এআই: কতোটা পাল্টাবে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র

ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে এআই নির্ভরতা বিষয়বস্তুর মান, সৃজনশীলতা এবং মৌলিকত্ব নষ্ট করতে পারে। তাই নির্মাতাদের চলচ্চিত্র শিল্পে এআই ব্যবহারে সম্ভাব্য ঝুঁকি এবং নৈতিক দিক বিবেচনার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ।

রহমান লেনিনরহমান লেনিন
Published : 13 June 2023, 01:02 PM
Updated : 13 June 2023, 01:02 PM

প্রযুক্তির অনস্বীকার্য প্রভাবে চলচ্চিত্র শিল্পেও এসেছে পরিবর্তন। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের উত্থানে বৈশ্বিক পরিস্থিতির মতো বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পকেও নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে।

ডিজিটাল প্রযুক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং ‘ইন্টারনেট অফ থিংস’-এর অগ্রগতির দ্বারা চালিত বিশ্ব অর্থনীতির চলমান রূপান্তরকে এক কথায় প্রকাশের বহুল ব্যবহৃত টার্মটি হচ্ছে—চতুর্থ শিল্প বিপ্লব  (কেউ কেউ ‘বিপ্লব’ বলেন )। 

যান্ত্রিক শক্তি বনাম পেশিশক্তি। এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক আজকের নয়। মূলকথা, যন্ত্র সব কাজ কেড়ে নেবে। শ্রমজীবীদের বেকার করবে। মানুষের শ্রমকে বাহুল্যে পরিণত করবে।

আশঙ্কা কিংবা সম্ভাবনা যেটাই বলি না কেন এর ইতিহাস ও বিবর্তন সরলরৈখিক না। এর সঙ্গে জড়িত সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি আর ইতিহাসের জটিল সম্পর্ক। প্রযুক্তি যতই আধুনিক ও উন্নত হোক, সেটিকে সফল হতে হলে এসব সম্পর্কের সমীকরণ মেলাতে হয়। প্রাণী হিসেবে মানুষের সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা চিন্তা ও কল্পনা করার সক্ষমতা, কায়িক শ্রম নয়। কিন্তু বিশ্বায়নের এই যুগে প্রযুক্তির সহায়তা পেয়ে আমাদের চিন্তা ও কল্পনার জায়গা অনেকটাই সরল ও সংকীর্ণ হয়েছে এবং হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে , এ কারণে কী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সহজেই আমাদের চিন্তা ও কল্পনার সীমা ধরে ফেলতে পারবে?       

অনেকেই বিশ্বাস করেন, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দ্বারা মুক্ত চিন্তার ও সচেতন কম্পিউটার সিস্টেম বোঝায়, যা জীবিত প্রাণীর মতোই নিজস্ব মতামত পোষণ করতে পারবে। যদিও বাস্তবে আমরা এরকম কম্পিউটার সিস্টেম তৈরি করা থেকে এখনো বেশ দূরে রয়েছি। তবে ‘চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে’র মধ্য দিয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের জানান দিচ্ছে।

অনিবার্যভাবে এটি আমাদের ভবিষ্যৎ পাল্টে দেবে। তবে কিভাবে—আমরা এখনও জানি না। আর সে কারণেই এটি ভেতরে ভেতরে যুগপৎ বিস্ময় আর ভীতি তৈরি করছে। যে প্রচণ্ড গতিতে সবকিছু এগোচ্ছে, তাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে সবচেয়ে বিদ্বান মানুষটিও সব প্রশ্নের নিশ্চিত উত্তর কি দিতে পারবেন?  

অতীতে যন্ত্র মূলত মানুষের শ্রমকে প্রতিস্থাপন করত। ক্যালকুলেটর ও কম্পিউটারের মাধ্যমে গণনা করা যায়, তবে চিন্তা করে মানুষই। কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শক্তি ও চিন্তা—দুই জায়গায় মানুষকে সরাসরি প্রতিস্থাপন করবে। আবার এখন পর্যন্ত আসা প্রযুক্তি বেশকিছু কাজকে অপ্রয়োজনীয় করে দিলেও নতুনভাবে আবার কর্মক্ষেত্র তৈরি করেছে। যেমন টাইপরাইটার কিংবা কম্পিউটার, রিকশা থেকে অটোরিকশা … এসব ক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জন করে মানুষই মানুষকে প্রতিস্থাপন করে। কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে উচ্চপর্যায়ের নীতিনির্ধারণ ছাড়া মানুষের পেশি ও মগজের প্রয়োজন পড়বে কি না—তা এখন বড় প্রশ্ন। 

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে অতি প্রাসঙ্গিকভাবেই A.I. Artificial Intelligence- নামের একটি পুরনো চলচ্চিত্রের কথা মনে পড়লো।

সিনেমাটির কাহিনি এরকম— ডেভিড, একটি অত্যন্ত উন্নত রোবট ছেলে। দেখতে তার বয়স আনুমানিক ৭–৮ বছর। তার দত্তক মায়ের ভালোবাসা ফিরে পেতে একটি মানব সন্তান হতে চায় সে। কিন্তু সত্যিকার মানব সন্তান পাওয়ায় তার পালিত মা তাকে পরিত্যাগ করেছিলেন। মায়ের প্রতি তার চিরন্তন ভালোবাসার কারণে সে সত্যিকার অর্থেই একজন মানবে পরিণত হয়ে ওঠে! সে অন্য যে কাউকে ভালোবাসতে পারে এবং অন্যদের ভালোবাসা পাওয়ার আশা-আকাঙ্ক্ষা রাখতে পারে। চলচ্চিত্রের শেষ দিকে দুই হাজার বছরের অপেক্ষার পর ডেভিডের সঙ্গে তার মায়ের দেখা হয়। ডেভিড মানব শিশুতে পরিণত না হলেও ভিনগ্রহের বাসিন্দাদের দৃষ্টিতে সে মানুষের জীবিত জীবাশ্ম, কারণ তার অনন্য স্মৃতি ও ভাবানুভূতি আছে।  

আশির দশকের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক ও চিত্রনাট্যকার  স্ট্যানলি কুবরিক এ সিনেমার কাহিনি লিখলেও প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতায় এই চলচ্চিত্রটি নির্মাতা স্টিফেন স্পিলবার্গের পরিচালনায় মুক্তি পায় ২০০১ সালে, যার দুই বছর আগেই কুবরিকের মৃত্যু ঘটেছে। স্পিলবার্গ সিনেমাটি কুবরিকের স্মরণে উৎসর্গ করেন।     

চলচ্চিত্রটিতে বলার চেষ্টা করা হয়েছে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি যত দ্রুত উন্নত হোক না কেন, ভালোবাসা হলো ইউনিভার্সের চূড়ান্ত কথা।

এমন অনেক চলচ্চিত্র রয়েছে যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) একটি প্রধান থিম বা প্লট ডিভাইস হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে যেমন— ‘আ স্পেস ওডিসি’ (১৯৬৮), ‘ব্লেড রানার’ (১৯৮২) ,‘দ্য টার্মিনেট’র (১৯৮৪), ‘ওয়ার গেমস’ (১৯৮৩), ‘দ্য ম্যাট্রিক্স’ (১৯৯৯) ‘অ্যাভাটার’ ( ২০০৯)। তবে আমাদের আলোচনার বিষয় সেটি নয়। বরং গত কয়েক দশকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কীভাবে চলচ্চিত্র তৈরি করতে সাহায্য করছে সেটির প্রায়োগিক বিষয়গুলো দেখা।

এ সময়ে এসে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই— পাণ্ডুলিপি থেকে প্রচুর পরিমাণে ডেটা বিশ্লেষণ করে এবং কোন উপাদানগুলো দর্শকদের কাছে জনপ্রিয় হবে সেটি বিশ্লেষণ করে চলচ্চিত্রের পাণ্ডুলিপি তৈরি করে দিচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, ScriptBook এবং LargoAI-এর মতো কোম্পানিগুলো চিত্রনাট্য বিশ্লেষণ করতে এবং পাণ্ডুলিপি মূল্যায়ন করতে মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদম ব্যবহার করছে।

এমনকি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে ক্রম চিহ্নিত করতে অ্যালগরিদম ব্যবহার করে সম্পাদনা এবং পোস্ট-প্রোডাকশনে এআই ব্যবহার করা শুরু হয়েছে। এর ব্যবহারে সময় কম লাগছে এবং শট নির্বাচন এবং সাজানোর প্রক্রিয়া সুগম হচ্ছে এবং অনিবার্যভাবে খরচ কমছে। উদাহরণস্বরূপ, ওপেন এআই এবং অ্যাডোবের মতো সংস্থাগুলো এমন সরঞ্জাম তৈরি করেছে যেগুলোর ভিডিও সম্পাদনায় এআই-এর ব্যবহার নতুনমাত্রা যোগ করেছে।

‘অ্যাভেঞ্জার্স: এন্ডগেম’ এবং ‘দ্য লায়ন কিং’, ‘অ্যাভাটার’ ইত্যাদি চলচ্চিত্রগুলোয় ব্যবহৃত মুখের অ্যানিমেশন প্রযুক্তি মানুষের অভিব্যক্তি এবং নড়াচড়ার অনুকরণ করতে মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদম ব্যবহার করা হয়েছে। এআই-এর ব্যবহারে এই চলচ্চিত্রগুলো অনেক বাস্তবসম্মতভাবে তৈরি হয়েছে এবং দর্শককে বিমোহিত করছে।       

চলচ্চিত্র নির্মাণে বিভিন্ন ক্ষেত্রে এআই ব্যবহার করা হলেও, এটি এখনও এ শিল্পে অপেক্ষাকৃত নতুন প্রযুক্তি। কাজেই এর সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। চলচ্চিত্র নির্মাণের সৃজনশীল সিদ্ধান্তগুলো শেষ পর্যন্ত মানুষের ইনপুটের ওপরই নির্ভর করে এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রক্রিয়াটিকে সহায়তার জন্য হাতিয়ার মাত্র।      

বড় পর্দায় তারকাদের বয়স কমিয়ে আনছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি। ৮০ বছর বয়সী হ্যারিসন ফোর্ডের তার বর্তমান চেহারা নিয়ে ‘ইন্ডিয়ানা জোনস’ সিনেমার প্রধান চরিত্রে অভিনয় হয়তো অসম্ভব ছিল। কিন্তু ট্রেইলারে ঠিকই আগের মতোই ঝলমলে চেহারায় ধরা দিয়েছেন হ্যারিসন। আর এর পেছনে রয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির কারসাজি।

রবার্ট জেমেকিসের নতুন সিনেমা 'হেয়ার' (Here) - এ টম হ্যাংকস, রবিন রাইটসহ আরও যেসব অভিনেতাদের নিজেদের বয়সের চেয়ে তরুণ দেখানোর প্রয়োজনে—তাদের ক্ষেত্রেও এই প্রযুক্তির সুবিধা নেওয়া হয়েছে।

২০১৯ সালে 'ক্যাপ্টেন মার্ভেল' চলচ্চিত্রে স্যামুয়েল এল জ্যাকসনের বয়স প্রায় ২৫ বছর কমিয়ে আনা হয়েছিল। কারণ, দর্শকরা চান তাদের অতি পরিচিত অভিনেতাই বারবার চলচ্চিত্রে থাকুক, যাতে করে ওই আবেদন থেকে তারা বিচ্ছিন্ন না হয়ে যান।

প্রযুক্তি আরও উন্নত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই আশঙ্কাও রয়েছে যে, ডিজিটালি চেহারা এবং শরীর পাল্টে দেওয়ার সুবিধা নিয়ে এটিকে অপকর্মের হাতিয়ারও বানানো হতে পারে।

এ ধরনের একটি ছলচাতুরি ইউক্রেইন-রাশিয়া যুদ্ধে হয়েছে। একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছিল যে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট বলছেন—তারা আত্মসমর্পণ করছেন এবং সৈন্যদের অস্ত্র নামিয়ে রাখতে দেখা যায়। কিন্তু আসলে তা করা হয়েছিল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে।

কাজেই প্রশ্ন হলো, আমরা মানুষের সব কাজকে কি স্বয়ংক্রিয় করে ফেলব? নাকি আমরা এমন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তৈরি করব, যা আমাদের ছাড়িয়ে যাবে বা আমাদের চেয়েও উন্নত হবে? আমরা কি আমাদের সভ্যতার নিয়ন্ত্রণ হারানোর ঝুঁকি নেব?

এআই ঘিরে যে উত্তেজনা ও আশঙ্কা ছড়িয়েছে, তার কারণ এর সুযোগ ও ঝুঁকির বিষয়টি এখন পর্যন্ত বিবেচনা করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক্ষেত্রে শিল্প খাতে প্রযুক্তির ব্যবহার ও রূপান্তরের ইতিহাস থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে আরও সক্ষম করতে কী ধরনের পরিবর্তন আনতে হবে, কতটা ভয় পেতে হবে, যথাযথ কর্তৃপক্ষের কী করতে হবে—এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে দেখতে হবে।    

সন্দেহ নাই চতুর্থ শিল্প বিপ্লব বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পে গভীর প্রভাব ফেলবে।

একদিকে, ডিজিটাল প্রযুক্তি চলচ্চিত্র তৈরি করা সহজ এবং সস্তা করেছে। অন্যদিকে এটি চলচ্চিত্র থেকে অর্থ উপার্জন করা আরও কঠিন করে তুলেছে। দর্শকদের সামনে অনেক বিকল্প থাকায় প্রতিযোগিতা এখন অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে তীব্রতর।

বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের জন্য ভালো কিছু সুযোগ রয়েছে। সবচেয়ে বড় সুযোগগুলোর মধ্যে একটি হলো—বিশ্বব্যাপী দর্শকদের কাছে পৌঁছানোর ক্ষমতা। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের উত্থানের ফলে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নির্মাতাদের পক্ষে তাদের চলচ্চিত্র বিশ্বব্যাপী দর্শকদের কাছে বিতরণ করা সম্ভব। এর ফলে ছোট বাজেটের চলচ্চিত্রও বিশ্বব্যাপী দর্শক খুঁজে পেতে পারে, যা আগে সম্ভব ছিল না।

আরেকটি সুযোগ হলো, গল্প বলার নতুন এবং উদ্ভাবনী ফর্ম তৈরি করতে প্রযুক্তি ব্যবহার করার ক্ষমতা। এর পাশাপাশি ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি এবং অগমেন্টেড রিয়্যালিটি প্রযুক্তির ব্যবহার।

ভালো মানের ক্যামেরা এবং সম্পাদনা সফটওয়্যারে বিনিয়োগ করা এবং সেইসঙ্গে চলচ্চিত্রের প্রচারের জন্য কীভাবে সোশ্যাল মিডিয়া এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলো ব্যবহার করতে হয় তা শেখার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের নির্মাতারা নিজেদের অন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারেন। এআই প্রযুক্তি আত্মীকরণের মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলের চলচ্চিত্র নির্মাতারা খরচ কমিয়ে আরও আকর্ষণীয় কনটেন্ট তৈরি করে এখানকার হাজার বছরের সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধিতে অবদান রাখতে পারে।

তবে এখানে একটি কথা না বলেও পারছি না, যেখানে আধুনিক চলচ্চিত্র নির্মাণের অপরিহার্য হাতিয়ার গ্রিন স্ক্রিন আমাদের পাশের দেশ ভারতেও সর্বোচ্চ ব্যবহার হচ্ছে, সেখানে আমাদের চলচ্চিত্রে এখন পর্যন্ত এ প্রযুক্তি ব্যবহারই করতে শিখিনি আমরা।

ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলো ঐতিহ্যবাহী চলচ্চিত্র শিল্পের ওপর বিশাল প্রভাব ফেলেছে। চলচ্চিত্র নির্মাণ বা কনটেন্ট বিতরণ এবং বাজারের প্রকৃতিতে এসেছে বিশাল পরিবর্তন। স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতাদের ক্ষেত্রে অবশ্য এটি নিয়ে এসেছে বিশাল সুযোগ। তাদের কাজ অনেক বড় পরিসরে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। ইউটিউব এবং ভিমিওর মতো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের উত্থানের সঙ্গে, স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতারা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি দর্শকের কাছে পৌঁছাতে সক্ষম হচ্ছেন। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব চলচ্চিত্র নির্মাতাদের জন্য নতুন বিজনেস মডেল বিকাশের দিকেও ঠেলে দিয়েছে। 

মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদমের সাহায্যে চলচ্চিত্র নির্মাতারা এখন গল্পের জন্য ধারণা তৈরি, স্ক্রিপ্ট বিশ্লেষণ এবং এমনকি চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য ভার্চুয়াল চরিত্র এবং সেট তৈরি করতে পারেন। ভিজ্যুয়াল ইফেক্ট এবং পোস্ট-প্রোডাকশনের মতো কিছু প্রক্রিয়া স্বয়ংক্রিয় করে চলচ্চিত্র নির্মাতারা ব্যয়বহুল মানব শ্রম এবং সরঞ্জামের উপর তাদের নির্ভরতা কমাতে পারেন, যা নতুন নির্মাতাদের শিল্পে প্রবেশ করা এবং উদ্ভাবনী বিষয়বস্তু তৈরি করা সহজ করে তুলেছে।

এআই অনুবাদ কৌশলের সাহায্যে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নির্মাতারা অন্যান্য দেশের অংশীদারদের সঙ্গে যোগাযোগ এবং সহযোগিতার পরিধি বাড়ানোর সুযোগটি নিতে পারেন। এটি সাংস্কৃতিক সংযোগ, বিনিময় এবং সৃজনশীলতার জন্য নতুন দিগন্ত উন্মুক্ত করেছে।    

তবে এমনও উদ্বেগ রয়েছে, ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে এআই-এর উপর ক্রমবর্ধমান নির্ভরতার কারণে বিষয়বস্তুর মান, সৃজনশীলতা এবং মৌলিকত্ব হারাতে পারে। নির্মাতাদের জন্য চলচ্চিত্র শিল্পে এআই ব্যবহারের সম্ভাব্য ঝুঁকি এবং নৈতিক বিবেচনার মিথষ্ক্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ। দায়িত্বশীলভাবে ব্যবহার না করলে এটি নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। যেমন—সৃজনশীলতা এবং মৌলিকত্বের অভাব হতে পারে। ফলে চলচ্চিত্রকে মনে হতে পারে অংকের সূত্রের মতো এগোচ্ছে এবং পরিণতিও দর্শকের কাছে অনুমানযোগ্য হতে পারে। এতে অন্তর্দৃষ্টি ও আবেগের অভাব তৈরি হতে পারে।

তাই চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রক্রিয়ায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং মানব সৃজনশীলতার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ। এর অর্থ হলো, ফিল্ম প্রোডাকশনের নির্দিষ্ট কাজগুলো স্বয়ংক্রিয় করতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার করা। তবে মানব চলচ্চিত্র নির্মাতাদের লেখা এবং পরিচালনার মতো সৃজনশীল কাজগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা।  

যন্ত্র মানুষের চাকরি কেড়ে নেবে— এ আশঙ্কা শতাব্দীপ্রাচীন। এখন পর্যন্ত নতুন প্রযুক্তি নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করেছে। যন্ত্র কিছু কাজ করতে পারে। তবে সব কাজ পারে না। তাই যন্ত্র যেসব কাজ পারে না, সে ক্ষেত্রে কর্মীর চাহিদা বেড়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে কি সেই চিত্র আলাদা হবে? কিছু চাকরির ক্ষেত্র হয়তো বন্ধ হবে। তবে এখন পর্যন্ত তার কোনো চিহ্ন দেখা যায়নি। আগের অনেক প্রযুক্তি ‘অদক্ষ কাজে’র কিছু ক্ষেত্র বদলেছে। জার্মান দার্শনিক কার্ল মার্ক্সও ভাবতেন, যদি পুঁজিবাদীদের থেকে শ্রমিকেরা উৎপাদনযন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেন, তবে কষ্টকর কাজ করার বদলে মানুষ আনন্দময় পরিবেশে চিন্তাশীল কাজ করতে পারবে। সেক্ষেত্রে যন্ত্র ফ্রাঙ্কেনস্টাইন না হয়ে মানুষের আজ্ঞাবহ সহযোগী হবে।

পুরো ব্যাপারই নির্ভর করবে আদতে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিস্থিতির ওপর। সবচেয়ে আধুনিক ও অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক প্রযুক্তির উপস্থিতি সত্ত্বেও তা রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক পর্যায়ে সবসময় গ্রহণযোগ্য হয় না। একই সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে যে রোবট দিয়ে উৎপাদন বাড়ালেই হবে না, ভোক্তারা বেকার হয়ে পড়লে উৎপাদিত পণ্য ও সেবা কে কিনবে? অন্যদিকে লাখ লাখ বেকারের যে সামাজিক ও রাজনৈতিক চাপ, তা অর্থনীতি ও রাজনীতিতে বড় আঘাত হানতে পারে। 

মূল বিষয় হলো, ঝুঁকি মূল্যায়ন করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রতিশ্রুতির ভারসাম্য বজায় রাখা ও মানিয়ে নিতে প্রস্তুত থাকা। আবার আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, ১৯৯৭ সালে দাবায় বিশ্বচ্যাম্পিয়ন গ্যারি কাসপারভ সবশেষ চালে ‘ডিপ ব্লু’ নামের সুপার কম্পিউটারের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন।