বাংলা কি-বোর্ড জটিলতা: উড়িয়ে ধ্বজা অভ্রভেদী রথে

মেহদীকে আমি কখনো দেখিনি। চিনিও না। কিন্তু তার তৈরি সফটওয়্যারটি ব্যবহার করে লেখার সময় প্রতিবার যখন দেখি ‘ভাষা হোক উন্মুক্ত’ স্লোগানটি, তখন আমার মন ভরে যায়।

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 19 Jan 2023, 01:25 PM
Updated : 19 Jan 2023, 01:25 PM

আমার বয়স এখন চৌষট্টি । আমরা সেই প্রজন্মের মানুষ যখন দোয়াতের কালি আর কলমই ছিল ভরসা। প্রাইমারি ক্লাসে ছিল খড়ি-চক স্লেট, আর পরে পেন্সিল। সবশেষে কলমে উন্নতি। তাও আবার প্রথম যুগে ফাউন্টেইন পেন, পরে বলপয়েন্ট পেন। এখন এই ওয়ান টাইম বলপয়েন্ট কলমেও অনেকে আর লিখেন না। আমি যখন সিডনি এসে থিতু  হই তখন আমার লেখালেখির বড় চ্যালেঞ্জ ছিল কাগজ-কলম আর ফ্যাক্সের খরচ জোগানো। দিস্তা দিস্তা কাগজ লাগতো। সবাই যখন বিদেশে বড় টিভি সেট, দামী গাড়ি কিনতে ব্যস্ত তখন আমি তিনখানা ফ্যাক্স মেশিন কিনে ফেলেছিলাম। যাতে আমার লেখা পাঠানোর কাজ হয়।

এরপর এলো ইমেইল ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের যুগ। আমার স্ত্রী দীপা এসব বিষয় ভালো বোঝে। আমি সবসময় বলি সে প্রকৌশলী হলেই ভালো করতো। সেই আমার ফেইসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়েছিল। তারপর শুরু হলো বিপত্তি। রোমান হরফে টাইপ করি বটে মানুষ তার কিছুই বুঝতো না। পারতো না পাঠোদ্ধার করতে ।

আমার কিছু বিজ্ঞ বন্ধু আছে সারা দুনিয়ায় । তাদের একজন ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন। কানাডা প্রবাসী রিটনের সাথে প্রায়ই কথা হয় আমার। সেই মূলত আমাকে একরকম বাধ্য করে বাংলা টাইপ শিখতে। তার একটাই কথা ছিল তখন, দোস্ত তুমি পারবা। অভ্র ডাউনলোড করো, তারপর শুরু করো। বলাবাহুল্য, এর আগে যে কি-বোর্ডে চেষ্টা করেছিলাম, তা যেমন ছিল কষ্টসাধ্য তেমনি জটিল। অভ্র ডাউনলোডের পর থেকে আমাকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। বলতে গেলে বিখ্যাত ছড়াকার রিটনের চাইতেও বেশি লেখা পোস্ট করি আমি, যার কারণ ‘অভ্র’।

‘অভ্র’ নিয়ে লেখার কারণ আপনারা সবাই জানেন। বিটিআরসির নির্দেশনা অনুযায়ী সব অ্যান্ড্রয়েড স্মার্টফোনে বিজয় কি-বোর্ড ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা এসেছে সম্প্রতি। এ সংক্রান্ত বিষয়ে আমদানি করা ও স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত সব অ্যান্ড্রয়েড ফোনে বিজয় অ্যান্ড্রয়েড এপিকে ফাইল ব্যবহারের লক্ষ্যে কমিশনের স্পেকট্রাম বিভাগ থেকে বিনামূল্যে বিজয় অ্যান্ড্রয়েড এপিকে ফাইল সরবরাহ করা হবে বলে জানানো হয়েছে। আরও বলা হয়েছে, স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ও বিদেশ থেকে আমদানিকৃত সব অ্যান্ড্রয়েড স্মার্টফোন কমিশন থেকে বাজারজাতকরণের অনুমতি গ্রহণের পূর্বে বিজয় অ্যান্ড্রয়েড এপিকে ফাইল ইনস্টল করে কমিশনে তা প্রদর্শন করতে হবে। তা না হলে বাজারজাতকরণের অনাপত্তি দেওয়া হবে না। স্পষ্টতই বিজয়কে পপুলার করার এটা একটা সরকারি চেষ্টা বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। এক সময় বাংলা লেখায় অপরিহার্য বিজয় কি-বোর্ড এর বদলে দিনদিন তরুণ প্রজন্মের কাছে ‘অভ্র’ জনপ্রিয় হয়ে উঠছিল। বিশেষ করে ‘অভ্র’ ফোনেটিকস এর সুবিধার কথা না বললেই নয়। টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তফা জব্বার অবশ্য শুরু থেকেই রোমান হরফে বাংলা লেখার ব্যাপারে ফেইসবুকে খুব সোচ্চার। কিন্তু তার এই আলোচনায় তরুণ প্রজন্মকে কেবল হাসাহাসি করতেই দেখেছি।

যতটা বিদেশ বসে ইন্টারনেট ঘেঁটে বুঝেছি মানুষের মনে মানুষের মগজে আর হাতের আঙুলে জায়গা করে নিয়েছে চিকিৎসক মেহদী হাসান খান এর অভ্র। তার সম্পর্কে নতুন কিছু বলার নেই। নিচে তার কাজ ও অভ্র আবিস্কারের যে ঘটনা তুলে ধরলাম তার সুত্র বিভিন্ন লেখায় উঠে আসা অভ্র ও তার জনকের কাহিনি। এই উদ্ধৃত অংশের জন্য কুম্ভিলক বৃত্তির দায় নিতে রাজী নয় এই লেখাটি।

অভ্র-র আবিষ্কারক মেহেদী হাসান ২০০৩ সালে বাংলা একাডেমির বইমেলায় বাংলা ইনভেনশ থ্রু ওপেন সোর্স, সংক্ষেপে বায়োস একটি সংগঠন অংশ নিয়েছিল। এই সংগঠনের সদস্যরা মেলায় উপস্থাপন করেছিল বাংলা লিনাক্স। এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল কম্পিউটারে বাংলা লেখাসহ টাইটেল মেনু ও ট্যাবের নামকরণ বাংলা। ওই সিস্টেমটি নজর কাড়ে সবার, পরিচিতি পায় বায়োস।

সেদিন সেই প্রদর্শনীর একজন দর্শনার্থী ছিলেন তরুণ মেহেদী। বায়োসের প্রদর্শনী দেখে তার মাথায় আসে এক অন্যরকম চিন্তা। কিভাবে এমন একটি সহজ সমাধান বের করা যায় যার মাধ্যমে কম্পিউটারে কোন ঝামেলা ছাড়াই বাংলা লেখা যাবে। ২০০৩-এর বইমেলার সেই তরুণ ২০১৪ সালে অভ্র সফটওয়্যার তৈরি করে ফেলেন। তখন তিনি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের ছাত্র।

অভ্র তৈরিতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে মেহেদীকে। তার কম্পিউটারটি উইন্ডোজ বেজড হওয়ায় লিনাক্সে কাজ করা কঠিন হয়ে ওঠে। বাংলা লিনাক্সের ওই ফন্টটি ইনস্টল করেন তিনি। এসময়ই মেহেদী দেখলেন মাইক্রোসফট ওয়ার্ডের কিবোর্ডের ইনসার্ট ক্যারেক্টার ব্যবহার করে বাংলার ফন্ট ভালোভাবে ব্যবহার করা যায় বটে, কিন্তু এর মতো বিড়ম্বনা আর হয় না। আর যুক্তাক্ষর লেখা তো প্রায় অসম্ভব।  

এবার তিনি ভাবলেন, একটি কি-বোর্ড এ সমস্যার সমাধান দিতে পারে। তিনি ভেবেছিলেন, কোথাও থেকে একটি কি-বোর্ড নামিয়ে নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু তা আর হলো না। তিনি বুঝতে পারলেন, এমন কি-বোর্ড পেতে হলে তাকে কি-বোর্ড তৈরি করতে হবে। সেই থেকেই তিনি অভ্র তৈরিতে উদ্যোগী হলেন।

‘অভ্র’-এর যাত্রা শুরুতে মেহদী একা থাকলেও শেষে ধাপে ধাপে যুক্ত হয়েছেন অনেকেই, তৈরি হয়েছিলো অভ্র টিম। অভ্র-র ম্যাক ভার্সন প্রস্তুতকারী রিফাত উন নবী, অভ্র-র কালপুরুষ ও সিয়াম রুপালী ফন্টের জনক সিয়াম, অভ্র-র বর্তমান ওয়েবসাইট ও লিনাক্স ভার্সন প্রস্তুতকারী সারিম, ভারতের নিপন এবং মেহেদীর সহধর্মিনী সুমাইয়া নাজমুনসহ অনেকের কষ্টের ফসল আজকের অভ্র।

আমরা এমন এক দেশ ও সমাজের মানুষ যেখানে কেউ কাউকে সম্মান করি না। এ লেখা যখন লিখছি, তখন পাঠ্য বইয়ের ভুলভ্রান্তির দায়ে জাতি হামলে পড়েছে মুহম্মদ জাফর ইকবালের ওপর। যেন সব দোষ তার! অন্যদিকে অভ্র- এর জয়রথ থামানোর চেষ্টা যদি ফলবতী হয়তো, আমরা হারাবো মেহদী হাসানের মতো প্রতিভাবান তরুণের জয়গাথা। মেহদীকে আমি কখনো দেখিনি। চিনিও না। কিন্তু তার তৈরি সফটওয়্যারটি ব্যবহার করে লেখার সময় প্রতিবার যখন দেখি ‘ভাষা হোক উন্মুক্ত’ স্লোগানটি, তখন আমার মন ভরে যায়।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানে লিখেছেন, ‘উড়িয়ে ধ্বজা অভ্রভেদী রথে ঐ যে তিনি ঐ যে বাহির পথে ...’। অভ্রভেদী মেহদী হাসানের অভ্র বেঁচে থাকুক। মেহদী ও তার অভ্র হোক পুরস্কৃত।