‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’ এই কথাও অনেকে বিশ্বাস করেন না। ধর্মীয় আচার পালন আর উৎসবকে গুলিয়ে ফেলেন অনেকে।
Published : 09 Apr 2024, 06:40 PM
দেশে এখন ছুটির বাঁশির সুর সবার প্রাণে। ঈদের ছুটি, শুক্র-শনিবারের ছুটি, বাংলা নববর্ষের ছুটি, এর সঙ্গে আগে-পরে দু-একদিন যোগ করে প্রায় দশ দিনের ছুটির আমেজ। শিক্ষার্থীরা আগেই চলে গেছেন। চাকরিজীবীরা এখন ঘরে ফিরতে শুরু করেছেন।
ঈদ আর পহেলা বৈশাখে পরিবারের সঙ্গে কাটানোর আকাঙ্ক্ষা নিয়ে সবাই ঘরে ফিরছেন। অনেক বিড়ম্বনা ও ভোগান্তির পরও মানুষ হাসিমুখে ঘরে ফেরে। আপনজনের সঙ্গে দেখা করার সুখ অনির্বচনীয়। সেই আপনজন যারা সুখে-দুঃখে, বিপদে-আপদে পাশে থাকেন। যাদের ভালোবাসায় জীবন পূর্ণ হয়। মানুষ বেঁচে থাকার মানে খুঁজে পায়। এই ঘরে ফেরা তাই শুধুই যাওয়া-আসা নয়, স্বজনদের প্রতি মানুষের এক অনন্য মানবিক সম্পর্কেরও বহির্প্রকাশ।
যদিও এই আনন্দ দীর্ঘ নয়। ছুটির দিনগুলো শেষ হলেই সখেদে মনে হবে ইস, আর কয়টা দিন যদি প্রিয়জনদের সঙ্গে এভাবে কাটানো যেত! এ কথা সবারই জানা যে চাওয়া-পাওয়া একসঙ্গে মেলানো সহজ নয়। তবু আমরা চেষ্টা করি। তবু অসম্ভবের মতোই যেন হয়ে আছে আমাদের অনেক গভীর প্রত্যাশা।
ঈদের ছুটিতে প্রিয়জনের সান্নিধ্য অত্যন্ত আনন্দের। ঈদ শুধু ধর্মীয় আচার নয়, উৎসবেরও দিন। শান্তি, সৌহার্দ্য আর আনন্দের বার্তা নিয়ে পালন করা হয় ঈদ-উৎসব।ঈদুল ফিতরে আনন্দের মাত্রাটা যেন একটু বেশি। কারণ দীর্ঘ এক মাসের ত্যাগ ও সংযম সাধনার পর ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা এই দিনটি খুব আনন্দের সঙ্গে পালন করে থাকে।
বাংলাদেশের মানুষের জন্য ঈদুল ফিতর হলো বৃহত্তম বাৎসরিক উৎসব। এর ধর্মীয় বিধানটুকু কেবল মুসলিমরা পালন করে, কিন্তু উৎসবের বাকি আনন্দটুকু জাতি-বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে প্রায় সব মানুষই সামিল হয়। দুঃখ-কষ্ট ভুলে অন্তত ঈদের দিনে যে যার সাধ্যমতো খুশিতে মেতে ওঠে। তবে এই দিনটি সবচেয়ে বেশি আনন্দের বার্তা বয়ে আনে শিশুদের জন্য। তারা ঈদের নতুন জামা-কাপড় পরে সকাল থেকে শুরু করে সারাটা দিন প্রজাপতির মতো ঘুরে বেড়ায়। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধবের বাড়ি যায়, এটা-ওটা খায়। আনন্দ-আর খুশিতে মেতে ওঠে।
আমরা যারা ভিন্ন ধর্মাবলম্বী ছিলাম, ছোটবেলায় আমরাও এই বিশেষ দিনটির জন্য অপেক্ষা করতাম। ভালো জামা-কাপড় পরে অপেক্ষা করতাম কখন ঈদের নামাজ শেষ হয়। নামাজ শেষ হওয়া মাত্র আমরাও উৎসবে সামিল হয়ে যেতাম। সবাই খুশি মনে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে কোলাকুলি করতাম। তারপর শুরু হতো বাড়ি বাড়ি গিয়ে সেমাই খাওয়ার পালা।
দুপুরে পোলাও-মাংসের জন্যও আমরা অপেক্ষা করতাম। তখন দেখেছি, আমাদের মতো ধর্মাবলম্বীদের জন্য আলাদা করে মুরগি কিংবা খাসির মাংস রান্না করা হতো। আমাদের আলাদা করে খাওয়ানো হতো। সেই খাওয়া নিয়ে আমাদের মনে কখনো কোনো সন্দেহ-সংশয় ছিল না। কেননা তখন যারা যেটা খায় না, সেটা না খাওয়ানোটাই ‘ধর্ম’ হিসেবে বিবেচিত হতো।
শুধু ঈদ নয়, ওই সময় রমজান মাসেও দলেবলে ইফতার খাওয়া ও খাওয়ানোর রীতি ছিল। কে রোজা আছে, কে নেই, কাদের কী ধর্ম, এসব বিষয় মোটেও মুখ্য ছিল না। ইফতারের সময় প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে ইফতার সামগ্রী আসত। অথবা আসত ইফতারিতে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ!
ভিন্নধর্মের এবং বে-রোজদার হওয়া সত্ত্বেও শৈশব-কৈশোরে বন্ধু ও প্রতিবেশীদের বাড়িতে ইফতারের দাওয়াতে গিয়ে ইফতার সামগ্রী সামনে নিয়ে অপেক্ষা করতাম, কখন আজান হয়। আজান হওয়ার পর প্রথমে একটু আদা-পানি খেয়ে ছোলা-মুড়ি-পেঁয়াজু-জিলেপি মাখা খেতাম। তাতে কারও ধর্ম যায়নি, কোনো সমস্যাও হয়নি।
এখন সবাই মিলে শান্তি ও সম্প্রীতির মাধ্যমে ধর্মপালনের চেয়ে ধর্মপালন নিয়ে উন্মত্ততা বেড়েছে। ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’ এই কথাও অনেকে বিশ্বাস করেন না। ধর্মীয় আচার পালন আর উৎসবকে গুলিয়ে ফেলেন অনেকে। ভিন্নধর্মীদের নিয়ে এক ধরনের তাচ্ছিল্য-উপহাসও বেড়েছে। একেবারে বড় মনের অল্প কিছু মানুষ ছাড়া বেশিরভাগ পরিবারে ভিন্ন ধর্মের মানুষ খুব একটা প্রবেশাধিকার পায় না।
যাই হোক, ছোটবেলায় দেখেছি, গ্রামে ঈদের দিন বিশেষ খেলাধুলার আয়োজন হতো, বসত মেলা। এসব অনুষ্ঠানে ছিল উপচে পড়া মানুষের সমাগম। ধনী-গরিব, জাত-ধর্ম নির্বিশেষে সবাই সেই উৎসবে যোগ দিত। যে যেখানেই চাকরি, লেখাপড়া কিংবা অন্য যে কোনো কারণেই অবস্থান করুক না কেন, ঈদে সবাই বাড়ি যেত। ঈদের দিনটা পরিণত হতো মিলনমেলায়। গল্প-আড্ডা, খাওয়া, ঘুরে বেড়ানো, সিনেমা দেখা, আর রাতে বাংলাদেশ টেলিভিশনে ঈদের বিশেষ নাটক আর আনন্দমেলা ছিল আমাদের কৈশোর ও যৌবনে সেরা আকর্ষণ।
আমাদের কৈশোরে ঘরে ঘরে টেলিভিশন ছিল না। আমরা আমাদের বড়লোক কোনো বন্ধুর বাড়িতে দল বেঁধে যেতাম টেলিভিশন দেখার জন্য। সেখানে গাদাগাদি করে বসে টেলিভিশন দেখতে হতো। আর ছিল লোডশেডিং আতঙ্ক। ঈদের বিশেষ নাটক কিংবা আনন্দমেলা চলাকালে বিদ্যুৎ থাকবে কিনা এটাই ছিল আমাদের সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তার বিষয়।
আমাদের ছোটবেলার ঈদ আনন্দের আরেকটি উপকরণ ছিল ঈদের সালামি কিংবা ঈদি সংগ্রহ করা। বড়দের সঙ্গে ছোটদের এই ভালোবাসার লেনদেন সম্পর্ককে করে তুলত আরও মধুর। ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী, বাবা-মা— কেউই এই সালামি থেকে বাদ যেত না। টাকার অঙ্কে যাই হোক, সালামি দিতে হবে, নিতে হবে। ঈদের দিন কেউ পা ছুঁয়ে সালাম করলে স্নেহ নিয়ে পাঞ্জাবির পকেট কিংবা শাড়ির আঁচল থেকে থেকে এক টাকা, দুই টাকা কিংবা পাঁচ টাকার একটা নোট বের করে দিতেন। সালামকারীর বয়স একটু বেশি হলে মাঝে মধ্যে ৫০ টাকাও মিলত। নতুন পোশাক পরে বড়দের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে ঈদের সালামি নেয়ার প্রথা চলে আসছে বহুবছর ধরে।
এখন অবশ্য সেভাবে সালাম করার প্রথা এক হিসেবে বিলুপ্তির পথে। কেউ আর এখন আগের মতো বড়দের সালাম করে না, কিন্তু সালামি ঠিকই চায়। পাশাপাশি সালামি দেওয়ার নিয়মটাও গেছে পাল্টে। এখন সালামি দেওয়া হচ্ছে মোবাইল ব্যাংকিং কিংবা মোবাইল রিচার্জের মাধ্যমে। এমনকি সালামিদাতা এবং সালামি গ্রহীতার সামনাসামনি আসারও প্রয়োজন পড়ে না।
ঈদ মানে উৎসব আর উৎসবের মর্মকথাই হলো প্রাণের মিলন, জীবনে জীবন যোগ করা। ধর্মের অর্থ যদি ধারণ করা হয়, তাহলে ছোট-বড়, ধনবান-নির্ধন সবাইকে সমভাবে গ্রহণ করে একটি সুখি ও সহযোগিতামূলক সমাজ গঠনই ছিল ধর্মের তাগিদ। প্রতি রমজানে এবং রমজানের ঈদেও এই তাগিদটি আমাদের কাছে আসে। কিন্তু উৎসব যখন প্রথা হয়ে দাঁড়ায়, তখন তার অন্তর্নিহিত মানবতাবোধ হ্রাস পায়। শ্রেণি-বৈষম্যটি বাহ্যিক কোলাকুলির আড়ালে ঢাকা পড়ে বটে, কিন্তু আড়ম্বর ও উৎসবের পার্থক্য ধনী ও গরিবের উৎসবের পার্থক্যটিও বুঝিয়ে দেয়।
ধর্মের মর্মবাণী সম্পর্কে কবি নজরুল বলেছেন, ‘ইসলাম বলে সকলের তরে মোরা সবাই, সুখ-দুঃখ সমভাগ করে নেব সকলে ভাই।’ এই মর্মবাণী কি আমাদের ধর্মবোধে এখনও টিকে আছে? আমরা কি সুখ-দুঃখ সমানভাবে ভাগ করে নেই? নিলে যে সামাজিক শক্তি তৈরি হতো তা আজ আমাদের মধ্যে কোথায়? সমাজ আজ শ্রেণিবিভক্ত। মানুষে মানুষে ধনবৈষম্যের আকার আজ পর্বতসমান। এখন পবিত্র রমজান মাসে এবং ঈদের দিনেও হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠনসহ তাবৎ সন্ত্রাসী কাজকর্মের খবর পাওয়া যায়। অর্থাৎ ধর্মের অন্তর্নিহিত মানবতার তাগিদ আজ মানুষের কাছে বিস্মৃত। সমাজ অধঃপতিত।
“প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র দীন একাকী— কিন্তু উৎসবের দিনে মানুষ বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হইয়া বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করিয়া মহৎ”— কথাগুলো রবীন্দ্রনাথের। উৎসবের সম্মিলনে আমরা অর্জন করি ‘আমরা’ হবার বোধ-উপলব্ধি! উৎসব তাই সবার জন্যই সতত সুখের এবং আনন্দের। এ এক মহৎ হবার সাধনা, বৃহৎ হওয়ার সংকল্প।
সবাইকে নিয়ে যে উৎসব তা জীবনকে নতুন তাৎপর্য দান করে। সব সংকীর্ণতা ও ভেদাভেদ ভুলে একে অপরের সঙ্গে মিলিত হওয়ার শক্তি দান করে। পরস্পরের বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী হয়ে ওঠার এক মহান উপলক্ষ হচ্ছে বিভিন্ন উৎসব, যেমন-ঈদ, পূজা, বড়দিন, প্রবারণা পূর্ণিমা। ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানকে ছাপিয়ে এসব উৎসব তাই এখন ঘোষণা করে মানুষে মানুষে মিলনের আহবান।
উৎসবের সঙ্গে শান্তির গভীর যোগসূত্র আছে। শান্তির কমতি থাকলে উৎসবের আনন্দেও ভাটা পড়ে। এই শান্তির জন্য চাই অনুকূল পরিবেশ। পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সম্মান ও সহমর্মিতা থেকে যে সামাজিক শান্তির পরিবেশ সৃষ্টি হয় তা উৎসবের আনন্দকে অনেক গুণ বাড়িয়ে দেয়।
ধর্মীয় উৎসব কিংবা অন্য যেকোনো সামাজিক সাংস্কৃতিক উৎসবের মূলে রয়েছে কল্যাণকামনা এবং শুভবোধ। এসব আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমরা উচ্চারণ করি শুভ, সত্য, সুন্দর এবং কল্যাণের মন্ত্র। ওই মন্ত্রের বলে আমরা যেন অশুভ শক্তি বিনাশের মাধ্যমে সবার হৃদয়ে মানবধর্ম এবং মানবিক মূল্যবোধের উদ্বোধন ঘটাতে পারি, আজকের দিনে আমাদের সেটাই হোক প্রার্থনা। সভ্যতার অগ্রযাত্রা সুর বা শুভ, সত্য এবং সুন্দর প্রতিষ্ঠার সাধনা ছাড়া আর কিছুই নয়।
যে ঐক্য ও শান্তি আমরা উৎসবের দিনগুলোয় দেখাতে পারি, তাকে কেন নিত্যদিনের বিষয়ে পরিণত করতে পারব না? যদি ছোট পরিসরে পারি, তো বড় পরিসরে, জাতীয় জীবনে একই আচরণ করতে না পারার তো কোনো কারণ থাকতে পারে না। ঈদ, পূজা, বড়দিন, প্রবারণা পূর্ণিমা, নববর্ষ ইত্যাদি বিভিন্ন অনুষ্ঠান আমাদের সামষ্টিক জীবনে শুভবোধ চর্চার যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে, তা সঞ্চারিত হোক সবার প্রতিদিনের জীবনযাপনে— আসুন আমরা সবাই মিলে সেই সাধনা করি।
বাঙালির জীবন উৎসবের আনন্দে মুখরিত হোক। আমরা সম্মিলিত চেষ্টায় ফিরিয়ে আনি সেই সব ঐতিহ্যবাহী উৎসব-অনুষ্ঠানের, যেগুলোর সঙ্গে আমাদের প্রাণের এবং বহুমানুষের মিলনের যোগ আছে। আসুন আমরা উদাত্ত কণ্ঠে বলি, সবাই সুখি হোক, সবার প্রাণ ভরে উঠুক সুখানুভবে। উৎসবের আনন্দ সবার জন্যই সমান হোক, উৎসব হোক সর্বজনীন, সবার।