প্রশ্ন হলো, একমাত্র ত্যানা প্যাঁচানোর বিদ্যায় পারদর্শী এই ফেইসবুক প্রজন্মকে লইয়া আমরা কোথায় যাইব? কী করিব?
Published : 16 Apr 2024, 08:24 PM
তেনা বা ত্যানা হচ্ছে ছেঁড়া কাপড়ের টুকরা; ন্যাকড়া। মলিন ও ছিন্ন বস্ত্রখণ্ড। আমাদের দেশে এক সময় কারও হাত-পা ভেঙ্গে গেলে বা কেটে গেলে গজ ব্যান্ডেজ হিসেবে ত্যানা প্যাঁচানো হতো। কালক্রমে এই ‘ত্যানা প্যাঁচানো’ একটা প্রতীকী শব্দে পরিণত হয়। এর মানে কোনোকিছু অর্থহীন অথবা ইচ্ছাকৃতভাবে জটিল করা। যার কোনো দরকার নেই।
ত্যানা প্যাঁচানো আমাদের জাতীয় বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটা সহজ-সরল জিনিসকে কীভাবে জটিল-কূটিল-মারাত্মক বানানো যায়, ওই ব্যাপারে আমরা অসাধারণ দক্ষতা অর্জন করছি। আর ত্যানা প্যাঁচানোর ব্যাপারে এখন ফেইসুবক এক লাগসই মাধ্যম।
আপনি হয়তো খুবই সহজ-সরল কিসিমের মানুষ। ঈদের ছুটিতে বাড়ি গেছেন। দেখলেন, বাড়ির আঙিনার পাশে এক টুকরো পতিত জায়গায় একটি গরু ঘাস খাচ্ছে। গরুর এই ঘাস খাওয়ার দৃশ্য দেখে আপনি মোহিত হয়ে মোবাইল ফোন দিয়ে গরুর একটি ছবি তুললেন। বর্তমান জমানায় ছবি তুললে তা ফেইসবুকে দিতে হয়। এটাই নিয়ম। সেই নিয়মের দাস হিসেবে আপনি ফেইসবুকে ছবিটি আপলোড করলেন। শুধু ছবি দিলে হয় না। একটা ক্যাপশনও দিতে হয়। আপনি সাত-পাঁচ না ভেবে লিখলেন: বাড়ির আঙিনায়, গরু এখনও ঘাস খায়!
আপনার কাজ আপনি করলেন। খুব সরল মনে গরুর ঘাস খাওয়ার একটি ছবি আর নিরীহ একটা ক্যাপশন দিলেন। এরপর আপনার দায়িত্ব শেষ। বাকিটা আপনার তথাকথিত বন্ধু-অনুসারীরা করবে।
আপনি যদি সনাতন ধর্ম-অনুসারী হন তাহলে এই ক্যাপশন থেকে অনেকেই অনেক কিছু পেয়ে যাবে। যারা আপনার মতো সরলমনা, তারা লিখবে। ওয়াও! কেউ লিখবে সুন্দর দৃশ্য। কেউ বলবে অপূর্ব! অসাধারণ! কেউ কেউ ভুল বানানে দীর্ঘ মন্তব্য লেখার চেষ্টা করবে। লিখবে: গরু মাঠে চরছে কিংবা ঘাস খাচ্ছে— এমন দৃশ্য বর্তমানে খুব একটা দেখা যায় না। অথচ আমাদের ছোটবেলায় এমন দৃশ্য কত দেখেছি। সত্যিই এমন দৃশ্য দেখে মনটা ভরে যায়। অতীত জীবনের কথা মনে পড়ে যায়। গোধূলিলগ্নে মাঠে চরানো গরু নিয়ে ঘরে ফেরা—এমন সুন্দর দৃশ্য আমাদের সমাজ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে।
কেউ লিখবে: গরু নয় গোরু লিখুন। ‘ইন্ডিয়া একাডেমি’র বানান ফলো করুন!
কেউ লিখবে: গরু ঘাস খাবে নাতো কি আলকাতরা খাবে? আপনার মাথা ঠিক আছে?
আরেকজন লিখবে: গরু ঘাস খায়, কথাটা ঠিক নয়। গরু ভাতের মাড়, ভূষি, চিটাগুড়, খড়সহ আরও অনেক কিছুই খায়। ইদানিং হরমোন ও ভিটামিন ট্যাবলেটও খায়। আগে ভালোভাবে জানুন, তারপর ফেইসবুকে লিখতে আসুন।
কেউ লিখবে: গরু তো আপনাদের মা। গোমাতা লিখলেন না যে দাদা?
কেউ লিখবে: ইন্ডিয়ার দালালরা এখনো এদেশে কেন? এদের পিটিয়ে বাপের দেশে পাঠিয়ে দেওয়া উচিত।
কেউ লিখবে: দাদা, নিয়মিত গরুর মুত খাচ্ছেন তো? আপনাদের মোদী তো শুধু গরু নয়, গরুর মুতেরও পূজারী।
কেউ লিখবে: মঙ্গল শোভাযাত্রা, আল্পনা, ঘাস খাওয়া গোমাতা নিয়ে দাদারা এদেশে বেশ আছে! থাকবেই বা না কেন? এপারে-ওপারে দুপারেই তো দাদাদের সরকার!
কেউ লিখবে: মনে রাখবেন, গরু নিয়ে আপনার উচ্ছ্বসিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। এটা কিছুতেই হিন্দুয়ানি সংস্কৃতির উপাদান নয়। এটা ইসলামী সংস্কৃতির অংশ। ১৮৬১ সালে জন্ম নেয়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা গান যদি বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হতে পারে, ১৯৮৬ সালে মঙ্গল শোভাযাত্রা যদি বাঙালি সংস্কৃতির অংশ হতে পারে তাহলে একাদশ শতকে আসা ইসলামের উপাদনগুলো কেন বাঙালি সংস্কৃতির অংশ হতে পারবে না?
কেউ লিখবে: গরু নিয়ে আওয়ামী লীগের দালালদের মাতামাতি দেখলে হাসি পায়। এরা জানে না, রবীন্দ্রনাথ কিংবা শরৎচন্দ্র নয়, গরুকে সবার আগে আধুনিক সাহিত্যে ধারণ করেছিলেন আহমদ ছফা। তিনি গাভীবৃত্তান্ত নামে একটি অমর গ্রন্থ লিখেছিলেন। ব্রিটিশের দালাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতাকারী, রক্তচোষা জমিদার রবীন্দ্রনাথ নয়, পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি-লেখক-দার্শনিক হলেন আহমদ ছফা। গরুর কথা বললে সবার আগে ছফা ভাইয়ের কথা বলতে হবে।
কেউ লিখবে: আমি কোনো গরু-টরু-কিংবা রবীন্দ্রনাথকে চিনি না। নামও শুনিনি। গরু যা খুশি তাই খাক, আমি গরু খাই। এটাই আমার পরিচয়।
কেউ লিখবে: দেশ দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে, মানুষের ভোটাধিকার নাই। আর আপনারা আছেন গরু নিয়ে? আসুন আমরা সবাই মিলে ইন্ডিয়া বয়কট করি।
কেউ লিখবে: গরুর ঘাস খাওয়া আর বেশিদিন দেখতে পাবেন না। দেশের কৃষি, গরুছাগল সব করপোরেটদের দখলে চলে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষ নিঃস্ব হচ্ছে। ওরা গরুর ফার্ম বানাচ্ছে। গরু, মাংস, দুধ— সবকিছুর দাম ওরাই নির্ধারণ করছে। ওরাই দেশটাকে লুটেপুটে খাচ্ছে। যে গরু ছিল কৃষকের সম্পদ, আজ সেটা করপোরেট ব্যবসায়ীদের দখলে। আস্তে আস্তে পুরো দেশটাই ওরা দখল করে নেবে। তখন আপনাদের বসে বসে আঙুল চুষতে হবে।
কেউ বলবে: ভাই, আপনি অনেক উদার মানুষ। এই চরম স্বার্থপরতার যুগে আপনি নিষ্পাপ একটি গরুর ঘাস খাওয়ার মতো সুন্দর ছবি পোস্ট করেছেন। আপনাদের জন্যই দেশটা টিকে আছে। আপনারা এখনো ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ান, উলুবনে মুক্তো ছড়ান, বাঁদরের গলায় হার পরান, রুমাল দিয়ে কুমীরের চোখের জল মুছে দেন, টিস্যু দিয়ে ব্যাঙের সর্দি পরিষ্কার করেন। আপনাকে সালাম!
কেউ বলবে: কাজির গরু কিতাবে আছে, গোয়ালে নেই!
এভাবে মন্তব্য, প্রতিমন্তব্য চলতেই থাকে। সাধারণ একটা বিষয়কে ত্যানা পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে জটিল থেকে জটিলতর বানানো হয়। সামাজিক, রাজনৈতিক, রাষ্ট্রীয়, জাতীয়, আন্তর্জাতিক, জলবায়ু, রঙ, আল্পনা, বর্ষবরণ, হিরো আলম, অনন্ত জলিল, জায়েদ খান, সাহিত্য, ফ্যাশন, মোটিভেশন, ফুটবল, ক্রিকেট, যুদ্ধ, সমরাস্ত্র, ধর্ম, ইহকাল, পরকালসহ যেকোনো বিষয়ে ভালোভাবে ত্যানা প্যাঁচানোর জন্যে একটা নতুন প্রজন্মের জন্ম হয়েছে। এটা ফেইসবুক প্রজন্মও বটে।
এই ফেইসবুক প্রজন্ম হারাচ্ছে গভীর অন্তর্দৃষ্টি। জীবনবোধ তৈরি হচ্ছে না। নেই ইতিবাচক মানসিকতা। দার্শনিক জ্ঞান সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে, নীতি-আদর্শের চর্চা কমছে, ব্যস্ত কেবল ত্যানা প্যাঁচানোর মহৎ কাজে!
প্রশ্ন হলো, একমাত্র ত্যানা প্যাঁচানোর বিদ্যায় পারদর্শী এই ফেইসবুক প্রজন্মকে লইয়া আমরা কোথায় যাইব? কী করিব?