অরণ্যবিনাশী আয়োজন ও স্থানীয় প্রতিরোধ

প্রাকৃতিক বনভূমি নিশ্চি‎হ্ন হওয়ার এবং আদিবাসী অরণ্য অধিকার লঙ্ঘনের আরেকটি কারণ হলো আদিবাসী জনগণের নিজস্ব উৎপাদন ব্যবস্থা ও উৎপাদন সম্পকর্কে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা না করা।

পাভেল পার্থপাভেল পার্থ
Published : 21 March 2024, 12:52 PM
Updated : 21 March 2024, 12:52 PM

বনজংলার সঙ্গে ঐতিহাসিকভাবেই এই জনপদের এক গভীর গোপন সম্পর্ক আছে। মৈতৈ মণিপুরী, মান্দি কি বাঙালি জাতির ভেতর প্রচলিত মহাকাব্যসমূহ অরণ্যজীবন তাড়িত। মহাভারতে আছে, দেবতা অগ্নির অরুচি ও ক্ষুধামান্দ্য হলে খাণ্ডববন আগুনবাণ মেরে পুড়িয়ে দেয়া হয়। অগ্নিকে বনপোড়া প্রাণীর মাংস খাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। বনপোড়া মাংস খেয়ে অগ্নির ওই রোগ সারে বলে অরুচি ও ক্ষুধামান্দ্য ‘অগ্নিমান্দ্য’ হিসেবেও পরিচিত। এক ময়দানব ছাড়া আর কেউ বেঁচে থাকে না ওই বনের। মহাভারতের কাল শেষ হয়ে গেলেও আমরা দেখি এখনও বাজার কি বনবিভাগের ক্ষুধামান্দ্য শেষ হয়ে যায়নি। আর তাই একটির পর একটি মুমূর্ষু শীর্ণকায় বনের টুকরোও আর আস্ত রাখে না কেউ। নির্বিচারে অরণ্যভূমি দখল, বিক্রি, নিশ্চি‎হ্ন ও লুট হয়ে যায়। সুন্দরবনসহ উপকূলীয় বনভূমি, পার্বত্য চট্টগ্রামের বনাঞ্চল, সিলেট অঞ্চলের বর্ষারণ্য, মধুপুর-ভাওয়াল ও উত্তরবঙ্গের শালবন, বৃহত্তর ময়মনসিংহের সীমান্ত টিলার বনভূমি, বরেন্দ্রভূমির গ্রামীণবন, হাওরের জলাবন ঘিরে এখনও দেশের ৬০ কি তারও কমবেশি আদিবাসী এবং পেশাগত মৌয়াল-বাওয়ালী-চুনারি-মাঝি-জেলে জনগণের বসবাস। আদিবাসী ও পেশাগত বননির্ভর জনগোষ্ঠীসহ প্রায় ৩৫ লাখ মানুষ এখনও কোনো না কোনোভাবে দেশের প্রাকৃতিক বনভূমির উপর নির্ভরশীল। নিম্নবর্গের এই ঐতিহাসিক বননির্ভরশীলতা এখনো রাষ্ট্রীয় নীতি কি নথিতে স্বীকৃত হয়নি। প্রাকৃতিক বন ছাড়া সভ্যতা টিকে থাকে না। অপরদিকে বননির্ভর জনগণ ছাড়া প্রাকৃতিক বনের বিস্তারও রুদ্ধ হয়। দেশে বিদ্যমান ক্ষয়িষ্ণু প্রাকৃতিক বনভূমির কোনো কোনো নির্দিষ্ট অংশকে জাতীয় উদ্যান, অভয়ারণ্য, গেম রিজার্ভ, রক্ষিত বন, সংরক্ষিত বন নাম দেয়া হয়েছে। আবার একইসঙ্গে প্রাকৃতিক বনভূমিতেই প্রশ্নহীনভাবে গড়ে তোলা হয়েছে নানান সামরিক-বেসামরিক স্থাপনা, খনন, কারখানা, বাণিজ্যিক পর্যটন ও বৃহৎ প্রকল্প।

‘জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২’ অনুযায়ী দেশে আদিবাসী জনসংখ্যা দেখানো হয়েছে ১৬,৫০,১৫৯ জন এবং জাতিসত্তা ৫০টি। দেশে আদিবাসী জনসংখ্যা মোট জনসংখ্যার মাত্র ১.২ ভাগ। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট পরিচালিত ২০১৮ সালে শেষে হওয়া ভাষাগত জরিপের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে আদিবাসীদের ৪০টি মাতৃভাষা আছে। এর ভেতর কন্দ, খাড়িয়া, কোডা, সৌরা, মুন্ডারি, কোল, মালতো, খুমি, পাংখোয়া, রেংমিটচা, চাক, খিয়াং, লুসাই ও লালেং এই ১৪টি আদিবাসী মাতৃভাষা বিপন্ন। আদিবাসী জাতির জীবনধারায় প্রাকৃতিক বনভূমি অবিচ্ছিন্নভাবে জড়িয়ে আছে। অনেক আদিবাসী নাগরিক নিজেদের বনভূমির সন্তান মনে করেন। আদিবাসী জনগণ বনবাস্তুসংস্থানের অংশ। আদিবাসী জনগণ নিজেদের বনের নিয়ন্ত্রক বা শাসক মনে করেন না, মনে করেন এর ব্যবস্থাপক। বনকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে আদিবাসী মনোজগৎ, নিজস্ব পরিসর, রীতি, আচার, কৃত্য, ধর্ম, আপন সত্তা ও বৈভব, সাহিত্য, লোকায়ত জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প ও সংস্কৃতি। আদিবাসী জনগণ এবং বনভূমি অভিন্ন যমজ। এদের জোর করে আলাদা করা যায় কিন্তু আলাদা করলে এরা কেউ আলাদাভাবে স্বকীয় সত্তা নিয়ে বাঁচতে পারে না। প্রায় সকল আদিবাসী জাতিরই রয়েছে নিজস্ব লোকায়ত বনবিজ্ঞান ও বনপ্রতিবেশীয় অভিজ্ঞতা। আদিবাসীদের পবিত্র বৃক্ষ, পবিত্র প্রাণবৈচিত্র্য, পবিত্র বনভূমি ও পবিত্র জলাভূমি সংরক্ষণ চর্চার ধারা আছে। খাদ্য, পানীয়, চিকিৎসা, কৃত্য, আচার, পার্বণ, গৃহস্থালিসহ দৈনন্দিন জীবন অনেকটাই বনের উপর নির্ভরশীল। আদিবাসী জনগণ বনকে ব্যক্তিগত সম্পত্তি মনে করেন না। বনকে কেনাবেচা করা যায়, এমন বাণিজ্যিক পণ্য মনে করেন না। বনভূমিকে কেবলমাত্র বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার বিবেচনা করেন না। খাদ্য ও জীবনের নিরাপত্তার জন্য আদিবাসীসহ স্থানীয় মানুষ বনের উপর নির্ভরশীল হলেও ইউরোপীয় রেকর্ড থেকে বনভূমি বাণিজ্যিকায়নের এক দুর্ধর্ষ কীর্তি জানা যায়। ১৭৭৮ সালে ক্যাপ্টেন জেমস কুক তার বাণিজ্য জাহাজ মেরামত করাতেন উত্তর-পশ্চিম আমেরিকার নুটকা সাউন্ড অঞ্চলে। জাহাজ মেরামতের জন্য তখন বনভূমির বৃক্ষের কাঠ ব্যবহৃত হতে থাকে। পরবর্তীতে ভ্যানকুভার দ্বীপ থেকে কাঠের তৈরি জাহাজের স্পার চীনে বিক্রি করাই এক লাভজনক ব্যবসা হয়ে দাঁড়ায়। এটি ১৮০০ শতক পর্যন্ত বনভূমিকেন্দ্রিক এক প্রধান বাণিজ্যে পরিণত হয়। পরবর্তীতে কেবলমাত্র জাহাজ নয় উপনিবেশিক শাসকদের দুর্গও তৈরি হতে থাকে কাঠ দিয়ে। বাড়তে থাকে কাঠের বাণিজ্য এবং বনের বাণিজ্যিকায়ণ। এই বাণিজ্য চাঙ্গা রাখতেই এশীয় অঞ্চলের বনভূমির উপর তৈরি হয় ব্রিটিশ উপনিবেশিক নিয়ন্ত্রণ। অরণ্যের গিলা-কলিজা তছনছ করে শুরু হয় এক প্রশ্নহীন উপনিবেশিক বন-বাণিজ্য।

ব্রিটিশ, ভারত, পাকিস্তান সব আমল শেষ হয়ে গেলেও স্বাধীন বাংলাদেশে এখনও বনবিভাগ সেই উপনিবেশিক মনস্তত্ত্বকেই ধারণ করে রেখেছে। বনভূমি এখনো কেবলই বাণিজ্যের কাঁচামালের উৎস আর মুনাফার নিরাপদ জোগানদার। বন-বাণিজ্য সামলাতে গিয়ে ‘সংরক্ষণ’, পরিবেশ রক্ষা, বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য গোছের কিছু কর্মসূচিও জারি রাখা হয়েছে। জাতীয় উদ্যান, অবকাশ যাপন কেন্দ্র, করপোরেট পর্যটন, ইকোপার্ক, ইকোট্যুরিজম, তেল-গ্যাস খনন, শিল্পকারখানা স্থাপন, সামাজিক বনায়ন, রাবার বাগান, আগ্রাসী গাছের বাগান ইত্যকার প্রকল্প এবং উদ্যোগসমূহ বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এইসব প্রকল্প জোর করে বনের সঙ্গে স্থানীয় আদিবাসী জীবনের সম্পর্ককে বিচ্ছিন্ন করেছে এবং এসব প্রকল্পভিত্তিক তৎপরতা প্রাকৃতিক বনবৈচিত্র্যের প্রতিবেশগত সুরক্ষাও নিশ্চিত করতে পারেনি। কিন্তু অরণ্য, প্রতিবেশ, প্রাণবৈচিত্র্য ও বাস্তুসংস্থান সুরক্ষায় আদিবাসী জনগণের লড়াই সংগ্রাম ঐতিহাসিক। আজকে এশীয় হাতি সুরক্ষায় বিশ্ব তৎপর হয়েছে। অথচ আজ থেকে দেড়শ বছর আগে নেত্রকোণার সুসং দুর্গাপুরে হাতি বাণিজ্যের বিরুদ্ধে জীবনবাজি রেখে হাজং আদিবাসীরা শুরু করেছিলেন ‘হাতিখেদা বিরোধী আন্দোলন’। সিলেট সীমান্তে খাসিরা পাথর খননের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ জুলুম সামলে দাঁড়ান। শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জে বালিশিরা পাহাড় রক্ষায় জীবন দেয় গ্রামীণ নিম্নবর্গ। কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে পাহাড়-জঙ্গল-বসতি বাঁচাতে পার্বত্য চট্টগ্রামে শুরু হয় দীর্ঘ সংগ্রাম। এককালে খর্জুর গাছ বাঁচাতে রাজার কুড়ালের কোপে প্রাণ দিয়েছিলেন অমৃতা দেবী। বাংলাদেশে মধুপুর শালবন রক্ষায় রাষ্ট্রের গুলিতে শহীদ হন পীরেন স্নাল। নেত্রকোণার মেনকিফান্দা পাহাড়ের শালবন বাঁচাতে জেলজুলুম সহ্য করেন অজিত রিছিল। রাষ্ট্র আদিবাসী জনগণের অরণ্য-যন্ত্রণা বুঝতে চায়নি। অরণ্য সুরক্ষায় আদিবাসীদের ঐতিহাসিক অবদানকে স্বীকৃতি দেয়নি। অরণ্য ঘিরে রাষ্ট্রের প্রকল্পভিত্তিক বাণিজ্যিক মনস্তত্ত্বের বিরুদ্ধে তাই জাগ্রত আছে আদিবাসী অরণ্য-সংগ্রাম। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর টগবগে ময়দানে দাঁড়িয়ে আজ আমরা কী দেখছি? দেশের অরণ্য, প্রাণবৈচিত্র্য আর জলাভূমির কী অবস্থা? এর জন্য দায়ী কে? দায়ী আমাদের অরণ্যবিচ্ছন্ন উপনিবেশিক বাণিজ্যিক মনস্তত্ত্ব। এখন আমাদের ঘুরে দাঁড়ানো ছাড়া কোনো উপায় নাই। অরণ্য সুরক্ষায় আদিবাসী জ্ঞান ও সংগ্রামকে রাষ্ট্রীয় নীতি ও তৎপরতায় যুক্ত করা জরুরি। চলতি আলাপখানি স্বাধীন বাংলাদেশে গড়ে ওঠা আদিবাসী নিম্নবর্গের অরণ্য ও পরিবেশ সংগ্রাম ঘিরে। প্রতি বছর ২১ মার্চ পালিত হয় বিশ্ব বন দিবস। এ বছরের প্রতিপাদ্য ‘অরণ্য ও উদ্ভাবন’। দেশের মুমূর্ষু নিপীড়িত অরণ্যরেখা সুরক্ষায় বন নিয়ে আমাদের উপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হতে পারে সবথেকে কার্যকর উদ্ভাবন। বনবাসী মানুষের অরণ্যজ্ঞান ও লোকায়ত সংরক্ষণ চর্চার স্বীকৃতি ও সুরক্ষা হতে পারে উদ্ভাবনী গুরুত্বপূর্ণ তৎপরতা।

নাহার পানপুঞ্জির রক্তাক্ত গাছের সারি

বিশ্ব পরিবেশ দিবসের ২৫ দিন পর, ২০০৮ সালের ৩০ জুন মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের নাহার চা বাগানের ভেতর খাসি পানপুঞ্জি এলাকার গাছকাটার অনুমোদন দেয় রাষ্ট্র। ৭ অগাস্ট ২০০৮ তারিখে ৪৭ লাখ ৫১ হাজার ৩৯১ টাকা রাজস্ব নির্ধারণ করে নাহার চা বাগানের বিভিন্ন প্রজাতির চার হাজার গাছ কাটার অনাপত্তি দেয় বাংলাদেশ বনবিভাগ। নাহার চা বাগান কর্তৃপক্ষের কাছে বনবিভাগের লিখিত চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, নাহার চা বাগানের ৪০০০ গাছের ভেতর ৩,৭৪৫টি গাছ প্রাকৃতিকভাবেই জন্মেছে। গাছসমূহ থেকে মোট ৮৭,১৭৪ ঘনফুট কাঠ এবং ৭৫,৫০৮ ঘনফুট জ্বালানি লাকড়ি পাওয়া যাবে। রাষ্ট্রের অনুমোদন পেয়ে নাহার চা-বাগান কর্তৃপক্ষ কাঠ ব্যবসায়ী মো. সেলিম উদ্দিন মহালদারের মেসার্স সালিম টিম্বার অ্যান্ড ট্রেডার্সের কাছে দেড়কোটি টাকায় গাছসহ স্থানীয় বন-বাস্তুসংস্থান বিক্রি করে দেয়। নাহার পুঞ্জির টিলাঅরণ্য ও বৃক্ষ সুরক্ষায় খাসি আদিবাসীরা শুরু করেন আন্দোলন। ২০ সেপ্টেম্বর ২০০৮ থেকে কর্তৃপক্ষ জোর করে গাছকাটা শুরু করে। পরবর্তী ১৯ অক্টোবর ২০০৮ তারিখে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় গাছকাটার অনুমোদন বন্ধ করে। ২০০৯ সালের ২৭ অগাস্ট পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের একজন উপসচিবের নেতৃত্বে সাত সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি এলাকাটি পরিদর্শন করেন। পরবর্তীকালে সিলেট বিভাগীয় বনকর্মকর্তা মো. দেলোয়ার হোসেন ২ ফেব্রুয়ারি ২০১০ তারিখে আবারও খাসিপুঞ্জির ৪৫০টি গাছ বাদে ২৩৫০টি গাছকাটার আবারও প্রশ্নহীন অনুমতি দেন মেসার্স সালিম ট্রেডার্সকে। পরবর্তীতে ২২ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টও গাছকাটার পক্ষে রায় ঘোষণা করে। নিদারুণভাবে ১৩ মার্চ ২০১০ থেকে নাহার চা বাগান এলাকার গাছেরা ধারালো করাতের কোপে রক্তাক্ত ছিন্নভিন্ন হতে থাকে। ১২০০ একর জায়গাজুড়ে নাহার চা বাগান ও খাসি পানপুঞ্জি এলাকা, এর ভেতর নাহার চা বাগান বৈধভাবে কেবলমাত্র ৮৬৪ একর জায়গা ইজারা নিয়েছে, বাদবাকি পুরোটাই দখল করে রাখা। চা বাগানের জন্য জমি ইজারা আইন ভঙ্গ করে ১৯৮৪ সন থেকে এ পর্যন্ত চা বাগান কর্তৃপক্ষ খাসিদের কাছ থেকেও ২০০ একর জমির জন্য প্রায় দুই কোটি টাকা ভূমিকর অন্যায়ভাবে গ্রহণ করেছে। নাহার খাসি পুঞ্জির গাছ বাঁচাতে শুরু হয় আন্দোলন।

নিরুদ্দেশ ‘বীর’ সিংড়া শালবন

বরেন্দ্র জনপদসহ উত্তরাঞ্চলে একসময় বিস্তৃত ছিল শালবনের মহিমায়। শালবন নিশ্চিহ্নকরণের পেছনে কৃষি সম্প্রসারণ এবং শালবন থেকে বনজ সম্পদ মূলত কাঠের জন্য শালবৃক্ষের বাণিজ্যিক আহরণই মূলত দায়ী। বৈদিক যুগেও শালবন আচ্ছাদিত ছিল গাঙ্গেয়ভূমির অধিকাংশ অঞ্চল। ১৮৫৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজত্ব দখলের পর রেলপথ উন্নয়নের জন্য সবচেয়ে বেশি শালবন নিশ্চিহ্ন হয়। শালবনের আদিবাসিন্দা আদিবাসী সাঁওতালদের ভাষায় অরণ্য মানে ‘বীর’। আর এই অরণ্যঅঞ্চলের জন্যই উত্তরাঞ্চলের অনেক স্থানের নাম হয়েছে বীরগঞ্জ, বীরটোলা, বালাবীর, বিরল।

কিন্তু পুরো উত্তরাঞ্চল জুড়ে এই শালবন নিরুদ্দেশ ও জখম হয়েছে রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন যন্ত্রণায়। দিনাজপুরের বীরগঞ্জে নর্ত ও ঢ্যাপা নদীর ধার ঘেঁষে সিংড়া শালবনের এক কংকালসার মৃতদেহ এখনো পড়ে আছে। আয়তনে ১২৭১.৮১ একর বনভূমির এই শালবনে বৈশিষ্ট্যময় লম্বা আকৃতির উঁইঢিবি দেখা যায়। যাকে স্থানীয় সাঁওতাল আদিবাসীরা বুনুম তুক্কে বলেন। সিংড়া শালবন এলাকায় কালীডাঙ্গা নামে এক সাঁওতাল আতো (গ্রাম) গড়ে তোলেন সাঁওতাল আদিবাসীরা। মুক্তিযুদ্ধের পর নোয়াখালী থেকে বহিরাগত বাঙালি মুসলমানরা এসে পুরো গ্রামটি দখল করে নেয়। বর্তমানে গ্রামটি বাঙালিদের গ্রাম। সিংড়া শালবন থেকে আদিবাসীদের তাড়িয়ে আশেপাশে গুচ্ছগ্রাম ও আশ্রয়ণ প্রকল্পের নামে বাঙালি অভিবাসন বাস্তবায়ন করে রাষ্ট্র। বনবিভাগ তাদেরকে দিয়ে আগ্রাসী ইউক্যালিপটাস লাগিয়ে ১৯৯১-১৯৯২ সালে বাগান গড়ে তোলে। সামাজিক বনায়নের নামে আদিবাসী ও সেটেলার বাঙালিদের ভেতর তৈরি হয় আন্তঃবিরোধ ও সংঘর্ষ। বনবিভাগ আদিবাসীদের নামে নানান মিথ্যা বনমামলা হাজির করে। বনমামলার হাজিরা দিতে দিতে নিঃস্ব হয়ে অনেক আদিবাসী গ্রাম ও বনভূমি এলাকা ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। হারিয়েছে সিংড়া বনের ভেতর ‘জাহেরথান’ নামের অনেক পবিত্র সংরক্ষিত বনস্থল। এখনো সিংড়াবনের চারধারের সাঁওতাল আদিবাসীরা নানা কৃত্য পালনের জন্য এই বনকে সুরক্ষা করে আসছে। এখানেই শকুন পরিচর্যাকেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে।

শিলখালী গর্জন বন

কক্সবাজারের আদি রাখাইন নাম অং শেংথা ম্রো মানে সমৃদ্ধময় শান্তি নগর, পরবর্তীতে এর নাম হয় ফালংশেই ম্রো মানে অধিকর্তা নগর। পটুয়াখালীর কুয়াকাটার রাখাইন নাম ক্যানছাই চুয়ান। টেকনাফকে রাখাইনরা কায়ৌ সং এবং নাফ নদীকে নেৎম্রাই বলে। দেশের সমুদ্র উপকূলের বনভূমিসমূহ আজ পরিণত হয়েছে চিংড়ি ঘের, লবণমাঠ আর করপোরেট পর্যটনের হোটেল বাণিজ্যের স্থান হিসেবে। আপন বনভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়েছে রাখাইন, তঞ্চংগ্যা, চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা জনগণ। কক্সবাজারের চকরিয়ার ২১,০০০ একর বিরানভূমিই এককালের চকরিয়া-সুন্দরবন। ১৯৭২ সালেও ১৯,৩৯০ একর এলাকা জুড়ে ছিল এই বনভূমি। ১৯৮১ সালে এর আয়তন কমে ৮,৬৫০ একর এবং ১৯৮৫ সালে ৪,০৭২ একরে দাঁড়ায়। কিন্তু ১৯৯৫ সালে এই বনের আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না বাণিজ্যিক চিংড়ি ঘেরের কারণে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের চিংড়ি প্রকল্পটি শেষ হয় ১৯৮৬ সালে এবং বিশ্ব ব্যাংকের একটি প্রকল্প শেষ হয় ১৯৯৩ সালে। বিশ্ব ব্যাংক তাদের প্রকল্প সমাপনী প্রতিবেদনে উল্লেখ করে যে, চিংড়ি প্রকল্পের জন্য এলাকায় কোনো ধরনের পরিবেশগত ক্ষতি হয়নি। তবে জলাবদ্ধতা ও তীরের কিছু সমস্যা হয়েছে। চিংড়ি প্রকল্পের জন্য ম্যানগ্রোভ বনের কোনো ক্ষতি হয়নি। কিন্তু এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, চিংড়ি চাষের ফলে ৮০০ হেক্টর ম্যানগ্রোভ বনভূমি নিশ্চি‎হ্ন‎ হয়।

কক্সবাজারের উপকূলীয় গর্জনবনগুলো স্থানীয় রাখাইন, চাকমা ও তঞ্চংগ্যা আদিবাসীদের জীবন-জীবিকার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যদিও প্রতিনিয়ত এই উপকূল বনভূমি থেকে আদিবাসীদের উচ্ছেদ হতে হচ্ছে। এমনকি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কারণে বাড়ছে সীমিত প্রাণসম্পদ নিয়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাত, হারিয়ে যাচ্ছে এশীয় হাতির বৃহৎ চলাচলের পথ। কক্সবাজারের দক্ষিণ বনবিভাগের আওতাধীন টেকনাফ উপজেলার শিলখালী রেঞ্জের জাহাজপুরা সংরক্ষিত বনের ভেতর দিয়ে পাকা সড়ক নির্মাণের জন্য প্রায় ৩৬টি প্রবীণ গর্জন বৃক্ষের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করেছিল স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল অধিদপ্তর। এলজিইডি ২০০৭-২০০৮ অর্থবছরে টেকনাফের সদর উপজেলা থেকে বাহারছড়া পর্যন্ত প্রায় ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩০ কি.মি. দীর্ঘ এক সড়ক নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়। প্রায় ২০০ একরের এই বনভূমির ১২০-১৫০ বছরের ৫০২৪টি গর্জন, দেড়হাজার তেলশুর-চাম্বল-সিভিট গাছসহ হাতী-বানর-হরিণসহ বন্যপ্রাণী রয়েছে। উপকূলীয় এই গর্জনবনের আদিবাসিন্দা তঞ্চংগ্যা, চাকমা আদিবাসীরা হলেও এখন বাঙালিদের সংখ্যাও কম নয়। সকলের সম্মিলিত প্রতিরোধের মুখে স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল বিভাগ গাছ না কেটে সড়কপথটি নির্মাণ করতে বাধ্য হয়।

মাধবকুণ্ড-মুরইছড়া ইকোপার্ক বিরোধী আন্দোলন

বাংলাদেশের পূর্বপ্রান্তের সবচেয়ে ছোট বিভাগ সিলেটের বন-পাহাড়-টিলা, হাওর, চা বাগান ও বনভূমি বেষ্টিত মৌলভীবাজার জেলার ভারত সীমান্তবর্তী উপজেলা বড়লেখা। এখানেই দেশের পরিচিত প্রাকৃতিক জলপ্রপাত মাধবকুণ্ড এবং পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হাওর হাকালুকির অবস্থান। আর এই বড়লেখা উপজেলার মাধবকুণ্ড জলপ্রপাতকে ঘিরেই গড়ে তোলা হয়েছে মাধবকুণ্ড ইকোপার্ক। মোট ৬৩৪ একর বনভূমি এবং খাসিপুঞ্জি এলাকা নিয়ে প্রশ্নহীনভাবে চালু হওয়া এই মাধবকুণ্ড ইকোপার্কের ফলে স্থানীয় খাসি জনগণ নানান নিপীড়নের নিশানা। তৎকালীন পরিবেশ ও বনমন্ত্রী সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী এই এলাকায় ইকোপার্ক প্রকল্পের উদ্বোধন করেন ১৫ এপ্রিল ২০০১ সালে। একইসাথে কুলাউড়ার মুরইছড়াতেও ইকোপার্ক করার পরিকল্পনা নেয়া হয়। পাহাড়-অরণ্য বাঁচাতে খাসি-মান্দি আদিবাসীরা শুরু করেন ইকোপার্ক বিরোধী আন্দোলন। মুরইছড়া খাসিপুঞ্জির মন্ত্রী (পুঞ্জি প্রধান) প্রবীণ অনিল ইয়ংইয়ং সেসময় ইকোপার্ক বাতিলের দাবিতে ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আমরণ অনশনে বসেছিলেন। মুরইছড়া থেকে সরে এলেও পরবর্তীকালে ৩ মে ২০০৫ তারিখে মাধবকুণ্ড ইকোপার্ক গেইট ও টোলপ্লাজার উদ্বোধন করে বনবিভাগ। মাধবকুণ্ড ইকোপার্ক এলাকায় খাসিদের তিনটি বসতি রয়েছে। মাধব খাসিপুঞ্জি, ৭ নম্বর পুঞ্জি এবং কাটাজঙ্গলপুঞ্জি। মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত থেকে সৃষ্টি হওয়া মাধবছড়ার পানিই খাসিয়া-মান্দি জনগোষ্ঠী দৈনন্দিন ব্যবহার, গোসল এমনকি আগে খাওয়ার কাজেও ব্যবহার করতেন। কিন্তু জেলা পরিষদ থেকে বাধা দেয়ায় এই পানি আর ব্যবহার করা যাচ্ছে না। বর্তমানে মাধবকুণ্ড ইকোপার্কের জন্য মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত বছর বছর ইজারা দেয়ার মাধ্যমে বিক্রি করা হয় এবং ভেতরে ঢুকতে হলে টিকেট কাটতে হয়। ইকোপার্কের ফলে প্রতিদিন অনেক পর্যটক, কোনো ধরনের পূর্ব অনুমতি ও সম্মতি ছাড়াই খাসিপুঞ্জি ও পানজুমের ভেতর ঢুকে পড়ে। কাউকে কিছু না বলে ক্যামেরা চালায়। এভাবে পানজুমে বহিরাগতদের প্রবেশের ফলে ‘উৎরাম’ নামের এক পানের রোগ জুম থেকে জুমে ছড়িয়ে পড়ে প্রায় অনেক খাসি পরিবার নিঃস্ব হয়ে পুঞ্জি ছেড়ে নিরুদ্দেশ ও অরণ্যহারা হতে বাধ্য হয়েছেন।

আগ্রাসী গাছ বিরোধী মেনকিফান্দা আন্দোলন

নেত্রকোনার দূর্গাপুরের সীমান্তসংলগ্ন টিলাভূমির এক শালবনকেন্দ্রিক মান্দি-হাজং এলাকা মেনকিফান্দা। মেনকিফান্দার মোট ১৩৩ একর জায়গা ছিল মান্দিদের। মেনকিফান্দার ১০-১২টি টিলায় মান্দিরা থাকতেন। বনবিভাগের জন্য এ জায়গা জমির ৫/৭টি টিলাভূমি ছেড়ে মান্দিরা নিরুদ্দেশ হতে বাধ্য হন। এরপর আবার ৩০টি মান্দি পরিবারের নামে মামলা হয়। পাকিস্তান আমল থেকেই বনবিভাগ প্রাকৃতিক জঙ্গল কাটার উদ্যোগ নেয়। ১৯৬০-১৯৬১ সালেও বনবিভাগ অনেক চেষ্টা করেছিল প্রাকৃতিক শালবন কেটে আগ্রাসী অচিন গাছ লাগাতে চেয়েছিল, কিন্তু মান্দিদের আন্দোলনের জন্য তা পারেনি। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭২-১৯৭৩ সালের দিকে বনবিভাগের মেনকিফান্দা বিটের তৎকালীন বনরক্ষী মো. দেওয়ান ও মো. আবদুস সাত্তারের সহযোগিতায় মেনকিফান্দার পাহাড় থেকে প্রচুর শালগাছ কাটা হয়। মূলত পাশ্ববর্তী এলাকার বহিরাগত বাঙালিদের ইটভাটাতে পোড়ানোর জন্য এইসব জঙ্গল উজাড় করা শুরু হয়। মেনকিফান্দা গ্রামের প্রবীণ শিক্ষক অজিত রিছিল পয়লা সংগঠিতভাবে এর প্রতিবাদ করেন। একদিন অজিত রিছিল ১৪টি কাটা শালগাছভর্তি গাড়িকে আটকান। ১৯৯৩ সালের ৪ এপ্রিল ময়মনসিংহ বনবিভাগের বাতেনশাহী বন বিট ৪০০-৪৫০ বাঙালিকে বাইরে থেকে মিথ্যে লোভ দেখিয়ে, ভয় দেখিয়ে, ভাড়া করে ও জোর করে মেনকিফান্দায় আনে। বনবিভাগের উদ্দেশ্য ছিল বাঙালিদের দিয়ে সকল মান্দিদের জানে শেষ করা। আর মান্দিগ্রাম উচ্ছেদ হলেই বনবিভাগ বিদেশী আগ্রাসী একাশিয়া, ম্যাঞ্জিয়াম গাছগুলো লাগাতে পারবে শালবনের জায়গায়। লাঠিসোঁটা অস্ত্রশস্ত্র সমেত চার-পাঁচশ বাঙালি জমায়েত নিয়ে বনবিভাগ একা এলেও কথা ছিল, বনবিভাগের সঙ্গে ছিল ‘বিডিআর’ দল। সকাল হতেই অস্ত্রশস্ত্র আর দলবলসহ বনবিভাগ চলে আসে মেনকিফান্দা পাহাড়ের পাদদেশে। বিডিআর-এর সেনারা সমানে ধমকাতে থাকে আর অশ্লীলভাষায় মান্দিদেরকে ওই মুহূর্তেই মেনকিফান্দা ছেড়ে চলে যেতে বলে। মান্দিরা যদি না যায় তবে সব মান্দিদের মেরে ফেলার হুমকি দেয়া হয়। অজিত রিছিলরাও দমে যান না, জীবনবাজি রেখে রক্ষা করেন মুমূর্ষু সীমান্ত বনভূমি।

বহুজাতিক খননের বিরুদ্ধে জাগ্রত লাউয়াছড়া

দেশের সাতটি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, ১০টি জাতীয় উদ্যানের ভেতর লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানই বর্তমানে বিলুপ্তপ্রায় উল্লুক গিবনের সবচেয়ে বড় বিচরণ এলাকা। মৌলভীবাজার রেঞ্জের ২,৭৪০ হেক্টর আয়তনের পশ্চিম ভানুগাছ সংরক্ষিত বনের ১২৫০ হেক্টর এলাকাকে ১৯৭৪ সালের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ) (সংশোধন) আইন অনুযায়ী ১৯৯৬ সালে ঘোষণা করা হয় লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। জাতীয় উদ্যান ঘোষণার পর ১৯৯৭ সালের ১৪ জুন মার্কিন কোম্পানি অক্সিডেন্টালের মাধ্যমে এক ভয়াবহ বিস্ফোরণে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় লাউয়াছড়া বনের প্রতিবেশ ও জীবনব্যবস্থা। পরবর্তীতে আরেক মার্কিন কোম্পানি ইউনোকল লাউয়াছড়া বনের ভেতর দিয়ে গ্যাস পাইপলাইন বসায়, যার ফলে এই সংবেদনশীল বনভূমির বাস্তুসংস্থান অনেকটাই উল্টেপাল্টে যায়। মাগুরছড়া পরিবেশ-গণহত্যার পর ২০০৮ সালে রাষ্ট্রের অনুমোদন নিয়ে ত্রিমাত্রিক ভূতাত্ত্বিক গ্যাস জরিপের নামে মার্কিন কোম্পানি শেভরন লাউয়াছড়া বনভূমিতে প্রশ্নহীন বোমা বিস্ফোরণে ঝাঁঝরা করে দেয় বনের মুমূর্ষু শরীর। মার্কিন কোম্পানির মাধ্যমে এইসব নিপীড়ন সংগঠিত হলেও আবারও প্রশ্নহীন কায়দায় মার্কিন সরকারের সহায়তায় এই বনভূমিতেই চালু হয়েছে নিসর্গ সহায়তা প্রকল্প এবং তার ল্যাজ ধরে আইপ্যাক কর্মসূচি। লাউয়াছড়ার পাশাপাশি শ্রীমঙ্গল বালিশিরা পাহাড় এবং হবিগঞ্জের সাতগাঁও পাহাড়ে চলছে বাপেক্সের গ্যাসখনন ও প্রশ্নহীন জরিপ। বিপন্ন খাসিপুঞ্জি, চা বাগানবাসীসহ অরণ্য জনপদ। এইসব বহুজাতিক খননের বিরুদ্ধে বারবার প্রশ্ন তুলেছে স্থানীয় খাসি, ত্রিপুরা ও চাবাগানের আদিবাসী মানুষেরা।

মধুপুর ইকোপার্কবিরোধী আন্দোলন

টাঙ্গাইলের মধুপুর শালবন পৃথিবীর এক প্রাচীন পত্রঝরা অরণ্য। ‘গড়’ হিসেবে পরিচিত এই বনের আদিবাসিন্দা মান্দি (গারো) ও কোচ-বর্মণ জাতি। মান্দি ভাষায় এই বন ‘বলসাল ব্রিং’ এবং মধুপুর গড় ‘হা.বিমা’ নামে পরিচিত। হা.বিমা মানে মায়ের মাটি। ১৯৬২ সালে আইয়ুব খান ও মোনায়েম খানের আমলে মান্দিদের উচ্ছেদের জন্য ‘জাতীয় উদ্যান’ নাম দিয়ে ২০,৮২৭.৩৭ একর শালবনে তারের বেড়া দেয়া হয়। ১৯৭৭-৭৮ সালে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণের জন্য বনবিভাগ দখলকৃত ‘সংরক্ষিত বন এলাকায়’ করা হয় বম্বিং রেঞ্জ। ১৯৮২ সালে ‘আটিয়া অধ্যাদেশের’ মাধ্যমে টাঙ্গাইল জেলার ৫৫,৪৭৬.৩৮ একর ভূমি ‘আটিয়া সংরক্ষিত বন’ হিসেবে ঘোষিত হয়। এর ভেতরেই মান্দি গ্রাম উচ্ছেদ করে প্রাকৃতিক শালবনে তৈরি হয় বিমান বাহিনীর ফায়ারিং ও বোম্বিং রেঞ্জ। ১৯৮৪ সালে মধুপুর বনে বসবাসরত মান্দি-কোচদের বনবিভাগ আবার উচ্ছেদ নোটিস দেয়। ২০০০ সন থেকেই শালবনের ৩০০০ একর কোর এলাকাকে ৬১,০০০ রানিং ফুট দেয়াল দিয়ে ঘিরে বিতর্কিত ‘ইকোট্যুরিজম প্রকল্প’ শুরু হয়। শালবন রক্ষায় শুরু হয় ইকোপার্কবিরোধী আন্দোলন। ২০০৪ সালের ৩ জানুয়ারি ইকোপার্কবিরোধী মিছিলে বনরক্ষী ও পুলিশের গুলিতে নিহত হয় পীরেন স্নাল। গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যায় শিশু উৎপল নকরেকের মেরুদণ্ড। ২১ অগাস্ট ২০০৬ তারিখে বনবিভাগের গুলিতে আবারও রক্তাক্ত হয় মধুপুর শালবন। ঘটনার দিন সাতারিয়া গ্রামের ফজলী দফো, ফলিদুত, শিশিলিয়া স্নালসহ ৮/১০ জন মান্দি নারী মধুপুর জাতীয় উদ্যানের রসুলপুর সদর রেঞ্জের সাতারিয়া এলাকায় জ্বালানির জন্য ঝরা শালপাতা কুড়াচ্ছিলেন। ২০১৬ সালে আবারও অরণখোলা মৌজার ৯১৪৫.০৭ একর ভূমিকে সংরক্ষিত বনাঞ্চল হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। আর শুধু এই মৌজাতেই আছে কয়েকশত বছরের প্রাচীন ১৩টি মান্দি গ্রাম। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটি দেশের সংরক্ষিত বনভূমি দখলদারদের তালিকা তৈরি করেন এবং ২০২১ সালের ৩০ জানুয়ারির ভেতর সকলকে উচ্ছেদ নোটিস পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন। পরবর্তীতে প্রাচীন মাংরুদাম বা শশ্মান নিশ্চিহ্ন করে আরবোরেটাম প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং শালবনের ভেতর কৃষিজমি বিনষ্ট করে কৃত্রিম লেক খননের বিরুদ্ধে আবারও মধুপুর শালবন বাঁচানোর আন্দোলন চাঙ্গা হয়।

শংকিত ভাওয়াল বন

ভাওয়াল গড়ের পুরো শালবনভূমিই জবরদখল ও বেদখল হয়েছে। অন্যায়ভাবে অরণ্যভূমি থেকে স্থানীয় কোচ, বর্মণ, মান্দি, রাজবংশী ও ক্ষত্রিয় আদিবাসীদের উচ্ছেদ করা হয়েছে। ভাওয়াল শালবনের প্রতিবেশব্যবস্থার কোনো গুরুত্ব না দিয়ে অরণ্য ও আদিবাসীদের উচ্ছেদ করে গড়ে তোলা হয়েছে সেনানিবাস, টাকশাল, সমরাস্ত্র কারখানা, আনসার একাডেমি ও নামে বেনামে একটির পর একটি কলকারখানা। শালবনের একমাত্র অন্যতম নদী শালদহকে গলাটিপে হত্যা করা হয়েছে। স্থানীয় বননির্ভর আদিবাসীদের কোনোধরনের অংশগ্রহণ ও সম্মতি ছাড়াই গড়ে তোলা হয়েছে ‘ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান’। শালবন নিশ্চি‎হ্ন করে তৈরি করা হয়েছে আগ্রাসী একাশিয়ার মনোকালচার বাগান। অরণ্য অধিকার হারিয়ে ভাওয়াল গড়ের আদিবাসী নতুন প্রজন্ম আজ ভুলে গেছে বনের নানা গাছগাছালি আর বন্যপ্রাণীর নাম-পরিচয়। রাষ্ট্র জোর করে এভাবেই কোনো জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা থেকে তার শব্দভাণ্ডার নিখোঁজ করে দিতে পারে। এমনকি নারীদের বনআলু তোলা বা কবিরাজী গাছগাছড়া কুড়িয়ে আনার চলও কমে যাওয়ায় নারীর এক বিশাল জ্ঞানভাণ্ডও খুন হয়েছে। তারপরও প্রতিনিয়ত বনবিভাগ নানা দ্বন্দ্ব-সংঘাতে জড়ায় স্থানীয় আদিবাসীদের। জারি রেখেছে বানোয়াট বন-মামলা।

চিনামাটির বাসালে অরণ্য চুরমারের ঝনঝন শব্দ

ঢাকার কাঁটাবন, সায়েন্স ল্যাবরেটরি, হাতিরপুল কি বাংলামোটরের চিনামাটির বাসনকোসন আর টাইলসের দোকানগুলোর সামনে দাঁড়ালে আত্মা ছ্যাঁত করে ওঠে। ঝকঝকে বাহারিসব চিনামাটির বাসনকোসন আর টাইলসের ভেতর থেকে ভেসে আসে দেশের উত্তর-পূর্ব সীমান্ত পাহাড় টিলার রক্তাক্ত করুণ বিলাপ। জামালপুরের বকশীগঞ্জ, শেরপুরের ঝিনাগাতী ও নালিতাবাড়ী, ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট ও নেত্রকোণার দুর্গাপুরের সীমান্তঅঞ্চলের টিলাবন ফালি ফালি করে সাদামাটি (চিনামাটি) তুলেই গত এক যুগের ভেতর চাঙ্গা করা হয়েছে দেশের ‘সিরামিক শিল্প’। সীমান্তের যে পাহাড় ও টিলাবনে ছিল আদিবাসী হাজং, মান্দি, কোচ জনগণের বসবাস তারা আজ উদ্বাস্তু ও সাদামাটি খনির দিনমজুর। শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার সমশ্চূড়ায় ২০০১ থেকে সাদামাটি উত্তোলন শুরু হয়। পিপলস সিরামিকস, স্ট্যান্ডার্ড সিরামিকস, সাংহাই, হোয়াইতাই, মুন্নু সিরামিকস, মধুমিতা সিরামিকস, চায়না-বাংলা কোম্পানি, সুইটি এন্টারপ্রাইজ, ফু-ওয়াং এরকম নানা নামের কোম্পানিরা এসে স্থানীয় এলাকার কৃষিজমি, পাহাড়ি ও বনটিলা নানান কৌশলে দখলে নেয়। এখানকার সীমান্ত টিলাবনে এখনও বেশকিছু বিলুপ্ত কচু ও বট প্রজাতি টিকে আছে। এশীয় হাতির এক বড় বিচরণ এলাকা এই সীমান্তঅঞ্চল। সাদামাটি ও পাথর খনন হাতির বিচরণ এলাকাকেও বিপন্ন করে তুলেছে। শেরপুরের রাংটিয়া পাহাড়ে গলেআঠ্ঠা, চেপ্পূং, রসে কান্টা, মারুকোড়া, জাখাইতিতা নামের কিছু কাষ্ঠল লতানো উদ্ভিদ এখনো স্থানীয় কোচ, মান্দি ও হাজং আদিবাসীদের যত্নে বেঁচেবর্তে আছে। কিন্তু সাদামাটি ও পাথর খননের এলোপাথারি কোপ না থামালে সীমান্ত এলাকার কোনো পাহাড় টিলাই আর টিকে থাকবে না। সিরামিক কোম্পানিরা সাদামাটি উত্তোলনের জন্য শেরপুরের সমশ্চূড়া কোচগ্রামের ১ একর ১৪ শতাংশ আয়তনের ‘কালীস্থান’ পর্যন্ত দখল করে নিয়েছিল। কোম্পানির কবল থেকে কালীস্থান বাঁচাতে কোচ ও বাঙালিরা ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করে কালীস্থান রক্ষা করেছেন।

চিম্বুক পাহাড় রক্ষা আন্দোলন

১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড় সমূহের যে তালিকা তৈরি করে তাতে দেখা যায় পার্বত্য চট্টগ্রামের ১১টি রেঞ্জের ২৯টি পাহাড়ের ভেতর ৫টি রেঞ্জের ৯টি পাহাড়ের নামই পাংখোয়া ভাষার। পাহাড়ের নামকরণের সঙ্গে স্থানীয় প্রাণবৈচিত্র্য, পাহাড়ের প্রতিবেশ, জাতিগত সংস্কৃতি এবং কোনো সামাজিক স্মৃতিময় ঘটনাকে গুরুত্ব দিয়ে দেখেন পাহাড়ের অধিবাসীরা। যেমন বান্দরবানের চিম্বুক পাহাড়। চিমবক ম্রোর নামে পরিচিতি পেয়েছে এই পাহাড়। যদিও ম্রো আদিবাসীদের কাছে পাহাড়টির নাম ইয়াংবংহুং। চিম্বুকের কাছেই আরেক পাহাড়ের ম্রো নাম শোংনামহুং। মারমা ভাষায় নাইতং। বাঙালিরা এখন এই পাহাড়ের নাম দিয়েছে ‘চন্দ্রপাহাড়’। আর এই পাহাড়েই বিলাসবহুল পাঁচতারকা মার্কিন ম্যারিয়ট হোটেল নির্মাণকে কেন্দ্র করে চিম্বুক পাহাড়ে জনমনে আশংকা ও উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। দেশের নানাস্থানে তরুণ সমাজ এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ম্রো গ্রাম এবং পাহাড় বিনাশ করে এমন বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণের বিরোধিতা করছেন। ৮ নভেম্বর ২০২০ তারিখে ম্যারিয়ট হোটেল বন্ধ এবং জীবন-জীবিকা সুরক্ষার দাবিতে বান্দরবান-চিম্বুক-থানচি সড়কে প্লুং বাঁশী বাজিয়ে ‘কালচারালাল শোডাউন’ করেছে ম্রোরা। পদযাত্রা, মানববন্ধনসহ প্রতিবাদ র‌্যালিতে মুখর চিম্বুক পাহাড়। দেশজুড়ে তর্ক উঠেছে, ম্যারিয়ট হোটেলের এই বিলাসী বিনোদন প্রকল্পকে প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ এবং জনবসতিবিরোধী হিসেবে আখ্যা দেয়া হচ্ছে।

‘অরণ্য অধিকার আইন’ জরুরি

এই হলো দেশের অরণ্যহারা আদিবাসী জনগণের অরণ্যসংগ্রামের কিছু টুকরো স্ফুলিঙ্গ। প্রাকৃতিক বনভূমি নিশ্চি‎হ্ন হওয়ার এবং আদিবাসী অরণ্য অধিকার লঙ্ঘনের আরেকটি কারণ হলো আদিবাসী জনগণের নিজস্ব উৎপাদন ব্যবস্থা ও উৎপাদন সম্পকর্কে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা না করা। আদিবাসীদের নিজস্ব জুমচাষ বন্ধ করার জন্য রাষ্ট্র যারপরনাই জুলুম চালিয়ে যায়। এক পার্বত্য চট্টগ্রামবাদে মধুপুর শালবনসহ দেশের সর্বত্র জোর করে জুমআবাদ বন্ধ করেছে রাষ্ট্র। জুমআবাদ বন্ধ করে ষাটের দশকে চালু হওয়া তথাকথিত সবুজ বিপ্লবের ফলেও দেশের প্রাকৃতিক বনভূমির এক ব্যাপক পরিবর্তন ও নিশ্চি‎হ্নকরণ ঘটেছে। গাজীপুরের কোচ-বর্মণ-ক্ষত্রিয় আদিবাসী জনগণের কাছ থেকে ভাওয়াল শালবন কেড়ে নিয়ে শিল্পকারখানা, লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা শালবন থেকেও বিতাড়িত হয়েছেন রাজবংশী-বর্মণ-পালিয়া আদিবাসী জনগণ, বরেন্দ্র অঞ্চলের গ্রামীণ বন উজাড় করেছে আগ্রাসী ইউক্যালিপটাস-করপোরেট খনন আর হাইব্রিড ভুট্টা চাষ, হাওর অঞ্চলের জলাভূমি বনে যাবতীয় প্রবেশাধিকার হারিয়েছেন স্থানীয় হাজং-লেঙ্গাম জনগণ। প্রাকৃতিক বনের উপর আদিবাসীসহ বনজীবী জনগণের অধিকার নিশ্চিতকরণে ‘অরণ্য অধিকার আইন প্রণয়ন’ জরুরি। আর এটিও হতে পারে অরণ্য সুরক্ষায় আমাদের এক গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবনী বিনিয়োগ।