চন্দরিয়ার স্মৃতি-বিস্মৃতি

এক কোটি তো ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল, অভ্যন্তরীণ শরণার্থীর সংখ্যা কত ছিল জানার মতো কোনো তথ্য পাইনি। তবে অনুমান করা যায়, রাজাকার-আলবদর ছাড়া এমন পরিবার খুব কম আছে, যারা একবারও যুদ্ধদিনে আতঙ্কিত হয়ে ঘর ছাড়েনি। নিজ গ্রাম ছেড়ে অন্য গ্রামে আশ্রয় নেয়নি। আমরা ফিরতে পারিনি পুরো নয় মাস।

মুস্তাফিজুর রহমান রূপমমুস্তাফিজুর রহমান রূপম
Published : 25 March 2023, 06:14 PM
Updated : 25 March 2023, 06:14 PM

দিনাজপুর শহরের পশ্চিম দিক দিয়ে বয়ে যাওয়া পুনর্ভবা নদীর সেতু পার হয়ে উত্তরে বাঁক নিয়ে একটি পথ চলে গেছে রাধিকাপুর সীমান্তের দিকে। সেখানে একটা ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট আছে। এই দিক দিয়ে রেলপথে ভারত থেকে মালবাহী ট্রেন আসা-যাওয়া করে মাঝেমধ্যে। আর একটি পথ উত্তর দিকে মাইলখানেক গিয়ে বাঁক নিয়ে চলে গেছে পশ্চিম দিকে। এই পথেই আমাদের গন্তব্য বাজনাহার রেল ক্রসিং পার হয়ে আরও কয়েক কিলোমিটার পরে ঢেরাপাটিয়া নামে একটা পাঁচ রাস্তার মোড়। পাট থেকে রশি তৈরি করবার জন্য পাঁচ বাহু বিশিষ্ট বাঁশ বা কাঠের তৈরি একটি গ্রামীণ যন্ত্রকে স্থানীয় ভাষায় ঢেরাপাটিয়া বলা হয়। ঢেরাপাটিয়া নামে পাঁচ রাস্তার মোড় থেকে সোজা পশ্চিমে যে রাস্তাটি গেছে, সেটি ধরে আমাদের চলা। ছোট কিন্তু পাকা রাস্তা, রাস্তার দুই পাশে সারিবদ্ধ মেহগনি গাছ, গাছে গাছে নতুন পাতা দৃষ্টি প্রশান্ত করে। আরও ভালো লাগার বিষয় যে গাছগুলো ইউক্যালিপটাস বা একাশিয়া নয়। সামনে টাঙ্গন নদী। সরু সেতু পার হয়ে সোজা রাস্তা ধরে আমরা চলছি। এ পথেই একাত্তরে আমরা পালিয়েছিলাম কখনও গরুর গাড়িতে করে, কখনও আবার পায়ে হেঁটে।

ওই দিন পরিবারের যাঁদের সঙ্গে শিশু আমিও পালিয়েছিলাম, তাঁদের কেউ আর নেই। দাদী আর আব্বা নেই অনেক দিন হয়ে গেছে। দুই ফুপু আর ভাইয়াও মারা গেছেন। গতবছর আমার মা চলে গেছেন ধরাধাম ছেড়ে। আমি শুধু একলা রয়ে গিয়েছি স্মৃতি নিয়ে। কিন্তু ওইসব দিনের স্মৃতি কতটা আমার এবং কতটা আমাদের যৌথ স্মৃতির অংশ কেমন করে বলি? আমার জন্ম ১৯৬৭ সালে, যদিও কাগজে-কলমে তা আবার ১৯৬৯ সাল করা আছে। ১৯৭১ সালে আমার বয়স ছিল মাত্র চার বছর। চার বছরের এক শিশু যুদ্ধের দিনগুলোর কথা কতটুকু মনে করতে পারে, সেই সময় থেকে ৫৩ বছর পরে? এই কথা আমি বহুবার ভেবেছি, আলোচনাও করেছি বিভিন্ন বয়সে। হতে পারে আমি একটি পরিবারের কালেকটিভ স্মৃতিকে ধারণ করছি। আমার নিজের কতটা মনে আছে, কতটা মনে থাকার কথা? বড় কোনো ঘটনার অভিঘাত হয়তো মনে রয়ে যায়। আবার এটাও হতে পারে যখন একটু একটু করে বড় হচ্ছি, তখন মুক্তিযুদ্ধের সময়ের অনেক কথা, ঘটনা বহুবার গল্পে গল্পে শুনে শুনে বড় হয়েছি। সেই সব গল্পের কল্পচিত্রই আমার কাছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি হয়ে গেছে। তবে ধারাবাহিকভাবে না হলেও মুক্তিযুদ্ধের সময়কার এই বাংলার কিছু ঘটনা যে বিচ্ছিন্নভাবে স্পষ্ট মনে আছে, তাতে আমার কোনো সন্দেহ নেই। আমরা ছিলাম অভ্যন্তরীণ শরণার্থীদের দলে।

১৯৭১ সালের মধ্য এপ্রিলে দশমাইলে প্রতিরোধ যুদ্ধে মুক্তিকামীদের হারিয়ে দিয়ে পাকিস্তানি সেনারা দিনাজপুর শহরেঢুকে পড়ে। শহরের অনেক মানুষ পরিবারসহ রামসাগরের দিক দিয়ে খানপুর সীমান্ত হয়ে ভারতে চলে যায়। পরবর্তীকালে অল্পবিস্তর পড়াশোনা করে যা জেনেছি এপ্রিল থেকেই শুরু হয়েছিল শরণার্থীদের ভারত অভিমুখী যাত্রা। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে এসে ভারতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় এক কোটি। ত্রিপুরার জনসংখ্যার প্রায় সমান হয়ে গিয়েছিল আশ্রিত শরণার্থীর সংখ্যা। তবে শরণার্থীদের প্রধান আশ্রয়স্থল ছিল পশ্চিমবঙ্গ। ১৯৭২ সালে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশ ডকুমেন্টস অনুযায়ী ২৬ মার্চ থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারত ৯৮ লাখ ৯৯ হাজার ৩০৫ জন বাংলাদেশি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছিল। সবচেয়ে বেশি শরণার্থী আশ্রয়দাতা রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে আশ্রিতের সংখ্যা ছিল ৭৪ লাখ ৯৩ হাজার ৪৭৪। দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল ত্রিপুরা। তবে সেখানে আশ্রিত ১৪ লাখ ১৬ হাজার ৪৯১ শরণার্থী ছিল ত্রিপুরার মোট জনসংখ্যার প্রায় সমান। মেঘালয়ে ছয় লাখ ৬৭ হাজার ৯৮৬ ও আসামে তিন লাখ ১২ হাজার ৭১৩ জন। যখন বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এই রাজ্যগুলো আরও শরণার্থী আশ্রয় দিতে অপারগ হয়ে পড়ে, তখন দূরবর্তী তিনটি রাজ্যেও বাংলাদেশি শরণার্থী পাঠানো হয়েছিল।

দিনাজপুরে একটা বড়সংখ্যক লোকজন রয়েছে ১৯৪৭ সালের ভারত ভাগের পর বিভিন্ন সময়ে পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসা। তাদের পক্ষে খুব সহজ ছিল ওপারে চলে যাওয়া। কারণ ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হওয়া পাকিস্তানে আসা মুসলমানদের আত্মীয়স্বজন অনেকেই রয়ে গিয়েছিল ওপারে। হিন্দুদের অবশ্য যুদ্ধের পর দেশে থাকা ছিল কঠিন। পাকিস্তানিদের বেছে বেছে গণহত্যার প্রধান টার্গেটই ছিল হিন্দুরা। হিন্দুদের প্রায় সবাই চলে গিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে এবং বেশিরভাগের আশ্রয় হয়েছিল শরণার্থী শিবির। আমাদের না ছিল আত্মীয়স্বজন, না ছিল শরণার্থী শিবিরের যন্ত্রণা সইবার ক্ষমতা। তাই দেশেই ছিলাম আতঙ্ক নিয়ে। আমাদের মতো অভ্যন্তরীণ শরণার্থীর সংখ্যাটা কোথাও হয়তো নেই। এক কোটি তো ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল, অভ্যন্তরীণ শরণার্থীর সংখ্যা কত ছিল জানার মতো কোনো তথ্য পাইনি। তবে অনুমান করা যায়, রাজাকার-আলবদর ছাড়া এমন পরিবার খুব কম আছে, যারা একবারও যুদ্ধদিনে আতঙ্কিত হয়ে ঘর ছাড়েনি। নিজ গ্রাম ছেড়ে অন্য গ্রামে আশ্রয় নেয়নি। আমরা ফিরতে পারিনি পুরো নয় মাস।

আমরা বিপ্লব ভাইদের পরিবারসহ পুনর্ভবা নদী পার হয়ে প্রথমে আশ্রয় নিয়েছিলাম বিরল উপজেলার বাজনাহার গ্রামে জোহা ভাইদের বাড়িতে। আল মামুন বিপ্লবের উদ্যোগে পাঁচ দশকের ধূলোপড়া স্মৃতি পুনরুদ্ধারে বেরিয়েছিলাম এই মার্চেরই ৯ তারিখে। সঙ্গে সৈয়দ জোহা, মানে আমাদের জোহা ভাই।

বিপ্লব ভাই আমার বছর দুয়েকের বড়। জোহা ভাই পনের বছরের। দিনাজপুর শহর থেকে পৌনে বারোটার দিকে পুনর্ভবা সেতু পার হয়ে দিনাজপুরের বিরল উপজেলার বাজনাহার গ্রামে পৌঁছাই। দিনাজপুর-বোচাগঞ্জ সড়কের পাশে জোহা ভাই আমাদের সঙ্গে যুক্ত হলেন। জোহা ভাই ৭২ বছরের একজন উদ্যমী মানুষ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাশ করে কিছুদিন দেশেই ছিলেন। এরপর থেকে গত ৩৫ বছর যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। বাজনাহার গ্রামের এক সময়ের পোস্টমাস্টার আজিজার রহমানের ১১ জন পুত্র-কন্যার মধ্যে তিনি সবার বড়। বসন্তকালের উদাস দুপুর, গাড়িতে হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়ার ‘বসন্ত’ রাগের বাঁশির সঙ্গে ছন্দময় নিরাপদ গতিতে ড্রাইভ করতে করতে ভালো-মন্দ টুকটাক কিছু কথা বলি। এরই মাঝে আমি কিছুটা স্মৃতিকাতর, সেই স্মৃতি ১৯৭১ সালের স্মৃতি। আমরা দিনাজপুর শহর ছেড়ে প্রথমে আশ্রয় নিয়েছিলাম বাজনাহারে জোহা ভাইদের বাড়িতে।

বাজনাহার যাত্রাকালের স্মৃতির সামান্য অংশ এখনও আমার চোখে ভাসে। একটি গরুর গাড়িতে আমাদের ও বিপ্লব ভাইদের দুই পরিবারের কিছু কিছু করে মালপত্র নিয়ে যাত্রাটার শুরু। ধূলিময় পথ ঢালু হয়ে নদীতে নেমে গেছে। আমার বড় ভাই আব্বার সাইকেলটি ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে আর আমি কিছু একটা কাজ করব বলেই একটি টিনের বালতি হাতে নিয়ে গম্ভীরভাবে হাঁটছি। বৈশাখ মাসে হাঁটুজলের নদীতে ‘পার হয়ে যায় গরু পার হয় গাড়ী’ এভাবে দিনাজপুর শহর থেকে মাত্র ১২ কিলোমিটার দূরের বাজনাহার যেন দূরতম শত মাইল মনে হয়েছিল। বাজনাহার জোহা ভাইদের বাসায় আমরা কয়দিন ছিলাম আজ আর তার হিসেব মনে করতে পারছি না। পাকিস্তানি সেনারা পুনর্ভবা নদী অতিক্রম করেছে খবর পেয়ে আমরা সেখান থেকে জোহা ভাইদের মামা বাড়ি চন্দরিয়া চলে যাই।

চন্দরিয়া সুন্দর একটা নাম। সুন্দর একটি গ্রাম। অন্তত আমার কাছে তাই মনে হলো ঠাকুরগাঁও জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার জাবড়হাট ইউনিয়নের গ্রামটিকে। একেবারে ভারতীয় সীমান্তসংলগ্ন একটি গ্রাম এটি। ১৯৭১ সালে আমাদের আরও অনেক অভ্যন্তরীণ শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছিল গ্রামটি। কিন্তু সেই গ্রামটিতে ফিরে এলাম এত এত বছর পর, যুদ্ধদিনের স্মৃতি পুনরুদ্ধারে। যখন পৌছালাম, তখন সূর্য মধ্যগগনে। নিস্তব্ধ দুপুর, কোনো যান্ত্রিক কোলাহল তো দূরের কথা, কোনো মানুষের কথা, এমনকি কোনো পাখির ডাকও শোনা যাচ্ছে না আশপাশে। জোহা ভাই, বিপ্লব ভাই আত্মীয়-পরিজনদের সঙ্গে প্রাথমিক সালাম-কুশল বিনিময়ের পর আলাপচারিতায় মেতে উঠলে আমি একাই বেরিয়ে পড়লাম গ্রামটি দেখতে, ৫৩ বছর আগে মুক্তিযুদ্ধের সময় দেখা এই গ্রামে আমার বিচরিত জায়গাগুলো খুঁজতে।

গ্রামের বাড়িঘরের মাঝ দিয়ে মেঠোপথ চলে গেছে দক্ষিণ দিকে। একটি তাল ও একটি খেজুর গাছ বাঁকা হয়ে দাঁডিয়ে আছে অনেকটা ইংরেজি ভি অক্ষরের আকৃতি নিয়ে। দুই গাছের মাঝ দিয়ে তাকালে চোখে পড়ে অনেক গাছপালা ঘেরা বিজিবির বিওপি ক্যাম্প। পূর্বদিকে বেশ বড়সড় একটা তালপুকুর, পুকুরের পশ্চিম পাড়ে একটি তালগাছ ‘এক পায়ে দাঁড়িয়ে’। প্রায় তলানিতে পড়ে আছে পুকুরের জল, সেই জলে তিনটি মহিষ দেহের অধিকাংশ ডুবিয়ে বসে আছে স্থির হয়ে। পুকুরের উত্তর পাড়ে নতুন তৈরি হওয়া বাড়িঘরের সামনে গরু-ছাগল এবং কয়েকটি মুরগিও চোখে পড়ল। অন্য পাড়ে মাটি লেপা খোলানে সেদ্ধ ধান শুকাতে দেওয়া আছে চাল তৈরির জন্য। এগিয়ে এলো এক তরুণ, শ্যামবর্ণের সুঠাম দেহ। জানালো তার নাম আব্দুল ওহাব। সে ঢাকায় নির্মাণাধীন ভবনের বৈদ্যুতিক সংযোগের জন্য পাইপ বসানোর কাজ করে। ছুটিতে বাড়িতে এসে মাকে ধান সেদ্ধ করে চাল তৈরির কাজে সাহায্য করছে।

মালেক ভাইদের বাড়িতে এসেছি শুনে, সে বলল, ‘বিএনপি মালেক?’ মালেক ভাই মুক্তিযুদ্ধের সময় চন্দরিয়ায় আমাদের আশ্রয়দাতা পরিবারটির সাত সন্তানের মধ্যে কনিষ্ঠ জন। মালেক ভাই বিএনপির রাজনীতি করেন। ইউনিয়ন কমিটির সভাপতিও ছিলেন। তাই তার এমন নামকরণ। মালেক ভাই আমাকে কাঁধে নিয়ে বেড়াতেন সে কথা খুব মনে আছে আমার। এই পুকুরের চার দিকে অনেক বাঁশঝাড়, ঝোপজঙ্গল ছিল। আমাদের ছোটদের পুকুরের কাছে যাওয়া বারণ ছিল। একটু দূরে বয়সী গাছের আম বাগান ছিল অনেকটা জায়গাজুড়ে, একাত্তরের গ্রীষ্মে সেই বাগানের কাঁচাপাকা আম খেয়েছি কত। এখানে আমরা বাঁশের তৈরি খেলনা স্টেনগান , মেশিনগান দিয়ে অদৃশ্য খান সেনাদের প্রতিনিয়ত পরাজিত এবং হত্যা করতাম। স্টেনগান অস্ত্রটি মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং তার কিছুকাল পরেও বেশ জনপ্রিয় ছিল। দেখলাম সেই আম বাগানের চিহ্নও নেই, ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু নবীন আম গাছ মুকুলে ভরা। মনে পড়ল ‘মঞ্জরী ও মঞ্জরী আমের মঞ্জরী/ আজ হৃদয় তোমার উদাস হয়ে পড়ছে কি ঝরি’।

হৃদয়কে বেশিক্ষণ উদাস হতে না দিয়ে পুকুর পাড়ের এক কোণে পারিবারিক কবরস্থানের পাশ দিয়ে ফিরতি পথে কিছু দূর এগোতেই দেখি মালেক ভাই একটি ভাঙাচোরা সাইকেল চালিয়ে আসছেন। একাত্তরের তরুণ আজ বৃদ্ধ। জোহা ভাই, বিপ্লব ভাই আরও দুজন তারা জোহা ভাইয়ের ছোট মামার ছেলে, আজিজ ও আলীম হেঁটে চলে এসেছেন। আমরা মালেক ভাইয়ের বাবা-চাচাদের কবর জিয়ারত করলাম। সেই দিনগুলোতে পুকুর পাড়ে বাঁশঝাড়ের পরে অনেক জমিজুড়ে পাটক্ষেত ছিল। আজ ভুট্টার চাষ দেখতে পাচ্ছি। মাঝেমাঝে রাতের বেলা আমাদের বিশেষ করে নারী ও শিশুদের ওই পাট ক্ষেতে লুকিয়ে থাকতে হতো। ঠিক কি কারণে তা আমার কাছে বোধগম্য ছিল না।

পাকিস্তানি সেনারা ভারত সীমান্তের অতো কাছে পৌঁছাবার সাহস করেনি। রাজাকার-আলবদরদের কথাও তেমন কিছু শুনেছি বলে মনে পড়ে না। তারা ডাকাত ছিল বলেই শুনেছি একাধিকবার। তাদের মধ্যে কেউ কেউ পরবর্তীকালে মুক্তিযোদ্ধা সাজারও চেষ্টা করেছে বলে শোনা গেল। মুক্তিযুদ্ধের বাকি সময়ের পুরোটা আমরা চন্দরিয়ায় ছিলাম না। খুব সম্ভবত এই আতঙ্কের কারণেই।

যুদ্ধের শেষ দিনগুলো, বিজয়ের আগের দিনগুলো আমরা কাটিয়েছি আব্বার সেই সময়ের কর্মস্থল গাইবান্ধায়। আব্বা গাইবান্ধা কলেজের বাংলার জনপ্রিয় শিক্ষক ছিলেন। আমরা গাইবান্ধায় চলে যাওয়ার পর এক রাতে মালেক ভাইদের বাড়িতে ভয়াবহ আক্রমণ করে তথাকথিত ডাকাতেরা। মালেক ভাইয়ের ছোট চাচা, জোহা ভাইয়ের ছোট মামাকে হত্যা করে বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।

জোহা ভাইয়ের ছোট মামার ছোট ছেলে আব্দুল আজিজের ঘরে দুপুরের খাওয়ার আয়োজন করা হয়েছে। আব্দুল আজিজ ইউনিয়ন কৃষক লীগের সভাপতি। এই গ্রাম অঞ্চলেও তার ক্যাবল নেটওয়ার্কের জমজমাট ব্যবসা। আজিজের এইচএসসি পাস করা বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছে গত জানুয়ারি মাসে। আমরা সোফায় বসে সেই বিয়ের অনুষ্ঠানের ভিডিওচিত্র দেখলাম। ইতোমধ্যে জাহানারা বুবু সেখানে আসলেন। জোহা ভাইয়ের সমবয়সী মামাতো বোন এবং মুক্তিযুদ্ধের সময়কার একমাত্র জীবিত নারী। চোখে কালো লেন্সের চশমা থাকলেও মোটামুটি সাবলীলভাবে হাঁটাচলা করতে পারেন। আমার পরিবারের প্রায় সকলের কথা এক এক করে জিজ্ঞেস করলেন। তারা কেউই এই পৃথিবীতে নেই জেনে মর্মাহত হলেন। মালেক ভাইয়ের বাসায় যে ঘরটিতে বসেছি সেটার দেয়াল মাটির তৈরি। আলোচনায় উঠে এলো ঠিক এখানেই এমন একটি মাটির দেয়াল এবং দক্ষিণে বারান্দা যুক্ত ঘরে আমরা আশ্রিত ছিলাম। কিন্তু এই ঘরটি সেই পুরনো ঘর নয়, এটি নতুন।

এরপর আমরা চললাম শুকানদিঘী দেখতে। শূন্য রেখায় বাঁশের মাথায় সাদা পতাকা উড়ছে সীমান্ত স্তম্ভের পাশে। ভারতের সীমান্তের কাঁটা তারের বেড়া দেখা যাচ্ছে খালি চোখেই। বিএসএফের একটি ওয়াচ টাওয়ারও দৃষ্টি সীমানার মধ্যে। সেদিকে ক্যামেরা তাক করে ছবি তুলতে দিতে চাইছেন না জোহা ভাই। কারণ বিএসএফ গুলি ছুঁড়তে পারে। কদিন আগেই দিনাজপুরের হিলি সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে এক বাংলাদেশী প্রাণ হারিয়েছে।

ফিরতি পথে আমরা টাঙ্গন নদীর সেতুর কাছে দাঁড়ালাম। নদী ও অস্তগামী সূর্যের ছবি তুললাম। একাত্তরের বর্ষাকালের শেষ দিকে এই টাঙ্গন নদীতে কলা গাছের তৈরি ভেলায় চেপে ফিরেছিলাম বলে মনে হলো আমার। আমরা কি সেদিন গাইবান্ধার উদ্দেশে যাত্রা করেছিলাম কিনা ঠিক বলতে পারব না। সেদিন আমরা নদীতে ভেলা ভাসানোর আগে থেকেই একটু বৃষ্টি পড়ছিল। ভেলা কিছুদূর এগোতেই শুরু হয় মুষলধারার বৃষ্টি, সেই সঙ্গে ঝড়ো বাতাস। মালেক ভাই এবং তার সাথী কেউ সাঁতরে ভেলাটি নিয়ন্ত্রণ করে নদীর ওপারে পারে নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন এবং নিতে পেরেছিলেন বলেই আমাদের সলিল সমাধি হয়নি। মালেক ভাইয়ের সঙ্গী আরেকজন কে ছিলেন, সেই সাহসী মহান ব্যক্তিটির কথা আজ স্মরণে নেই। ভেলার ওপর বাঁশের কাঠি দিয়ে তৈরি ‘বানা’ বিছানো ছিল। ভেলায় আমি ছোট ফুপুর পাশে হাঁটু মুড়ে নিষ্কম্প বসে থাকার চেষ্টা করছিলাম। সে কথা কখনও ভোলার নয়। নদী পার হয়ে বৃষ্টির মধ্যেই কর্দমাক্ত পথ পেরিয়ে আমরা প্রথমে যে বাড়িটি পাই, সেই বাড়ির বাইরে দিকের গোয়ালঘরে আশ্রয় নিই, অনবরত বৃষ্টি ভেজা থেকে রক্ষা পেতে। সেই গোয়াল ঘরের মাটির দেয়াল ঘেঁষে আমরা গুটিসুটি হয়ে বসে আছি। সেখানে গরু-বাছুর কয়টি ছিল মনে নেই, কিন্তু একদল কিশোর তারই মাঝে মার্বেল খেলায় মেতেছিল। অন্য কোনো দিকে তাদের কোনো খেয়াল ছিল না। অথচ তখন দেশে যুদ্ধ চলছে। তাদেরই সমবয়সী আমি ঘরহীন ভাসছিলাম যুদ্ধের তাণ্ডবে।