ইউএনও নারী, ম্যাজিস্ট্রেট নন?

গার্ড অব অনারে বিঘ্ন ঘটিয়ে কাদের সিদ্দিকী নারীর অগ্রযাত্রাকেই শুধু অবজ্ঞা করলেন না, একাত্তরে বীর নারীদের অবদান এবং আত্মত্যাগকেও তিনি অসম্মান করেছেন। তার বক্তব্য নারী নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ধর্মীয় গোঁড়ামিকেও উসকে দেয়।

সালেক খোকনসালেক খোকন
Published : 30 April 2023, 05:23 AM
Updated : 30 April 2023, 05:23 AM

মুক্তিযুদ্ধে কাদের সিদ্দিকীর গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার কথা তো স্বীকার করতেই হবে। ‘কাদেরিয়া বাহিনী’ নামে পরিচিত মুক্তিযোদ্ধাদের সবচেয়ে শক্তিশালী গেরিলা দলটির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। তবে বিজয়ের অব্যবহিত পর থেকে নানা বিতর্কের জন্ম দিয়ে আসছেন। বিজয় দিবসের দু-দিন পরই ঢাকার পল্টন ময়দানে প্রকাশ্যে বিহারীদের হাত-পা বেঁধে বেয়নেট দিয়ে হত্যা করার দায় তাঁর এবং তাঁর বাহিনীর ওপরই বর্তেছিল। এই একটি ঘটনাকে বহুবার বহুভাবে মুক্তিযুদ্ধবিরোধীরা নয় মাসের গণহত্যাকে গৌণ করে দিতে ব্যবহার করে এসেেছে। তবু এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে গভীর ভালোবাসা দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দীর্ঘদিন তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের ১ নম্বর সদস্য। বঙ্গবন্ধু যে তাঁকে খুব ভালোবাসতেন এই কথা কাদের সিদ্দিকী নানান অপকর্ম করার সময় আমাদের মতো আমজনতাকে মনে করিয়ে দিতে চান। সর্বশেষ গত ২৯ এপ্রিল সখীপুরেও তাই করেছেন।  

টাঙ্গাইলের সখীপুরে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় সম্মান জানাতে আসা সেখানকার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফারজানা আলমকে বাধা দিয়েছেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি কাদের সিদ্দিকী। ইউএনও একজন নারী এবং নারী ইউএনওর নেতৃত্বে রাষ্ট্রীয় সম্মান বা গার্ড অব অনার জানানো ‘শরিয়ত পরিপন্থি’ বলে উল্লেখ করেন একদা ‘বঙ্গবীর’ কাদের সিদ্দিকী। এই ‘রঙ্গ’ করার সময়ও তিনি সমবেতজনের উদ্দেশে বলেছেন, “এখন বঙ্গবন্ধু থাকলে এখানকার অনেক অফিসারদের লাথি মেরে ঢাকা পাঠিয়ে দিতাম।”

কী বিচিত্র কাদেরের বাসনা। সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান থাকলে কাদের সিদ্দিকী বুঝতেন, মুসলিম লীগের এক কিশোর সদস্য শেখ মুজিবুর রহমান কিভাবে আওয়ামী লীগ গঠন করলেন, হয়ে উঠলেন বঙ্গবন্ধু, প্রতিষ্ঠা করলেন ধর্মনিরপেক্ষ একটি রাষ্ট্র। কেমন করে কাদের সিদ্দিকী ভাবতে পারেন, তাঁর মতো কূপমণ্ডুকে পরিণত হওয়া পরিত্যক্ত এক মুক্তিযোদ্ধাকে এখনও বেঁচে থাকলে প্রশ্রয় দিতেন বঙ্গবন্ধু?

গত ২৯ এপ্রিল দুপুরে সখীপুর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে সখীপুর বাজার বণিক সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হামিদ খানের জানাজা ও গার্ড অব অনারে এ ঘটনাটি ঘটে।

জানাজার আগে কাদের সিদ্দিকী বক্তব্য দেন এবং বলেন, “আমি আজ মর্মাহত পুলিশের গার্ড অব অনার নিয়ে। রাত ১২টার সময় একজন শ্রেষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যু। আর (শনিবার) বেলা দুইটার সময়েও একজন ম্যাজিস্ট্রেট রাখা হয় নাই। এখন বঙ্গবন্ধু থাকলে এখানকার অনেক অফিসারদের লাথি মেরে ঢাকা পাঠিয়ে দিতাম।” নারী ইউএনওকে আটকানোর ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন, “মেয়ে যত বড়ই হোক, জানাজায় সামিল হওয়া তার সুযোগ নেই, পুরুষের সাথে।”

দীর্ঘদিন ধরে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কাজ করার কারণে বঙ্গবীর বলে অভিহিত কাদের সিদ্দিকীর গণমাধ্যমে উঠে আসা বক্তব্যটি কয়েকবার পড়লাম। মনে কয়েকটি প্রশ্নও জেগেছে। সচেতন নাগরিকদের মনেও নিশ্চয়ই ওই প্রশ্নগুলো আসবে।

কাদের সিদ্দিকী বলেছেন, “বেলা দুইটার সময়েও একজন ম্যাজিস্ট্রেট রাখা হয় নাই।” নারী বলে কি ওই উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে তিনি ম্যাজিস্ট্রেট মনে করেন না? আবার বলেছেন, ‘মেয়ে যত বড়ই হোক, জানাজায় সামিল হওয়া তার সুযোগ নেই, পুরুষের সাথে।’ কিন্তু নারী ইউএনও তো গিয়েছিলেন রাষ্ট্রীয় নিয়মে গার্ড অব অনার দিতে, জানাজায় অংশ নিতে নয়। ফলে সেখানে ওই ইউএনওকে বাধা দিয়ে বরং তিনিই আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়েছেন। কাদের সিদ্দিকী কেন এমন ভুল বক্তব্য দিলেন। তাঁর এমন আচরণ কি ধর্মীয় উগ্রবাদকে উৎসাহিত করবে না?

এক বীর মুক্তিযোদ্ধার মুখে শোনা একাত্তরের একটি ঘটনার দিকে একটু চোখ ফেরাই।

“তখন মুক্তিযুদ্ধ চলছে পুরোদমে। একবার নির্দেশ আসে সিলেটের বড়লেখায় সাতমা ছড়া ব্রিজ উড়িয়ে দেওয়ার। রেকি করা হলো। ছোট্ট দুটি নদী পার হয়ে যেতে হবে ওখানে। গাইড জানাল দুই নদীর ঘাটেই নৌকা রাখা থাকবে। আমরা চৌদ্দজন। ক্যাম্প থেকে মুভ করি রাতে। প্রথম নদীটির পাড়ে এসে নৌকা পেলাম। কিন্তু দ্বিতীয় নদীর কাছে কোনো নৌকা ছিল না। রাত তখন দুটো। নৌকার খোঁজে সহযোদ্ধারা আশপাশে ছোটে। কিন্তু না, কোনো নৌকা নেই। কী করব ভাবছি। হঠাৎ আমাদের পেছনে একটা ঝোপে কি যেন নড়ে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে বন্দুক তাক করি।

‘কে ওখানে?’

কাঁপতে কাঁপতে একটা কিশোরী বেরিয়ে আসে। বয়স তার পনের বা ষোল। পরনে শাড়ি। সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় বলে, ‘মুক্তি নি? আমি জানতাম আপনারা আইবা।’ সে জানাল গ্রামে মুক্তিবাহিনী আসছে, এমন খবর পেলে পাকিস্তানি আর্মি এসে গোটা গ্রামটা জ্বালিয়ে দেবে। সেই ভয়েই গ্রামবাসী ঘাটের সব নৌকা ডুবিয়ে রেখেছে। ‘আও আমার লগে আও’ বলেই মেয়েটা নদীর এক পাশে ডোবানো নৌকাগুলো দেখিয়ে তুলে নিতে বলে।

নিজেই খুঁজে আনে লগি। সহযোদ্ধারা পানি সেচে নৌকা দুটি নদীতে ভাসায়। মেয়েটিকে সঙ্গে নিয়েই ওপারে যাই। একটি নৌকা ঘাটে রাখি। আরেকটি নৌকা নিয়ে সে নদীর জলের অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। ব্রিজটা উড়িয়ে ভোরের দিকে আমরা ক্যাম্পে ফিরি। গ্রামবাসীর চোখ এড়িয়ে, জীবনের ঝুঁকি জেনেও ওই রাতে মেয়েটি এসেছিল শুধুই মুক্তিযোদ্ধাদের পার করিয়ে দিতে। এর চেয়ে বড় যুদ্ধ আর কি হতে পারে! তার নামটা জানা হয়নি, ধন্যবাদ পর্যন্ত দিতে পারিনি। সহযোদ্ধাদের কাছে মেয়েটি ছিল পরী বা ফেরেশতা। কিন্তু আমার কাছে সে একজন মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু ওই মেয়েটি কি এখনো বেঁচে আছে? নাকি সে ধরা পড়ে গিয়েছিল? বেঁচে থাকলে ওর কি বিয়ে হয়েছে? তার ছেলেমেয়েরা কি জানে তার মা একজন ফ্রিডম ফাইটার?”

যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা রুহুল আহম্মদ বাবুর কাছে শোনা ওই কিশোরীর গল্পটি আমার মনের অতলে হাজারও প্রশ্ন তৈরি করে। বুকের ভেতর দাগ কেটে থাকা যুদ্ধদিনের ঘটনাটি এভাবেই তুলে ধরেছিলেন বাবু ভাই ।

ইতিহাস তুলে আনার কাজ করতে গিয়ে একাত্তরে নারীদের বীরত্বের এমন অসংখ্য অজানা ঘটনার কথা শুনেছি মুক্তিযোদ্ধাদের মুখে। একাত্তরে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়াসহ রাতভর রান্না করে মুক্তিযোদ্ধাদের খাইয়ে, শুকনো খাবার দিয়ে তাদের পালানোর পথ দেখিয়ে দিতেন মা-বোনরা। তখন সবাই যুদ্ধে চলে গেছে। কিন্তু মায়েরা, বোনেরা এই অবরুদ্ধ বাংলায় চরম নিরাশ্রয় অবস্থায় ছিলেন। পাকিস্তানি সেনা ও তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও শান্তি কমিটির হায়েনাদের কাছ থেকে নিজেদের ও শিশুদের বাঁচানোটাই ছিল তখন আরেকটা যুদ্ধ। সেই যুদ্ধটিই নিঃশব্দে করেছেন বাংলার মায়েরা-বোনেরা-মেয়েরা। দেশের জন্য তারা অত্যাচারিত হয়েছেন, ধর্ষিত হয়েছেন। তারা একেকজন বীর মুক্তিযোদ্ধা।

অথচ স্বাধীনতার এত বছর পরে কাদের সিদ্দিকীর মতো একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার আচরণ আমাদের ব্যথিত করে, হতাশাও জাগায়। নারী ইউএনওকে গার্ড অব অনারে বাধা দিয়ে তিনি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও সংবিধানের ২৮-এর (১) ও (২) অনুচ্ছেদের পরিপন্থী কাজ করেছেন। সংবিধানের ২৯ (১) অনুচ্ছেদে ‘সরকারি নিয়োগ লাভে সমতা’ শিরোনামে (২) ধারায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে: কেবল ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী, নারী পুরুষভেদে... কোনো নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের অযোগ্য হবে না, কিংবা সে ক্ষেত্রে তার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাবে না।’

গার্ড অব অনার কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়। এটি রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে জাতির বীর সন্তানদের শেষ যাত্রায় সম্মান জানানোর রাষ্ট্রীয় আয়োজন। যেখানে নিয়মমাফিক উপজেলার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়।

দেশে বর্তমানে শতাধিক উপজেলায় নারীরা ইউএনও হিসেবে কাজ করছেন। সেখানে বীর মুক্তিযোদ্ধা মারা গেলে নিয়মমাফিক গার্ড অব অনার প্রদানে নেতৃত্ব দিলেও ধর্মীয় নিয়ম মেনে জানাজায় অংশ নেওয়া থেকে বিরত থাকেন ওই নারী কর্মকর্তারা। ওই বীর মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের নারী সদস্যরাও তাই করেন। তাহলে এই স্বাভাবিক বিষয়টি কাদের সিদ্দিকী কেন বুঝলেন না!

গার্ড অব অনারে বিঘ্ন ঘটিয়ে কাদের সিদ্দিকী নারীর অগ্রযাত্রাকেই শুধু অবজ্ঞা করলেন না, একাত্তরে বীর নারীদের অবদান এবং আত্মত্যাগকেও তিনি অসম্মান করেছেন। তার বক্তব্য নারী নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ধর্মীয় গোঁড়ামিকেও উসকে দেয়। যা একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার কাছ থেকে আমরা প্রত্যাশা করি না।

বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একজন নারী। তার সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের সফল বাস্তবায়নের ফলে নারী উন্নয়ন আজ সুস্পষ্টভাবে দৃশ্যমান। ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনীতি, বিচার বিভাগ, প্রশাসন, কূটনীতি, সশস্ত্র বাহিনী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, শান্তিরক্ষা মিশনসহ সর্বক্ষেত্রে নারীর সফল অংশগ্রহণ দেখছি আমরা। লিঙ্গীয় সমতা ও নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ এখন রোল মডেল। জাতীয় অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণও বাড়ছে। তাই এ সরকারকে বলা হয় নারীবান্ধব সরকার, যা আমাদের জন্য নিঃসন্দেহে গর্বের।

জামায়াত ও হেফাজতে ইসলামসহ জঙ্গি মৌলবাদী দলগুলো নারী নেতৃত্ব হারাম বলে প্রায়শই ফতোয়া দিয়ে থাকে। তাহলে কাদের সিদ্দিকী কি তাদের সেই পথটিকেই মসৃণ করার কাজে নেমেছেন!

দেশের প্রধানমন্ত্রী নারী হলেও সংসদ, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, আইন-আদালত প্রভৃতি এখনো নারীবান্ধব হয়ে ওঠেনি। পুরোপুরি বদলায়নি নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিও। যা স্পষ্ট হয়েছে সখীপুরে কাদের সিদ্দিকীর ঘটনাটিতে। সরকার যেখানে সব ক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্য কমিয়ে আনায় কাজ করছে, সেখানে রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে নারী-পুরুষ বৈষম্য করা হলে তা সমাজে নারী অগ্রগতির পথে একটি ভুল বার্তা দেবে। এটি বোঝার সক্ষমতা কাদের সিদ্দিকীর আছে বলে মনে হচ্ছে না। তবু কাদের সিদ্দিকী এবং তাঁর মতো মানুষদেরও বোধোদয় ঘটুক এমন প্রত্যাশা করতে চাই আমরা।