এই লেখাটি মূলত 'মুজিববর্ষে' বিশ্বনেতাদের দেওয়া বাণীর একটি সঙ্কলন। পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু নিয়ে তাদের বক্তব্যের দৃষ্টিকোণ ও প্রেক্ষাপট এতে তুলে ধরা হয়েছে।
Published : 26 Aug 2022, 09:13 PM
২০২১ সালে সম্মিলিতভাবে মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করা হয়েছিল। সেই অনুষ্ঠান উপলক্ষে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধান সহ অনেক সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা ভিডিও মেসেজ অথবা লিখিত বক্তব্য পাঠিয়েছিলেন। করোনা মহামারীর জন্য এই বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছিলেন বিশ্ব নেতারা। তবে মহামারীর তীব্রতা ও ভয়াবহতা উপেক্ষা করেও ঢাকায় উপস্থিত হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার দিবসকে বিশেষ সম্মান জানাতে দক্ষিণ এশিয়ার নেতারা; তারা হলেন ভুটান, ভারত ও শ্রীলংকার প্রধানমন্ত্রীসহ মালদ্বীপ এবং নেপালের রাষ্ট্রপতি।
‘মুজিববর্ষ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল বাংলাদেশ ২০২১ সালকে বঙ্গবন্ধুর সম্মানে। আর সে বছরের শেষ আকর্ষণ ছিল বিজয় দিবসের সুবর্ণজয়ন্তী। সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ভারতের সম্মানিত রাষ্ট্রপতি শ্রী রাম নাথ কোবিন্দ। বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা জানাতে বর্তমান বিশ্বের নেতাদের বক্তব্যের চৌম্বকীয় অংশ নিম্নে তুলে ধরা হল:
ভুটানের প্রধানমন্ত্রী ড. লোটে শেরিং
“আমার জন্য বাংলাদেশে ফিরে আসতে পারা সবসময়ই খুব উল্লাসের, যে দেশটিকে আমি আমার দ্বিতীয় মাতৃভূমি বলে থাকি। কিন্তু এবারের কারণটা আরও জোরালো। আমি এখানে দুটি খুব গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান উদযাপন করতে এসেছি।
আমরা সবাই জানি, আমরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শততম জন্মবার্ষিকী এবং যে দেশের জন্য তিনি তার জীবন দিয়েছেন সেই দেশের স্বাধীনতার ৫০তম বার্ষিকী (সূবর্ণ জয়ন্তী) উদযাপন করছি। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, আমাদের সকলের,সমস্ত মানুষের এবং সে জন্যই বিশ্বের সমস্ত জাতির অবশ্যই অন্যের সাথে ভাগাভাগি করার মত একটি গল্প থাকতে হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি চমৎকার গল্প উপহার দিয়েছেন বাংলাদেশকে বিশ্ব জনগণের সাথে ভাগাভাগি করার জন্য।
যদিও আমাদের অনেক দ্বিপাক্ষিক অনেক বিষয়ে সম্পর্ক রয়েছে, আমি এবার বাংলাদেশ সফরের সুযোগটি নিয়েছি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার ঐতিহাসিক উত্তরাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর একমাত্র উদ্দেশ্যে যিনি শান্তিপূর্ণ, প্রগতিশীল এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশের জন্য শক্তিশালী ভিত্তি স্থাপন করেছেন।
ভুটানে আমাদের রাজার নীতি 'সার্বিক জাতীয় সুখের' ভিত্তিতে উন্নয়ন পরিচালিত করে যাচ্ছি, আমি স্বাচ্ছন্দ্যে এটাকে আপনাদের নেতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুরূপ প্রজ্ঞার সাথে সম্পর্কিত করতে পারি, যিনি বলেছিলেন, ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়’।
শেখ মুজিবুর রহমান ভেবেছিলেন, ‘কারো সাথে বিদ্বেষ নয়’ এবং আমাদের রাজা মনে করতেন শান্তি ও সম্প্রীতিই সাফল্যের চাবিকাঠি। এই দুটি অভিন্ন আলো আমাদের চলার পথকে আলোকিত করে এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে দেশ দুটি এই আলোর পথ ধরে এমন সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে।”
ভুটানের মহামান্য প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং বাংলাদেশকে জানেন খুব ভালো করে, তাই তিনি বঙ্গবন্ধুকেও ধারণ করেন হৃদয়ে। দীর্ঘদিন তিনি বাংলাদেশে চিকিৎসা বিজ্ঞান শাস্ত্রে অধ্যয়ন করেছেন। তিনি একজন জনপ্রিয় ও চমক প্রদানকারী রাজনীতিবিদ। দ্রুত তিনি যে জনপ্রিয়তা অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন তা অভাবনীয়। একজন চৌকস রাজনীতিবিদদের জন্য অধ্যাবসায় খুবই জরুরী। মিস্টার শেরিং এর বক্তব্যে প্রকাশ পায় তিনি সেটা করেন। অনেক পড়াশোনা ছাড়া এমন চমৎকার বক্তব্য উপস্থাপন অসম্ভব। তিনি যেমন বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে অনেক জানেন তেমনি জানেন তাঁর রাজা সম্পর্কেও। তাইতো তিনি দুই নেতার মধ্যে মিল খুঁজে পেয়েছেন। একটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের রাজনীতিবিদ ও সরকারপ্রধান বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যে গবেষণা করেছেন তা অভাবনীয়।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদী
"অপারেশন সার্চ লাইটের নিষ্ঠুরতা, নিপীড়ণ ও নৃশংসতা নিয়ে বিশ্বে যতটা আলোচিত ও প্রতিফলিত হওয়া উচিৎ ছিল ততটা হয়নি। বন্ধুরা, এত কিছুর মধ্যেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন এখানকার মানুষের জন্য এবং আমাদের ভারতীয়দের জন্যও আশার আলো।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব এবং তার সাহসিকতা নিশ্চিত করেছিল যে কোনো শক্তি বাংলাদেশকে দাস করতে পারবে না।
বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করলেন-
এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।
তার নেতৃত্বে সাধারণ মানুষ, সে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে, কৃষক, যুবক, শিক্ষক, শ্রমিক, সকলেই মুক্তিবাহিনীতে পরিণত হয়।
আর তাই আজ মুজিববর্ষ, বঙ্গবন্ধুর দূরদৃষ্টি, তার আদর্শ ও সাহসিকতাকে স্মরণ করার দিন। এখনই সময় 'চির বিদ্রোহী' ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে স্মরণ করার। বন্ধুরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ভারতের প্রতিটি কোণে, প্রতিটি দল এবং সমাজের সকল স্তরের দ্বারা সমর্থিত ছিল।
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতীর ইন্দিরা গান্ধী এবং তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা সকলেরই জানা। একই সময়ে, ৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে, অটল বিহারী বাজপেয়ী জি বলেছিলেন- "স্বাধীনতা সংগ্রামে যারা জীবন উৎসর্গ করেছেন আমরা শুধু তাদের পাশেই লড়ছি না, ইতিহাসকে নতুন দিশা দেওয়ারও চেষ্টা করছি।" আজ বাংলাদেশে যারা তাদের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছে এবং ভারতীয় সেনাদের রক্তও তাদের পাশাপাশি প্রবাহিত হচ্ছে।
এই রক্ত এমন সম্পর্ক গড়ে তুলবে যা কোনো চাপে পড়বে না, কোনো কূটনীতির শিকার হবে না। আমাদের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি, প্রণব দা, বঙ্গবন্ধুকে একজন অক্লান্ত রাষ্ট্রনায়ক বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ধৈর্য, অঙ্গীকার ও আত্মসংযমের প্রতীক।
‘বাংলাদেশ ইতিহাসে, স্বাধীন রাষ্ট্র, হিসাবে ঠিকে থাকবে বাংলাকে দাবিয়ে রাখতে পারে, এমন কোন শক্তি নেই’। বাংলাদেশের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মতো শক্তিশালী কেউ নেই। বঙ্গবন্ধুর এই ঘোষণা বাংলাদেশের অস্তিত্বের বিরোধিতাকারীদের জন্য শুধু সতর্কবাণীই ছিল না, বাংলাদেশের সামর্থ্যের প্রতি তার বিশ্বাসের প্রতিফলনও ছিল।”
মোদির বক্তব্যের একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো, তিনি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মহান ইন্দিরা গান্ধীর অবদানকে উল্লেখ করতে ভোলেননি। সাধারণত নেতারা তার প্রতিপক্ষ দলের নেতাদের অবদানকে এড়িয়ে যান; কিন্তু মোদীজি এড়িয়ে যাননি বরং গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করেছেন। তার এই মানসিকতা সকলেই অনুসরণ করলে ভারত ও উপমহাদেশ দ্রুত এগিয়ে যাবে। তিনি বঙ্গবন্ধুকে উপস্থাপন করতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী ও সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির উক্তিরও উল্লেখ করেছেন শ্রদ্ধাভরে।
ভারতের রাষ্ট্রপতি শ্রী রাম নাথ কোবিন্দ (সাবেক)
“তার আলোড়ন সৃষ্টিকারী ৭ই মার্চের ভাষণের নির্যাস শুনে আমি বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম।কিন্তু বঙ্গবন্ধুর অনুপ্রেরণামূলক রাষ্ট্রনায়কত্ব; তার সুস্পষ্ট নৈতিক দৃঢ় প্রত্যয় এবং পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের জন্য ন্যায়বিচারের জন্য তার অদম্য দৃঢ়তা ছিল সত্যিকার অর্থে পট পরিবর্তনকারী। ফলস্বরূপ, বিশ্ব একটি মূল্যবান শিক্ষা পেয়েছে: সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ইচ্ছাকে কোনো শক্তি দ্বারা বশীভূত করা যায় না, তা যতই নৃশংস হোক না কেন।
আমার মনে আছে যে আমি যৌবনে বঙ্গবন্ধুর নৈতিক সাহস দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম। অন্যান্য লক্ষাধিক মানুষের মতো আমিও তার শক্তিশালী কণ্ঠে বিদ্যুতায়িত হয়েছিলাম এবং সেই সময়ে বাংলাদেশের ৭ কোটি মানুষের আকাঙ্খা বহন করেছিল এমন উপলব্ধি। আমার প্রজন্মের লাখ লাখ ভারতীয়ের মতো, আমরা একটি অত্যাচারী শাসনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয়ে উল্লসিত হয়েছিলাম এবং বাংলাদেশের জনগণের বিশ্বাস ও সাহসে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম।
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল এমন একটি বাংলাদেশের যা শুধু রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন নয়, একটি ন্যায়সংগত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক জাতিরও। দুঃখের বিষয়, জীবদ্দশায় তাঁর দর্শন বাস্তবায়িত হতে পারেনি। স্বাধীনতা বিরোধীরা যারা বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের অধিকাংশকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল তারা উপলদ্ধি করতে পারেনি যে বুলেট এবং সহিংসতা এমন একটি ধারণাকে নির্বাপিত করতে পারে না যা লক্ষ লক্ষ মানুষের কল্পনায় স্থান করে নিয়েছে।”
বঙ্গবন্ধু তার ঐতিহাসিক অতুলনীয় ৭ই মার্চের ভাষণের মধ্যে বলেছেন “যদি কেউ নেয্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও একজন যদিও সে হয় তার নেয্য কথা আমরা মেনে নেব।” এই কথা গুলোর মধ্যেই লুকিয়ে আছে যে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল এমন একটি বাংলাদেশের যা শুধু রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন নয়, একটি ন্যায়সংগত জাতিরও। সেই ৭ই মার্চের ভাষণের নির্যাসে ভারতের রাষ্ট্রপতি সম্মোহিত হয়েছিলেন, সেটাই স্বাভাবিক।
মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতি ইব্রাহিম মোহাম্মদ সোলিহ
“শেখ মুজিবুর রহমান আগামী প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবেন। ভালবেসে তাঁকে বঙ্গবন্ধু বা বাংলার বন্ধু হিসেবে সম্বোধন করা হত, বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হলেন দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসের একজন মহামানব, যার কর্মকাণ্ড বাংলাদেশের জনগণের জন্য একটি স্বাধীন ভাগ্য নিশ্চিত করেছিল।সারা জীবন তিনি গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার একজন আপসহীন প্রবক্তা ছিলেন। প্রায়শই তিনি বলিষ্ঠ কন্ঠে সেই সকল মূল্যবোধকে সমর্থন করেছিলেন যা জীবনের সকল স্তরের মানুষের সাথে অনুরণিত হয়েছিল। তার ছয় দফা কর্মসূচী বাংলাদেশের স্বাধীনতার ভিত্তি স্থাপন করেছিল এবং দেশের সংবিধানের অন্তর্নিহিত মূল্যবোধগুলি তাঁর দক্ষতা ও ঐতিহাসিক অবস্থানের স্বাক্ষর বহন করে। তাঁর ৭ই মার্চের ভাষণ কার্যকরভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে, ইউনেস্কো গণতান্ত্রিক প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে মেমোরি অফ দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টারে তা যুক্ত করেছে।
করুণ মৃত্যু পরিস্থিতি সত্ত্বেও, তার উত্তরাধিকার ভোলা যাবে না। গণতন্ত্র এবং স্বাধীনতার জন্য যারা আকাঙ্ক্ষিত ছিলেন তাঁরা আমাদের হৃদয়ে আমরা সর্বদা একটি সম্মানিত স্থান পাবেন।”
বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে মালদ্বীপের মহামান্য রাষ্ট্রপতির বক্তব্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এমন একটি বক্তব্য উপস্থাপনে একজন নেতাকে যথেষ্ট জানতে হয়, যার সম্পর্কে তিনি কথা বলেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তিনি যথেষ্ট গবেষণা করেছেন তাঁর বক্তব্যে সেটি ফুটে উঠেছে। তিনি সত্যটি উপলদ্ধি করেছেন ৭ই মার্চের ভাষণই ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা।
নেপালের ফেডারেল গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি বিদ্যা দেবী ভান্ডারী
“বঙ্গবন্ধুর অবিরাম সংগ্রাম বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে। তিনি এর জন্য অটল নেতৃত্ব এবং অবিরাম পদক্ষেপ দেখিয়েছিলেন। তাঁর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ, ১৯৬৯ সালে তৎকালীন সর্বদলীয় ছাত্র অ্যাকশন কমিটি তাঁকে বঙ্গবন্ধু সম্মানিত উপাধিতে ভূষিত করে। সমগ্র বাংলাদেশ তাৎক্ষণিকভাবে তা গ্রহণ করে।
বাংলা ভাষার প্রতি বঙ্গবন্ধুর গভীর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা ছিল। তিনি সেই ব্যক্তি যিনি বাংলাদেশী জনগণের সমর্থনে বাংলা ভাষার সুরক্ষা ও প্রসারের জন্য নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
আমরা দুর্বল, নিঃস্ব, দরিদ্র এবং অসুবিধায় থাকা অন্যান্য নাগরিকদের প্রতি তাঁর মহান মমতার কথাও জানি।
একজন চমৎকার বক্তা, সংগঠক এবং নিরলস প্রতিবাদকারী হিসেবে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের মানুষের হৃদয় ও মন জয় করেছিলেন এবং একটি নতুন জাতি গঠনের লক্ষ্য অর্জন করেছিলেন। তিনি এ অঞ্চলের পূজনীয় নেতা।
আমি অত্যন্ত আনন্দের সাথে বলতে পারি যে নেপাল বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানকারী সপ্তম দেশ। স্বাধীনতার পর স্বল্প সময়ের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বাংলাদেশের পরিধিকে প্রসারিত করেছিলেন।
এখন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা, অবদান ও আত্মত্যাগের স্বীকৃতিস্বরূপ সারা বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন দেখে আমরা আনন্দিত।”
নেপালের রাষ্ট্রপতি যে মূল্যবান বক্তব্য রেখেছেন ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে, তা প্রমাণ করে তিনি একজন অধ্যবসায়ী রাজনীতিবিদ। তার বক্তব্যে বাংলাদেশের জন্য বঙ্গবন্ধুর আত্মত্যাগ ও সংগ্রাম ফুটে উঠেছে স্পষ্টভাবে। নেপালের রাষ্ট্রপতি তার প্রতিবেশী দেশের একজন মহান নেতার অবদানকে ভোলেননি।
শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে (সাবেক)
“বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন একজন নীতিবান ব্যক্তি যিনি বাঙালি জনগণ, তাদের ভাষা এবং কল্যাণের জন্য তাঁর সমগ্র জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। তিনি ১৯৭১ সালে "বাংলাদেশ" নামে একটি নতুন জাতি সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত তার স্বাধীনতা সংগ্রাম চালিয়ে যেতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন।
দুর্ভাগ্যবশত, তিনি তার প্রিয় দেশের জন্য যে স্বপ্ন লালন করেছিলেন তা উপলব্ধি করার জন্য বেঁচে থাকতে পারেননি।
মহামান্য, আমি ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্টে ঘটে যাওয়া অপরিসীম ক্ষতির যন্ত্রণা বুঝতে পারছি। সেদিন জাতি একজন বীর ও স্বাধীনতার জনককে হারিয়েছিল। একই সঙ্গে বাবা-মা ও ভাইবোনকে হারিয়েছিলেন তাঁর প্রিয় কন্যা।
তাঁর উত্তরাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে উৎসর্গ করার জন্য, আমি একজন বাঙালি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা একটি কবিতার একটি অংশ উদ্ধৃত করি:
চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির,
জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর
নিজ হস্তে নির্দয় আঘাত করি, পিতঃ,
ভারতেরে সেই স্বর্গে করো জাগরিত।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, “বাংলাদেশ উর্বর এবং সৌরভ সমৃদ্ধ। পৃথিবীর খুব কম দেশেই আমাদের মতো উর্বর ভূমি আছে।”
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে শ্রীলংকার প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। অন্যান্য বিশ্বনেতারা বঙ্গবন্ধুর জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করে নতুন,নতুন তথ্য প্রদান করেছেন। কিন্তু ১৫ অগাস্ট ১৯৭৫-এ তার হত্যাকাণ্ডের কথাটি বিশ্বনেতাদের প্রায় সবাই এড়িয়ে গেছেন। এক্ষেত্রে রাজাপাকসে ব্যতিক্রম তিনি উল্লেখ করেছেন হত্যাকাণ্ডের কারণে তিনি নিজের স্বপ্ন সোনার বাংলা বাস্তবায়ন করে যেতে পারেননি।
আলজেরিয়ার রাষ্ট্রদূত রাবাহ লার্বি
"জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের শীর্ষ সম্মেলনের কাঠামোর মধ্যে যা অন্যদের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৭৩ সালের ৫ থেকে ৯ই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। এবং সেই সময় শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি হাউয়ারি বুমেডিয়ানের প্রতি কোন আপত্তি ছাড়াই তাঁর সমর্থন ব্যক্ত করেছিলেন, যাতে তিনি জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি জাতিসংঘের কাছে একটি নতুন বিশ্ব অর্থনৈতিক নির্দেশের দাবী করে একটি অসাধারণ সিদ্ধান্ত চেয়েছিলেন।
১৯৭৪ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারি লাহোরে ওআইসি সম্মেলনের প্রাক্কালে পুরো দিনের কথা। আলজেরিয়া সহ মুসলিম দেশগুলির একটি প্রতিনিধি দল যারা বাংলাদেশকে বন্ধু হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করে, যারা এর অংশ হতে পেরে গর্বিত ছিল। লাহোরের ইসলামী শীর্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর প্রাপ্য সম্মানের সাথে অংশগ্রহণের বিষয়ে তাঁর সাথে আলোচনা করতে ২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় আসেন। ঢাকায় এবং পাকিস্তানে এই বিষয়ে আলোচনার শেষে ইসলামাবাদ সরকার ২২শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৪ তারিখে বাংলাদেশকে একটি নির্ভরশীল ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়। যার ফলশ্রুতুতে একই দিনে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন জরুরী ভিত্তিতে গনভবনে একটি সংবাদ সম্মেলন করে লাহোর সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর অংশগ্রহণের ঘোষণা দেন। সেই মুহুর্তে রাষ্ট্রপতি বোমেডিয়ান দ্রুত মুজিবুর রহমানের কাছে একটি বিশেষ বিমান পাঠন, যাকে তিনি ভাই মনে করতেন তাঁকে ঢাকা থেকে লাহোরে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর সমগ্র জীবন জনগণের মুক্তি, স্বাধীনতা ও এর অগ্রগতির জন্য উৎসর্গ করেছেন তা ব্যক্ত না করে আমি এই বক্তব্য শেষ করতে পারবো না। এই মানুষটি যিনি তার মহান আত্মাকে উতস্বর্গ করছেন এবং যাকে ফিদেল কাস্ত্রো বলেছিলেন, "তিনি হিমালয় দেখেননি কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে হিমালয়ের বিশালতা দেখেছেন।" বিশ্বাসে ভুল নাহলে এই মানুষটি অক্লান্তভাবে তাঁর জনগণকে দিয়ে যেতে পারতেন। বিজয়ের মাধ্যমে মজিবুর রহমান তার উচ্চতা ও আভায় অনেক বৈশ্বিক সমস্যার সমাধানেও অবদান রাখতে পারতেন, যা এই মনের মধ্যেই রয়ে গেছে এবং তাতে কোনো সন্দেহ নেই।”
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে প্রদত্ত বিভিন্ন দেশের নেতৃবৃন্দের বক্তব্যের উপর একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেছে। সেখানে ২০০ এর উপরে বিশ্ব ব্যক্তিত্বের বক্তব্য লিপিবদ্ধ হয়েছে। তবে আলজেরিয়ার রাষ্ট্রদূতের বক্তব্য সে গ্রন্থে অনুপস্থিত। এই কারণ আমাকে একটু হতাশ করেছে। লাহাব লারবির বক্তব্যটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি তৎকালীন ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন তার বক্তব্যে।
ভুটানের মহামহিম রাজা জিগমে খেসার
“বাংলাদেশের মানুষের জন্য সাম্য ও ন্যায়বিচারের সর্বোচ্চ আদর্শের প্রতি দৃঢ় অঙ্গীকার নিয়ে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথ আলোকিত করেছিলেন। আমরা যখন একজন অসাধারণ মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই এবং তার জীবন ও উত্তরাধিকার উদযাপন করি, আমরা সেই মহান ব্যক্তির ব্যক্তিগত অগ্নিপরীক্ষার কথাও স্মরণ করি যে তিনি এবং আপনার পরিবার সহ্য করেছিলেন এবং তিনি যে চূড়ান্ত আত্মত্যাগ করেছিলেন যাতে বাংলাদেশের ভবিষ্যত চিরকাল স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার এবং সমৃদ্ধিতে সুরক্ষিত থাকে।”
ভুটানের বর্তমান রাজা যথার্থই বলেছেন, মানুষের জন্য সাম্য ও ন্যায়বিচারের আদর্শের দৃঢ় অঙ্গীকার নিয়ে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে স্বাধীনতার পথে নিয়ে গিয়েছিলেন। যার কারণেই তিনি বাংলাদেশের সংবিধানে গনতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের সম্মিলন ঘটিয়েছিলেন, যাতে সামাজিক গনতন্ত্রের প্রয়োগ করা যায় বাংলাদেশে। আর সামাজিক গনতন্ত্র ছাড়া সাম্য ও ন্যায় বিচার অসম্ভব।
ভুটানের চতুর্থ রাজা মহামহিম জিগমে সিংয়ে ওয়াংচুক
“শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন একজন অদৃষ্টপুরূষ যিনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলনকে সংগঠিত ও নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন অর্জনের প্রচেষ্টায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনে তার জীবনের প্রতিটি নিঃশ্বাস ও রক্ত উৎসর্গ করেছেন।”
জিগমে সিংয়ে ওয়াংচুক ভুটানের চতুর্থ রাজা। তার বাবা মহামহিম জিগমে দরজি ওয়াংচুক ছিলেন ভুটনের তৃতীয় রাজা। তিনি ক্ষমতায় ছিলেন ৩০ মার্চ ১৯৫২ থেকে ২১ জুলাই ১৯৭২। আর সেই সময়ের মধ্যেই ঘটেছিল দক্ষিণ এশিয়ায় সৃষ্টি হয়েছিল নতুন ইতিহাসের। বাংলাদেশের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য নেতৃত্বে বিশ্ব মানচিত্রে নতুন একটি দেশের অভ্যুদয় হয়েছিল।
আর সেই দেশটিকে ৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, সর্বপ্রথম স্বীকৃতি দিয়ে টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলেন ভুটানের ততকালীন রাজা জিগমে দরজি ওয়াংচুক। আর তার পুত্র জিগমে সিংয়ে ওয়াংচুক পরবর্তীতে বাংলাদেশ সফর করেছেন, তিনি তার বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ ও স্মৃতির কথা আমাদের জানিয়েছেন। শেখ মুজিবের জন্মশতবার্ষিকিতে তাঁর পাঠানো বানীতে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বঙ্গবন্ধুর মহান অবদানের কথা তুলে ধরেছেন।
কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো
“আমি স্বাধীন বাংলাদেশের ৫০ বছরে সবাইকে অভিনন্দন জানাতে চাই। যা আজ আমরা উদযাপন করতে পারছি তা শেখ মুজিবুর রহমানের একটি স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক দেশের স্বপ্ন - যা জনগণের প্রতি তাঁর ভালাবাসার জন্য নির্মিত হয়েছিল।
১৯৮৩ সালে শৈশবে আমি প্রথম আপনাদের দেশে দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম, আমার বাবার সাথে - যিনি তখন কানাডার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। সে সময় আমার বাবা ও শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে দৃঢ় সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। যার মূলে ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতি কানাডার প্রাথমিক সমর্থন। এবং তারপর থেকে আমাদের দুই দেশ একটি দীর্ঘস্থায়ী বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে, যা দুই দেশের জনগণের সাথে জনগণের সম্পর্ক এবং অভিন্ন স্বার্থের ভিত্তিতে রচিত হয়েছে।
বন্ধুগণ, আজ সময় হয়েছে অতীতে ফিরে দেখার এবং উদযাপনের। আমরা শেখ মুজিবুর রহমানের উত্তরাধিকারকে ফিরে দেখবো- তাঁর শততম জন্মবার্ষীকিতে - এবং স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপন করবো। এবং এর মাধ্যমে, একজন বিশেষ ব্যক্তির সেই ক্ষমতার কথা স্মরণ ক'রবো যা স্থায়ী পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল। শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত হয়েছিল কারণ তিনি তার জনগণকে প্রথমে স্থান দিয়েছিলেন। এবং আমরা যখন আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলির মুখোমুখি হই, আমাদের - নেতা এবং নাগরিক হিসাবে - অবশ্যই একই কাজ করতে হবে।”
কানাডার প্রধানমন্ত্রী একজন সংবেদনশীল রাষ্ট্রনায়ক ও সুবক্তা। তাঁর বক্তব্য উপস্থাপনের ধরণ দর্শক ও শ্রোতাদের মুগ্ধ করে। তিনি যখন কথা বলেন বিশ্বের অন্যান্য দেশের নেতারা গভীর মনোযোগের সাথে সে কথা শোনেন। তাঁর সকল বক্তব্যে ফুটে ওঠে সঠিক বিশ্লেষণ ও তথ্য।
বাংলাদেশের জাতির জনককে তিনি যতটা ধারণ করেন সত্যি বলতে অধিকাংশ বাংলাদেশী ততটা পারেন বলে মনে হয় না। একজন প্রকৃত নেতা বিশ্বের অন্যান্য দেশের মহান নেতাদের অনুসরণ করেন, তাদের নিয়ে গবেষণা করেন।
গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং
“পঞ্চাশ বছর আগে শেখ মুজিব গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেন। একজন মানুষ যিনি তার সারা জীবন দেশ ও মানুষের জন্য উৎসর্গ করেছেন, শেখ মুজিবকে বাংলাদেশের মানুষ আজও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। তিনি যে "সোনার বাংলা"-র স্বপ্ন দেখেছিলেন তা এখনও ১৬০ মিলিয়ন বাংলাদেশীকে তাদের জাতীয় পুনরুজ্জীবনের সাধনায় জাগিয়ে তুলছে। তিনি যে নীতির উল্লেখ করেছিলেন "সকলের সাথে বন্ধুত্ব কারো সাথে বিদ্বেষ নয়" এই নীতিটি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির ভিত্তি হিসেবে রয়ে গেছে।
শেখ মুজিব ছিলেন চীনা জনগণের পুরনো ও ভালো বন্ধু। ১৯৫২ এবং ১৯৫৭ সালে চীনে তার দুটি সফরে, তিনি চেয়ারম্যান মাও সেতুং, প্রিমিয়ার ঝোউ এনলাই এবং প্রাচীন প্রজন্মের অন্যান্য চীনা নেতাদের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন। একটি চীনা প্রবাদ আছে, ‘যারা কূপ খনন করেছিল তাদের ভুলে যাবেন না, যখন সেই কূপ থেকে জলপান করবেন।‘ চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য প্রবীণ প্রজন্মের নেতারা যা করেছেন তা আমাদের সর্বদা মনে রাখতে হবে, এবং আমরা চীন-বাংলাদেশ বন্ধুত্বের দণ্ডটি ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে অর্পণ করব।”
চীনের সাথে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এখন শিখরে অবস্থান করছে, বর্তমান বাংলাদেশ সরকার বঙ্গবন্ধুর নীতি অনুসরণ করায়। সে কথা প্রতিধ্বনিত হয়েছে রাষ্ট্রপতি শি পিংয়ের বক্তব্যেও। তিনিও উল্লেখ করেছেন- 'সকলের সাথে বন্ধুত্ব কারো সাথে বিদ্বেষ নয়', বঙ্গবন্ধুর এই নীতির কথা।
বঙ্গবন্ধুর চীন সফর সম্পর্কে খুব কম মানুষ জানতো আগে। কিন্তু তার 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' থেকে চীন সফর সম্পর্কে জানা যায় আর পরবর্তীতে আমরা 'আমার দেখা নয়া চীন' গ্রন্থ থেকেও জানতে পারি বিস্তারিত। সেখানে চীন সফরের বিস্তারিত উঠে এসেছে। চীনের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে চীনা জনগণের পুরানো ও ভালো বন্ধু বলে উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ আজকের উষ্ণ সম্পর্কের ভিত্তি বঙ্গবন্ধুই সূচনা করেছিলেন।
চীন সরকার তাদের সব খুঁটিনাটি নির্ভুল সংরক্ষণ করে। আর সেখান থেকেই বেরিয়ে এসেছে বঙ্গবন্ধুর অবদান। সে দেশের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু চীন সফরের কথা চীনের রাষ্ট্রপতি উল্লেখ করেছেন। যে ঐতিহাসিক সফরে তিনি চীনের মহান নেতাদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন।
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি সোনিয়া গান্ধী
“১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক ঘটনায় ইন্দিরা গান্ধীর বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন এবং বঙ্গবন্ধু তিনি যে পারষ্পরিক শ্রদ্ধার প্রশংসা করেছিলেন তার কারণেই এই গভীর বন্ধুত্বের বন্ধন স্থাপিত হয়েছিল। ১৯৭১ ভারতের জন্য ততটাই রূপান্তরকারী বছর ছিল যতটা ছিল বাংলাদেশের জন্য, এমন একটি বছর যেটি ইন্দিরা গান্ধীকে একজন রাজনৈতিক নেতা এবং রাষ্ট্রনায়ক হিসাবে সর্বোপরি মহিমামান্বিত করেছিল। এরপরই শেখ মুজিবুর রহমান মুক্ত মানুষের নেতা হিসেবে বিশ্ব মঞ্চে আবির্ভূত হন।”
বাংলাদেশের স্বাধীনতার নেপথ্যে যে বিদেশি বন্ধুর অবদান সবচেয়ে বেশি তিনি হলেন তৎকালীন ভারতের মহানুভব প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য সর্বোচ্চ দিয়েছেন। তারই পুত্রবধূ সোনিয়া গান্ধীর বক্তব্য সে কথা প্রতিধ্বনিত হয়েছে।
ঐতিহাসিক একসময়, এক অধ্যায়ের সাক্ষী কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী। তিনি পুত্রবধূ হিসেবে ইন্দিরা গান্ধীর খুব কাছে ছিলেন এবং সে সময়ের রূপান্তরকারী দিনগুলোর উদ্বিগ্নতা উপলব্ধি করেছেন। তিনি তখনকার সাফল্যের নির্যাসও উপভোগ করেছেন।
জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইয়োশিহিদ সুগা
“জাপানে অবস্থানকালে, বঙ্গবন্ধু গ্রামাঞ্চলে কৃষক ও মৎসজীবিদের গ্রাম পরিদর্শন করেন, যেখানে তিনি অনেক স্থানীয় জাপানি নাগরিকের সাথে মতবিনিময় করেন। তিনি বলেন, তিনি জাপানের উন্নয়নকে অনুসরণের আদর্শ হিসেবে বিবেচনা করেন এবং পরবর্তীতে তিনি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদার করার জন্য ব্যাপক প্রচেষ্টা চালান। আমি বুঝি যে, বঙ্গবন্ধুর নিজের ধারণা থেকে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা এইভাবে নকশা করা যা জাপানি পতাকার মতো, যেন আমরা ভাই-ভাই।”
জাপানের সাথে বাংলাদেশের বন্ধুত্ব মহান নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ব্যক্তিত্বের কারণেই তৈরী হয়েছিল।
তারা বঙ্গবন্ধুর নীতিকে সমর্থন করেছিল এবং বাংলাদেশকে একটি জাতি রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। জাতির জনক শেখ মুজিব যখন জাপান সফরে যান সে দেশের সরকার ও জনগণ তাকে প্রাণঢালা শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ধ্যান-জ্ঞান ছিল দেশ ও দেশের জনগণ। তিনি যেখানেই গিয়েছেন দেশ জাতি নিয়ে ভেবেছেন। জাপান শুধু শিল্পোন্নত দেশ নয়, সে দেশের কৃষি মৎস্য শিল্পও উন্নত। তাই তিনি বাংলাদেশের উন্নয়নে জাপানকে মডেল হিসেবে অনুসরণ করতে চেয়েছিলেন। সেইজন্য তিনি জাপানের গ্রামগুলো পরিদর্শন করেছিলেন।
বাংলাদেশের একজন প্রকৃত বন্ধু ওসামু হায়াকাওয়া
“স্বাধীনতা অর্জনের অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ভীষণ ব্যস্ততা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু তার কার্যালয়ে আমাদের আমন্ত্রণ করলেন। বাবার সঙ্গে দেখা হলে তিনি বাবাকে আন্তরিকভাবে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। আমরা দেখলাম, দেশের স্বাধীনতার জন্য উৎসর্গকৃত জীবনের অর্ধেক কারাগারে কাটাতে বাধ্য হলেও বঙ্গবন্ধু ছিলেন সদা উজ্জ্বল ও উষ্ণ মনের অধিকারী। বাবা বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য অভিনন্দন জানানোর পর তারা বৈঠকে বসেন রাষ্ট্র গঠন উৎসাহী দুই নেতার মধ্যে আন্তরিক আলোচনা যেন শেষই হতে চায়নি। তাঁদের মনের আবেগ মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। এই বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান বললেন যে বাংলাদেশকে পূর্ব ও পশ্চিমে বিভক্তকারী যমুনা নদীতে সেতু নির্মাণের কাজ যেন জাপানের হাতে সম্পন্ন হয়। তিনি আগ্রহের সঙ্গে আরও বলেন, সেই সেতু হবে বাংলাদেশ ও জাপানের বন্ধুত্বের প্রতীক।
১৯৭৩ সালের অক্টোবর মাসে রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসাবে জাপান সফরের সময় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার দল হায়াকাওয়া পরিবারের আদি নিবাস ওয়াকাইয়ামাতেও যান। বাবা বঙ্গবন্ধুকে কৃষি ও মৎস্যজীবিদের গ্রামে নিয়ে গিয়ে জাপানিদের সাধারণ ও অনাড়ম্বর জীবন দেখাতে চেয়েছিলেন। ওয়াকাইয়ামা সফরকালে বঙ্গবন্ধু স্কুলের শিশুদের সঙ্গেও দেখা করেন। একসময় তিনি রাস্তার ধারে হলুদ রঙের ফল দেখে কৌতুহলী হলেন। বাবা তার সঙ্গে গাড়ি থেকে নেমে কমলালেবু চাষীদের সঙ্গে কথা বলেন।”
বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে জাপানিরা খুবই বিশ্বস্ত, তারা তা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ধরে রাখে। বঙ্গবন্ধুর সাথে বন্ধুত্ব হয়েছিল তাকাশি হায়াকাওয়ার। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের একজন প্রকৃত বন্ধু। বাংলাদেশকে তিনি দ্বিতীয় মাতৃভূমি হিসাবে জানতেন। শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁর দেহাভষ্ম বাংলাদেশের মাটিতে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। খবরটি তৎকালীন সময়ের দৈনিক ইত্তেফাকে দেখেছিলাম। তাকাশি হায়াকাওয়ার পরবর্তী প্রজন্মও বন্ধুত্ব অটুট রেখেছেন বাংলাদেশের সাথে।
কোরিয়া প্রজাতন্ত্রের প্রধানমন্ত্রী চুং সাই-কিউন
“কোরিয়া এবং বাংলাদেশের মধ্যে অভিন্ন ভিত্তি রয়েছে: আমাদের উভয়েরই ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বিজয়ের গর্বিত উত্তরাধিকার রয়েছে। জাতির পিতা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের মহান আত্মত্যাগ, যিনি বাঙালি জাতির স্বাধীনতার সংগ্রামে এবং বাংলা ভাষাকে জাতীয় ভাষা হিসেবে সুরক্ষিত করার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, সেই মহান আত্মত্যাগ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়। পূর্বপুরুষরা যারা আমাদের জাতিকে রক্ষা ও নির্মাণের জন্য শহীদ হয়েছিলেন তাদের রক্ত ও ঘামের।”
বঙ্গবন্ধু যে ভাষা আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছেন ইতিহাসটি আগে বাংলাদেশের খুব কম মানুষই জানতো। কিন্তু কোরিয়ার প্রধানমন্ত্রী ঠিকই ইতিহাসটি খুঁজে বের করেছেন। তিনি বলেছেন স্বাধীনতা ও বাংলা ভাষাকে জাতীয় ভাষা হিসাবে সুরক্ষিত করার জন্য বঙ্গবন্ধু তার জীবন উৎসর্গ করেছেন।
ওআইসি মহাসচিব ইউসুফ বিন আল-ওথাইমিন
“মহান নেতার দূরদর্শী নির্দেশনায় ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়। ১৯৭৪ সালে নবীন দেশটির জাতির পিতা ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থার সদস্য হিসাবে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেন। তখন থেকে বাংলাদেশ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছে এবং অর্থপূর্ণভাবে ইসলামী সহযোগিতা ও সংহতির কার্যক্রমে সংস্থার প্রধান উদাহরণ হিসেবে অবদান রেখেছে।
১৯২০ সালের মার্চ মাসে জন্মগ্রহণকারী জাতির পিতা তার জীবনের বেশিরভাগ সময় বৈষম্য ও অসমতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তার জীবন উত্সর্গ করেছিলেন এবং সোনার বাংলার প্রচারণা চালিয়েছিলেন। জনগণ ও জাতির জন্য তার আজীবন সেবা সর্বদা স্মরণীয় এবং সর্বদা প্রশংসিত। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী দেশটি যেভাবে পালন করছে তা সত্যিই ঐতিহাসিক, জাতির পিতার নিজের কন্যা পিতার মতই বৈষম্য ও অসমতার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। আর তার বাবার সোনার বাংলার স্বপ্ন বাস্তবায়নে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন।”
বঙ্গবন্ধু ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করতেন কিন্তু তিনি ধর্মবিদ্বেষী ছিলেন না। তিনি ধর্মের ব্যাখ্যাও করেছেন চমৎকার। বাংলাদেশ শুরু থেকেই মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল, সেই বাস্তবতায় তিনি অন্যান্য ধর্মের অধিকার সংরক্ষণ করেই ওআইসিতে যোগ দিয়েছিলেন। ১৯৭৪ সালে সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তের কথাই স্মরণ করেছেন ওআইসি মহাসচিব ইউসুফ আল ওথাইমিন। বঙ্গবন্ধু মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে শান্তি ও সম্প্রীতি রক্ষায়ও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান
“প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানকে স্মরণ করার জন্য শতবর্ষের অনুষ্ঠানগুলি আপনার এবং বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে তাঁর প্রতি গভীর ভালবাসা ও সম্মানের প্রতিফলন করে।”
ইমরান খান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিচয়টাও মনে হয়েছে জানেন না। নাকি তিনি জেনেও না জানার ভান করেছেন? ইমরানের জানা উচিৎ ছিল বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি কারণ তিনি রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় হত্যাকাণ্ডের শিকার হন।
পররাষ্ট্র সচিব ফিলিপাইন প্রজাতন্ত্র টিওডোরো এল লকসিন, জুনিয়র
“যিনি সাহসের সাথে দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন-তার জনগণের মুক্তি এবং জীবনের জন্য একটি সংগ্রাম প্রজ্বলিত করেছিলেন। তিনি সমগ্র জাতিকে, প্রকৃতপক্ষে সমগ্র সভ্য বিশ্বকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন, বাংলাদেশের জনগণের মুক্তির জন্য তৎকালীন বিশ্বের সমস্ত তারুণ্যের আদর্শিক সমর্থন লাভ করেছিলেন।”
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে বিভিন্ন গুণীজনদের কাছ থেকে তার মহত্বের কথা বেরিয়ে এসেছে। সবাই জাতির জনক শেখ মুজিবের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন। সত্য মুছে যায়নি, মুছে যায়না।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন
“গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আমার আন্তরিক অভিনন্দন গ্রহণ করুন। এটা প্রতীকী যে এই একই দিনে, আপনার দেশ শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করছে- একজন অসামান্য রাজনৈতিক নেতা, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা।”
বিশ্ব নেতা রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিনের বক্তব্যে একটি বিষয় বিশেষভাবে ফুটে উঠেছে যে স্বাধীনতা ঘোষণার সুবর্ণ জয়ন্তী, তিনি বুঝিয়েছেন স্বাধীনতা ঘোষণা আর স্বাধীনতা এক নয়। পরবর্তী সাড়ে নয় মাসে সেটি অর্জন করতে হয়েছে একটি গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে। চীন, তুরস্কের ও সৌদি আরব সহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ ছাড়া সারা বিশ্বের সমর্থন ছিল সেই স্বাধীনতার সংগ্রামে।
চেয়ারম্যান অব দ্য ফেডারেশন কাউন্সিল অব দ্য ফেডারেল অ্যাসেম্বলি অব দ্য রাশিয়ান ফেডারেশন
ভ্যালেন্টিনা মাতভিয়েনকো
“এই বিশিষ্ট রাজনীতিবিদকে রাশিয়ার একজন আন্তরিক বন্ধু হিসেবে স্মরণ করা হয়, যিনি বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতা, জাতীয় পরিচয় ও ঐক্যের সংগ্রামের প্রতীক হয়ে উঠেছেন। প্রণীত সংবিধান বাংলাদেশ সমাজের সকল আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত করেছে। আমরা অত্যন্ত প্রশংসা করি যে শেখ মুজিবুর রহমান পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং একে অপরের স্বার্থ বিবেচনার নীতির ভিত্তিতে আমাদের আন্তঃসরকারি সম্পর্কের জন্য একটি শক্ত ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন।”
ফেডারেল অ্যাসেম্বলি অব রাশিয়ান ফেডারেশনের চেয়ারম্যান মহামান্য ভ্যালেন্টিনা মাতভিয়েনকো তার বাণীতে চমৎকারভবে কিছু বিষয়ের অবতারণা করেছেন, যা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মহাত্ম্যকে ফুটিয়ে তুলেছে। একজন অভিজ্ঞ পার্লামেন্টেরিয়ান হিসেবে তিনি মহান বঙ্গবন্ধুর সরকারে প্রনীত বাংলাদেশের সংবিধানের মহাত্ম্য তুলে ধরেছেন। আর তাঁর পারষ্পরিক শ্রদ্ধা এবং একে অপরের স্বার্থ বিবেচনার নীতিরও প্রশংসা করেছেন। এসব ব্যক্তিত্বের বঙ্গবন্ধু চর্চা আমাকে বিস্মিত করেছে।
তুরস্কের রাষ্ট্রপতি রিসেপ তাইয়িপ এরদোয়ান
“বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি প্রয়াত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তিনি সারা জীবন তার জাতির জন্য যে সংগ্রাম করেছেন এবং তার ত্যাগের মাধ্যমে বিংশ শতাব্দীর বিশিষ্ট রাষ্ট্রনায়কদের মধ্যে তার স্থান করে নিয়েছেন।”
এক অর্থে মহান নেতা শেখ মুজিবই বাংলাদেশ। তাকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশে ভাবাই যায়না। বঙ্গবন্ধুর ত্যাগ ছাড়া বাংলাদেশের জন্মই হতো না, সে কথায় প্রতিধ্বনিত করেছেন তুরস্কের রাষ্ট্রপতি তাইপ এরদোগান।
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন
“আমি বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীতে বাংলাদেশের জনগণকে অভিনন্দন জানাতে লিখছি। ১৯৭১ সালে ট্রাফালগার স্কোয়ারে বিশাল সমাবেশ এবং ১৯৭২ সালে স্বাধীনতার পর ১০ ডাউনিং স্ট্রিটে শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক সফরের পর থেকে যুক্তরাজ্য এবং বাংলাদেশ পাঁচ দশক ধরে বন্ধু এবং অংশীদার। শেখ মুজিবুর রহমানের গণতান্ত্রিক, মুক্ত, ধর্মনিরপেক্ষ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক একটি বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার রূপকল্প অনুপ্রেরণাদায়ক এবং আমি আশা করি এটি ২০২১ সালে এবং তার পরেও ৫০তম বার্ষিকী উদযাপনের সময় বাংলাদেশকে পথ দেখাবে।”
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে তার বক্তব্য পাঠিয়েছেন। তিনি ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিট পরিদর্শনে কথা উল্লেখ করেছেন। মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী এডোয়ার্ড হীথের সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসাবে। বঙ্গবন্ধু কখনোই বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন না। বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মহামান্য তাজউদ্দিন আহমেদ। জাতির জনক ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি দেশে ফেরার পর ১২ই জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। যুক্তরাজ্যের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তথ্য প্রদানে যত্নবান হলে নতুন প্রজন্ম সঠিক ইতিহাস জানতে পারবে। বঙ্গবন্ধুর সময়কালীন যুক্তরাজ্যে নেতারা এজাতীয় তথ্য বিভ্রাট ঘটাননি।
লেখক ও বিবিসির সাবেক ব্যুরো প্রধান স্যার মার্ক টালি
“আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে স্মৃতিতে বিশেষভাবে আনন্দিত। মহান নেতা যিনি আপনার দেশকে স্বাধীনতার দিকে নিয়ে গেছেন। ঢাকা ফেরার পর তিনি আমাকে তার সাথে দেখা করার জন্য সদয় আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন এবং আমি সেই ক্ষণটি কখনই ভুলব না। তাঁর উচ্ছ্বাস, যে উষ্ণতার সাথে তিনি আমাকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন এবং তার কণ্ঠের আবেগ যখন তিনি তার জনগণের কথা বলেছিলেন। এটা সত্যিকার অর্থেই বলা যেতে পারে যে, শেখ শাব, যেমন আমি তাকে চিনতাম, তিনি ছিলেন বিংশ শতাব্দীর একজন মহান নেতা।”
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে একজন সাংবাদিক হিসাবে স্যার মার্ক টালির যে ভূমিকা তা খুব কম সাংবাদিকেরই আছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশে পাকিস্তান যে মানবিক বিপর্যয় ঘটিয়েছিল, তা বিশ্ববাসীকে জানিয়েছেন। মার্ক টালির মত একজন সাংবাদিকের কাছ থেকে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জানতে পারো ভাগ্যের ব্যাপার। তিনি বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধকে দেখেছেন খুব কাছ থেকে।
বর্তমান প্রজন্মের কেউ আর বঙ্গবন্ধুকে 'শেখ সাব' বা 'শেখ সাহেব' বলে সম্বোধন করে না। তবে এক সময় জনগণ যে তাঁকে ভালবেসে শেখ সাহেব সম্বোধন করতেন সে কথাটি মহামান্য মার্ক টালি আমাদের মনে করিয়ে দিলেন।
ইউনেস্কোর মহাপরিচালক অদ্রে আজলে
“৫০ বছর আগে ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন, যা বাংলাদেশ তথা বিশ্বের ইতিহাসকে চিহ্নিতকারি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ। তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ এই দিনটি দেশকে স্বাধীনতার দিকে পরিচালিত করেছিল। গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি সর্বজনীন মূল্যবোধকে রক্ষা করেছে: স্বাধীনতা, মানবাধিকার, মর্যাদা, শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং বিজ্ঞানের অগ্রগতি। এবং ঠিক এই সকল কারণেই ইউনেস্কো এই ঐতিহাসিক ভাষণটিকে স্মৃতিতে ধরে রাখতে বিশ্ব তথ্যতালিকাগ্রন্থে নথীভুক্ত করেছে। এই কারণেই আমাদের সংগঠন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবার্ষিকী উদযাপনে যোগ দিতে পেরে আনন্দিত।
এই সন্ধিক্ষণে, আসুন আমরা আশাবাদী হই এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে স্মরণ করি যে, মানবতার জন্য এই লড়াই আমাদের অধিকার, আমাদের মুক্তি এবং আমাদের স্বাধীনতার জন্যও।”
ইউনেস্কোর মহাপরিচালক অড্রে আজৌলে যথার্থই মূল্যায়ন করেছেন বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটিকে। স্বল্প পরিসরে তিনি বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে ৭ই মার্চ প্রদত্ত ভাষণের গুনাগুন তুলে ধরেছেন। তার জন্য এটা খুবই স্বাভাবিক ছিল। কারণ তার সংগঠন সকল দিক বিবেচনা করেই ভাষণটিকে স্বীকৃতি দিয়েছে।
জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস
“শেখ মুজিবুর রহমানের দৃষ্টিভঙ্গি এবং লক্ষ্যগুলি বাংলাদেশকে গঠন করতে সাহায্য করেছিল এবং অনেককে এখনও অনুপ্রাণিত করে চলেছে।”
অ্যান্তোনিও গুতেরেস একটি বাক্যে অনেক কথা বলেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের দৃষ্টিভঙ্গি ও লক্ষ্যগুলি বা তাঁর আদর্শসমূহ বাংলাদেশ গঠন করেছিল। শেখ মুজিব শুধু একজন ব্যক্তিই নন; তিনি একটি প্রতিষ্ঠানও। যার কারণেই অনেক জাতিই এখনও অনুপ্রাণিত হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে।
ক্যাথলিক চার্চের প্রধান এবং ভ্যাটিকান সিটি রাজ্যের সার্বভৌম পবিত্র পোপ ফ্রান্সিস
“শেখ মুজিবুর রহমান সকল বাংলাদেশীদের জন্য যে উত্তরাধিকার সমূহ রেখে গেছেন তার মধ্যে এটি একটি। তিনি মোকাবেলা এবং সংলাপের সংস্কৃতির প্রচার করেছিলেন, যা প্রজ্ঞা, অন্তর্দৃষ্টি এবং দৃষ্টিভঙ্গির প্রশস্ততাকে চিহ্নিত করে। তিনি জানতেন যে এই ধরনের বহুত্ববাদী এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজে, যেখানে প্রত্যেক ব্যক্তি স্বাধীনতা, শান্তি এবং নিরাপত্তায় বসবাস করতে পারে, একটি আরও ন্যায়সঙ্গত এবং ভ্রাতৃত্বপূর্ণ বিশ্ব গড়ে তোলা যেতে পারে।”
ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস এবং তিনি ভ্যাটিকানের সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। সাধারণত পোপেরা রাজনৈতিক বিষয়ে মন্তব্য এড়িয়ে যান এবং তাদের কর্মকাণ্ড ধর্মীয় বিষয়ে সীমাবদ্ধ রাখেন। কিন্তু পোপ পোপ ফ্রান্সিস রাজনৈতিক বিষয়ে যথেষ্ট খোঁজ খবর রাখেন। মাননীয় পোপ জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে যে মূল্যায়ন করেছেন তা গভীর মূল্যবোধ সম্পন্ন। বঙ্গবন্ধু গণতান্ত্রিক নিয়ম-নীতিতে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যাকে পোপ মোকাবেলা এবং সংলাপের সংস্কৃতি বলে উল্লেখ করেছেন। বঙ্গবন্ধু বহুত্ববাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষেই সংবিধানের চার মূল নীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতা যোগ করেছিলেন। যাতে জাতি গঠনে সকলের মতামতের গুরুত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।
ভিয়েতনামের সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি গুয়েন ফু ত্রং
“আমি সত্যিই বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা করি, প্রথম বাংলাদেশী রাষ্ট্রপতি যিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য তার সমস্ত ব্যয় করেছেন যেমন সংগ্রাম।”
ভিয়েতনামকেও অনেক সংগ্রাম ও যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আজকের এই অবস্থানে পৌঁছাতে হয়েছে। ভিয়েতনাম সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র, বাংলাদেশেরও সংবিধানের চার মূলনীতির একটি সমাজতন্ত্র। যা দুই দেশের মধ্যে ভাতৃত্বের বন্ধন তৈরি করেছে। এই কারণে একজন ভিয়েতনামী নেতা বোঝেন বঙ্গবন্ধুর তাঁর দেশের জন্য ত্যাগ ও সংগ্রাম এবং তিনি প্রকৃতই তাকে শ্রদ্ধা করেন।