পরিবেশ রক্ষায় ‘সিঙ্গেল ইউজ’ প্লাস্টিকের ব্যবহার কমাতে হবে

‘রিডিউস, রিইউজ ও রিসাইকেল’— এই থ্রি আরের ওপর ভিত্তি করে টেকসই প্লাস্টিক ব্যবস্থাপনা নীতি গ্রহণ একটি কার্যকরী সমাধান হতে পারে।

গাজী তাওহীদ আহমেদগাজী তাওহীদ আহমেদ
Published : 5 June 2023, 01:32 PM
Updated : 5 June 2023, 01:32 PM

ঢাকা শহরের একজন বাসিন্দা ২০০৫ সালে বছরে ব্যবহার করতেন ৫.৫৬ কেজি প্লাস্টিক, যা ২০১৭ সালে এসে দাঁড়ায় ১৭.২৪ কেজিতে, অর্থাৎ একজন ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্লাস্টিকের ব্যবহার তিনগুণেরও বেশি বেড়েছে এই সময়ের ব্যবধানে। এটি ২০১৭ সালের একটি সমীক্ষার ফল। অনুমান করা যায়, বিগত কয়েক বছরে প্লাস্টিক ব্যবহারের এই পরিমাণটি কমার কোনো কারণ ঘটেনি।

সন্দেহাতীতভাবে বেড়েছে প্লাস্টিকের ব্যবহার। যদিও এর মধ্যেই আমরা দেখেছি, প্লা‌স্টিকের ব্যবহার কমাতে বিকল্প পণ্য সহজলভ্য করার আহ্বান শুনেছি বারবার। সরকারি অফিসে সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধে নির্দেশনা জারির কথা জেনেছি। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ অধিশাখা-১ থেকে চিঠি দিয়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়সহ জেলার সব সরকারি অফিস, বিশেষ করে উপকূলীয় এলাকায় সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করা হয়েছে। এছাড়াও, প্লাস্টিক ও পলিথিন দূষণ রোধকল্পে মাসিক সভা ও অংশীজনদের নিয়ে নিয়মিত আলোচনা সভা এবং  জনসচেতনতা বৃদ্ধির কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে। কিন্তু কোথাও এই সব কার্যক্রম বাস্তবায়ন হতে খুব একটা শুনিনি।

আধুনিক সময়ে আমাদের ব্যবহার্য উপকরণের একটি বড় অংশই তৈরি হয় প্লাস্টিক দিয়ে। কাঁচাবাজার কিংবা মুদিপণ্য কেনার ক্ষেত্রে হরহামেশাই ব্যবহৃত হচ্ছে পলিথিন ব্যাগ। অর্ডার করা খাবার আসছে প্লাস্টিকের প্যাকেটে, সঙ্গে থাকছে প্লাস্টিকের চামচ কিংবা স্ট্র। অফিসে বা বাইরে খাওয়াদাওয়ার ক্ষেত্রে প্রাধান্য পাচ্ছে প্লাস্টিকের ওয়ানটাইম প্লেট-গ্লাস। আপাতদৃষ্টিতে এগুলো স্বাভাবিক মনে হলেও, পরিবেশের ওপর প্লাস্টিকের প্রভাব খুবই মারাত্মক। পরিবেশ বিপর্যয় বর্তমানে এমন এক বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, যেখানে প্লাস্টিকের ব্যবহার কমিয়ে আনার কোনো বিকল্প নেই আমাদের সামনে।

প্রতিদিন আমরা বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিক ব্যবহার করি। তবে পরিবেশের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক। সব প্লাস্টিকই সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক নয়। প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহারের পর আবার ব্যবহারের জন্য সংরক্ষণ করা গেলে কিংবা সংরক্ষণের পর রিসাইকেল করে একই ধরনের প্লাস্টিক পণ্য বা অন্য কোনো ধরনের পণ্য তৈরি সম্ভব হলে তাকে সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক বলা হবে না। প্লাস্টিককে সিঙ্গেল ইউজ তখনই বলা হয়, যখন এটি আবার অন্য পণ্যের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহারের অবস্থাতে থাকে না। আমাদের ব্যবহৃত প্লাস্টিক পণ্যের বেশির ভাগই সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক।

প্লাস্টিকে তৈরি দ্রব্য বা পণ্য সচারচর মাত্র একবার ব্যবহার করে ফেলে দিয়ে থাকি আমরা। এই সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক আমাদের ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে সামগ্রিক পরিবেশকে মহাবিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অরগানেইজেশন (ইএসডিও) পরিচালিত ২০১৯ সালের এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৮৭ হাজার টন সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয়। এসব প্লাস্টিকের ৯৬ শতাংশই আসে খাবার আর ব্যক্তিগত প্রসাধনী পণ্য থেকে। ইউএনইপি-এর (ইউএন এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রাম) হিসেব অনুযায়ী, এর প্রায় ৭৩ হাজার টন প্লাস্টিকই পদ্মা, মেঘনা, ব্রহ্মপুত্রের মতো প্রধান নদীগুলোকে দূষিত করে শেষে বঙ্গোপসাগরে জমা হচ্ছে। এই তথ্য নিঃসন্দেহে ভয়ঙ্কর।

গ্রাম-শহর, নগর-মহানগর, বন-পাহাড়, নালা-নদী, সাগর-মহাসাগর হয়ে প্লাস্টিক বিপন্ন করে তুলছে সারা বিশ্বকে। বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে তাই এ বছর বিশ্ব পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘সলিউশনস টু প্লাস্টিক পলুশন’। আজ বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে দিবসটি। ১৯৭২ সালে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচি (ইউএনইপি) প্রতিবছর সারা বিশ্বে ৫ জুন ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’ হিসেবে পালন করে। পরিবেশ বিষয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোই দিবসটির পালনের উদ্দেশ্য।

ইউরোপিয়ান কমিশন ১০ ধরনের সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক পণ্যের একটি তালিকা করেছে। সেগুলো হলো, কটনবাড স্টিক (আমরা কান পরিষ্কার করার জন্য যে ‘কটন বাড’ ব্যবহার করি), প্লাস্টিকের ছুরি, চামচ, প্লেট, গ্লাস, স্টারার (যেমন কফি নাড়ার ছোট স্টিক), বেলুন এবং এর সঙ্গে যদি কোনো কাঠি থাকে সেটিও, খাবারের মোড়ক (কন্টেইনার বা প্যাকেট), তরলপানীয়ের কাপ, তরলপানীয়ের কন্টেইনার, প্লাস্টিকের ব্যাগ, মোড়ক/ প্যাকেট, স্যানিটারি আইটেম।

ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা বিবেচনা করে প্লাস্টিক দূষণ কমিয়ে আনতে আমাদেরকে একযোগে কাজ করতে হবে। সকল পর্যায়ে প্লাস্টিক দূষণ প্রতিরোধে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। রেস্তোরাঁগুলোতে বায়োডিগ্রেডেবল এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক ব্যবহার করতে হবে। ‘রিডিউস, রিইউজ ও রিসাইকেল’— এই থ্রি আরের ওপর ভিত্তি করে টেকসই প্লাস্টিক ব্যবস্থাপনা নীতি গ্রহণ একটি কার্যকরী সমাধান হতে পারে।পরিবেশ বিপর্যয় রোধে আমাদেরকে এখন থেকেই সচেতন হতে হবে। আর এই লক্ষ্যে ২০২৫ সালের মধ্যে প্লাস্টিকের ব্যবহার ৫০ শতাংশ কমিয়ে আনা ও ২০২৬ সালের মধ্যে সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকের ব্যবহার ৯০ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে আনার যে লক্ষ্যমাত্রা বিশ্ব ব্যাংক নির্ধারণ করেছে, তার সঙ্গে একাত্মতা পোষণ আমাদের জন্য হতে পারে সময়োপযোগী ও সেরা সিদ্ধান্ত।