বঙ্গবাজারের আগুন দেখে বিদেশেও আমরা স্তম্ভিত হয়ে আছি। আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া মানুষের ভবিষ্যৎ দূর থেকে দেখাও কষ্টের। একেকজন মানুষের অসহায় মুখ আর আর্তি ঘুমাতে দেয়নি। হঠাৎ করে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া এই মানুষগুলো ঈদ বাণিজ্যের জন্য ধৈর্য ধরে, বুক বেঁধে অপেক্ষা করছিলেন। অথচ এক নিমিষেই ছাই হয়ে গেল সবকিছু।
বঙ্গবাজারের আগুন এবং পরবর্তীতে তাদের পাশে দাঁড়ানো নিয়েও চলছে বাকবিতণ্ডা। সোশ্যাল মিডিয়ার এই ডিজিটাল দুনিয়ায় আর যা কিছুর অভাব হোক উপদেশ বা পরামর্শের অভাব হয় না। এক শ্রেণি বলছে কোটিখানেক মানুষ সাহায্য করলেই ব্যবসায়ীরা আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন। কেউ কেউ টাকার অংক দিয়ে হিসেব কষেও দেখিয়ে দিচ্ছেন কীভাবে তা সম্ভব। হয়তো সম্ভব। কারণ জনবহুল দেশে জনসংখ্যা যেমন সমস্যা তেমনি সম্ভাবনাও বটে। কিন্তু বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? আর ঘণ্টা যে বাঁধা যাবে না সেটাও লিখেছেন অনেকে। তাদের সাফ কথা টাকা দেয়াটা সমস্যা না, সমস্যা টাকার বিতরণ আর সঠিক জায়গায় গিয়ে তা পৌঁছানো। এরা বলছেন, তারা টাকা দেবেন না। কারণ তারা নিশ্চিত এইসব সাহায্যের টাকা নয়-ছয় হবে, অন্যের ভোগে লাগবে। কথাগুলো কি বেঠিক?
বঙ্গবাজারের আগুনে আলু পোড়া খাবার লোকের অভাব যে হবে না সেটা তো আগুন লাগার সময়েই টের পাওয়া গিয়েছে। না হলে কি মাইকিং করে বারবার বলতে হতো যে, দয়া করে কাপড় চুরি করবেন না? ভাবুন একবার। আগুনের লেলিহান শিখায় সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে আর তার ভেতরেই চলছে কাপড় চুরি। অন্যদিকে ফায়ার ফাইটারদের মারছে, তাদেরকে হেনস্তা করছে উগ্র জনগণ। ভাবখানা এই দায়িত্ব তাদের হাতে দিলে তারা তখনই আগুন নিভিয়ে দিতে পারবেন।
ফায়ার সার্ভিসের মানুষজন এই সিডনি শহরে হিরো হিসেবে গণ্য হন। তাদের কাছে পেলে ছবি তুলে রাখে জনগণ। অতীতে ফায়ার ফাইটার ছিলেন তেমন একজন অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রীও হয়েছিলেন। আমাদের দেশে এই পেশাকে এখনো সম্মানের চোখে দেখার সৌজন্য চালু হয়নি। আমি বিস্মিত ও অবাক হয়েছি এদের ওপর হামলাকারীদের আচরণে। আর একদল মানুষ আধুনিক পদ্ধতি বা যন্ত্রের ওপর বিশ্বাস না রেখে হাতে নিয়ে পানি ছুঁড়ে মারার যে ধর্মকৌশল দেখালেন তাতে অবাক হবারও বিকল্প থাকে না।
আগুন নিভেছে। জীবন আবার তার নিজের নিয়মে ঘুরে দাঁড়াবে। সরকার-প্রশাসন-মানুষ-সমাজ সবাই মিলে পাশে দাঁড়ালে বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীরা ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন। কিন্তু এই দুর্ঘটনা থেকে তারা কী শিক্ষা নেবেন? যেমন আমরা এখন আর কোনো কিছু থেকেই শিক্ষা নেই না। আগুন শুধু বঙ্গবাজারে না, আগুন আমাদের স্বাধীনতা, বিশ্বাস, মিডিয়া– কোনোকিছুকেই ছাড় দিচ্ছে না। দেশের খবরাখবর এখন আর দেশের ভেতর সীমাবদ্ধ থাকে না। মুহূর্তে তা ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বময়।
আজকাল দুনিয়ার সব দেশে বাংলাদেশীদের বসবাস। তারা রেমিটেন্সযোদ্ধা। তাদের আয়ের এক বিরাট অংশ তারা দেশে পাঠায়। সবারই কেউ না কেউ আছে দেশে। আর ওই কারণেই নাড়ির টানে বাঁধা দেশ ও বাইরের বাঙালি। প্রশ্ন হচ্ছে এসব মিডিয়া ও স্বাধীনতা বিষয়ক বিতর্ক দেশের ভাবমূর্তিকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করাবে? এই কয়েক বছর আগেও আমাদের দেশের উন্নয়ন আর অগ্রগতি সাড়া ফেলেছিল বিশ্বে। সে আলোড়ন কিছুটা হলেও স্তিমিত হয়ে এসেছে। বিশ্বমন্দা আর ইউক্রেইন-রাশিয়া অসম যুদ্ধে সারা দুনিয়ায় এখন মন্দা চলছে। বাংলাদেশ তার বাইরে নয়। ফলে বলা যাবে না অভাবের কারণে ইমেজ নষ্ট হচ্ছে। বরং সাম্প্রতিক সময়ের দুর্ঘটনাগুলো, যুক্তরাষ্ট্রের নজরদারি, একের পর অনিয়ম, মানবতা বিরোধিতার অভিযোগই এখন গলার কাঁটা।
আমাদের দেশে অভাব, মন্দা, আনন্দ, শান্তি যাই থাক আর না থাক একটা বিষয়ের অভাব নেই। তা হলো উত্তেজনা। আগুনের কথা বলছিলাম। কথায় বলে সূর্যের চেয়ে বালির গরম বেশি। বঙ্গবাজারের আগুন যতটা উত্তাপ ছড়িয়েছে তার বেশি আঁচ আর উত্তাপে দগ্ধ হয়েছে সমাজ। মানুষের বিশ্বাস পুড়েছে মিডিয়া ও সরকারের দ্বন্দ্বে। সরকারের এত ভালো কাজ, এত উন্নয়ন, শেখ হাসিনার এমন প্রজ্ঞাশীল নেতৃত্বের পরও আজ তাদের আচরণকে প্রশ্নবিদ্ধ করে চলেছে অতিউৎসাহীর দল। শামসুজ্জামান শামসকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ভোর রাতে। আর এই জন্য যে মামলাটি রুজু করা হয়েছিল তার সময় রাত একটার পর। যে কারণে এই অতিউৎসাহের নাম হয়ে গেছে মধ্যরাতের মামলা-হামলা।
সবুর করার সময় নেই কারও। সময় নেই সময়কে সময় দেয়ার। লাভের লাভ কী হলো? মিডিয়া জগৎ, শিক্ষক সমিতি সবকিছু দুভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছে। দেশের মানুষ আসলে কী ভেবেছেন বা আদৌ তারা এসব তর্কে উৎসাহী কি না তা জানার আগেই বিভক্ত হয়ে গিয়েছে দেশ ও সমাজ। বলাবাহুল্য বিদেশে বসবাসরত বাঙালিরাও বসে থাকেনি। তারাও মাঠে নেমে গিয়েছেন দুই দলে ভাগ হয়ে। দুই দলে ভাগ হয়ে যাওয়া সমাজ আর মিডিয়া মনে করিয়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগ আর বিএনপির শত্রুতা যেমন স্বাভাবিক নিয়তি, তেমনই স্বাভাবিক যেকোনো বিষয়ে দুই দলে ভাগ হয়ে যাওয়া। এই সমাজিক আগুন নিভবে কীভাবে?
বাজারে আগুন, সমাজে আগুন, বঙ্গবাজারে আগুন, মিডিয়ায় আগুন তারপরও কি শান্তিতে ঘুমাবে মানুষ? বিদেশী মিডিয়াও এখন আক্রমণাত্মক। এতসব ঝামেলায় কোনো ধনী, কোনো নেতা বা সুশীল নামের কেউ বিপদে পড়বেন না। বিপদে পড়বে আমজনতা। সবার আগে আমাদের দেশ। আমাদের স্বাধীনতা।