আমাদের রাজনীতি ও কুমিরের রচনা

আমাদের দেশের রাজনীতির সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে বাস্তবতাকে অস্বীকার করা, কোনোরকম বিরোধিতা ও সমালোচনাকে সহ্য না করা।

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 25 Nov 2022, 06:47 PM
Updated : 25 Nov 2022, 06:47 PM

আমাদের রাজনীতিতে কোনো নতুনত্ব নেই। নতুন নেতাও নেই। বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ ধরে রাজনীতিবিদরা একই বক্তব্য দিচ্ছেন, একইভাবে দল পরিচালনা করছেন। কেউ কোনো দোষ স্বীকার করেন না। কেউ কখনো দলের নীতি-আদর্শ পরিবর্তন করেন না। একদলের খারাপ কোনো কিছু থাকলে অন্য দল সেটা অনুসরণ করে, অনুকরণ করে। রাজনীতিবিদরা রাজনীতিকে ‘খেলো’ নীতিহীন এক বাটপারির বিদ্যায় পরিণত করেছেন, আমরাও সেই দলীয় রাজনীতির জামা গায়ে দিব্যি চাপা পিটিয়ে যাচ্ছি। আমাদের আড্ডায়-গল্পে সাবলীলভাবে ঢুকে পড়ে রাজনীতির আলোচনা। আমরা গলা ফাটিয়ে নিজের দলের পক্ষে এবং প্রতিপক্ষ দলের বিপক্ষে কথা বলি, চায়ের কাপে ঝড় তুলি। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমাদের সব রাজনৈতিক বিবেচনা ও আবেগ রাজনৈতিক সমর্থনতাড়িত।

আমরাও দলান্ধ ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছি। আমরা যে দলকে সমর্থন করি ওই দল খারাপ কিছু করলেও আমাদের সমর্থন দলের পক্ষেই থাকে। ফলে খারাপ কাজ করলেও দলের সমর্থন খুব একটা কমে না। পাঠক বা শ্রোতারাও এখন দলীয় পক্ষপাতদুষ্ট। কেউই বস্তুমুখী সৎ খবর পছন্দ করেন না। মনমতো খবর তাদের কাছে পৌঁছলেই খুশি। তারা এমন খবর খোঁজেন যা মনকে তৃপ্তি দেবে। আজকের পাঠক নিজের পছন্দের কাগজ থেকে নিজ মতাদর্শ সমর্থনের পাথেয় জোগাড় করে নেন। সংবাদপত্র গোষ্ঠীর ‘টার্গেট মার্কেটিং’ মডেলটা বেশ খাপ খায় এর সঙ্গে। এলাকার রাস্তা কেন খারাপ? উত্তর, নিশ্চয়ই বিরোধীদলের ষড়যন্ত্র অথবা ক্ষমতাসীনদের অপদার্থতা, যিনি যেটা শুনতে চান। বিরোধীরা সবসময় সরকারের দোষ দেখেন, আর ক্ষমতাসীনরা সবকিছুতে বিরোধীদলের ষড়যন্ত্র খুঁজে চলেন। অথচ রাস্তা খারাপ থাকার প্রকৃত কারণ হয়ত অন্য।

আশ্চর্যের বিষয়, আপাদমস্তক পক্ষপাতদুষ্ট মানুষের সংখ্যাই সমাজে এখন বেশি। এই বিশাল সংখ্যা নেহাত উপেক্ষার বস্তু নয়। এটা কি কাম্য? তাই এখানে কোনো বিশৃঙ্খলা, দুর্নীতি, ধর্ষণ বা খুনের তদন্তে শেষ অবধি ন্যায়বিচার জোটে না, কেবল পক্ষপাতদুষ্ট পারস্পরিক দোষারোপ চলতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত উপসংহার যে কী হবে, সেটা প্রায় পূর্বনির্ধারিতই বলা চলে!

একটি সমস্যা সামনে আসে, আর ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে বলা হয়: সরকারকে বিব্রত করার জন্য একটি মহল এই কাজ করছে। এর পেছনে ষড়যন্ত্র আছে। পেঁয়াজ-চালের মূল্যবৃদ্ধি, দলের নেতাকর্মীদের মারামারি, সড়ক দুর্ঘটনা– সব ব্যাপারেই ক্ষমতাসীনদের একই বক্তব্য, একই প্রতিক্রিয়া। ক্ষমতাসীনদের এই বক্তব্যের সমর্থনে একশ্রেণির ‘ধামাধরা’ লেখক, কবি, সাংবাদিক, শিক্ষক, সংস্কৃতিকর্মীও বীরবিক্রমে মাঠে নেমে পড়েন। তারাও ক্ষমতাসীনদের বক্তব্যকে অভ্রান্ত প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু কারা বিব্রতকারী বা ষড়যন্ত্রকারী, সেটা স্পষ্ট হয় না। ফলে অদৃশ্য বিব্রতকারী-ষড়যন্ত্রকারীরা এই সর্বনাশা কার্যক্রমে ইন্ধন জুগিয়েই চলে!

বর্তমানে আমাদের দেশের রাজনীতির সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে বাস্তবতাকে অস্বীকার করা, কোনোরকম বিরোধিতা ও সমালোচনাকে সহ্য না করা। সমালোচনা শুনলেই ক্ষমতাসীনরা কেমন যেন তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন। বিরোধী কণ্ঠস্বর দেখলেই তীব্র হিংসার প্রয়োগে স্তব্ধ করার চেষ্টা হয়। আমাদের রাজনীতিতে এ অসুখটা দিন দিন যেন গভীর হয়ে উঠছে। অসহিষ্ণুতা তীব্রতর হচ্ছে। বাড়ছে হিংসার দাপট।

অন্য দিকে বিরোধীপক্ষ সবসময় ক্ষমতাসীনদের সমালোচনায় মুখর। দুনিয়ার সবকিছুর জন্য ক্ষমতাসীনরা দায়ী। কারও যদি ডায়রিয়াও হয়, তবু বিরোধীপক্ষ এ জন্য ক্ষমতাসীনদের দায়ী করেন। নিজেরা ক্ষমতায় থাকাকালে কি কি সংকট তৈরি হয়েছিল, সেগুলো ভুলে গিয়ে কেবল ক্ষমতাসীনদের পিণ্ডি চটকানোর কাজ করেন। তাদের একটাই কথা, এ সরকারকে এখনই ছুঁড়ে ফেলতে হবে। ছুঁড়ে ফেলার পর কি হবে, তারা কীভাবে কোন সমস্যার সমাধান করবেন, তা নিয়ে কখনো আলোচনা হয় না।

নেতা-নেত্রীদের মুক্তি দেওয়া না হলে সবকিছু অচল করে দেওয়ার হুমকি ছাড়া তাদের মুখে নতুন কোনো কথা শোনা যায় না।

‘বিরোধীদলীয় চক্রান্ত’, ‘ষড়যন্ত্র,’ ‘মানহানি/কটুক্তি’, ‘উন্নয়নের জোয়ার’, দেশ ধ্বংস করে দেওয়া– এই শব্দগুলোই ঘুরে ফিরে উচ্চারণ করা হয়। এই শব্দগুলোই মোটাদাগে আমাদের রাজনৈতিক ভাষ্য।

রাজনীতিবিদদের এ ধরনের কথা শুনে ছোটবেলায় পড়া গরু রচনার কথা মনে পড়ে যায়। এক ছাত্র ছিল, তাকে যে বিষয়েই লিখতে দেওয়া হোক না কেন সে কোনো না কোনোভাবে গরু নিয়ে আসবেই। তারপর সেই গৎবাঁধা একই কথা।

আরেক ছাত্রের কথা শুনেছিলাম যার পছন্দের বিষয় হল কুমির। যে বিষয়েই তাকে লিখতে বলা হোক, সে যেভাবেই হোক সেটাকে কুমিরে নিয়ে ফেলবেই। ক্লাসে শিক্ষক হয়তো গরু নিয়ে একটি রচনা লিখতে বলেছেন। ছাত্রটি শুরু করে এভাবে– গরু একটি গৃহপালিত প্রাণী। গরু শান্ত স্বভাবের। তার একটি লেজ ও চারটি পা আছে। গরুর প্রিয় খাদ্য ঘাস। ঘাস খাওয়ার জন্য গরুকে মাঠে নিয়ে যেতে হয়। কিন্তু আপনারা যেখানেই গরুকে ঘাস খাওয়ানোর জন্য নিয়ে যান না কেন, কখনোই নদীর তীরে নিয়ে যাবেন না। কারণ নদীতে কুমির আছে। কুমির খুব হিংস্র প্রাণী। তার একটি লেজ, চারটি পা এবং মুখভর্তি ধারালো দাঁত আছে। আর তার সারা গা কাঁটা কাঁটা…

শিক্ষক সাহেব মহা বিরক্ত। ভাবেন, শুধু কুমিরের গা না– এই ছেলের মগজও মনে হয় কাঁটা কাঁটা। সামনের বার তারে মহা টাইট দেওয়া লাগবে। পরবর্তী পরীক্ষায় ওই শিক্ষার্থীকে দেওয়া হলো বাড়ি নিয়ে রচনা লিখতে। শিক্ষক সাহেব ভাবলেন, এবার নিশ্চয় বাড়ি নিয়ে লিখতে গিয়ে কুমির নিয়ে আসতে পারবে না ওই ছাত্র। এবার দেখা যাবে কত ধানে কত চাল! ছাত্রটি লেখা শুরু করল এভাবে– আমাদের বাড়ি শান্তির নীড়। বাড়িতে আমরা চার ভাই এক বোন বাবা-মার সাথে থাকি। আমাদের বাড়িতে তিনটি শোয়ার ঘর, একটি বসার ঘর, একটি খাওয়ার ঘর এবং একটি রান্নাঘর রয়েছে। বাড়ি বানানো খুব কঠিন কাজ। তবে আপনারা যাই করেন, বাড়ি কখনো নদীর পাড়ে বানাবেন না। কারণ নদীতে কুমির আছে। কুমির খুব হিংস্র প্রাণী। তার একটি লেজ, চারটি পা এবং মুখভর্তি ধারালো দাঁত আছে। আর তার সারা গা কাঁটা কাঁটা…

বাড়ি বিষয়ক রচনা পড়ে তো শিক্ষকের মাথায় বাড়ি। রাগে তিনি দাঁত কিড়মিড় করেন। ভাবেন এই ছাত্র তো মহা ত্যাদর। বাড়ি রচনায় যা লিখেছে তাতে এইটারে ব্যাতের বাড়ি দেওয়া লাগবে। হাত নিশপিশ করে শিক্ষকের। তবে দেশের আইনে এখন ছাত্রকে বেতপেটা করা বেআইনি। আগেকার সেই সুদিন আর নেই। খামোখা এই বেতমিজটাকে তমিজের সাথে বেত পেটা করে জেল খাটার কোনো মানে নেই। আইন-আদালত থেকে দূরে থাকাই ভালো ভেবে চুপ করে থাকেন তিনি। অনেক ভেবে-চিন্তে অসামান্য এক টপিক খুঁজে বের করলেন শিক্ষক। ‘পলাশীর যুদ্ধ’।

এবারে শিক্ষকের মুখ হাসি হাসি। ভাবেন, এবার চাঁন্দু যাবি কই। পলাশীর যুদ্ধে আর যাইহোক কুমির আসবে না কখনোই। ছাত্রকে কাছে ডেকে একটু বাঁকা হাসি দিয়ে বলেন: বাপধন, এবার পলাশীর যুদ্ধ নিয়ে একটা নাতিদীর্ঘ রচনা লিখে ফেলো তো দেখি…

ছাত্র আর কী করে। শুরু করে এভাবে– বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার সাথে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পলাশী নামক স্থানে যে যুদ্ধ হইয়াছিল তাহাই পলাশীর যুদ্ধ নামে পরিচিত। ১৭৫৭ সালের জুন মাসের ২৩ তারিখে পলাশীর আম্রকাননে এই যুদ্ধ সংঘটিত হইয়াছিল। এক পক্ষে সিরাজউদ্দৌলার অনুগত অকুতোভয় বীর সেনানী আর অন্যদিকে লর্ড ক্লাইভের ঔপনিবেশিক বেনিয়া সৈন্যবাহিনী।

ঢাক-ঢোল বাজিল, যুদ্ধ লাগিল। যুদ্ধে নবাবের জয়লাভের সমূহ সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও তাহাকে পরাজয় বরণ করিয়া নিতে হইল। কারণ, সরলমনা নবাব মীরজাফরকে প্রধান সেনাপতি বানাইয়া খাল কাটিয়া কুমির আনিয়াছিলেন।

আর আপনারা জানেন, কুমীর খুব হিংস্র প্রাণী। তাহার একটি লেজ, চারটি পা এবং মুখভর্তি ধারালো দাঁত আছে। আর তার সারা গা কাঁটা কাঁটা…

আমাদের রাজনীতিবিদরাও যেকোনো সমস্যা গিয়ে ঠেকান প্রতিপক্ষের ওপর সব দায় চাপিয়ে দিয়ে। বাংলাদেশের রাজনীতি বর্তমানে এক কঠিন সময় অতিক্রম করছে। গণতন্ত্র বিবর্জিত পরিবেশে রাজনীতি ও রাজনীতিবিদ উভয়ে তাদের কর্তৃত্ব হারিয়েছে। ব্যবসায়ী ও আমলাতন্ত্রের দাপটে পেছনের সারিতে চলে গেছেন রাজনীতিবিদরা। সরকার ও প্রশাসনে গুরুত্ব হারিয়েছে তারা। আমলাতন্ত্রের ওপর সরকারের অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা, রাজনীতিকদের সাফল্য ও কর্তৃত্বকে ম্লান করে দিয়েছে। ওয়ান ইলেভেনের কুশীলবেরা যে বিরাজনীতিকরণ শুরু করেছিল এখন যেন তারই ধারাবাহিকতা চলছে। রাজনৈতিক নেতাদের জন্য রাজনীতি কঠিন করে তোলা হয়েছে। রাজনীতি এখন রাজনীতিবিদদের হাতে নেই। এর নিয়ন্ত্রণ এখন আমলা এবং বিত্তশালীদের হাতে চলে গিয়েছে। রাজনীতিতে আমলাতন্ত্রের এমন উত্থান গণতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত। কিন্তু রাজনীতিবিদরা তা কখনোই উপলব্ধি করছেন না। তারা ওই শিক্ষার্থীর মতো, ‘কুমির খুব হিংস্র প্রাণী। তাহার একটি লেজ, চারটি পা এবং মুখভর্তি ধারালো দাঁত আছে। আর তার সারা গা কাঁটা কাঁটা…’ স্টাইলেই চলছেন।

যেন এর শুরু আছে, শেষ নেই!