ফুটবল, আশা ও হতাশা

আমরা ফুটবল এবং রাজনীতি উভয়কে নিয়েই স্বপ্ন দেখেছি, প্রত্যাশার মিনার গড়েছি; সেই প্রত্যাশার মিনার আজ শুধুই জিজ্ঞাসার চিহ্ন! আমরা তবুও স্বপ্ন দেখি।

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 19 Nov 2022, 09:55 AM
Updated : 19 Nov 2022, 09:55 AM

ফুটবল। আজ মানব সভ্যতার অপরিহার্য অংশ হিসেবে সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় খেলা। আধুনিক সভ্যতার একটি অঙ্গ হলো খেলাধুলা। মানুষের বিভিন্ন সৃজনশীলতার মধ্যে এটি একটি। শরীরকে সুস্থ রাখা এবং আনন্দ পাওয়ার মাধ্যম হিসেবে খেলাধুলার জন্ম। এর মধ্যে ফুটবলও পড়ে। বায়ুপূর্ণ একটি চর্মগোলক, বাইশ জোয়ান আর একখানি সবুজ মাঠ যে কি সাংঘাতিক কাণ্ড ঘটাতে পারে সেটা ফুটবল দুনিয়ার দিকে তাকালেই টের পাওয়া যায়। নব্বই মিনিটের এই রুদ্ধশ্বাস খেলাটির মধ্যে বিস্ফোরক, নাটকীয়তা, পেলবতা, শিল্প, হিংস্রতা, রাগ-দ্বেষ-ভালোবাসা, হাসি-অশ্রু, টাকা, রাজনীতি, ভাগ্য-কুসংস্কার, বাণিজ্য– সবকিছু এমন মিলেমিশে আছে যে অবাক হতে হয়। বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের আনন্দ, উল্লাস, উত্তেজনা বা হতাশা, বেদনা, বিক্ষোভ প্রতি চার বছর অন্তর এই ‘পাদগোলক’টিকে ঘিরে!

ফুটবল মানে একটাই মাঠ। সবার জন্য সমান। একটাই বল। সবার জন্য সমান। খেলোয়াড়দের মধ্যে পার্থক্য করে দেয় শুধু পরিশ্রম আর প্রতিভা। ফুটবল এমন একটা সহজ সাধারণ কাঠামো, যেখানে জাতি-ধর্ম-সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে সবাইকে স্বাগত জানানো হয়। তাই তো ফুটবল সারাবিশ্বের সর্বাধিক জনপ্রিয় খেলা। বাংলাদেশে জনপ্রিয় তো বটেই।

আমাদের দেশের রাজনীতি ও ফুটবল– দুটোই ‘এ’ এবং ‘বি’ এই দুই শিবিরে বিভক্ত। ‘এ’ হচ্ছে আওয়ামী লীগ; আর ‘বি’ হচ্ছে বিএনপি। ফুটবলে ‘এ’ হচ্ছে আর্জেন্টিনা; আর ‘বি’ হচ্ছে ব্রাজিল। যেমনভাবে দেশীয় ফুটবলে আবাহনী ও মোহামেডান! ইদানীং বিশ্বকাপে স্পেন, জার্মান, ফ্রান্স এবং জাতীয় লীগে মুক্তিযোদ্ধা, শেখ জামাল, শেখ রাসেল ইত্যাদি দলের উত্থান ঘটলেও সেগুলো তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি।

এদেশের মানুষ ফুটবল অন্তপ্রাণ হলেও আমরা ফুটবলের ‘ফেয়ার প্লে’-এর আদর্শটা গ্রহণ করতে পারিনি। আমরা জাতিগতভাবে ‘ফাউল’-কেই গেম মনে করেছি। বিশ্বকাপ ফুটবলেও আমরা ল্যাং মারা, প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়ের জার্সি ধরে টানাটানি করা, ঢুঁস মারা, কামড়ে দেয়া ইত্যাদি দৃশ্য দেখেছি। আর জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অত্যন্ত সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে আমরা তা অনুসরণ করে চলেছি। বিশ্বকাপ ফুটবলে একজন রেফারি থাকেন। যারা নিয়ম ভঙ্গ করেন, তাদের তিনি হলুদ কার্ড বা লাল কার্ড দেখান। কিন্তু আমাদের রাজনীতির খেলায় যারা নিয়মিতই বিধি লঙ্ঘন করেন, তাদের কার্ড দেখানোর কেউ নেই। ফলে আমাদের রাজনীতিতে ফাউলটাই খেলার অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এই বাংলাদেশে ফুটবল খেলা চলছে প্রায় একশ বছর ধরে। এই খেলা ঘিরে জীবনমুখী প্রাণচাঞ্চল্যের চিহ্ন বুকে নিয়ে উৎসাহ-উদ্দীপনার কালাতি-স্রোত বয়ে চলেছে। এই ফুটবল আমাদের কখনও আনন্দে আপ্লুত করেছে। কখনওবা জীবনের আর পাঁচটা ক্ষেত্রের পরাজয় ভোলাতে, ব্যর্থতার গ্লানি ঢাকতে সাহায্য করেছে। আনন্দ-যন্ত্রণা, আশা-নিরাশার আলো-আঁধারিকে কেন্দ্র করে এই ফুটবল নিয়ে কতো মজার ও দুঃখজড়িত দৃশ্যকাব্য প্রকাশ্যে ও নেপথ্যে অভিনীত হয়েছে! তারপরও ফুটবলে আমরা এগোতে পারিনি।

একথা সত্য যে, ফুটবল-সংসারে বাংলাদেশ নিতান্তই নাবালক, এমনকি পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, ভারত, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমারকে অতিক্রম করার যোগ্যতা আমাদের নেই। স্বাস্থ্য-মেধায়-গতিতে-চিন্তাশক্তিতে-উদ্ভাবনে আমাদের যে দুর্বলতা পরাধীন আমলে ছিল তা এখনো শেকড় গেড়ে বসে আছে। স্যাটেলাইট টিভির কল্যাণে আমরা বর্তমানে বিদেশি ফুটবলের অতি উন্নত ক্রীড়াশৈলী দেখে বিস্মিত, উত্তেজিত। আর সেইসঙ্গে প্রকটভাবে প্রকাশ পাচ্ছে আমাদের ফুটবল দৈন্য। আমাদের ফুটবল আজও পর্যন্ত শুধুই একটি হতাশার গোলক, অন্ধকার গ্লানিময় একটুকরো দীর্ঘশ্বাস!

বর্তমান যুগ প্রতিযোগিতার যুগ। এই তীব্র প্রতিযোগিতার যুগে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার। আমাদের জাতীয় ফুটবলকে কেমন করে আনা যাবে আলোকিত গৌরবে, খেলোয়াড়, অনুশীলন, আস্থা, উদ্যম, ব্যবস্থাপনা, সংগঠক, পরিচালক, প্রশিক্ষণ কোথায় তাদের ত্রুটি? ক্ষুরধার অনুশীলন প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, গতিবেগ, বিজ্ঞানসম্মত প্রশিক্ষণ– এ সবকিছুর সমন্বয় না ঘটলে এবং প্রতিভাবান খেলোয়াড় খুঁজে বের করায় মনোযোগী না হলে এ হতাশা চিরস্থায়ী হবে। টেনিস বা ক্রিকেটের সূক্ষ্মতা ফুটবলে নেই। কিন্তু আছে রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনা, প্রবল স্নায়ুযুদ্ধ। ফুটবলের মাঠে যত মারামারি খুনোখুনি হয়– এমনটি আর কোনো খেলায় হয় না।

এই যে ফুটবলের অজস্র দর্শক– এই বিরাট দর্শকের অধিকাংশই আজকের অবক্ষয়গ্রস্ত তরুণ সমাজের প্রতিনিধি। সমাজ যদি পঙ্গু হয় সেই সমাজের ব্যক্তিদের চিন্তা-ভাবনাও পঙ্গু হতে বাধ্য। তাদের অনেকের নিজের কোনো চিন্তা-ভাবনা নেই। চিন্তা-ভাবনা করার মতো অবস্থা হারিয়ে ফেলেছে। কিসে কি হয় এই সিদ্ধান্তে আসার মতো ক্ষমতা নেই। এক কথায় তারা ‘রিট্রিটিং ফ্রম রিজনিং’। নিজেদের ব্যক্তিত্ব ভুলে নিছক গোষ্ঠী মনোভাবের দাস হয়ে পড়েছে। আলাদা করে কাউকে চেনার উপায় নেই। কারণ তাদের এখন গোষ্ঠীবদ্ধ চেহারা। যেহেতু নিজেরা কোনো কিছু ভেবে দেখে না, তারা চায় ওদের হয়ে অন্য কেউ চিন্তা-ভাবনা করে দিক। এই গোষ্ঠীটি বাঁচার তাগিদে এক একটা ‘গুরু’ খুঁজে নেয়। কারও গুরু কোনো রাজনৈতিক বড় ভাই, কারও গুরু কোনো সিনেমা তারকা, আবার অনেকের গুরু ফুটবল-ক্রিকেট মাঠের নক্ষত্ররা। যে ফুটবল ছিল একসময় নিছক একটি খেলা, অবস্থার চাপে সেই ফুটবল এখন পণ্য। ফুটবল এখন বিক্রি হয়ে গেছে। একইসঙ্গে ফুটবলার এবং দর্শকরাও। ফুটবল বিশ্বকাপে যখন দুটো দল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামে তখন আসলে এগারোজন মিলিয়নারের বিরুদ্ধে এগারোজন মিলিয়নারের খেলাই আমরা দেখতে পাই।

যদিও আমাদের জীবনে ফুটবল একটি ট্রাজেডির নাম। খেলোয়াড় হতে না পেরে সমাজের অধিকাংশ মানুষের দর্শকে পরিণত হবার আশ্চর্য গল্প! আমাদের ফুটবল এবং রাজনীতির মধ্যেও রয়েছে একটি ভয়ঙ্কর সাদৃশ্য। ফুটবলে যেমন বছরান্তে দলবদল হয় রাজনীতিতেও ইলেকশন মৌসুমে দলবদল হয়। এ দলবদলের ক্ষেত্রে দলের আদর্শ বা নীতি মুখ্য বিবেচ্য নয় বরং নগদ অর্থ তথা প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধার ওপরই নির্ভর করে কে কোন দলের আনুগত্য বরণ করবে। ফুটবল ক্লাবের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে কোটিপতি, কালো টাকার মালিকদেরই প্রাধান্য লক্ষ করা যায়। বড় বড় ক্লাবগুলোতে বেশি বেশি টাকাওয়ালাদের সমাবেশ ঘটে এবং এদের সামর্থ্যের ওপর ক্লাবের শক্তিমত্তা নির্ভর করে। একইভাবে রাজনীতিতেও যে দল যত বেশি কালোটাকার মালিক এবং কোটিপতির সমর্থন পায় তারাই তত শক্তি অর্জন করে। ফুটবলে যেমন গোটা জাতি ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা, আবাহনী-মোহামেডান ইত্যাদি গোষ্ঠীতে বিভক্ত, রাজনীতিতেও আওয়ামী লীগ-বিএনপি ইত্যাদি বিভাজন রয়েছে। উভয় ক্ষেত্রেই বিভাজিত সমর্থক গোষ্ঠীর উন্মত্ততা অত্যন্ত নগ্নভাবে প্রকাশ পায়।

আসলে আমদের আর্থসামাজিক কাঠামোর সঙ্গে ফুটবল একাকার হয়ে গেছে। এদেশের এক শ্রেণির মানুষ আছে যারা বিভিন্ন লীগ বা টুর্নামেন্ট আয়োজন করে। এরা হচ্ছে আমলা-সেনা-বৃহৎ দলের নেতা-পুঁজিপতি প্রমুখ। আরেক শ্রেণি আছে যারা খেলোয়াড়। যারা উচ্চদামে বিক্রি হন বিভিন্ন দলের কাছে। নগদ নারায়ণের ভরসায় তারা খেলে যান পেশাদারী মনোভাব নিয়ে। রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, অবসরপ্রাপ্ত আমলা প্রমুখ এ জাতভুক্ত। এর বাইরে আপামর জনগণ দুই ভাগে বিভক্ত। আম-জনতার একটা বড় অংশ নিজেই ফুটবল। সারাজীবন যারা লাথি খেয়েই যায়। এক খেলোয়াড়ের কাছে লাথি খেয়ে অন্যজনের কাছে। এভাবে পায়ে পায়ে দীর্ণ হতে হতেই তাদের বেঁচে থাকা কিংবা মরে যাওয়া। এর বাইরে আরেকটা দল আছে যাদের বলা যায় নির্বোধ। এরা গাঁটের পয়সা ভেঙে সময়-শ্রম নষ্ট করে, রাত জেগে খেলা দেখে, হাততালি দেয়। স্লোগান তোলে, পটকা ফাটায়, প্রতিপক্ষ দলের বিরুদ্ধে মরণপণ ঝগড়ায় মত্ত হয়, নির্বোধের মতো মাঝে মাঝে আত্মদান করে। এরা দর্শক।

স্বাধীনতার পর এতগুলো বছর কেটে গেলে– আমাদের রাজনীতি হতাশা, ব্যর্থতা আর দলবাজি ছাড়া তেমন কিছুই উপহার দিতে পারেনি। আমাদের ফুটবলও আজ পর্যন্ত ব্যর্থতা আর পরাজয়ের গ্লানি ছাড়া অন্য কিছুই দিতে পারেনি। আমরা ফুটবল এবং রাজনীতি উভয়কে নিয়েই স্বপ্ন দেখেছি, প্রত্যাশার মিনার গড়েছি; সেই প্রত্যাশার মিনার আজ শুধুই জিজ্ঞাসার চিহ্ন! আমরা তবুও স্বপ্ন দেখি। প্রতিনিয়ত প্রতারিত হয়েও আওয়ামী লীগ-বিএনপির নামে রাজপথে মাতম তুলি। বঞ্চনার দগদগে ঘা নিয়ে ধানের শীষ বা নৌকামার্কায় ভোট দিই। বার বার স্বপ্নভঙ্গের বেদনা নিয়েও ফুটবল খেলা দেখি। সবকিছুর মৃত্যু ঘটলেও স্বপ্নের তো মৃত্যু ঘটে না! তাই তো আশায় বুক বাঁধি– বাংলাদেশ একদিন বিশ্বকাপ খেলবে। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা নয়, এদেশের মানুষ একদিন বাংলাদেশের ফুটবল টিমের জন্য হাততালি দেবে, প্রাণপণে চিৎকার করবে! আওয়ামী লীগ-বিএনপি কিংবা অন্য কারও হাত ধরে একদিন জাতির মুক্তি আসবে!

প্রশ্ন হলো, আমাদের আশার রাজনীতি, প্রত্যাশার ফুটবল আর কতকাল অনন্ত হতাশার গোলক হয়েই থাকবে?