আমাদের দেশ ও সমাজে প্রতিবাদ বিষয়টাই হারিয়ে গেছে প্রায়। অগ্রজ যারা বেঁচে আছেন, তাদের অনেকেই এখন গৃহকোণে। তাদের কোণঠাসা করে রেখেছে সমাজপতিরা। আর যারা গড্ডালিকা প্রবাহে ভাসছেন, তাদের মন মজে আছে পদ-পদকে।
Published : 26 Feb 2024, 01:56 PM
কেমন আছে আমাদের তারুণ্য? আমরা সবাই যখন সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যস্ত, আমাদের কারো হাতে সময় নেই, তখন তাদের অবস্থা কী? একটা প্রচলিত ধারণা আছে, কলাম মানে মাথাভারী সব লেখা। এ প্রক্রিয়া অনেকে ভেঙ্গে ফেলার চেষ্টা করেছেন। অনেকে এখনো চালু রেখেছেন। আমি মনে করি এমন সব বিষয়ে লেখালেখি বেশি হওয়া দরকার যা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য মঙ্গলজনক। এই যে তারুণ্য এখনও বইমেলায় ভিড় করে এটা আশার বিষয়। আমরা এই বয়সে এসে আকুল হয়ে দেখি কেমন তাদের প্রতিক্রিয়া? কী চায় তারা?
পরিস্থিতি খুব একটা সুবিধার নয়। এখনকার সমাজের ‘ক্রেইজ’ বা ‘ক্রাশ’ শব্দগুলোর ব্যবহার যেমন বোঝা দায় তেমনই বোঝা মুশকিল কে কার জন্য কী করে, কেন করে? হঠাৎ করে অসম বয়সী বিয়ের ধুম আর ওইসব নিয়ে মাতামাতি হয়ে উঠেছে নতুন বিষয়। তিশা মেয়েটি এখনও অভিজ্ঞতা আর বয়সে নবীন। সে ভুল করেছে না ভালো করেছে তা বুঝে উঠতে উঠতে খন্দকার মুশতাক কোথায় কীভাবে থাকবেন কে জানে! কিন্তু আমার কথা হচ্ছে দেশের খ্যাতনামা লেখক আমার প্রিয় গদ্যশিল্পী হুমায়ূন আহমেদও কন্যার বয়সীকে বিয়ে করেছিলেন। তখনকার মেহের আফরোজ শাওনের ছবি আর আজকের তিশার ছবির ভেতরে তফাৎ খুব কম। প্রশ্ন হচ্ছে তখন এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাত মধ্যবয়সীরা। বেশি বয়সীদের কাছে ছিল এগুলো ঘৃণার বিষয়। এখন দেখছি উল্টো।
বদলে যাওয়া সমাজের চিত্র বলছে, তরুণ-তরুণীদের একাংশ এ নিয়ে মনে মনে খুশি। আরেক অংশ দেখলাম প্রতিবাদ করছে। প্রতিবাদ করাটা খারাপ কিছু নয়। বরং আমাদের দেশ ও সমাজে প্রতিবাদ বিষয়টাই হারিয়ে গেছে প্রায়। আমাদের দেশ ও সমাজে প্রতিবাদ বিষয়টাই হারিয়ে গেছে প্রায়। অগ্রজ যারা বেঁচে আছেন, তাদের অনেকেই এখন গৃহকোণে। তাদের কোণঠাসা করে রেখেছে সমাজপতিরা। আর যারা গড্ডালিকা প্রবাহে ভাসছেন, তাদের মন মজে আছে পদ-পদকে। কীভাবে তা বাগানো যায় সে নিয়ে জীবন কাটাচ্ছে তারা। মধ্যবয়সীরা সব বাদ দিয়ে খালি জিন্দাবাদ আর স্তাবকতায় ব্যস্ত। এমন একটা অবরুদ্ধ সমাজে তরুণরা প্রতিবাদ করছে দেখে ভালো লাগার কথা। কিন্তু তা হতে পারছি কোথায়?
এইসব প্রতিবাদের শিকার যারা তাদের প্রতি আমার কোনো সমর্থন নেই। তাদের এসব অসামাজিক টাইপ কাজের বিরুদ্ধে আমি। কিন্তু প্রতিবাদটা হঠাৎ করে বইমেলায় কেন? বইমেলাটি এমনিতেই ক্রেতার সমস্যায় আছে। মানুষ যাচ্ছে বটে খবর পাই তাদের আগ্রহের তালিকায় চটপটি, কফি, ফুচকা শীর্ষে। তারপর আড্ডা। তারও আগে আছে মিট নামের দেখা, যার আবার আরেক নাম ডেটিং। তা হঠাৎ করে সব প্রতিবাদ বইমেলায় করার কারণ কি মেলার শান্তি বিনষ্ট করা? এ লেখা যখন লিখছি তার দু-চারদিন আগে হিরো আলমকে ভুয়া ভুয়া ধ্বনি দিয়ে বের করে দেওয়া হয়েছে বইমেলা থেকে। হিরো আলম তো অসম বিয়ে-শাদি করেননি। তার দায় কী বা তিনি কেন অভিযুক্ত? যদি তার কনটেন্ট বা কথাবার্তা দায়ী হয়ে থাকে তো এতদিন কোথায় ছিল এরা? নাট্যকার মামুনুর রশীদ যখন হিরো আলমকে রুচির সংকট বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন, তখন যে হাজার হাজার লেখা ও মন্তব্যে তাকে অপমান করা হলো ওই তারুণ্য কোথায়? রাতারাতি বদলে গেছে তাদের মনোভাব? আমি ওই মানুষটির সঙ্গে একমত যিনি আগ বাড়িয়ে লিখেছেন, এই অপমান মূলত একটি রিহার্সাল। হয়তো এরা পরের বছর ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের মতো কাউকে টার্গেট করলেও করতে পারে। ফলে এই প্রতিবাদ যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয়, তা বলা যাচ্ছে না।
বলছিলাম তারুণ্যের কথা। আমরা তাদের হাতে সঠিক বইপত্র তুলে দিতে পারিনি। টিভি বা অন্যসব মিডিয়ায় সিলেবাসের বইপত্র বিনা পয়সায় দেওয়ার ছবি দেখে আমরা আকুল হই। সেটা নিঃসন্দেহে শুভ প্রক্রিয়া। কিন্তু তাদের হাতে আরও অনেক বইপত্র দেওয়ার কথা ছিল আমরা পারিনি। ভয়াবহ সব বইয়ের খবর দেখি সোশ্যাল মিডিয়ায়। শিশুদের সেসব বইয়ে গ-তে গান-বাজনা ভালো না এমন কথা লেখা।
এরা বর্ণমালা পরিচয়ের নামে সুকৌশলে বিষ তুলে দিচ্ছে শিশুদের মুখে। আনন্দ ভালো না, গান ভালো না— এসব বিষয় মাথায় ঢোকানোর অপচেষ্টা নিয়ে সরকারি মহলে কোনো সাড়া আছে বলে মনে হয় না। অথচ এভাবেই আমরা হারিয়েছি প্রচুর অর্জন, যা চিরতরে ছেড়ে গেছে আমাদের।
দেখবেন ইউটিউবজুড়ে তরুণ-তরুণীদের ভয়াবহ সব সংলাপ। এদের একটা বৃহৎ অংশ ভাষা আন্দোলন জানে না। কবে কখন স্বাধীনতা দিবস জানে না। ষোল ডিসেম্বর কেন বিখ্যাত তাও জানে না। কী হবে এদের নিয়ে? টকশোতেও এগুলো বিষয় হয় না। বিষয় আওয়ামী লীগ-বিএনপি। রাজনীতিতে মৃতপ্রায় বিএনপিকে নিয়ে যে আগ্রহ তার সিকিভাগও নেই তরুণদের নিয়ে। অথচ বিদেশের মাটিতে বড় হওয়া যে প্রজন্মকে নিয়ে আমরা ভাবতাম, মনে করতাম এদের কী হবে, তারাই বরং এগিয়ে চলেছে।
সিডনিতে বড় হয়ে ওঠা প্রজন্মের এক তরুণী মুনাসিব। তাকে আমি কথা ফোটার আগে থেকেই চিনি। সে এখন পূর্ণ তারুণ্যে। হাত দিয়েছে চলচ্চিত্রের মতো গভীর বিষয়ে। সিরিয়াস ধরনের কাজ দিয়ে শুরু। ওয়েস্টার্নার নামের ছোট্ট ছবিটি তাকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করাবে জানি না। তবে এই প্রক্রিয়া এর আগেই আমি ঘরে দেখেছি। আমার একমাত্র সন্তান অর্ক এই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে গেছে। যে কথাটা বলতে চাই প্রবাসের প্রজন্মকে আমরা যেন ভুল না বুঝি। তারা দেশ ও দেশের আন্তর্জাতিক ইমেজ-সম্মান তুলে ধারার কাজে ব্যস্ত। অথচ এর ভিত্তিভূমি জন্মভূমির মাটিতে চলছে উল্টোযাত্রা। দু-দিন পর যখন ফেব্রুয়ারি শেষ হয়ে যাবে পুরনো কাপড়ের মতো জাতি ছুঁড়ে ফেলবে একুশের চেতনা। আবার নয়া উদ্যমে ইংরেজি বলা, হিন্দি গান শোনা আর বিদেশের সংস্কৃতি আরবির প্রেমে মজবে সমাজ। বলে রাখি কোনো ভাষা জানা বা শেখা কিংবা চর্চা করা অন্যায় নয়। অপরাধও নয়। কিন্তু তা শিখতে হবে, জানতে হবে। কতগুলো শব্দ জেনে তার বিকৃত প্রয়োগে বাহাদুরি নেই। সেটাই চলছে সগৌরবে। এবং ভয়টা সেখানেই।
আমি আশাবাদী মানুষ। এই ফেব্রুয়ারি মাসের অকৃত্রিম এক মহামানুষ আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। তার সঙ্গে শেষ কথোপকথনে আমি প্রশ্ন করেছিলাম, জাতির জন্য তার শেষ কথা কী? তিনি একটু থমকে বলেছিলেন, আবার তোরা বাঙালি হ। বাঙালি হবার সাধনা সত্তর বছরেও পূর্ণতা পায়নি। উল্টো এখন ভয় আর আতঙ্কে আছে জাতি। উন্নয়নের গল্প ও বাস্তবতার সঙ্গে এগুলো মানায় কিনা তা ভেবে দেখার অনুরোধ কি আদৌ তাদের কানে পৌঁছাবে, গদি যাদের?