গুজব ঠেকাতে কী করছে আওয়ামী লীগ?

বিপ্লব কুমার পালবিপ্লব কুমার পাল
Published : 4 Jan 2023, 03:12 PM
Updated : 4 Jan 2023, 03:12 PM

ডিজিটাল বাংলাদেশের যুগে সবার হাতে হাতে মোবাইল। ঘরে ঘরে ইন্টারনেট। শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রামে সহজেই দুনিয়ার সাথে যোগাযোগ রাখছে মানুষ। চারপাশে, কী ঘটছে, কী শুনছে সেগুলো ফেইসবুক, টুইটার, ইউটিউবসহ অন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাৎক্ষণিকভাবে পেয়ে যাচ্ছে সবাই। বাংলাদেশে যারা ইন্টারনেট ব্যবহার করে তাদের মধ্যে ৮০ শতাংশ মানুষের রয়েছে ফেইসবুক অ্যাকাউন্ট। দেশে বর্তমানে ফেইসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় পাঁচ কোটি। আর ইউটিউবের দর্শকের সংখ্যা ৩ কোটিরও বেশি।  এই সুযোগ কেউ ভালো কাজে ব্যবহার করে অর্থ উপার্জন করছেন। আবার কেউ কেউ এর ফায়দাও লুটছে। বিভিন্ন গ্রামে গড়ে ওঠেছে ‘হ্যাকার চক্র’।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে ব্যবহার করে কীভাবে রাজনৈতিক ময়দান গরম করা হচ্ছে- এ লেখার মূল আলোচনার বিষয় মূলত সেসব। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এখন গুজব আর মিথ্যাচারে ভরপুর। বিশেষ করে সরকার বা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কুৎসা ছড়ানো হয় প্রতিদিন। এসব গুজবে প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিচারপতিসহ রাষ্ট্রের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও সেলিব্রেটিদের নাম জড়ানো হচ্ছে। কোনো গুজবে সশস্ত্র বাহিনীর মতো সংবেদনশীল প্রতিষ্ঠানের নামও জড়ানো হয়েছে। মিথ্যা তথ্য দিয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার বিষয়বস্তু (কনটেন্ট) ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে।  আর তা দেখছে লক্ষ লক্ষ মানুষ। অনেকে তা বিশ্বাসও করছে। কারণ মূল ধারার গণমাধ্যম ছাড়া এসব খবরের কোনো বিশ্বাস যোগ্যতা নেই, তা অনেকের অজানা। তাছাড়া প্রত্যন্ত অঞ্চলের কোটি কোটি মানুষের পক্ষে সেসব তথ্য সত্য-মিথ্যা যাচাই করাও সম্ভব নয়। আর এই সুযোগটি নিচ্ছে একটি প্রতিক্রিয়াশীল চক্র।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিএনপি-জামায়াত কী করছে?

সম্প্রতি বিএনপির ১০ ডিসেম্বরের আন্দোলন রাজনীতির কেন্দ্রীয় আলোচনার বিষয় ছিল। রাজনীতির মাঠে বিএনপি সফল না হলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আওয়াজ তৈরি করতে পেরেছিল। বিএনপির নেতা-কর্মী ছাড়াও তাদের শুভাকাঙ্খীরা নিয়মিত কনটেন্ট প্রচার করেছে। যার বেশিরভাগ ছিল মিথ্যাচারে ভরা।

‘রাতেই প্রধানন্ত্রীর পদত্যাগ, সকালে ১৪৪ ধারা জারি’, ‘আরও ভয়ংকর হরতালের ডাক বিএনপির’, ‘উভয় সংকটে শেখ হাসিনা, যেকোনো মুহূর্তে পতন’, ‘ঢাকা ঘেরাও করেছে নূরবাহিনী’, ‘আন্দোলনে উত্তাল রাজপথ’- এমন মিথ্যা তথ্য দিয়ে সংবাদ পরিবেশন করা হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। বলা হয়, ‘রানওয়ে বিমান রেডি’, ‘২৭ জনকে নিয়ে দেশ ছেড়ে পালাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী, ‘শেখ হাসিনার নিরাপত্তায় ২৭ ব্রিগেট তৈরি করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে’, ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রীর বাসায় র‌্যাবের অভিযানে উদ্ধার করা হয়েছে কোটি কোটি টাকা’ ইত্যাদি ইত্যাদি। আর এসব গুজবের বেশিরভাগটাই ছড়ানো হয়েছে ইউটিউবে। সেখানে অন্য অভিযানের ভিডিও ব্যবহার করে ছড়ানো হয়েছে এই গুজব।

গোয়েন্দা বিভাগের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ বলছে, যারা দেশকে অস্থিতিশীল করতে চায় তারাই মূলত এমন কাজগুলো করে থাকে। তাই এসব খবর বিশ্বাস না করতে পরামর্শ দিয়েছে সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ। তারা পরামর্শ দিয়ে বলেছে- যেকোনো খবর শুনেই প্রতিক্রিয়া না দেখাতে, আগে যাচাই করতে বলেছেন ঘটনা সত্য কিনা।

এসব গুজব দেখে মনে পড়ছে হিটলারের তথ্য উপদেষ্টা গোয়েবলসের কথা। তিনি বিশ্বাস করতেন, একটা মিথ্যা ১০ বার প্রচার করলে তা সত্যে পরিণত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর দিকে এ তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে অনেক গুজব ছড়িয়েছিলেন তিনি। বিএনপি-জামায়াতের অতি উৎসাহীদের কথা শুনে মনে হয়েছে তারাও 'গোয়েবলস স্টোরি' বাস্তবায়ন করতে চেয়েছেন। যদিও মানুষকে বিভ্রান্ত করে রাজপথে নামাতে পারেনি তারা। যদি মানুষকে নামাতে পারতো তাহলে সহিংসতা করে সরকারকে বিপদে ফেলা তাদের পক্ষে সহজ হতো।

একই তত্ত্বের ওপর ভর করে বাংলাদেশে তারা সফলও হয়েছিল। ২০১৩ সালের ৩ মার্চ রাতে চাঁদে সাঈদীর চেহারা দেখা গেছে বলে গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। বিএনপি, জামায়াত ও শিবিরের সন্ত্রাসীরা পরিকল্পিতভাবে গুজব ছড়ায় যে, সরকার সাঈদীকে গোপনে ফাঁসি দিয়েছে। এরপর তাকে চাঁদে দেখা যাচ্ছে। তারা মসজিদের মাইকে এবং মোবাইল ফোনের মাধ্যমে এমন গুজব ছড়িয়ে ধর্মভীরু জনগণকে ঘর থেকে ডেকে বাইরে আনে। যা দ্রুত সারাদেশে ছড়িয়ে যায়। তাদের ফাঁদে পা দেয় অনেক নিরীহ মানুষ। বগুড়া, রাজশাহী, নাটোর, জয়পুরহাট, ঝিনাইদহ, সাতক্ষীরা ও চট্টগ্রামসহ ৩৪ জেলায় ব্যাপক সহিংসতা হয়। প্রাণ যায় ৭৮ জনের। 

একই কায়দায় এবার ফল আসেনি। তাদের এই গুজব মানুষ দেখেছে ঠিকই কিন্তু তারা রাস্তায় নেমে আসেনি। শেখ হাসিনাকে উৎখাত করে কোন অমৃতের খোঁজে মানুষ মাঠে নামবে? আগের চেয়ে জনগণ অনেক সচেতন। তবে কেউ তো ভুলের উর্ধ্বে নয়। যদি তারা গুজবের ফাঁদে আবার পা দিয়ে রাস্তায় নেমে যায় তখন কী হবে?

সব গুজবের বাইরে রাজনৈতিক কর্মসূচি দ্রুত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো। দেশের যেখানে তাদের কর্মসূচি হোক না কেন, ফেইসবুক-ইউটিউবে সরাসরি প্রচার করে। আবার সেসব কর্মসূচির গুরুত্বপূর্ণ অংশ দিয়ে আলাদা কনটেন্ট করে ছেড়ে দেওয়া হয়। এজন্য তাদের আছে একাধিক ফেইসবুক গ্রুপ, ইউটিউব চ্যানেল। অভিযোগ আছে, এসব কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি দিয়ে লোক নিয়োগ দিয়েছে বিএনপি। 

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আওয়ামী লীগ কী করছে?

আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে গুজব, অপপ্রচার ও প্রোপাগান্ডা রুখে দিতেও নিয়মিত কাজ করে আওয়ামী লীগের ওয়েব টিম। গত বছরের এপ্রিলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও অনলাইনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পরিপন্থি প্রচারণা, দেশ ও সরকারের বিরুদ্ধে গুজব এবং অপপ্রচার প্রতিরোধে সাইবার মনিটরিং টিম গঠন করে আওয়ামী লীগ। এ টিম গুজব প্রতিরোধের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়ন অগ্রগতিও প্রচারে কাজ করে। অনলাইন এই কার্যক্রম সমন্বয় করার জন্য ২২ সদস্যের মনিটরিং উপ-কমিটি গঠন করে আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক উপ-কমিটি। এই কমিটি তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত কাজ করছে। আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উপ-কমিটির উদ্যোগে দলের গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের (সিআরআই) সহযোগিতায় নেতাকর্মীদের নিয়ে কর্মশালাও করছে।

এছাড়া ১ লাখ অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টের একটি প্ল্যাটফরমও তৈরি করছে সরকারে থাকা দলটি। তাদের প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য ১০ হাজার মাস্টার ট্রেনার তৈরি করছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উপ-কমিটি। তাদের প্রধান কাজ, আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়ন ও আগামীর ভিশন সম্পর্কে জনসাধারণকে বারবার জানানো এবং দেশবিরোধী অপপ্রচার মোকাবিলা করা।

আওয়ামী লীগের বিভিন্ন উপকমিটির ওয়েবিনার ও অনলাইন কার্যক্রমের টেকনিক্যাল সাপোর্ট এবং লাইভ অনুষ্ঠানগুলো বিভিন্ন গণমাধ্যমের ফেইসবুক পেইজে সম্প্রচার এবং অনুষ্ঠান পরবর্তী সাংবাদিকদের তথ্য সরবরাহের যাবতীয় কাজ করে যাচ্ছে সিআরআই এবং আওয়ামী লীগের ওয়েব টিম।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের প্রধান টার্গেট তরুণ ভোটার। দেশের তরুণ ভোটারদের আকৃষ্ট করতে সরাসরি প্রচার কাজটি তত্ত্বাবধান করছেন প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার চালানোর জন্য বিভিন্ন কনটেন্ট আওয়ামী লীগের গবেষণা সেল ‘সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই)’- এর পক্ষ থেকে সরবরাহ করা হবে। এরই মধ্যে সেটি শুরু করেছে সিআরআই।

কিন্তু বাস্তবতা কী? সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশি প্রচার হচ্ছে সরকারের বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য দিয়ে বানানো কনটেন্ট। ১০ কিংবা ৩০ ডিসেম্বর কেন্দ্র করে গুজব নির্ভর কনটেন্ট বহু মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে। এছাড়া জাতির পিতা, রাষ্ট্রপ্রধান, মন্ত্রী, এমপিদের বিরুদ্ধে কুৎসা সহজে ঘুরছে সামাজিকে যোগাযোগ মাধ্যমে। এর বিপরীতে সত্য তথ্য নির্ভর কনটেন্ট পাওয়া খুবই কঠিন।

এছাড়া আওয়ামী লীগের ফেইসবুক পেজ কিংবা ইউটিউব খুব বেশি সক্রিয় নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুষ্ঠান থাকলে বিটিভি থেকে সম্প্রচার করা সরাসরি অনুষ্ঠান দেখানো হয়। এছাড়া কয়েকটি জেলা আওয়ামী সম্মেলন ইউটিউব চ্যানেল থেকে প্রচার করা হয়। এছাড়া সরকারের উন্নয়ন নিয়ে আওয়াম লীগে নেতা-কর্মীদের কিছু বক্তব্য প্রচার করা হয়।

মিথ্যাচার মোকাবেলা কী সম্ভব নয়?

যারা নিয়মিত খোঁজ খবর রাখেন তারা বুঝতে পারেন কীভাবে সরকাররোধী গুজবে ভরে গেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। সাইবার অপরাধ নিয়ে কাজ করা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, এসব গুজবের উৎস খুঁজতে গিয়ে দেখা যায়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গুজব ছড়ানোর লোকজন দেশের বাইরে থাকে। ফলে তাদেরকে আইনের আওতায় আনা যায় না। কিন্তু যারা দেশে বসে গুজব ছড়াচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া যায়। যিনি বললেন, ‘প্রচুর স্বর্ণালঙ্কার-ডালার নিয়ে বিমানে পালাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সাথে  ২৭ জনকে নিয়ে যাচ্ছেন। রানওয়েতে বিমান রেডি। ২৭ জনের নামের তালিকাও আছে।’ তিনি দেশে থেকেই একাজটি করেছেন। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায়না?

আমাদের রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর কোনো ভেরিফায়েড ফেইসবুক, টুইটার অ্যাকাউন্ট নেই। অনেক মন্ত্রী-এমপিদের ভেরিফায়েড ফেসবুক, টুইটার অ্যাকাউন্ট নেই। অথচ আধুনিক রাষ্ট্রে সরকার প্রধান, মন্ত্রীদের ফেসবুক, টুইটার আইডি ‘ভেরিফায়েড’অ্যাকাউন্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয়। তাদের আছে লাখ লাখ ফলোয়ার। আমাদের দেশের মন্ত্রী-এমপিদের ফেরিফায়েড অ্যাকাউন্ট সক্রিয় থাকলে সাধারণ মানুষ প্রকৃত তথ্য জানতো। পাশাপাশি আওয়ামী লীগের শুভাকাঙ্খী সেলিব্রিটিদের আরো বেশি সক্রিয় হওয়া প্রয়োজন।

এছাড়া যেসব ফেইসবুক-ইউটিউব থেকে গুজব ছড়ানো হয় সেগুলো বন্ধ করতে দ্রুত উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। এজন্য নিয়মিত ফেইসবুক কর্তৃপক্ষের সাথে বৈঠক করা জরুরি। যদিও ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে থেকে ফেইসবুক-ইউটিউবের সাথে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের বৈঠক হচ্ছে। সরকারের পাঠানো লিংকের মধ্যে এখন পর্যন্ত প্রায় শতকরা ৬০ শতাংশ লিংক ফেইসবুক-ইউটিউব বন্ধ করেছে। এই হার আরো বাড়াতে হবে। আইন অনুযায়ী অনলাইনে গুজব ছড়ালে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে ৫৭ ধারার মামলার বিধান রয়েছে। ৫৭ ধারার প্রয়োগ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও অনেকে মনে করেন, তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার বন্ধে পদক্ষেপ নেওয়াটাও জরুরি।