বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে শক্তিধরদের তৎপরতা

আমাদের রাজনীতিবিদদের কে বোঝাবে যে, নির্বাচন নিয়ে বিদেশিদের হস্তক্ষেপ দাবি করাটা মোটেও সম্মান ও স্বস্তির কোনো ব্যাপার নয়।

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 22 June 2023, 09:51 AM
Updated : 22 June 2023, 09:51 AM

বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো এখনও পুরোমাত্রায় তৎপর হয়নি। কিন্তু বিভিন্ন শক্তিধর রাষ্ট্র নির্বাচনমুখী তৎপরতা শুরু করেছে পুরোদমে। এ যেন অনেকটা ‘যার বিয়ে তার খবর নাই, পাড়া-পড়শির ঘুম নাই’ অবস্থা। গণতান্ত্রিক প্রথা অনুযায়ী ভোটাররাই হচ্ছেন কোনো রাষ্ট্রের ক্ষমতার পালাবদলের নিয়ামক। সাধারণ জনগণ যাদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেন, তারাই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। আর যারা সংখ্যারিষ্ঠ মানুষের সমর্থন পেতে ব্যর্থ হন, তারা হম্বি-তম্বি করে কাটিয়ে দেন।

আমাদের দেশে অবশ্য গণতান্ত্রিক প্রথাপদ্ধতির চর্চা সীমিত। ভোটে জেতার জন্য নানা কৌশল প্রয়োগ করা হয়। ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে সুষ্ঠু নির্বাচনের গরজ তুলনামূলক কম। সর্বাত্মক চেষ্টা চলে কীভাবে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে কৌশলে নির্বাচন থেকে দূরে সরিয়ে রাখা যায়। আর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষও শক্তি ও কৌশলে সুবিধা করতে না পেরে ‘প্রহসনের নির্বাচন বর্জন ও প্রতিরোধের’ ডাক দেয়।

ভোটের রাজনীতিতে ‘বিশ্বাস ও আস্থার সংকটের’ কারণে বিদেশি রাষ্ট্রগুলোকে সমীহ করে চলতে হয়। অন্য দিকে বিরোধীপক্ষ ক্ষমতাসীনদের শক্তি-সাহস ও কৌশলের কাছে মার খেয়ে ক্ষমতায় যাবার চোরাপথ অন্বেষণ করে। নাশকতা, ষড়যন্ত্র ইত্যাদিতে সুবিধা করতে না পেরে তারা বিদেশি প্রভুর শরণাপন্ন হয়। বিদেশিরা দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করে দেবে, ক্ষমতাসীনদের উচিত শিক্ষা দিয়ে বিরোধীপক্ষকে আলতো করে মসনদে বসিয়ে দেবে, এটাই মূল আকাঙ্ক্ষা। এ জন্য তারা বিভিন্ন শক্তিধর রাষ্ট্রের সঙ্গে দেন-দরবার, ধর্না, লবিংয়ের প্রাণান্ত চেষ্টা করেন। ক্ষমতাসীনরাও ‘আরেকটি বার সুযোগ দিন, আপনারদের সব আবদার রাখব’ বলে বিদেশিদের কাছে সমর্থন চায়। ক্ষমতাসীন ও বিরোধীপক্ষের সম্মিলিত নরম অবস্থান বিদেশিদের নড়ে-চড়ে বসার সুযোগ করে দেয়। তারা নিজেদের স্বার্থ হাসিলের মওকা খুঁজতে থাকেন। বিদেশিরা দেখেন কে ক্ষমতায় থাকলে তাদের স্বার্থের পক্ষে কাজ করবে, সেটা। তাদের নড়াচড়া আর তৎপরতা আসলে উভয়পক্ষের অকুণ্ঠ সমর্থন পাবার কৌশল মাত্র!

বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর এই ভূমিকা আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা বোঝেনও না, বুঝতে চানও না। তাদের তো একটাই মন্ত্র: তোরা যে বলিস ভাই, আমার সোনার মসনদ চাই! আসলে আমাদের দেশে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ না করায় নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য বিদেশিদের সহায়তা চাওয়ার সংস্কৃতির চালু হয়েছে। যারা ক্ষমতায় থাকেন তারা বিদেশিদের তৎপরতার বিরোধিতা করেন; আর যারা ক্ষমতার বাইরে থাকেন তারা বিদেশিদের সহায়তায় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা চান। এটা গত দুই দশক ধরেই চলছে।

কিন্তু আমাদের রাজনীতিবিদদের কে বোঝাবে যে, নির্বাচন নিয়ে বিদেশিদের হস্তক্ষেপ দাবি করাটা মোটেও সম্মান ও স্বস্তির কোনো ব্যাপার নয়। এটা যেকোনো আত্মমর্যাদাসম্পন্ন জাতির জন্যই অত্যন্ত লজ্জা ও অপমানের।

প্রাচীন ভারতের বিখ্যাত চিন্তাবিদ কৌটিল্য কূটনৈতিক আচার-আচরণ সম্পর্কে বলেছিলেন, কোনও দেশের রাজ প্রতিনিধি অন্য দেশের খবরাখবর নিজের দেশে পাঠাতে পারেন। প্রয়োজনে গোয়েন্দাগিরিও চালাতে পারেন। কিন্তু সে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাতে পারেন না। অন্য দেশের সঙ্গে নিজের দেশের সম্পর্ক উন্নয়নে সচেষ্ট থাকাই রাষ্ট্রদূতের বড় দায়িত্ব। কৌটিল্যের সেই বাণীর প্রতিফলন ছিল ১৬৪৮ সালের ‘ওয়েস্ট ফেলিয়া’ সন্ধিতেও। যার কথা প্রাক্তন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার তাঁর একাধিক বইয়ে প্রশংসাসূচকভাবে উল্লেখ করেছেন। সেই চুক্তির অন্যতম শর্ত ছিল, কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অন্য দেশের হস্তক্ষেপের ওপর নিষেধাজ্ঞা। সেই পথেই ১৯৬১ সালের ভিয়েনা কনভেনশনের ৪১ অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে, কূটনীতিকরা অন্য দেশের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবেন এবং সে দেশের ঘরোয়া ব্যাপারে মাথা ঘামাবেন না। কনভেনশনের ৯ অনুচ্ছেদে চুক্তিভুক্ত দেশগুলিকে যেকোনও বিদেশি কূটনীতিককে ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণার অধিকার দিয়েছে। 

আমেরিকা নিজের দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশি কূটনীতিকদের নাক গলানো কখনও সহ্য করেনি। আর তাই ভিয়েনা কনভেনশনের বহু যুগ আগে, ১৮৮৮ সালে নির্বাচনে হস্তক্ষেপের অভিযোগে ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত লর্ড সেকভিলকে ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করেছিল আমেরিকা। শেষপর্যন্ত ব্রিটিশ সরকার লর্ড সেকভিলকে রাষ্ট্রদূতের পদ থেকেই অপসারিত করতে বাধ্য হয়েছিল। পরবর্তী সময়েও অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের দায়ে আমেরিকা বহু বিদেশি কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছে। ২০২১ সালে নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষপাতিত্ব করার অভিযোগে ১০ জন রাশিয়ান কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছিল মার্কিন প্রশাসন।

এই বহিষ্কারের তালিকা বেশ লম্বা। গোটা দুনিয়াকেই এই শক্তি দিয়েছে ভিয়েনা কনভেনশন। অথচ, বাংলাদেশে নির্বাচনের সময় এলেই আমেরিকা, জাপান, পশ্চিমের দেশগুলি সক্রিয়তা বাড়াতে থাকে! নড়ে বসে ভারত, চীন, রাশিয়াও।

সম্প্রতি জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান, কানাডা, অষ্ট্রেলিয়াসহ প্রভাবশালী দেশগুলো জানিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশে ‘আন্তর্জাতিক মানের মডেল নির্বাচন’ দেখার জন্য তারা মুখিয়ে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র গত ৩ মে নির্বাচন ইস্যুতে নাইজেরিয়া, উগান্ডার কাতারে ফেলে বাংলাদেশের জন্য ‘নতুন ভিসা নীতি’ ঘোষণা করেছে। যা শাসক দলের রাজনীতিকদের মধ্যে নয়, প্রশাসনে কর্মরত আমলা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, শাসক দলের অনুগত ব্যবসায়ী, এমপি যারা বৈধ-অবৈধভাবে অর্থ কামিয়ে বিদেশে পাচার করেছেন তাদের আতঙ্কে ফেলে দিয়েছে।

বাংলাদেশের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতি ঘোষণার মধ্যেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ইস্যুতে দেশটির প্রেসিডন্টে জো বাইডেনের কাছে চিঠি দিযেছে ৬ প্রভাবশালী কংগ্রেসম্যান। চিঠিতে বাংলাদেশে অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান ও মানবাধিকার লংঘন বন্ধে প্রেসিডেন্টকে উদ্যোগ নেয়ার আহবান জানানো হয়। যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসম্যানদের মতোই ইউরোপীয় ইউনিয়নের ৬ পার্লামেন্ট সদস্য বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে ভূমিকা রাখতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতি আহবান জানিয়েছেন।

উল্লেখ্য, অনেক দিন ধরেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সম্পর্কের টানাপড়েন চলছে। এর আগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে মানবাধিকারের মারাত্মক লঙ্ঘনের অভিযোগে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‍্যাব) সাবেক ও তৎকালীন সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। আর গত মে মাসে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন ঘোষণা করেন ভিসা নীতি। আওয়ামী লীগ সরকার প্রথমে এই নীতিকে স্বাগত জানালেও পরে এর বিরুদ্ধে বেশ জোরালো অবস্থান নিয়েছে। খোদ প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ভিসা না দিলে বা যুক্তরাষ্ট্রে না গেলে কি যায় আসে। সরকারের এই অবস্থানের প্রশংসা করেছে এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী চীন। তারা জানিয়েও দিয়েছে যে, এ সরকারের পাশে তারা আছে। রাশিয়াও ক্ষমতাসীনদের পক্ষে তাদের অবস্থান ব্যক্ত করেছে।

শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে মার্কিন প্রভাব কিছুটা হলেও কমে গেছে। আমেরিকা তাদের সেই প্রভাব বাড়াতে চায়। কিন্তু এখানে শক্তিশালী অবস্থানে আছে আমেরিকার স্বার্থের প্রতিদ্বন্দ্বী চীন। রয়েছে ভারতও। যদিও সকলের স্বার্থ এক রকম নয়।

বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক এখন বহুমাত্রিক এবং অনেক গভীর। চীনের শত শত কোম্পানি এই মুহূর্তে বাংলাদেশে ব্যবসা করছে। শুধু পদ্মা সেতু নয়, বাংলাদেশে গত কয়েক দশকে অবকাঠামোগত যে অগ্রগতি হয়েছে, তাতে চীনের বিপুল সাহায্য রয়েছে। সামরিক ক্ষেত্রেও তাই। তবে বাংলাদেশে চীনের নৈতিক ও সাংস্কৃতিক আবেদন দুর্বল। ভারত বা আমেরিকা সেই জায়গায় অনেক এগিয়ে। তাই বাংলাদেশকে শুধু চীনের সঙ্গে নয়, তিন সীমান্তের প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গেও ভারসাম্য রক্ষা করতে হয়।

তাহলে বাংলাদেশ কোন দিকে হাত বাড়াবে? এখানেই নেতৃত্ব নিতে চাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তার হাতে রয়েছে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, জাতিসংঘ এবং নানা মিশনের প্রভাব-প্রতিপত্তি। আমেরিকা ও ইইউ দেশগুলো এখন বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের বড় বাজার। বিশাল সংখ্যার প্রবাসী রয়েছেন এসব দেশে। যাদের আয়ে চলছে দেশে লাখ লাখ পরিবার।

তবে বিভিন্ন পরাশক্তির ডামাডোলের মধ্যে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন নিয়ে ভারতের ভূমিকা এখনও রহস্যাবৃত। প্রতিবার ভোটের আগে যে দেশটির ভূমিকা সবার আগে আলোচনায় আসে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়, সেই ভারত এখন পর্যন্ত নির্বাচন নিয়ে পুরোপুরি নীরব। ভোট ও রাজনীতি নিয়ে আগ্রহী দেশি-বিদেশি সবার নজর তাই এখন নয়াদিল্লির দিকে।

বিড়ালের পক্ষে সবসময়ই ছোট ইঁদুর শিকার করা সহজ। আর এই শিকার বিড়াল তার নিজের প্রয়োজনেই করে। ফলে আসন্ন নির্বাচন ঘিরে বিদেশি শক্তিগুলোর যে শিকার-ধরা অভিযান শুরু হয়েছে, বাংলাদেশের মতো নিরুদ্দেশযাত্রী ‘ক্ষুদে ইঁদুর’ সেখানে কী করে সেটাই দেখার ব্যাপার।