সম্প্রতি আবদ্ধ গ্যাসের ভয়াবহ বিস্ফোরণ এবং সেপটিক ট্যাংক পরিষ্কার কাজে প্রাণহানির ঘটনায় অসচেতনতা ও অজ্ঞতাকে দায়ী করেছে বাংলাদেশ রসায়ন সমিতি। পাশাপাশি গ্যাস সরবরাহে ত্রুটি, গাফিলতিও এসব দুর্ঘটনার কারণ।
Published : 20 Mar 2023, 11:07 AM
মাঝেমধ্যে দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ঘটলে আমরা খানিকটা সতর্ক হই। এছাড়া বেশিরভাগ সময় স্বাস্থ্যসম্মত, রুচিসম্মত, পরিবেশসম্মত ও নিরাপদ জীবনযাপনের কথা আমরা ভুলে থাকি। টাকা আছে তাই ভবন তুলে রাখি, তাতে পুনরায় টাকা আসলেই হলো। পরিবেশ ঝুঁকিমুক্ত কিনা তাতে কিছু যায় আসে না আমাদের। খোলামেলা নিরাপদ পরিবেশের প্রতি আগ্রহ না থাকাটা যেন টাকার প্রাচুর্যে গড়ে ওঠা বিকৃত রুচিবোধের বহিপ্রকাশ। আবার জনঘনত্বও একটা কারণ। আর এভাবেই পরিবেশকে একান্তভাবে অবহেলার কারণে পর্যায়ক্রমে দুর্ঘটনাগুলো ঘটে চলেছে।
সম্প্রতি আবদ্ধ গ্যাসের ভয়াবহ বিস্ফোরণ এবং সেপটিক ট্যাংক পরিষ্কার কাজে প্রাণহানির ঘটনায় অসচেতনতা ও অজ্ঞতাকে দায়ী করেছে বাংলাদেশ রসায়ন সমিতি। পাশাপাশি গ্যাস সরবরাহে ত্রুটি, গাফিলতিও এসব দুর্ঘটনার কারণ। ঘন অবকাঠামো গড়ে ওঠায় গ্যাস সংযোগ তদারকিতে যে ধরনের প্রশিক্ষিত জনবল দরকার তা কোথাও নেই। পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষ-নীরিক্ষা সাপেক্ষে রসায়ন সমিতি মতামত ও কিছু সুপারিশের পাশাপাশি দুর্ঘটনার কারণও জানিয়েছে।
সাধারণত সেপটিক ট্যাংক পরিষ্কার করার কোনো বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতিই এদেশে ব্যবহার করা হয় না। মাঝেমধ্যেই সেপটিক ট্যাংক পরিষ্কার করতে গিয়ে প্রাণহানির খবর পাই আমরা। এ এক ভয়ঙ্কর মৃত্যু। সেপটিক ট্যাংক পরিষ্কারকারীরা অবহেলিত পেশার মানুষ। যে কারণে তাদের মৃত্যু কোনো হা-হুতাশও তৈরি করছে না। সর্বশেষ ১৫ মার্চ সাভারের আশুলিয়ায় একটি পোশাক কারখানার সেপটিক ট্যাংক পরিষ্কার করতে গিয়ে নেমে একে একে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। পূর্বেও পৃথক ঘটনায় এরকম অনেকের মৃত্যু হয়েছে।
ম্যানুয়ালি সেপটিক ট্যাংক পরিস্কার করার কাজটি ঝুঁকিপূর্ণ, পাশাপাশি এটি মানুষের মর্যাদার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ২০১৩ সালে ম্যানুয়ালি সেপটিক ট্যাংক পরিষ্কার করা নিষিদ্ধ করেছে। ম্যানুয়ালি সেপটিক ট্যাংক পরিষ্কার অনেক দেশেই বেআইনি কারণ এর উচ্চ ঝুঁকি এবং সম্ভাব্য স্বাস্থ্যগত বিপদ। নিরাপদ এবং কার্যকরভাবে ট্যাংক পরিষ্কার করার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম, প্রশিক্ষণ এবং অভিজ্ঞতা আছে এমন সব পেশাদার সেপটিক ট্যাংক ক্লিনারের প্রয়োজন হলেও সেদিকে আমাদের নজর নেই।
রসায়ন সমিতির মতে, ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য অবিলম্বে ম্যানুয়ালি সেপটিক ট্যাংক পরিষ্কার নিষিদ্ধ হওয়া প্রয়োজন। ম্যানুয়াল শ্রমিকের কার্যক্রমকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে আইন প্রণয়ন জরুরি।
দেশের বিরাট বিরাট ভবন মালিকদের কত শতাংশই জানে এসব– প্রশ্ন সেখানেই। আর এসব দায়িত্ব কার?
সেপটিক ট্যাংকে মিথেন এবং হাইড্রোজেন সালফাইডের মতো বিপদজনক গ্যাস থাকে, যেখানে শ্বাস নিলে গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। মৃত্যুও হতে পারে। এছাড়াও ট্যাংকে ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাস থাকতে পারে। তাও গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। ট্যাংকের আবদ্ধ স্থানে পর্যাপ্ত বায়ু চলাচল না থাকায় প্রতিরক্ষামূলক গিয়ার ছাড়া সেপটিক ট্যাংকে শ্বাস বন্ধ বা বিষক্রিয়ায়ও মৃত্য ঘটতে পারে।
এজন্য সেপটিক ট্যাংক পরিষ্কারের সময় প্রতিরক্ষামূলক গিয়ার পরিধান করা, ক্ষতিকারক গ্যাস, ব্যাকটেরিয়ার সংস্পর্শ রোধের জন্য গ্লাভস, গগলস ও মুখোশ পরিধান করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ট্যাংক শনাক্ত করে পাম্প করে বর্জ্য অপসারণের কথা বলা হয়েছে যেখানে প্রতি ৩-৫ বছর পরপর এভাবে সেপটিক ট্যাংক পরিষ্কার করতে হবে।
আর আবদ্ধ স্থানের গ্যাসও বিপদজনক। এরকম জায়গায় যেসব গ্যাসের সৃষ্টি হয়, তাতে শ্বাস নিলে মৃত্যু হতে পারে। এসব গ্যাসের মধ্যে প্রপেন, মিথেন, কার্বন মনোক্সাইড, হাইড্রোজেন সালফাইড গ্যাস, অ্যামোনিয়াসহ বিভিন্ন গ্যাস থাকতে পারে। যেগুলোর মধ্যে অনেক গ্যাসই আবার বর্ণ ও গন্ধহীন।
আমরা এতদিন শুধু প্রকৌশলীদের কথা বলতাম। এখন বাসা-বাড়ি ও সুউচ্চ ভবনে রসায়নবিদেরও প্রয়োজন হচ্ছে। আর এসব শুধু রসায়নবিদেরা জানলেই হবে না– আধুনিক প্রযুক্তি ও এর সুযোগ-সুবিধা নিলে তার ব্যবহার সম্পর্কে আমাদেরও জানতে হবে। এখন আধুনিক জীবনযাপন ও প্রযুক্তির বিপদই আমাদের কাছে শ্বাপদ জন্তুর বিপদের সমতুল্য।
আবদ্ধ স্থানে বিপদজনক গ্যাসের উপস্থিতি এবং আবদ্ধ স্থানের ম্যানেজমেন্টের বিষয়ে কোনো স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর অনুসরণ না করার কারণে বিভিন্ন উৎস হতে গ্যাস নিঃসরণ হয়ে জমাটবন্ধ হচ্ছে এবং দুর্ঘটনা ঘটছে। এতে দেশের ভাবমূর্তিও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আবদ্ধ বিপদজ্জনক দাহ্য গ্যাস সৃষ্টির কারণ হিসাবে প্রাকৃতিক গ্যাসের সরবরাহ লাইনের ত্রুটি ও এলপিজি সিলিন্ডারের ত্রুটির বিষয়টি সামনে চলে আসছে। এতে বাসা-বাড়ি, অফিস, দোকান, রেসটুরেন্ট ইত্যাদি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠে।
আবদ্ধ স্থানে প্রপেন গ্যাস, মিথেন গ্যাস, কার্বন মনোক্সাইড, হাইড্রোজেন সালফাইড গ্যাস, অ্যামোনিয়া গ্যাসের উপস্থিতি শনাক্ত হলে কোনো ধরনের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ও জ্বলন্ত বস্তু ওই স্থানে প্রবেশ করানো যাবে না; বৈদ্যুতিক কোনো সুইচ অন করা যাবে না, দেশলাই জ্বালানো যাবে না এবং ইলেকট্রনিক কোনো ডিভাইস সেখানে চালানো যাবে না।
কার্বন-মনোক্সাইড গ্যাস বর্ণহীন ও গন্ধহীন হওয়ায় তার উপস্থিতি টের পাওয়া যায় না। কার্বন-মনোক্সাইডের উপস্থিতিতে বিস্ফোরণ ছাড়াই প্রাণহানি ঘটতে পারে। কার্বন মনোক্সাইড ট্র্যাপ হয়ে থাকলে সেখানে সাথে সাথে শারীরিক অস্বস্তি দেখা দেবে। এজন্য আবদ্ধ স্থানসমূহে যথাযথ ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা থাকা দরকার। ভবনে গ্যাস ডিটেক্টর স্থাপন করলে গ্যাসের জমাট হওয়া বা গ্যাসের উপস্থিতি বোঝা যায়। একই সাথে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা ও রিপেয়ারের বিষয় জড়িত। এছাড়া জেনারেটরের গ্যাসও আবদ্ধ ঘরে অক্সিজেনের স্বল্পতা সৃষ্টি করে।
প্রশিক্ষিত জনবল দ্বারা পিরিওডিক মনিটরিং ও যথাযথ ব্যবস্থাপনায় এ ধরনের দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব।
গ্যাসের নানা বিপদ থেকে রক্ষা পেতে বিপদজনক কেমিক্যাল ও বিপদজনক পদার্থ হ্যান্ডলিং, পরিবহন, বিতরণ, ব্যবহার ও গুদমজাতকরণে যথাযথ প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লোকবল ব্যবহার করতে হবে। তরল, কঠিন বা বায়বীয় যেকোনো গ্যাসের লোডিং এবং আনলোডিং কার্যক্রমে স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রোসিডিউর অনুসরণ করতে হবে। বিপদজনক কেমিক্যাল ও বিপদজনক পদার্থের অধিকাংশই সড়ক পথে পরিবাহিত হয়ে থাকে। পেট্রোলিয়াম জাতীয় পণ্য– এলএনজি ও এলপিজি পরিবহনে যুক্ত পরিবহনসমূহে আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী বিপদজনক পণ্যের নাম, ইউএন নম্বর, পণ্যের বিপদ সংক্রান্ত বর্ণনা, প্রতীক চিহ্ন ইত্যাদি প্রদর্শন করতে হবে।
বিপজ্জনক পদার্থের পরিবহন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক, জাতীয় এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষের তদারকিতে নিয়ন্ত্রিত হওয়া উচিত। বিপজ্জনক রাসায়নিক পদার্থ পরিবহন সংক্রান্ত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনের অনুসরণ করলে বিপদ কমে আসবে। এসব ক্ষেত্রে অংশীজনদের সচেতনতার অভাব যেমন রয়েছে তেমনি স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং সিস্টেমের অভাব, প্রশিক্ষণের অভাব, সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে রয়েছে পর্যাপ্ত জনবলের অভাব। রেগুলেটরি ব্যবস্থা, মনিটরিং ব্যবস্থার সাথে সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
আর বাসাবাড়ির গ্যাস সংযোগের আবদ্ধ স্থানে অবশ্যই গ্যাস ডিটেক্টর বসাতে হবে। স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে গ্যাস পাইপ লাইনের লিকেজ চিহ্নিত করার আধুনিক ব্যবস্থাদি গ্যাস সরবরাহকারী কোম্পানির থাকতে হবে। ভবনে বাসকারীসহ সংশ্লিষ্টদের এসব যন্ত্রপাতির ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। গ্যাস, বিদ্যুৎ সংযোগ, এসি, জেনারেটর সব বিষয় যাচাই-বাছাই করে কর্তৃপক্ষের সার্টিফিকেট প্রদান করতে হবে।
প্রতিটি এলাকার জন্য প্রশিক্ষিত দায়িত্বপ্রাপ্ত টেকনিশিয়ান ও কর্মকর্তাদের তালিকাও রাখাও জরুরি। কাজ করাতে হবে তাদের মাধ্যমে। ওয়ানস্টপ সার্ভিস আইন ২০১৮-এর অধীনে কেমিক্যাল রেজিস্ট্রশন ও ডাটাবেজ প্রস্তুতসহ সকল কার্যক্রমের জন্য ওয়ান স্টপ সার্ভিস ব্যবস্থা দরকার। মূলত মানব বসতির কোনো আবদ্ধ এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য পরিবেশকে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ রাখতে সচেতন তৎপরতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আর এসব ঘনঘটার মধ্যে মিথেন গ্যাস নিয়ে বেশ আলাপ হচ্ছে। অনেকটা অপপ্রচারের মতো। পাইপলাইনে লিকেজ থাকলে সে পথ দিয়ে মিথেন গ্যাস বের হয়ে অগ্নিকাণ্ড বা বিস্ফোরণ ঘটাচ্ছে। বাংলাদেশের যে খনিজ প্রাকৃতিক গ্যাস– বলা যায় তার প্রায় সবটাই মিথেন। বাসাবাড়িতে রান্নার জন্য পাইপ লাইনেও এই গ্যাসই আসছে। সিএনজিও বেশিরভাগ মিথেন গ্যাস। এটাকে কম্প্রেসড করা হয়, যা কম বিপদযুক্ত। আর এলপিজি হচ্ছে পেট্রোলিয়াম গ্যাস। এটাও রান্নার কাজে ব্যবহার করা হয় বলে আমাদের কাছে বেশি পরিচিত। তবে পাইপলাইনের গ্যাসের চেয়ে এলপিজিতে মিথেন থাকে কম। এটা বেশিরভাগ প্রোপেন আর বিউটেনের মিশ্রণ, মিথেন পরিমাণে কম থাকে। কিন্তু এগুলো সবই হাইড্রোকার্বন পরিবারের সদস্য।
তাই গ্যাস লাইন লিকেজ হলে তো মিথেনই বের হবে। এছাড়া আবদ্ধ পরিবেশে মিথেন গ্যাস উৎপন্ন হতে পারে। যেটাকে আমরা ‘ভূতের আগুন’ বলে রাতে ঝাড়-জঙ্গলে বা মাঝে মাঝে গাঁও-গেরামে জ্বলতে দেখি। ঘনবসতির মধ্যে আবদ্ধ পরিবেশে এসব গ্যাস উৎপন্ন হবার সম্ভাবনাও বেশি থাকে। আর ছিদ্র দিয়ে বের হয়ে এসব গ্যাস আবদ্ধ পরিবেশে জমে থাকতে পারে। যে কারণে আগুনের সংস্পর্শ পেলে বিপদ সৃষ্টি করে।
তাই মিথেন গ্যাস মানেই আমাদের শত্রু নয়। শত্রু হচ্ছে পরিবেশ-প্রতিবেশের প্রতি আমাদের অব্যবস্থাপনা, অসতর্ক মানসিকতা, রুচিবোধহীন জীবন-যাপন।