু চন্দ্রেও কলঙ্ক আছে এবং স্বর্ণমুদ্রারও কমপক্ষে দুটি দোষ আছে: প্রথমত, স্বর্ণের ওজন আছে এবং দ্বিতীয়ত প্রতি এক দশক পর পর (স্বর্ণের সরবরাহ প্রতি বছর ২% হাড়ে বাড়ার কারণে) স্বর্ণমুদ্রার মূল্যও কমপক্ষে ২০ ভাগ কমে যাবার কথা। এই দুই দোষের একটিও ডিজিটাল মুদ্রায় নেই।

রাইপাথর, পুঁতি, ঝিনুক, লবণ, তামা, রূপা, স্বর্ণ, কাগজের টাকা... ইতিহাসের বিভিন্ন বাঁকে যত রকম টাকার সঙ্গে মানুষের পরিচয় হয়েছে, তার মধ্যে কোনোটিই অর্থের চারটি ভূমিকা (১. বিনিময়ের একক, ২. মূল্যের একক, ৩. মূল্যের আধার এবং ৪. সঞ্চয়ের বাহন) গুপ্তমুদ্রার চেয়ে ভালোভাবে পালন করতে পারে না। অস্ট্রীয় ধারার অর্থনীতিবিদদের দাবি যদি সত্য হয়, সমাজে ফিয়াট মানির পরিবর্তে গুপ্তমুদ্রা চালু হলে মানুষ তার পরিশ্রমের ফসল উত্তরপুরুষের হাতে দিয়ে যেতে পারবে, যার ফলে পরবর্তী প্রজন্মের লোকজন পূর্ববর্তী প্রজন্মের তুলনায় সুখে দিন কাটাবে। সমাজে উত্তরোত্তর অর্থনৈতিক উন্নতির কারণে সসীম ডিজিটাল মুদ্রার দাম তথা এর ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে বৈ কমবে না। এমন অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে মানুষ বিলম্বিত ভোগে আগ্রহী হবে এবং সঞ্চয় করে মূলধন গঠন করবে। সে ভাববে, ভবিষ্যতে মুদ্রার দাম বাড়লে একই মুদ্রা দিয়ে সে কিংবা তার উত্তরপুরুষ আরও বেশি ভোগ করতে পারবে। সমাজে কার্যকর মূলধন গঠনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মনে ইতিবাচক মূল্যবোধও গড়ে উঠবে না কি?

বিটকয়েন অপরাধ জগতের মুদ্রা হিসেবে ব্যবহৃত হয়– এমন একটি অভিযোগ আছে। বিটকয়েন বাজারে আসার আগেও অপরাধ হতো এবং বিটকয়েন আসার পর অপরাধ বেড়ে গেছে, এমন কোনো প্রমাণ নেই। বিটকয়েন লেনদেনের সব তথ্য এমনভাবে ব্লকচেইনে লিপিবদ্ধ থাকে যে কে, কাকে, কখন, কত টাকা দিয়েছে, সেটা কর্তৃপক্ষ ইচ্ছে করলেই জানতে পারে এবং বিটকয়েনের তথ্য যেহেতু ব্লকচেইনে লিপিবদ্ধ থাকে, সেহেতু ওইসব তথ্য আজীবন মোছা বা পরিবর্তন করা যায় না। কোন বুদ্ধিমান অপরাধী এমন ঝুঁকি নিতে চাইবে?

এর প্রমাণ, ডার্কওয়েব বা কৃষ্ণজালভিত্তিক ওয়েব সাইট ‘সিল্ক রোড’ ২০১১ সাল থেকে ড্রাগের ব্যবসা চালাচ্ছিল বিটকয়েন দিয়ে। বিটকয়েনে লেনদেন হবার কারণে মার্কিন প্রশাসনের পক্ষে ২০১৩ সালে এই ওয়েবসাইটের পরিচালকদের গ্রেপ্তার করে ওয়েবসাইটটি বন্ধ করা সম্ভব হয়েছিল। ২০২০ সালে তাদের কমবেশি ৭০ হাজার বিটকয়েন বাজেয়াপ্ত করা সম্ভবপর হয়েছিল, যার মূল্য ছিল ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

একটি আধুনিক বাংলা গান আছে: ‘আজ দুজনে মন্দ হলে মন্দ কী?’ যুদ্ধ কিংবা মন্দার সময় মন্দ সরকারগুলো দেদার কাগুজে টাকা ছাপিয়ে অবস্থা সামাল দিতে চেষ্টা করে। সরকারের এই অপচেষ্টার ফলে পরিমাণ বেড়ে গিয়ে টাকার দাম কমে যায়। ক্রিপ্টোমুদ্রা ইচ্ছামতো তৈরি করা যায় না, সুতরাং বাজারে/সমাজে ক্রিপ্টোমুদ্রা চালু থাকলে যুদ্ধের সম্ভাবনা, নিদেনপক্ষে যুদ্ধের ব্যাপ্তি কমে যাবে। বিংশ শতকে যুদ্ধগুলো অনেক সময় কয়েক দশক স্থায়ী হতে পেরেছিল অনেকটাই ফিয়াট মানির কারণে। অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতকের স্বর্ণমুদ্রার যুগেও যুদ্ধ শুরু হলে, যুদ্ধরত দেশগুলো স্বর্ণমুদ্রা থেকে কাগজের মুদ্রায় ফেরত যেত শ্রেফ যুদ্ধের খরচ যোগানোর জন্য, যেমন করেছিল ইংল্যান্ড নেপোলিয়নের সঙ্গে যুদ্ধের সময়।

ক্রিপ্টোমুদ্রানির্ভর অর্থনীতি ফিয়াট মুদ্রানির্ভর অর্থনীতির তুলনায় উন্নততর হবে– এমনটা আশা করাই যায়। এই নতুন অর্থনীতিতে যুদ্ধ ও মন্দার সম্ভাবনা কমে যাবে, সঞ্চয় ও মূলধন বাড়বে, টাকার অবমূল্যায়ন হবে না, সরকারগুলো যথেচ্ছ আচরণ করতে পারবে না। ভোগবাসনা বিলম্বিত করে মানুষ ভবিষ্যতের প্রতি আগ্রহী উঠবে, কিন্তু বর্তমানকেও অবজ্ঞা করবে না। ইতিবাচক অর্থনীতির প্রভাবে মানুষের জীবনও ইতিবাচক ও সুখকর হয়ে উঠবে– এমনটা আশা করাই যায়।