দারিদ্র্য ও অসমতা নিরসনে নিশ্চিত হোক সকলের মর্যাদা

উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশ নামক গাড়িটিকে চালাতে হলে অবশ্যই আমাদেরকে প্রান্তিক ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে একটা শক্ত অবস্থানে নিতে হবে। সকলের সহযোগিতায় প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী সমাজে অবস্থান তৈরি করে নিক – এবারের আন্তর্জাতিক দারিদ্র্য দিবসে এটাই তাই আমার মূল প্রত্যাশা।

উপমা মাহবুবউপমা মাহবুব
Published : 22 Oct 2023, 10:57 AM
Updated : 22 Oct 2023, 10:57 AM

প্রতিবছর ১৭ই অক্টোবর আন্তর্জাতিক দারিদ্র্য বিমোচন দিবস পালিত হয়। দিনটিকে কেন্দ্র করে দারিদ্র্যকে কীভাবে নির্মূল করা যায় এ বিষয়ে অনেক আলাপ-আলোচনা হয়। এসব আলোচনায় প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর কথাও উঠে আসে। দারিদ্র্য বিমোচনে দেশ অনেক এগিয়ে গেছে। তারপরও এটা দুঃখজনক যে, এ বছরের দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘উপযুক্ত কাজ এবং সামাজিক সুরক্ষা: সবার জন্য মর্যাদার নিশ্চয়তা’ (Decent Work and Social Protection: Putting Dignity in Practice for All)-এর আলোকে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষায়, তাদেরকে দারিদ্র্য এবং অসমতা থেকে বের করে এনে সম্মানজনক জীবন দেয়ার ক্ষেত্রে আমরা এখনও অনেক পিছিয়ে।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বিষয়ক জাতীয় পরিসংখ্যান ২০২১ অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ২.৮০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর অন্তত এক ধরনের প্রতিবন্ধিতা আছে। ৭.১৪ শতাংশ জনসংখ্যার ফাংশনাল (functional) প্রতিবন্ধিতা আছে। একই রিপোর্ট দেখায় যে, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ৪৩.৩৮ শতাংশ অক্ষমতাজনিত বৈষম্যের সম্মুখীন হন। তবে আশার কথা হলো, বর্তমান সরকার প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে বহুবিধ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। অবকাঠামো নির্মাণে তাদের কথা বিবেচনা করা হচ্ছে। সরকারের সদিচ্ছার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বেসরকারি ও করপোরেট সেক্টরেও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের চাকরির সুযোগ তৈরি হয়েছে। সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশন সারা বাংলাদেশ জুড়ে প্রতিবন্ধী সেবা ও  সাহায্য কেন্দ্রের মাধ্যমে সুবর্ণ কার্ড ও প্রতিবন্ধী ভাতা প্রাপ্তি, বিভিন্ন ধরনের থেরাপি প্রদান, ব্যায়াম করানো, মনোসামাজিক এবং পুর্নবাসন সহায়তা দেওয়াসহ তাদের অন্যান্য প্রাপ্য অধিকার ও সেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে। তবে সমস্যা এবং প্রয়োজন – দুটোরই গভীরতা যতটুকু, করা সম্ভব হচ্ছে তার তুলনায় অনেক কম।

গত বছরের ঘটনা। রংপুরে আমরা কয়েকজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি এবং তাদের কেয়ারগিভারদের সঙ্গে একটা উঠান বৈঠকে বসেছিলাম। সেখানে শিশু থেকে বয়স্ক – সব বয়সী নারী ও পুরুষ প্রতিবন্ধী ছিলেন। এক আপার কথা এখনও কানে বাজে। জন্মগতভাবে ওনার একটা পা ছোটো। বাবা-মা, স্বামী এবং শশুর-শাশুড়ি কেউই ওনাকে কোথাও নিয়ে যান না। তার খুঁড়িয়ে চলা দেখলে তাদের লজ্জা লাগে। বাড়ির বৌ খোঁড়া – এই নিয়ে পাড়াপ্রতিবেশি কটুকথা বলে, হাসাহাসি করে। ওই আপা সম্প্রতি একটি এনজিও থেকে এক জোড়া বিশেষ স্যান্ডেল পেয়েছেন। সেগুলোর একটি তার ভিন্ন আকৃতির পায়ের মাপ অনুযায়ী বানানো। ফলে তিনি এখন স্যান্ডেল জোড়া পায়ে দিয়ে আশেপাশের অন্য সবার মতো করে হাঁটতে পারেন। এই ঘটনার পর পরিবার এবং সমাজে তার অবস্থান পাল্টে গেছে। তিনি এখন নিয়মিত বাইরে আসা-যাওয়া করেন। অস্বস্তিতে ভোগেন না। কেউ তার দিকে অন্য চোখে তাকায় না। কটুক্তিও করে না। চোখেমুখে হাসি নিয়ে আপা আমাদের বলেছিলেন, কিছুদিন আগে প্রথমবারের মতো তিনি স্বামীর সঙ্গে বিয়ের দাওয়াতে গিয়েছিলেন। এটা তার জীবনের অন্যতম আনন্দের ঘটনা। আমি অবাক হয়ে ভাবছিলাম একটা স্যান্ডেল কীভাবে একজন মানুষের জীবনে এত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে!

এই যে প্রতিবন্ধী একজন মানুষকে ছোট করে দেখা, তাদের পরিবারের সদস্যদের হীনমন্যতায় ভোগা – এই মানসিক দৈন্য থেকে মূলধারার সমাজকে বের করে আনতে হলে বৃহৎ আকৃতির কার্যক্রম প্রয়োজন। পরিবার থেকে এটি শুরু করতে হবে। শিশুদের পাঠ্যপুস্তকে অর্ন্তভুক্ত করা থেকে শুরু করে সামাজিক এবং মিডিয়া ক্যাম্পেইন পরিচালনায় সরকারি, বেসরকারি সংস্থাসহ সংশ্লিষ্ট সকল স্টেকহোল্ডারদের সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। একই সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের প্রায়গিক কর্মসূচিও গ্রহণ করতে হবে। যেমন, সকল প্রতিবন্ধিতার ধরন একই নয়। রংপুরের ওই আপার পায়ের আকৃতি নিয়ে যে স্যান্ডেল বানানো হয়েছে তা একই ধরনের প্রতিবন্ধকতার শিকার আরেকজন প্রতিবন্ধী নারী বা পুরুষের পায়ে আটবে না।

সারা দেশেই প্রতিবন্ধীদের জন্য বিভিন্ন ধরনের সহায়ক ডিভাইস বাজারে সহজলভ্য হয়ে উঠেছে। প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশন প্রতিবন্ধী সেবা ও  সাহায্য কেন্দ্রের মাধ্যমে সহায়ক ডিভাইস দিয়ে থাকে। অনেক বেসরকারি সংস্থাও এ ধরনের কাজ করছে। প্রতিবন্ধিতার ধরন ও অন্যান্য ফ্যাক্টর অনুযায়ী সহায়ক ডিভাইসও (assistive devise) নিশ্চিত করতে হবে। আজকে যদি কোনো প্রত্যন্ত গ্রামের একজন কিশোরী প্রতিবন্ধী তার আকৃতি এবং প্রয়োজন অনুযায়ী একটি হুইলচেয়ার পায়, কয়েক বছর পর সে যখন বড় হবে তখন তার ভিন্ন আকৃতির হুইলচেয়াল লাগবে। আগের হুইলচেয়ার সে আর ব্যবহার করতে পারবে না। তার চলাচল বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে সে হয়ত আবারও ঘরবন্দী হয়ে যাবে। তাই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য প্রয়োজনীয় সকল সুযোগ-সুবিধাগুলো যেন জীবনব্যাপী নিশ্চিত করা যায় তার জন্য মহাপরিকল্পনার আওতায় সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সরকারি-বেসরকারি সংস্থা বা অন্য কারও পক্ষে এককভাবে এটি সম্ভব নয়।

এক্ষেত্রে আরও একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাইকোসোশ্যাল কাউন্সিলিং এবং রিহ্যাবিলিটিশন বিষয়ে পড়ানো হয়। দুটো সেবাই প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে জেনেছি এই বিষয়গুলো নিয়ে পড়ালেখা করা তরুণ-তরুণীরা তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি পাচ্ছেন না। প্রতিবন্ধী সেবা ও  সাহায্য কেন্দ্রে এ বিষয়ক পদ আছে। কিন্তু সরকারি নিয়োগ বন্ধ থাকায় এবং জেলা বা উপজেলা পর্যায়ে গিয়ে বসবাস করার মতো উপযুক্ত পরিবশে না থাকায় বহু জায়গায় ওই পদগুলো খালি পড়ে আছে। এই প্রতিবন্ধকতাকে কাটিয়ে উঠতে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে।

এই রংপুরেই আরেকজন বুদ্ধি প্রতিবন্ধী তরুণীর দেখা পেয়েছিলাম। বাবা নেই। মা একাই বড় করেছেন। মেয়েটি ভালোভাবে কথা বলতে পারে না। গোসল, টয়লেট করাসহ দৈনন্দিন কাজগুলো নিজে করতে পারে না। মা-ই তার সব। অত্যন্ত দরিদ্র এই মা একজন শ্রমিক। রাস্তা কাটা বা অন্যের জমিতে কাজ করে তিনি তাদের দুজনের সংসার চালান। কন্যাকে আগলে রেখেছেন। সঙ্গে নিয়ে কাজে গিয়েছেন। মেয়েটি কোনো কাজই নিজে করতে পারে না। তাই বাড়িতে রেখে যাওয়ার উপায় নেই।

সেই মেয়ে এবং তার মা আমাদের সংস্থা থেকে জীবিকায়নের জন্য গরু পেয়েছে। পেয়েছে কারিগরী এবং জীবন দক্ষতা প্রশিক্ষণ। টাকা-পয়সার লেনদেন এবং সঞ্চয় করতে শিখেছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো মেয়েটি আমাদের সাইকোসোশ্যাল এবং রিহ্যাবিলিটেশন অফিসারদের নিবিড় তত্ত্বাবধানে ছিল। নিয়মিত ব্যায়াম করেছে। থেরাপি পেয়েছে। তার বাসাকে স্থানীয় উপকরণ ব্যবহার করে খুব কম খরচে প্রতিবন্ধী-বান্ধব করে দেওয়া হয়েছে। ফলে দৈনন্দিন কিছু কাজ, যেমন, গোসল এবং টয়লেট সে এখন একাই করতে পারে। মেয়েটি এখনও মায়ের সঙ্গে সরকারিভাবে পরিচালিত রাস্তা কাটার কাজে যায়। তবে আর অলস বসে থাকে না। সক্ষমতা অনুযায়ী নিজেও শ্রমিকের কাজ করে। বাড়ির গবাদিপশুরও কিছুটা দেখাশোনা করতে পারে। মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে কন্যাও আজ সংসারের হাল ধরেছে। এই মেয়েটির মতো আরও অসংখ্য প্রতিবন্ধী ব্যক্তি এবং তাদের কেয়ারগিভাররা প্রয়োজনীয় সহায়তা পেলে নিজেদের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটাতে পারবে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তি এবং তাদের পরিবারের জীবিকায়নে যতটা সহায়তা দেওয়া যাবে, ততই দেশে দারিদ্র্য এবং বৈষম্য কমবে।

একটা বয়সের পর প্রতিটি মানুষকেই কোনো না কোনো প্রতিবন্ধিতার শিকার হতে হয়। কারও চোখের জ্যোতি কমে। কারও চলার গতি হারায়। আমরা আমাদের পরিবারের এই বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষদের ভালোবাসি, যত্ন করি। অথচ চারপাশে বসবাসকারী প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর দিকে এই ভালোবাসার দৃষ্টি দিয়ে তাকাই না। ২০৩১ সালের মধ্যে দারিদ্র্যের হার শূন্যে নামিয়ে আনার যে জাতীয় লক্ষ্য, তা পূরণে এই জনগোষ্ঠীকে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করা অপরিহার্য। একটি গাড়ির সবগুলো চাকা সমান না হলে ওই গাড়ি হয়ত এলোমেলোভাবে এদিক-ওদিক ছুটবে, কিন্তু দ্রুত গতিতে হাইওয়েতে চলতে পারবে না। তাই উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশ নামক গাড়িটিকে চালাতে হলে অবশ্যই আমাদেরকে এই প্রান্তিক ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে একটা শক্ত অবস্থানে নিতে হবে। সকলের সহযোগিতায় প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী সমাজে অবস্থান তৈরি করে নিক – এবারের আন্তর্জাতিক দারিদ্র্য দিবসে এটাই তাই আমার মূল প্রত্যাশা।