যুদ্ধাহতের ভাষ্য-১১৪: হাকিমের শহীদ হবার খবরটি আজও জানে না পরিবার!

হাকিমের শহীদ হওয়ার খবরটি পরিবার জানে কিনা এখনও জানি না! একাত্তরে দেশের জন্য শহীদ এমন অনেক যোদ্ধার খবরই জানে না তার পরিবার।

সালেক খোকনসালেক খোকন
Published : 21 Sept 2022, 11:30 AM
Updated : 21 Sept 2022, 11:30 AM

“বাজারেই তখন মানুষের আড্ডা জমত। আমরা আড্ডা দিতাম রাজা চাপিতলা বাজারে। টেইলরের একটি দোকান ছিল সেখানে। টেইলর মালিককে সবাই ডাকত মতি খলিফা। তাকে আমরা ডাকতাম মতি ভাই। বঙ্গবন্ধুর খুব ভক্ত ছিলেন তিনি। সবসময় দোকানে তার ছবি টাঙিয়ে রাখতেন। স্কুলে যেতে হতো বাজার হয়েই। ফেরার পথে তার দোকানে ঢুকতাম। একদিন না গেলে পরদিনই ডাক দিয়ে মতি ভাই বলতেন, দোকানে আয়।”

কেন যেতেন?

“শেখ মুজিবকে নিয়ে সকল খবরই থাকত তার কাছে। গল্পের মতো করে তিনি সেগুলো আমাদের বলতেন। আমরাও মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনতাম। ফলে ছোটবেলা থেকেই শেখ মুজিবের একটি ছবি আঁকা হয়ে যায় মনপটে।

ক্লাস সেভেনে পড়ি তখন। শেখ মুজিব আসবেন পাশের থানায়, দেবীদ্বারে। বড় ধরনের একটা মিটিং হবে। সঙ্গে আসবেন মতিয়া চৌধুরী। তাকে সবাই ডাকে ‘অগ্নিকন্যা’ বলে। মিটিং নিয়ে সবার মধ্যে সে কি উত্তেজনা। তখন মতি ভাই জরুরী খবর পাঠালেন। দেখা করতেই বললেন, ‘মিটিংয়ে যাব কালকে। তোরা চলে আসিস’।

প্রবল আগ্রহ আর আনন্দ নিয়ে মিটিংয়ে যাই আমরা। ওইদিনই সরাসরি ও প্রথম দেখি শেখ মুজিবুর রহমানকে। তার ভাষণ শুনেই বিমোহিত ও উদ্দীপ্ত হই। অগ্নিকন্যার বক্তব্যও মনে দাগ কাটে। ফলে ছাত্রাবস্থাতেই দেশের জন্য কিছু করার বোধটা তৈরি হতে থাকে।

ঊনসত্তরের আন্দোলন তখন তুঙ্গে। দেশ ও বঙ্গবন্ধুর আন্দোলন নিয়ে নানা খবরাখবর জানতাম। গ্রামে ইত্তেফাক পত্রিকা আসত। বাজারে বসে পত্রিকায় আন্দোলনের নানা খবর পড়তাম। খালেক সাহেব ছিলেন গ্রামের শিক্ষিত লোক। তার মুখেও শুনেছি বৈষম্যের নানা খবর। আর মতি খলিফা বাজারে বসেই আন্দোলন-সংগ্রামের খবর জানিয়ে দেশের জন্য কাজ করতে উৎসাহিত করতে থাকেন সবাইকে।

১৯৭০ সালে নির্বাচন হয়। গ্রাম পর্যায়ে ছিলাম আমরা। ওখানে আন্দোলন হতো না। নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়ে বিজয়ী হয় আওয়ামী লীগ। এ খবর পেয়ে আমরা তখন গ্রামেই বিজয় মিছিল বের করেছি। মনে হয়েছে এরপর আর কোনো সমস্যা থাকবে না। কিন্তু সেটা তো হলো না।

খবর আসে পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে ক্ষমতা না দিয়ে নানা ষড়যন্ত্র করছে। হাট-বাজারের চায়ের দোকানে এ নিয়ে ওঠে আলোচনার ঝড়। এত ভোট পাওয়ার পরও বঙ্গবন্ধুকে ওরা ক্ষমতা দেবে না! এটা অন্যায়। এ অন্যায়ের শক্ত জবাব দিতে হবে। পুরো দেশের মানুষের বুকে চাপা ক্ষোভ তৈরি হতে থাকে। ভেতরে ভেতরে সবাই সশস্ত্র সংগ্রামের জন্যও তৈরি হতে থাকে।

কিন্তু সবাই অপেক্ষায় নেতার নির্দেশের। বঙ্গবন্ধু সেই নির্দেশটিই দেন ৭ মার্চ ১৯৭১ তারিখে, ঢাকায় রেসকোর্স ময়দানে। ওই ভাষণ আমরা শুনি পরদিন, রেডিওতে। তিনি বললেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবো। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ্। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ আমাদের কাছে ওটাই ছিল নেতার শেষ নির্দেশনা, স্বাধীনতার স্পষ্ট ঘোষণা। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ বুকে নিয়েই আমরা মুক্তিযুদ্ধে যাই।”

মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার নানা প্রেক্ষাপটের কথা এভাবেই তুলে ধরেন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আব্দুল হাকিম। এক বিকেলে তার বাড়িতে বসেই আলাপ হয় মুক্তিযুদ্ধের নানা ঘটনা প্রসঙ্গে।

আব্দুল সোবহান ও জোবেদা খাতুনের বড় সন্তান আব্দুল হাকিম। বাড়ি কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর উপজেলার রাজা চাপিতলা গ্রামে। লেখাপড়ায় হাতেখড়ি রাজা চাপিতলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। অতঃপর ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন বাঙ্গরা উমালোচন (ইউএল) হাই স্কুলে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন ওই স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র।

২৫ মার্চ ১৯৭১। ঢাকায় শুরু হয় গণহত্যা। সেখানে যারা চাকরি করতেন তারা দলে দলে পালিয়ে চলে যান গ্রামের দিকে। হাকিমদের গ্রামেও ফিরে আসেন অনেকেই। কেউ কেউ পরিবারসহ হেঁটেই জীবন নিয়ে বহুকষ্টে পালিয়ে আসেন। খবর পেয়ে হাকিমরা ছুটে যান বাড়ি বাড়ি। সবার চোখেমুখে দেখেন ভয়ের ছাপ। যেন মৃত্যুকূপ থেকে ফিরে এসেছেন। হেঁটে আসায় কারও কারও পা ফুলে গেছে। তাদের মুখেই শোনেন গণহত্যার খবর। সবার মুখে একই কথা– ঢাকার কেউই বেঁচে নেই। সবাইকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে পাকিস্তানি সেনারা। শুনে ঠিক থাকতে পারেন না হাকিমরা। তাদের কিশোর মনে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। বন্ধুরা মিলে নানা বিষয়ে আলোচনা করেন। অতঃপর সিদ্ধান্ত নেন যুদ্ধে যাওয়ার।

কীভাবে গেলেন তারা?

আব্দুল হাকিমের ভাষায়, “একবার খবর পাই ভারতে মুক্তিবাহিনী তৈরি করা হচ্ছে। কিন্তু কোথায় যাব– বুঝে উঠতে পারি না। বন্ধু জয়দুল হোসেন, আমাদের থেকে এক বা দেড় বছরের সিনিয়র। সে প্রস্তাব করে, ‘আগে ভারতে ঢুকি। ওখানেই খোঁজ পাব’। তার কথায় নির্ভর করেই ঘর ছাড়ি তিনজন– ফিরোজ আহম্মেদ, জয়দুল হোসেন ও আমি। এক বিকেলে কাউকে কিছু না বলেই চলে যাই। সঙ্গে ছিল পাকিস্তানি ৪-৫ টাকা। অন্যরাও অল্প কিছু টাকা নিয়ে নেয়। খুব স্বচ্ছল ছিলাম না আমরা। তাই জামা কাপড়ও নিতে পারি নাই। বাড়ি থেকে ১০-১২ মাইল পূর্বদিকে ভারতীয় বর্ডার, সেখানেই সিদরাই গ্রাম। ওই গ্রামে এক আত্মীয়র বাড়িতে রাত কাটাই।

ওই পথেই দলে দলে হিন্দুরা চলে যাচ্ছিল ভারতের দিকে। পরদিন ভোরে কোনাবন বর্ডার দিয়ে আমরাও ঢুকি ভারতে। জঙ্গলের মতো একটা জায়গা ছিল, সেখানে দুটি তাবু গাড়া। এক দোকানদারকে বলতেই দেখিয়ে দেন রিক্রুটিং ক্যাম্পটি। ওই ক্যাম্পেই প্রথম নাম লেখাই।”

হাকিমদের সেখানে বিকাল পর্যন্ত রেখে গাড়িতে করে পাঠিয়ে দেওয়া হয় দেবীপুর ট্রানজিট ক্যাম্পে। সেখান থেকে আর্মির ট্রাকে করে নিয়ে যাওয়া হয় কাঠালিয়া ট্রেনিং ক্যাম্পে।

এরপর কী ঘটল? ওই ইতিহাস শুনি হাকিমের মুখে।

“কাঠালিয়ায় নেমে ছেনা দিয়ে জঙ্গল পরিষ্কার করে আমরা ক্যাম্প তৈরি করে নিই। ৪০-৪৫ জনের মতো ছিলাম তখন। শোয়ার জন্য তৈরি করা হয় বাঁশের ছোট ছোট মাচা, কারণ ওখানে একপ্রকার জোক ছিল। রাত হলেই ওরা দলেদলে বের হতো। কয়েকদিন পরেই বিভিন্ন জায়গা থেকে ক্যাম্পে আসতে থাকে শত শত যুবক। সেখানে কিছুদিন চলে রাইফেলসহ সাধারণ ট্রেনিং। সাত রাউন্ড গুলি দেওয়া হয়। আমি সবগুলোই টার্গেটে লাগিয়েছিলাম। এরপর বাছাই করে আমাদের পাঠানো হয় হায়ার ট্রেনিংয়ে– ভারতের ওমপি নগরে। আমি ট্রেনিং করি আলফা কোম্পানিতে। জামান ভাই ছিলেন কমান্ডার। তিনি ভার্সিটির ছাত্র ছিলেন।

ট্রেনিং ক্যাম্পটি ছিল পাহাড়ের ওপর। ২৮ দিন ট্রেনিং হয় সেখানে। রাম খিলোরি সিং নামে এক ওস্তাদের কথা এখনও মনে আছে। খুবই আন্তরিক ছিলেন তিনি। এসএমজি, এলএমজি, স্টেনগান, মেশিনগান পর্যন্ত ট্রেনিং করি আমরা। এরপর শেখায় আর্টিলারি থ্রো, টু-ইঞ্চ মর্টার, থ্রি-ইঞ্চ মর্টার। ট্রেনিং শেষে আমাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় দুই নম্বর সেক্টরের হেড কোয়ার্টার, মেলাঘরে।”

মেলাঘরের দায়িত্বে তখন মেজর এ টি এম হায়দার। সেখান থেকেই অস্ত্র পান মুক্তিযোদ্ধা হাকিমরা। কিশোর বয়স ও ছোটখাট হওয়ায় তাকে দেওয়া হয় থ্রি নট থ্রি রাইফেল। এরপর তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় মতিনগর সাবসেক্টরের অপারেশন ক্যাম্পে। সেখানে ফোর বেঙ্গলের সিপাহিরা ছিল বেশি, যারা ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হয়ে ওই অঞ্চলে অবস্থান করছিল। জালাল ওস্তাদ, রহিম ওস্তাদ, নায়েক সুবেদার আফজাল সাহেবসহ অধিকাংশই ছিলেন ডিফেন্সের লোক। হাকিমরা এফএফ (ফ্রিডম ফাইটার) ছিলেন মাত্র বাইশ জনের মতো। ওই সাবসেক্টরের কমান্ড করতেন লেফটেন্যান্ট দিদারুল আলম (হাকিমরা বলতেন ডি আলম)।

মুক্তিযোদ্ধা হাকিমের ভাষায়, “এক রাতে অপারেশনের জন্য রওনা হই চৌদ্দগ্রামের মিয়ার বাজার এলাকায়। সেখানে একটি স্কুলে ছিল পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প। ওরা বাঙ্কার করে স্কুলের আশেপাশে। আমরাও রাতে এসে বিভিন্ন জায়গায় পজিশনে যাই। ১৭-১৮ জন ছিলাম– কেউ গাছের আড়ে, কেউ নিচুতে, কেউ ধানক্ষেতের আইলে। এসএলআরসহ অনেক গোলাবারুদও ছিল সঙ্গে। এই অপারেশনের কমান্ড করেন নায়েক সুবেদার আফজাল সাহেব।

খুব ভোর তখন। ক্যাম্পে ওদের মুভমেন্ট দেখছি। আফজাল সাহেব বললেন, ‘সবাই একসঙ্গে ফায়ার দিবে’। উনি ফায়ার ওপেন করার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের রাইফেলগুলোও গর্জে ওঠে। দেখলাম পাকিস্তানিদের ৪-৫ জন তখনই মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। প্রচণ্ড গোলাগুলি চলে দুই থেকে আড়াই ঘন্টা। হঠাৎ ওরা আর্টিলারি থ্রো করা শুরু করে। বিকট শব্দে আর্টিলারি এসে পড়ে চারপাশে। ফলে জায়গাগুলো গর্ত হয়ে যায়। স্প্লিন্টারও ছিটকে ছড়িয়ে যায় চারদিকে। তখন সবাই ভয় পেয়ে যাই।

পাশেই ছিলেন এক মুক্তিযোদ্ধা, আমার নামেই নাম, হাকিম। চোখের সামনে শহীদ হন। ব্রাশের গুলি লাগে তার পা ও তলপেটের নিচের অংশে। ফলে তলপেট যায় ফুটো হয়ে। কিছু মাংসও উড়ে যায়।

দেবীদ্বার কলেজের ছাত্র ছিল সে। বিকেলের দিকে গুলি ও আর্টিলারি কমে আসে। তখন ফিরোজসহ আমি ক্রলিং করে ওর পা টেনে পেছনে নিয়ে আসি। তখনও থেমে থেমে গুলি চলছিল। মাথা তুললেই মৃত্যু। তবুও সহযোদ্ধা হারানোর কষ্টটা শক্তিতে রূপ নিয়েছিল।

সন্ধ্যার দিকে বহুকষ্টে লাশটা নিয়ে আমরা মতিনগর ক্যাম্পে ফিরি। সেখানেই তাকে দাফন করা হয়। পরে তার পরিবারের খোঁজ করেছিলাম। কিন্তু তথ্য না থাকায় কাউকেই খুঁজে পাইনি। তার শহীদ হওয়ার খবরটি পরিবার জানে কিনা এখনও জানি না! একাত্তরে দেশের জন্য শহীদ এমন অনেক যোদ্ধার খবরই জানে না তার পরিবার।”

আব্দুল হাকিমরা এভাবেই মুক্তিযুদ্ধ করেন চৌদ্দগ্রামের জামবাড়ি, ঝাউলা পাড়া, বসন্তপুর, কুটিশ্বর প্রভৃতি এলাকায়। এক অপারেশনে রক্তাক্ত হন এই বীর যোদ্ধা।

কীভাবে?

তিনি তুলে ধরেন সেদিনের আদ্যোপান্ত। তার ভাষায়, “অগাস্টের শেষ দিকের ঘটনা। আমরা তখন অ্যাডভান্স হচ্ছি। চৌদ্দগ্রামের ঝাউলা পাড়ায় ওদের মুখোমুখি হই। সন্ধ্যায় বের হয়ে রাতেই ওখানে পজিশন নিই। রাত তিনটা বা চারটায় অ্যাম্বুশ করে বসে থাকি। খুব ভোরে দেখি ওরা এক বাঙ্কার থেকে অন্য বাঙ্কারে হাঁটাহাঁটি করছে। পরিষ্কার দেখে যায় ওদের মুভমেন্ট। তখনই ফায়ার ওপেন করি।

কয়েক ঘন্টা চলে তুমুল গোলাগুলি। সামনে একটা বড় গাছ। গাছটাকে আড় করে আমি লাইন পজিশনে। ফায়ার করছি। হঠাৎ বিকট শব্দে একটা শেল এসে পড়ে আমাদের ঠিক পেছনে, প্রায় ৫০ গজ দূরে। ওটা বার্স্ট হলে অসংখ্য স্প্লিন্টার চারপাশে ছিটকে যায়। কয়েকটা স্প্লিন্টার আমার ডান পায়ের গোড়ালি ও পিঠে বিদ্ধ হয়। মাটিতে পড়েই আমি ছটফট করি। ক্ষত জায়গায় রক্ত ঝরছিল। ভেবেছিলাম মরে যাব। এক সহযোদ্ধা আমাকে টেনে প্রথমে পেছনে এবং পরে ক্যাম্পে নিয়ে যায়। পা ও পিঠ থেকে স্প্লিন্টারগুলো বের করে ওয়াশ করে দেন ক্যাম্পেরই এক ডাক্তার। অসুস্থ ছিলাম পাঁচ-ছয়দিন। এরপরই আবার ফিরি রণাঙ্গণে। স্প্লিন্টারের আঘাতে গোড়ালির রগ কেটে গিয়েছিল। ফলে এখনও ঠিকভাবে হাঁটতে পারি না। তবে কোনো আফসোস নেই। স্বাধীন দেশ পেয়েছি। তাতেই আমি তৃপ্ত।”

সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকের কথা। হাকিমসহ চারজন চলে যান চুলুরিয়া গ্রামে। মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গ্রুপের ক্যাম্প ছিল সেখানে। ওই ক্যাম্পে তারাসহ ছিল ২৫-২৬ জন– কমান্ড করতেন মমিন সাহেব। অপারেশন বেশিরভাগ চলত রাতে। বর্ষাকাল তখন। নৌকা দিয়ে বিভিন্ন এলাকায় অপারেশন করে আবার ফিরে আসতেন হাকিমরা। এভাবেই তারা যুদ্ধ করেন মুরাদনগর থানার উত্তর ও দক্ষিণে কালিপুর বাজার, রামচন্দ্রপুর বাজার, মেঘডুবি, ঢামতি, ইলিশগঞ্জ প্রভৃতি এলাকায়।

রাজাকাররা মুক্তিকামী মানুষকে ধরিয়ে দিতো, বাড়ি-ঘরে আগুন দেওয়া আর নারীদের ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যেত। লুটপাট ও অত্যাচারও কম করেনি। এসব খবর পেলেই হাকিমরা অপারেশন করত। কোরবানপুরে রাজাকারদের ক্যাম্পে আক্রমণ চালায় তারা। আবু তাহের নামে নেতৃস্থানীয় নামকরা এক রাজাকার ছিল সেখানে। স্বাধীনতা লাভের পর আব্দুল হাকিম অস্ত্র জামা দেন নিজ থানায়, মুরাদনগরে। তখন থানা কমান্ডার ছিলেন কামরুল হাসান।

নিজ এলাকায় স্বাধীনতাবিরোধী ও রাজাকারদের সম্পর্কে এই সূর্যসন্তান বলেন, “গ্রামে নামকরা রাজাকার ছিল মাজেদুল ইসলাম ভূঁইয়া। কিন্তু পরে তাকে আমরা খুঁজে পাইনি। এছাড়া পাকিস্তানিদের পক্ষে কাজ করেছেন আব্দুল হালিম ভূঁইয়া ও কেরামত আলী। এরা গ্রামে খুব প্রতাপশালী ছিল, মুসলিম লীগ করত। মুক্তিযুদ্ধের সময় এরাই পাকিস্তানি সেনাদের গ্রামে ডেকে আনে। স্বাধীনতার পক্ষের মানুষদের বাড়ি চিনিয়ে দিয়ে নানাভাবে অত্যাচার করে। মূলত রাজাকার, আলবদর ও আলশামসদের কারণেই পাকিস্তানি সেনারা একাত্তরে এত ব্যাপক গণহত্যা ঘটাতে পেরেছিল।”

নয় মাসে দেশ স্বাধীন হওয়ার অন্তর্নিহিত কারণ তুলে ধরেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাকিম। তার ভাষায়, “আমরা চিন্তাও করিনি নয় মাসে দেশ স্বাধীন হবে। প্রথমত, দেশটা আমাদের। ওরা অন্য দেশ থেকে এসে যুদ্ধ করছে। রাস্তাঘাট সব আমাদের চেনা। সাধারণ মানুষও নানাভাবে সহযোগিতা করেছে প্রতিনিয়ত। ফলে গেরিলা আক্রমণ প্রতিহত করা পাকিস্তানি সেনাদের পক্ষে সহজ ছিল না। পরবর্তীতে আক্রমণে ভারত যুক্ত হলে স্বাধীনতা আনা আরও সহজ হয়েছে।”

তিনি আরও বলেন, “মুক্তিযুদ্ধে শিক্ষিত ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলেরা কম গেছে। অধিকাংশ ছিল অশিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত লোক। উচ্চবিত্ত শ্রেণির মানুষকেও কম পেয়েছি। অনেক সাধারণ মানুষ মুক্তিযোদ্ধাদের আর্মস-অ্যামুনেশনের বোঝা টেনে নিয়ে গেছে। জয় বাংলা স্লোগানই ছিল আমাদের শক্তি। ওই স্লোগানেই রক্ত গরম হয়ে যেত, উদীপ্ত হতাম প্রবলভাবে। কোনো অপারেশনে জিতলেই কণ্ঠ আকাশে তুলে জয় বাংলা বলতাম। বুকের ভেতর তখন অন্যরকম শক্তির সঞ্চার হতো। এ সবই মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিজয়কে সহজ করে দিয়েছিল।

স্বপ্নের বাংলাদেশ প্রসঙ্গে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা অকপটে বলেন, আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। কিন্তু স্বপ্নের সোনার বাংলা এখনও হয় নাই। দেশে দুর্নীতিবাজ লোকের অভাব নেই। ওদের কারণেই মানুষের যত কষ্ট। দুর্নীতি থাকলে দেশের উন্নতি কেমনে হবে? এটার একটা প্রতিকার হওয়া উচিত। তাই সুষ্ঠ নেতৃত্ব ও দুর্নীতিমুক্ত দেশ চাই।”

তবে প্রজন্মকে নিয়েই আশায় বুক বাঁধেন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আব্দুল হাকিম। তাদেরকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ও নির্মোহ ইতিহাস জানার এবং শহীদের আত্মত্যাগ ও বীরত্বকে নিজের ভেতর ধারণের অনুরোধ জানান। প্রজন্মের উদ্দেশে এই বীর বললেন শেষ কথাগুলো, “আমরা অনেক কষ্টে একটা স্বাধীন দেশ এনে দিয়েছি। আমাদের সময় তো শেষ। এই দেশটাকে এগিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব তোমাদের হাতেই দিয়ে গেলাম। দেশটাকে তোমরা ভালো রেখো।”

ছবি ও ভিডিও: সালেক খোকন