নিবন্ধন হারানো জামায়াতকে সমাবেশ করতে দিয়ে সরকার দেশ-বিদেশে এই বার্তা দিতে চাইছে যে, সরকার দেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে অবাধে সভা-সমাবেশ করতে দিচ্ছে। এখানে সরকারের অহেতুক কোনো হস্তক্ষেপ নেই।
Published : 12 Jun 2023, 05:28 PM
হঠাৎ করে রাজনীতিতে আবার জামায়াতে ইসলামী আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। প্রায় এক যুগ পর সরকারি অনুমতি নিয়ে গত ১০ জুন ঢাকায় প্রকাশ্যে সমাবেশ করেছে জামায়াত। এই সমাবেশ থেকে পুরনো ধারার রাজনীতির পক্ষেই কথা বলেছেন জামায়াত নেতারা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন, বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন এবং মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত আসামি দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীসহ আটক জামায়াত নেতাদের মুক্তি দাবি করে গরম বক্তৃতা করে জামায়াত কী এই বার্তা দিল যে তারা আগের মতোই আছে? আবার সমাবেশ করার হঠাৎ অনুমতি দিয়ে সরকার কী নিজেদের দুর্বলতাই প্রকাশ করলো না? নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন বাতিল হলেও দেশের রাজনীতিতে জামায়াত নিষ্ক্রিয় নেই।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষভাবে বিরোধিতা করেও জামায়াত যে রাজনীতিতে এখনো প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি—এটা কম বিস্ময়কর নয়। মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরু হওয়ার পর ২০১২ সাল থেকে জামায়াতে ইসলামী রাজনৈতিকভাবে কার্যত কোণঠাসা অবস্থায় থাকলেও এই দলটি নিয়ে মাঝেমধ্যেই রাজনীতির সদর-অন্দরে কথা বন্ধ হয়নি। নিবন্ধন বাতিল হয়ে যাওয়ার পর কোনো নির্বাচনে দলীয়ভাবে অংশ নিতে না পারলেও বেনামে নির্বাচনে অংশ নেওয়া থেকে বিরত নেই।
গত এক যুগ ধরে বিভিন্ন সময় আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী ও সিনিয়র নেতারা দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীকে সন্ত্রাসী সংগঠন আখ্যায়িত করে নিষিদ্ধ করার দাবি করেছেন। এমন কথাও বলেছিলেন, জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করা শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র। কিন্তু সেই জামায়াত দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে হঠাৎ প্রাকাশ্যে সরব হয়েছে। প্রশ্ন উঠছে, দলটিকে হঠাৎ প্রকাশ্যে সমাবেশ করতে প্রশাসনের অনুমতি দেয়ার নেপথ্যে কী?
মনে করা হচ্ছে, যেহেতু বাংলাদেশের সংবিধানে নিবন্ধন না থাকলেও সভা-সমাবেশ করার স্বাধীনতা রয়েছে, সেহেতু নিবন্ধন হারানো জামায়াতকে সমাবেশ করতে দিয়ে সরকার দেশ-বিদেশে এই বার্তা দিতে চাইছে যে, সরকার দেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে অবাধে সভা-সমাবেশ করতে দিচ্ছে। এখানে সরকারের অহেতুক কোনো হস্তক্ষেপ নেই।
আবার চলতি বছরের শেষে অথবা আগামী বছরের প্রথম দিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে জামায়াতকে প্রকাশ্যে সমাবেশ করতে দেয়া সরকারের একটি কৌশলের অংশও হতে পারে। এমন কথাও শোনা যাচ্ছে, নির্বাচন সামনে রেখে ক্ষমতাসীন মহলের সঙ্গে জামায়াতের একটা সমঝোতা হয়েছে, বিএনপি নির্বাচনে না গেলে জামায়াতকে নির্বাচনে এনে দিয়ে শূন্যস্থান পূরণ করা যায়। একাধিক নামে নিবন্ধন পাওয়া জামায়াতের বিভিন্ন সংগঠন ভোটের মাঠে লড়তে পারবে। আর তাহলে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখানো সম্ভব হবে। বিষয়টি নিয়ে সপ্তাহখানেক আগে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের এক সমাবেশে বলেছেন, রাজনীতির মাঠে কথা আছে, আওয়ামী লীগ জামায়াতকে বিভিন্ন নামে কিছু সিট দেবে। আমাদেরও কিছু সিট দেবে। জি এম কাদের নিশ্চয়ই অসত্য তথ্য দেননি। সেজন্য রাজপথের বিরোধী দল বিএনপিকে চাপে রাখতে সরকারের একটি ভিন্ন কৌশলও হতে পারে।
জামায়াতের অতীত কর্মকাণ্ডের কারণে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের অনেক দেশই নেতিবাচকভাবে মূল্যায়ন করে থাকে দলটিকে। এছাড়া জামায়াতকে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে যেখানে সরকার গত ১২ বছর যাবৎ প্রকাশ্যে বলে আসছে, সেখানে তাদের প্রকাশ্যে সমাবেশের অনুমতি দিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ বন্ধুদেশগুলোকে এটাও বার্তা দেয়ার চেষ্টা করা হতে পারে—বিএনপির সঙ্গে উপরে জামায়াতের সম্পর্ক ছিন্ন হলেও ভেতরে ভেতরে একই পথে চলছে চিরবন্ধু দল দুটি। কারণ জামায়াতের দাবি আর বিএনপির দাবির মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। অভিন্ন দাবিতে আন্দোলন করছে তারা। আর জামায়াতকে মাঠে নামতে আসকারা দিচ্ছে খোদ বিএনপি। ফলে আন্তর্জাতিক বিশ্ব বিষয়টি অন্যভাবে মূল্যায়ন করতে পারে।
জামায়াতকে সরকার এমন এক সময়ে সমাবেশ করার অনুমতি দিয়েছে, যখন রাজনীতির মাঠ কিছুটা উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশে আগামী সংসদ নির্বাচন যাতে ‘অবাধ ও সুষ্ঠু’ হয় সে লক্ষ্যে অল্প কিছুদিন আগেই নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। সেই ভিসানীতির মূল কথা, যেসব কর্মকাণ্ড গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বানচালের আওতায় পড়বে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে—শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ করার অধিকার প্রয়োগ করা থেকে মানুষকে বঞ্চিত করা। কারো কারো মতে, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি জামায়াতে ইসলামীর জন্য নতুন ‘অপরচুনিটি’ বা সুযোগ তৈরি করেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জামায়াতের এক নেতাকে উদ্ধৃত করে গণমাধ্যমে খবর বের হয়েছে, গত ১০ বছর কিংবা তারও বেশি সময় ধরে দলটি একটি অনুকূল পরিবেশের জন্য অপেক্ষা করছিল। অবশ্যই মার্কিন ভিসানীতি তাদের কিছুটা হলেও উৎসাহিত করেছে।
অন্যদিকে সরকারের দিকের ভাবনা সম্ভবত এই যে—বিএনপির বি টিম হিসেবে মাঠে রয়েছে জামায়াত। এক্ষেত্রে জামায়াতকে আলাদা করা হলে একদিকে বিএনপির শক্তি কমে যাবে, অন্যদিকে একাধিক নামে নিবন্ধন পাওয়া জামায়াতের বিভিন্ন সংগঠনগুলো ভোটের মাঠে লড়তে পারবে। তখন অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখানো সম্ভব হবে। এছাড়া জামায়াতের নিবন্ধন নিয়ে আদালতের বিষয়টি এখনো ফয়সালা হয়নি। পরিস্থিতি তেমন হলে জামায়াতের বিষয়টি ফয়সালাও হতে পারে। দশ বছর পর কেন প্রকাশ্যে জামায়াতকে সমাবেশের অনুমতি দেয়া হয়েছে—এ নিয়ে প্রকাশ্যে কিছু না বললেও জামায়াতের সঙ্গে কখনোই ক্ষমতাসীনদের সখ্য হবে না, এ বিষয়ে স্পষ্ট জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের নেতারা।
দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেছেন, সন্ত্রাসী এই সংগঠনকে রাজনৈতিকভাবে মূলোৎপাটন করা প্রয়োজন। কেন তাদের অনুমতি দেয়া হলো—এ বিষয়টি আমার জানা নেই, তাই মন্তব্য করতে পারছি না। তবে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী এই সংগঠনের বিচার দাবি করি সব সময়।
যুদ্ধাপরাধসহ নানা কারণে কোণঠাসা হয়ে পড়া জামায়াত প্রায় এক যুগ প্রকাশ্যে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের সুযোগ পায়নি। একই সময়ে ঢাকার মগবাজারে অবস্থিত দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ জেলা কিংবা উপজেলা পর্যায়ের অফিসগুলোও বন্ধ রয়েছে। এসময়ে রাজনৈতিকভাবে তাদের প্রকাশ্যে তেমন কোনো কর্মসূচিও ছিল না। তবে যখনই সুযোগ পেয়েছে তখনই দলের কর্মীরা ঝটিকা মিটিং-মিছিল করেছে। ঘরোয়াভাবে জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীরা মিটিং করেছে। আবার এমন কিছু মিটিং থেকে জামায়াতের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারের ঘটনাও ঘটেছে।
এরমধ্যে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বিচার শেষে দলটির সিনিয়র কয়েকজন নেতার মৃত্যুদণ্ডও কার্যকর করা হয়। ওই সময় আন্দোলনের নামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর প্রকাশ্যে আক্রমণ, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে হামলা ও অগ্নিসন্ত্রাসসহ নানা কারণে দেশে-বিদেশে রাজনৈতিকভাবে একেবারে কোণঠাসা হয়ে পড়ে দলটি।
১০ জুনের সমাবেশে মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসির দণ্ড কার্যকর হওয়া জামায়াত নেতাদের ‘শহীদ’ বলে আখ্যায়িত করেছে জামায়াতে ইসলামী। একই সঙ্গে আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মুক্তিও দাবি করেছে অনিবন্ধিত এই রাজনৈতিক দলটি। রাজধানীর রমনায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনের সমাবেশে জামায়াত-শিবিরের নেতারা রীতিমতো দম্ভোক্তি ও মিথ্যাচার করেছেন। জামায়াত নেতাদের বক্তব্য থেকেই এটা স্পষ্ট যে, কয়লার ময়লা ধুলে যায় না। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্ব গতিরোধ, আমির ডা. শফিকুর রহমানসহ জাতীয় নেতা ও ওলামায়ে কেরামের মুক্তি এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দাবিতে অনুষ্ঠিত সমাবেশে দলটির নেতারা বলেন, ষড়যন্ত্র করে ভুয়া অভিযোগের মাধ্যমে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে সাজা দিয়ে কারাগারে আটকে রেখেছে সরকার। খুব বেশি দিন বাকি নেই, আপনাদের এই ষড়যন্ত্র থাকবে না। সমাবেশে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতাদের শহীদ উল্লেখ করে তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করা হয়। পাশাপাশি ফাঁসি কার্যকর হওয়া নেতাদের জামায়াতের অলঙ্কার ও উজ্জ্বল নক্ষত্র দাবি করে এই প্রজন্মের শিবির নেতারা নিজেদের যুদ্ধাপরাধীদের উত্তরসূরি হিসেবে গর্ববোধ করার কথা জানান।
জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক তৎপরতার প্রশংসা করে ও সরকারের সমালোচনায় মুখর হয়ে এক জামায়াত নেতা বলেছেন, ‘যে সরকার জামায়াতকে সন্ত্রাসী ও নিষিদ্ধ দল বলেছে, সেই তারাই আজ আমাদের সমাবেশের অনুমতি দিয়েছে। এখন তারাই প্রমাণ করেছে, জামায়াত কোনো সন্ত্রাসী সংগঠন নয়। জামায়াত একটি সুশৃঙ্খল দল। এখন আপনাদের মুখ কোথায় যাবে? আপনারাই প্রতারক হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করেছেন। আমাদের মুখ খুলেছে, আর বন্ধ হবে না।’
সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলেছেন, ‘অবশেষে জালিম সরকারের শুভ বুদ্ধির উদয় হয়েছে। আমাদের সমাবেশের অনুমতি দিয়েছে। আওয়ামী লীগ একটি কালো সাপ। তাদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করতে হবে। এদের কাছে কখনো গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিরাপদ নয়। জনমতকে উপেক্ষা করে পৃথিবীর কোনো স্বৈরশাসক ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেনি। আপনারাও পারবেন না। আলেম-ওলামাদের গ্রেপ্তার করে জনমতের রোষ থেকে নিজেদের পতন ঠেকাতে পারবেন না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির বিষয়টি পুনর্ব্যক্ত করে তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলবে। আগামী নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই হবে।’
জামায়াতকে সমাবেশের অনুমতি দেওয়ার পক্ষেবিপক্ষে প্রচারণা আছে। তবে যে উদ্দেশ্যেই এই অনুমতি দেওয়া হোক না কেন, সরকারের এই কৌশল মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসী সব মহলের কাছেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। জামায়াতের সঙ্গে সমঝোতা করে চলার নীতি কোনোভাবেই গণতন্ত্র ও প্রগতির ধারার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তবে জামায়াতের সমাবেশের অনুমতি দেওয়া প্রসঙ্গে সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী বলেছেন, আওয়ামী লীগের নীতি বদলায়নি। অপেক্ষা করুন, দেখবেন। দেশের মানুষ জামায়াত ইস্যুতে বহু বছর ধরে অপেক্ষায় আছে, সুখবর কিছু পায়নি। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ‘বিচার করে দোষী সাব্যস্ত না করা পর্যন্ত আমি বলতে পারবো না যে জামায়াত দোষী।’
প্রশ্ন হলো, এই বিচারের জন্যই বা আর কত বছর অপেক্ষা করতে হবে?