নারী দিবস ও গুম হয়ে যাওয়া নারী আন্দোলন

দু-চারটে সফলতার গল্প বাদে গ্রামে-গঞ্জের লাখ লাখ নারী কী পেল? কয়জন ন্যায্য মজুরি পায়? পুরুষতান্ত্রিক কটাক্ষ ও লোলুপতামুক্ত হয়ে কয়জন সম্মান-মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে পারে? এসব কথা নারী দিবসে বলা হয় না কেন?

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 7 March 2023, 06:42 PM
Updated : 7 March 2023, 06:42 PM

নারী দিবসের আগে রাজধানীতে সাজ সাজ রব পড়ে যায়। স্লোগান, পোস্টার, ফ্যাশন হাউস ও মাল্টিন্যাশনালের ছাড়ের ছড়াছড়ি। রেডিও-টিভিতে বিজ্ঞাপনের বাহার। নারী তুমি প্রেরণা। নারী তুমি অজেয়। নারী তুমি সেরা। নারী দিবসের আগেই নারী নারী আহামরি! নারীর অবস্থানকে আলোকিত করতে অজস্র কর্মশালা, অভিযান, চায়ের আড্ডায় তর্ক। খুব পেরেছি আমরা! নারীরা সমাজে বড় জায়গায় পৌঁছেছে। নারী বৈজ্ঞানিক। নারী পাইলট। এমনকি নারী ট্যাক্সিচালক। বাহ!

কিন্তু দু-চারটে সফলতার গল্প বাদে গ্রামে-গঞ্জের লাখ লাখ নারী কী পেল? কয়জন ন্যায্য মজুরি পায়? পুরুষতান্ত্রিক কটাক্ষ ও লোলুপতামুক্ত হয়ে কয়জন সম্মান-মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে পারে? এসব কথা নারী দিবসে বলা হয় না কেন? কেন চিৎকার করে বলা হয় না, একদিনের সম্মান নয়, মানুষ হিসেবে নারীকে প্রতিদিন সমান সম্মান ও মর্যাদা দেওয়া হোক! সব নারী যেন মানবিক অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে, বিকশিত হতে পারে, তার ব্যবস্থা করা হোক! না, তা বলা হয় না। এখন সাফল্য উদযাপনের দিন। এক লাখে একজন সফল হলে তাকে মাথায় তুলে নাচার দিন। বাকিরা গোল্লায় গেলেও তাতে কারও কিছু যায় আসে না!

সময়টাই কেমন বদলে গেছে। একসময় রাজপথে মিছিল-সমাবেশ করে দাবি আদায় করা হতো। একটি বিশেষ দাবি নিয়ে রাজপথে হাতে হাত ধরে দাঁড়ানো হতো। সমবেত চিৎকারে উচ্চারিত হতো অধিকারের কথা, এগিয়ে যাবার কর্মসূচির কথা। সেই দাবি মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচার করা হতো। এই সব দাবি-দাওয়ার প্রতি অন্যদের একাত্মতার প্রকাশ ঘটত। আর যারা আন্দোলনে শামিল হতেন, তাদের প্রতি অন্যদের শ্রদ্ধা ঝরে পড়ত।

কিন্তু আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে দাবি আদায়ের সেই কাল কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছে। এ নিয়ে অনেকেরই আফসোসের শেষ নেই। এই যে হারিয়ে যাওয়ার আফসোস, এ কেবল হাতে-হাত রেখে লড়াইয়ের আশা-আশ্বাস খোয়ানোর দুঃখ নয়। নারীদের সংকটের মূল চেহারা যে রাজনৈতিক, সেই অতি কষ্টে লাভ করা উপলব্ধিটা যেন হারিয়ে গিয়েছে। যে পরিবর্তনটা নারীরা চায় তা কেবল ‘উন্নয়ন’ নামক সর্বসংকটনাশক বটিকা নয়, তা ক্ষমতার ভারসাম্যে বদল, সে বোধটাও ফিকে হয়ে এসেছে। এখন আমাদের ভাবখানা এমন, যেন দাতারা আরেকটু টাকা দিলে, সরকার ও প্রশাসন আরেকটু সক্রিয় হলে, বাপ-শ্বশুর আর একটু ‘সচেতন’ হলে মেয়েদের শিক্ষা, রোজগার, উত্তরাধিকার– সব নিশ্চিত। ফলে মার্চের নারী দিবস থেকে ডিসেম্বরের নির্যাতনবিরোধী পক্ষ, সবটাই ‘সেলিব্রেশন’ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বর্তমানের নারী আন্দোলন যেন: অনুদান-সংস্থার থেকে টাকা নাও, পোস্টার-ব্রোশিয়ার ছাপো, সেমিনার-ওয়ার্কশপ করো, হিসেব পাঠাও। বেশ একটা পেশাদারি ব্যাপার। পথ ছেড়ে নারী আন্দোলন গ্যারেজ নিয়েছে এনজিওর দফতরে।

আশি-নব্বইয়ের দশকে নারী অধিকারকে মূলস্রোতে আনার জন্য লড়াই করছিলেন যে নারীরা, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সহায়তায় তাদের আনন্দ পাওয়ারই কথা ছিল। কিন্তু ভয় দেখা দিয়েছে– এই টাকা কি মেয়েদের সক্ষমতার জন্য, নাকি নারী আন্দোলনকে পোষ মানানোর জন্য? আমরা দেখছি, আর্থিক অনুদান পাওয়ার জন্য ‘জেন্ডার মেলা’ বসে গেল, ‘পুরুষতন্ত্র’ শব্দটাই যেন সরে যেতে লাগল নারীবাদ থেকে। নারীবাদকে রাজনীতির বৃহত্তর ক্ষেত্র থেকে সরিয়ে আনার চেষ্টার অংশ হিসেবে রাষ্ট্রও এনজিও স্টাইলে মেলা-র‌্যালী-শোভাযাত্রার মোড়কে নারীর ‘ক্ষমতায়ন’ ঘটাতে কোমর বেঁধে লাগল, তখন নারীরা নিজেদের মৌলিক অধিকার, জল, জমির ওপর অধিকার হারাতে লাগল।

মেয়েদের জমির অধিকার, সম্পত্তির অধিকারের বিষয়গুলো থেকে সরে আসা নারী আন্দোলনের জীবনীশক্তি হারিয়ে যাওয়ার একটা মস্ত কারণ। যদিও মেয়েদের ভূসম্পত্তি বা বসতবাড়িতে অধিকার না থাকা তাদের ওপর নির্যাতনের একটা বড় কারণ, তবু নারী আন্দোলন জমি-বাড়ির অধিকারের ইস্যু থেকে সরে গিয়ে নির্যাতনের ইস্যুকেই গুরুত্ব দিয়েছে। তবে কি পাশ্চাত্যের নারীবাদ আমাদের বেশি প্রভাবিত করেছে, আমাদের নিজস্ব চাহিদা ও রাজনীতির চাইতে?

রাজনীতির ক্ষেত্রে নারীবাদকে যুক্ত করার ধারা তৈরি হয়েছিল বামপন্থীদের সঙ্গে। মেয়েরা পুরুষতন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ করার তত্ত্বগত উপকরণ বামপন্থীদের থেকে গ্রহণ করেছিল। কিন্তু বামপন্থী দলগুলো শ্রেণিসংগ্রামের সঙ্গে নারীসংগ্রামকে স্বীকৃতি দিতে রাজি ছিল না (আর এখন তো বাম রাজনীতিই অস্তিত্বহীন)!

রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নারী শাখা গঠনের একটা প্রবণতা লক্ষ করা গেলেও শেষপর্যন্ত তা হয়ে ওঠে আলঙ্কারিক। তৃণমূল স্তরে মেয়েদের সঙ্গে কাজ করে পাওয়া অভিজ্ঞতা, নিচ থেকে উঠে-আসা বিতর্ক, এগুলোকে দলের সাংগঠনিক স্তরে আনা যায়নি। মেয়েরা সন্তর্পণে কাজ চালিয়ে গেলেন বটে, মূলধারায় সুবিধা করে উঠতে পারলেন না। দলের মধ্যে গণতন্ত্র তৈরির কাজটা সহজ হয়নি সে দিন। আজও সহজ নয়।

নারী আন্দোলন থেকে রাজনীতি ধীরে ধীরে সরে গেল। সেই রাজনীতি কী করে সরে গেল কিংবা নারীবাদই সরে এল রাজনীতি থেকে, সে বিষয়ে যথাযথ বিশ্লেষণ ও গবেষণা হয়নি। অথচ এটি খুব জরুরি।

আমাদের নারী আন্দোলন নারীবাদ প্রভাবিত নয়। নারীবাদীদের মুখ থেকেও যেমন মেয়েদের কথা খুব একটা উঠে আসেনি, অন্যদের মুখ থেকেও তা তেমনভাবে উঠে আসেনি।

কিন্তু আশির দশকের নারীবাদীরা তো বলেছিলেন, ‘নারীবাদী অবস্থান’ বলে আলাদা কিছু নেই। যেকোনো আন্দোলনই নারীবাদের, যদি তা হয় মর্যাদার লড়াই, সমানাধিকারের লড়াই। আজ কী করে নারীবাদের হাঁড়ি আলাদা হয়ে গেল তথ্যের অধিকার আন্দোলন, খাদ্যের অধিকার আন্দোলন কিংবা দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন থেকে? তবে কি যেকোনো আন্দোলনের মতোই নারী আন্দোলনেও নেতারা বড় হয়ে উঠলেন নীতির চাইতে? এটা আমার লড়াই, ওটা তোমার, এমন করে জমিদারি ভাগ হতে হতে শেষে পায়ের তলার মাটিটুকু সরে গেল নারী আন্দোলনের?

স্বাধীন দেশে একবিংশ শতাব্দীতে নারীরা পরাধীন নিজের বাড়িতে। দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ। নিজের অধিকার সে জানে না। আজও গ্রামগঞ্জ অন্ধকারাচ্ছন্ন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর গ্রামে জ্ঞানের আলো জ্বালাতে তৈরি করেছিলেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। নারী শিক্ষা এবং সার্বিক শিক্ষা। প্রাণপাত করে ছাত্রছাত্রী সংগ্রহ করেছেন। স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন। শিক্ষক তৈরি করেছেন। পাঠ্যক্রম নিজের হাতে তৈরি করছেন, যাতে নৈতিক শিক্ষা দেওয়া যায়। তা সত্ত্বেও মেয়েরা অন্ধকারে। আজও শিক্ষা, সচেতনতা, অধিকারবোধ নেই। নিজের পায়ে দাঁড়াতে গেলে যতটুকু শিক্ষার প্রয়োজন, সেটারও অভাব।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সে কাজ যতটুকু করেছিলেন, তার বিনিমিয়ে কিছু শিক্ষিত নারীর মুখের ভাষা ফুটেছে। স্বাধীনভাবে তারা জীবিকা অর্জন করছেন। কিন্তু আজও বাংলার গ্রামের অগণিত মেয়ে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত, নিজের অধিকার রক্ষা করতে অপারগ। তাদের শিক্ষা ও সক্ষমতার জন্য কী করা হচ্ছে? সেই দাবিও আজ উচ্চারিত হয় না।

শুধু নারী আন্দোলনেই নয়, আমাদের আচরণে ধ্যান-ধারণাতেও স্থান গেড়েছে নিখাদ ভণ্ডামি। কি পুরুষ, কি নারী–সবার মধ্যেই। সংসার, সমাজে সেই মেয়েই বেশি প্রশংসিত হন, যিনি নিজের ইচ্ছা, অনিচ্ছা, অধিকারবোধ সব বিসর্জন দিয়ে অন্যদের সুবিধা দেখেন, তাদের পরিচর্যা করেন। নারীর অবমাননা ও হেনস্থা শুরু হয় জন্মলগ্ন থেকে, একাধিক কন্যাসন্তান থাকা সত্ত্বেও নারী আবার গর্ভধারণ করেন পুত্রসন্তানের তাগিদে। তবে, সবসময় যে স্বামী বা শ্বশুরবাড়ির চাপে নারী গর্ভধারণ করেন, তা ঠিক নয়। অনেক সময় পুরুষতান্ত্রিক ধ্যানধারণা দ্বারা চালিত মেয়েরা নিজেরাই পুত্রসন্তানের আকাঙ্ক্ষায় বার বার গর্ভবতী হন স্ব-ইচ্ছায়। তাই তো প্রায়ই সদ্যোজাত কন্যাসন্তানের স্থান হয় ঝোপে, নালা, নর্দমাতে। সন্তান না হলে পুত্রবধূকে ‘বাঁজা’ উপাধিতে আখ্যায়িত করেন শাশুড়ি-ননদ। একবারও ভাবেন না নিজের বাড়ির ছেলেটিরও খামতি থাকতে পারে। আর কোনো পুরুষ যদি তার স্ত্রীর সুখ-সুবিধা দেখতে যান, সমাজ তাকে ‘বৌ পাগলা’ বলে হাসির খোরাক করে। নববিবাহিত মেয়ে-জামাই ঘুরতে গেলে, তাদের জুটি দারুণ আর ছেলে-পুত্রবধূ গেলে বেহায়া! আমরা পরের বাড়ির মেয়ে ধর্ষিত হলে মাথা ঘামাই না, শুধু চাই নিজের বাড়ির মেয়েরা সুরক্ষিত থাক।

মোদ্দা কথা, নারী মানেই নিজের স্বার্থ না দেখে সবসময় পরের জন্য জীবনধারণ করা। এমনকি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাসে যে নারী যত নিজের সত্তা বিসর্জন দিয়ে পরিবারের, পুরুষের প্রতি মমত্ব দেখিয়েছেন, তিনি ততই মহান হয়েছেন। যে মেয়ে নিজে শ্বশুরবাড়িতে নির্যাতিত, তিনিও কিন্তু বাপের বাড়িতে ভোল পাল্টে ভ্রাতৃবধূকে অসম্মান করেন। ভাবেন না, নিজে নির্যাতিত হচ্ছেন, আর কাউকে তিনি নির্যাতনের শিকার হতে দেবেন না। নারীরা যতদিন এমন পুরুষতান্ত্রিক ধ্যানধারণা দ্বারা চালিত হবেন, এই দ্বিচারিতা যত দিন না দূর হবে, তত দিন নারীর অধিকার ড্রইংরুমের গল্পগুজবের চেয়ে বেশি এগোবে না।

আন্তর্জাতিক নারী দিবসে এই প্রশ্নগুলোই আজ মাথায় ঘুরে-ফিরে আসছে।