ধর্মাবতার মানবিক মর্যাদার কী হবে?

আমরা আশা করব বিচারক রুবাইয়া ইয়াসমিন অনুতপ্ত হবেন, নিজের ও তাঁর কন্যার ভুল শুধরে নেবেন এবং যে দু’জন সম্মানিত অভিভাবক ভয় পেয়ে তাঁর পা ধরে মাফ চেয়েছিলেন, তাঁদের কাছে তিনি করজোড়ে ক্ষমাপ্রার্থনা করবেন।

শেখ হাফিজুর রহমান কার্জনশেখ হাফিজুর রহমান কার্জন
Published : 25 March 2023, 09:32 AM
Updated : 25 March 2023, 09:32 AM

বিচারক যেহেতু ন্যায়বিচার করেন, সেজন্যে তাঁকে বলা হয় ধর্মাবতার। বিচারকের দিকে সারা দেশ, সারা বিশ্ব এবং বিচারপ্রার্থীরা তাকিয়ে থাকেন; কেননা, ন্যায়ের দণ্ড তাঁর হাতে। কিন্তু সেই বিচারক যদি নিজেই অবিচার করেন, অধর্ম করেন, নিজেই মানবিক মূল্যবোধ লঙ্ঘন করেন, তাহলে আমরা যাব কোথায়? একটি সমাজে মানুষ যাদের অনুসরণ করে মোটা দাগে তাঁরা হচ্ছেন শিক্ষক, বিচারক, চিকিৎসক এবং অসাম্প্রদায়িক, প্রাজ্ঞ ও মানবিক বোধসম্পন্ন ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতা। এঁদের মধ্যেও বিচারক ও শিক্ষকের রয়েছে উঁচু মর্যাদা। বিশেষ করে আমাদের বিচারিক ব্যবস্থায়, যেটি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের তৈরি এবং যেটি কমন ল’ সিস্টেমের অন্তর্ভুক্ত, একজন বিচারককে ‘ইওর অনার’, ‘মাই লর্ড’ (এটির সঙ্গে আমার দ্বিমত আছে) বা ধর্মাবতার বলে, সেখানে বিচারককে অত্যন্ত উচ্চ আসনে বসানো হয়েছে। আগেকার দিনে বাবা-মায়েরা তাদের ছেলেকে ‘জজ-ব্যারিস্টার’ বানানোর স্বপ্নে বিভোর থাকতেন। এখনও অনেক পরিবারে সেটি বহাল আছে। সেই উঁচু মর্যাদার একজন বিচারক বগুড়াতে যে কাণ্ড করে বসলেন, তাতে সাধারণ মানুষ যেমন হতাশ হয়েছে, তেমনি বিচারকদের ভাবমূর্তি হয়েছে প্রশ্নবিদ্ধ।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যাচ্ছে যে, বগুড়ার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ বেগম রুবাইয়া ইয়াসমিন বগুড়া সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের দুই ছাত্রীর মাকে বিদ্যালয়ে ডেকে এনে তাঁর পা ধরে মাফ চাইতে বাধ্য করেছেন। এ কারণে ওই বিচারককে ইতোমধ্যে বগুড়া থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। যে ঘটনার অবতারণা করা হয়েছে, সেটি এরকম— বগুড়া সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণিতে জজ রুবাইয়া ইয়াসমিনের মেয়ে পড়াশোনা করে। বিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে থাকে। গত ২০ মার্চ ওই বিচারকের মেয়ের শ্রেণিকক্ষ ঝাড়ু দেওয়ার কথা ছিল। তবে নিজেকে বিচারক তথা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার মেয়ে পরিচয় দিয়ে সে শ্রেণিকক্ষ ঝাড়ু দিতে অস্বীকার করে। এই নিয়ে তার অপর সহপাঠীদের সঙ্গে তাঁর বাগবিতণ্ডতা হয়। ওই রাতেই বিচারকের মেয়ে ফেসবুক মেসেঞ্জারে তার সহপাঠীদের বস্তির মেয়ে উল্লেখ করে পোস্ট দেয়। সে পোস্টে উল্লেখ করে, তোরা বস্তির মেয়ে। আমার মা সরকারি...। তোদের মায়েদের বল আমার মায়ের মতো .... হতে।

ওই পোস্টে বিচারকের মেয়ের চারজন সহপাঠী পাল্টা উত্তর দেয়। এই নিয়ে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রাবেয়া খাতুনকে অভিভাবকদের ডাকতে বলেন বিচারক রুবাইয়া ইয়াসমিন। ২১ মার্চ সকাল ১১টার দিকে প্রধান শিক্ষকের ডাকে ওই চার শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা বিদ্যালয়ে আসেন। ওই সময় সেই বিচারক শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার হুমকি দিয়ে তাঁদের জেলে  পাঠানোর কথা বলে ভয় দেখান। এ সময় দুই অভিভাবককে ওই বিচারকের পা ধরে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করানো হয়। খবরটি জানাজানি হলে প্রতিষ্ঠানের ছাত্রীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তারা মঙ্গলবার বিকাল ৩টার দিকে ক্লাস বর্জন করে স্কুলের সামনে নওয়াববাড়ি সড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকে। দু-দফায় মঙ্গলবার রাত ৮টা পর্যন্ত সড়ক অবরোধ অব্যাহত রাখে। ঘটনার ভয়াবহতা ও গুরুত্ব বিবেচনায় জেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ কয়েকটি কমিটি গঠন করে।

নিঃসন্দেহে ঘটনাটি দুঃখজনক ও মর্মান্তিক। আমি সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছি মানবিক মর্যাদার ভূলুণ্ঠিত হতে দেখে। বাংলাদেশে তো এখন দাসপ্রথা নেই, জমিদার বা রাজা-রানীও নেই। তাহলে পদস্থ কর্মকর্তা, সম্পদ ও ক্ষমতা যাঁদের আছে, তাঁরা সাধারণ মানুষকে দাসী-বাঁদী কেন মনে করবেন? বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংবিধানে ‘পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’-এর বাংলা করা হয়েছে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’, যেটি ভুল বলে এ লেখক মনে করেন। আমি শুনেছি, গণপরিষদের আলোচনায় ‘জনগণতন্ত্রী’ বাংলাদেশ বলা হয়েছিল। কিন্তু পরে বাংলা একাডেমির ভুলের কারণে এটি ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ হয়ে যায়। তবে ভুলক্রটি যাই হোক, ‘পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’, সংবিধানের মুখবন্ধ এবং ৭ অনুচ্ছেদের কারণে একথা নির্দ্ধিধায় বলা যায় যে, বাংলাদেশে সকল ক্ষমতার উৎস হচ্ছে জনগণ এবং সেজন্য এখানে সাংবিধানিক ও আইনিভাবে কোনো রাজা-প্রজা, জমিদার-রায়ত, প্রভু ও দাস বলে কিছু নেই। এখানে সকল মানুষ লিঙ্গ, বর্ণ, ধর্ম ও গোত্র নির্বিশেষে পদমর্যাদাগতভাবে সমান এবং আইনের সমান সুরক্ষা পাওয়ার অধিকারী।

কিন্তু সংবিধান ও আইনে যাই লেখা থাকুক না কেন, এখনও আমাদের অধিকাংশ মানুষের মনোজগতে বাস করে ফিউডালিজম বা সামন্তবাদ। আমরা যার যার ক্ষেত্রে এক একজন সামন্ত প্রভু। আমলা তাঁর অধস্তন কর্মকর্তা ও জনগণের সাথে, ডাক্তার রোগীদের সাথে, শিক্ষক ছা্ত্রছাত্রীদের সাথে, এবং রাজনীতিবিদ তাঁর সমর্থকদের সাথে সামন্ত প্রভুর মতো আচরণ করেন। আমলার কাছে জনগণ, ডাক্তারের কাছে রোগী, শিক্ষকের কাছে তাঁর শিক্ষার্থীরা যেন প্রজার মতো। প্রবল পরাক্রমশালী রাজনৈতিক নেতা, আমলা ও সরকারি নানা বাহিনীর কাছে জনগণ যেন দাসানুদাস প্রজা! শুধু ভোটের সময়ে নেতারা তাঁদের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করেন।

আমাদের পদস্থ ও উচ্চ-পদস্থ কর্মকর্তা এবং ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালীরা সাধারণ জনগণের কাছ থেকে ‘স্যার’ ডাক শুনতে চান, সমীহ চান, সালাম চান। নিজেদের দায়িত্বের কথা ভুলে গিয়ে, জনগণকে সেবা দেবার আইনসঙ্গত কর্তব্যের কথা বিস্মৃত হয়ে তাঁরা মালিকপক্ষ হয়ে যান। রাষ্ট্রের কর্মচারী ও জনগণের সেবক নয়, তাঁরা নিজেদের প্রভু, জমিদার ও ক্ষমতার মালিক ভাবেন। আমাদের রাষ্ট্রীয় চর্চা, রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও প্রচলিত সামাজিক প্রথা জমিদারি ও ফিউডালিজমকে পুষ্ট করে তোলে, উৎসাহ দেয় যেন জমিদার-প্রজা, ও প্রভু-ভৃত্য সম্পর্ক ফুলে-ফলে ফুলে-ফেঁপে ওঠে!

তবে এটাও মানতে হবে যে, সামন্ততন্ত্রের শেকড় শক্ত হওয়া সত্ত্বেও, সমান্ত প্রভু হবার উদগ্র বাসনা বহাল থাকার পরেও মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যে অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল; সেই রাষ্ট্রে নারীর ক্ষমতায়ন, লৈঙ্গিক ভারসাম্য, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার নানা উদ্যোগ আয়োজনের ফলে মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা একদম বিফলে যায়নি। শিক্ষক, বিচারক, আমলা, রাজনীতিবিদ ও আলেমদের মধ্যে অনেকেই আছেন যাঁরা প্রকৃত অর্থেই মানবিক মূল্যবোধে উচ্চকিত, অসাম্প্রদায়িক, প্রাজ্ঞ ও প্রগতিশীল চিন্তাভাবনা ও কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত। কিন্তু মুশকিলের জায়গাটি হচ্ছে এরা সংখ্যাগুরু নন, সংখ্যালঘু। আর সংখ্যাগুরুর মধ্যে কিছু না, বড় ধরনের ভেজাল আছে। সেই ভেজালের বয়ান শুরু করা যাক।

যাঁরা সরকারি পদস্থ কর্মকর্তা, বিচারক, রাজনীতিবিদ, শিক্ষক, চিকিৎসক ইত্যাদি হন, তাঁরা তো স্কুল, কলেজ ও বিশ্বদ্যিালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে যাঁর যাঁর পেশায় থিতু হন, তাই না? কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, সামাজিকীকরণ ও মূল্যবোধের শিক্ষা অনেকের মনোজগতে বিদ্যমান জাতপাত বা পদের বড়াই, সামন্তবাদ, ধর্মান্ধতা, ও কূপমণ্ডুকতার অন্ধকারকে মুছে দিতে পারে না। নানা কারণে এবং অনুকূল পরিস্থিতিতে সেটি নতুন শক্তি অর্জন করে কুৎসিতভাবে আঘাত করে মানবিক মর্যাদাকে। বগুড়ার জজ বেগম রুবাইয়া ইয়াসমিন মৌলিক মানবাধিকার ও বিচারকের দায়িত্ববোধের কথা বিস্মৃত হয়ে নিষ্ঠুরভাবে আঘাত করেছেন দু-জন অভিভাবকের মানবিক মর্যাদায়।

জজ রুবাইয়া ইয়াসমিন দুই অভিভাবককে জেলে পাঠানোর কথা বলায় ভয় পেয়ে তাঁরা যে রুবাইয়া ইয়াসমিনের পা ধরে মাফ চাইলেন; তাতে ধর্মগ্রন্থ, মানবিক দর্শন ও সংবিধানে বিবৃত মানবিক মূল্যবোধ ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়েছে। আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি বাঙালির মানবিক মর্যাদা ও মানবাধিকারের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিলের স্বাধীনতার ঘোষণায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, আমরা মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেছি তিনটি জিনিস অর্জন করার জন্য– একটি হচ্ছে সকল মানুষের সাম্য, দ্বিতীয়টি হচ্ছে মানবিক মর্যাদা, তৃতীয়টি হচ্ছে সামাজিক ন্যায়বিচার। ব্রিটিশরা বাঙালিকে মানবিক মর্যাদা দেয়নি, পাকিস্তানিরা বাঙালির মানবিক মর্যাদাকে চরমভাবে লঙ্ঘন করেছে। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে একজন বিচারক যেভাবে দু-জন অভিভাবকের মানবিক মর্যাদাকে ধুলোয় মিশিয়ে দিলেন, সেটি অমার্জনীয়। আমরা আশা করব বিচারক রুবাইয়া ইয়াসমিন অনুতপ্ত হবেন, নিজের ও তাঁর কন্যার ভুল শুধরে নেবেন এবং যে দু-জন সম্মানিত অভিভাবক ভয় পেয়ে তাঁর পা ধরে মাফ চেয়েছিলেন, তাঁদের কাছে তিনি করজোড়ে ক্ষমাপ্রার্থনা করবেন।