বিএনপি কেন আন্দোলন করে না– দ্বিতীয় পর্ব

সাধারণ জনগণ তো দূরের কথা, পূর্বের অভিজ্ঞতা থেকে তাদের মাঠ পর্যায়ের অনেক নেতাকর্মীই বিশ্বাস করে না যে, ক্ষমতায় যেতে পারলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেবে বিএনপি।

সাঈদ ইফতেখার আহমেদসাঈদ ইফতেখার আহমেদ
Published : 20 May 2023, 04:00 PM
Updated : 20 May 2023, 04:00 PM

খালেদা জিয়া গ্রেপ্তারের পর থেকেই ব্যাপক জনসমর্থন থাকা সত্ত্বেও বিএনপি নেতৃত্বের আন্দোলন বিমুখতা কেন? কেনইবা দলটি কর্মীদের বাইরে তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল যে বড় সমর্থক গোষ্ঠী রয়েছে তাদের কাউকে দলীয় কর্মসূচিতে যুক্ত করতে পারছে না?

এই যে ব্যাপক সমর্থকগোষ্ঠীকে বিএনপি তাদের কর্মসূচিতে যুক্ত করতে পারছে না, এ নিয়ে বিএনপি নেতৃত্ব কী ভাবছেন? অবশ্য অবস্থাদৃষ্টে অনেকের কাছে এটাই মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, বিষয়গুলি নিয়ে বিএনপি নেতৃত্বের মাঝে চিন্তাভাবনা করবার চেয়ে যেভাবে চলছে চলুক, এরকম একটা মনোভাবই যেন বিদ্যমান।

দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা গতানুগতিক রাজনীতি যে দলের কোনো কাজে লাগছে না বরং দলের অবস্থান যে জাতীয় পর্যায়ে ক্রমশ দুর্বল হচ্ছে—এ বিষয়টা নেতৃত্বের অনেকে যেন উপলব্ধি করতে পারছেন না।

গত শতাব্দীর আশি বা নব্বই দশক অথবা ৯/১১ পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক এবং আঞ্চলিক রাজনীতির যে ধারা, তার একটা পরিবর্তন এসেছে। বিষয়টা বিবেচনায় নিয়ে, জাতীয় পর্যায়ে কীভাবে বিএনপির রাজনীতিকে এগিয়ে নেওয়া যাবে, সেটা বিএনপি নেতাদের অনেকে ব্যক্তিগতভাবে বুঝলেও, তাদের রাজনৈতিক অবস্থানের ওপর দাঁড়িয়ে, বর্তমান পরিস্থিতিতে কর্মী/সমর্থকদের নিয়ে কীভাবে দলকে এগিয়ে নেওয়া যাবে, সে বিষয়টি বিএনপির নেতারা হয় বুঝতে পারছেন না অথবা বুঝলেও কিছু করতে পারছেন না। আর এই কিছু না করতে পারবার কারণে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিএনপি এখন অনেকটাই বন্ধুহারা।

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের ভারত-সোভিয়েত ধারার বাইরে গিয়ে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি চীন-মার্কিন ধারায় নিয়ে যান। এর সূত্র ধরে গণচীনের সাথে বিএনপির সখ্যতা গড়ে ওঠে। কিন্তু তাইওয়ানের মতো স্পর্শকাতর বিষয়কে ঘিরে বিএনপির সাথে চীনের সম্পর্ক যে তলানিতে পৌছায় সেখান থেকে আর সম্পর্কের উত্তরণ ঘটেনি। গণচীন এখন বাংলাদেশকে ঘিরে যে মার্কিন প্রভাব, তাকে স্তিমিত (neutralize) করবার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগকে অধিক গ্রহণযোগ্য মনে করছে।

র‍্যাবের কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞাকে বিএনপি তাদের প্রতি মার্কিন আশির্বাদ রয়েছে বলে মনে করতে থাকে। তবে, এ মনে করবার পেছনে যে সমস্যা তৈরি হয়েছে সেটি হলো শীতল যুদ্ধোত্তর বর্তমান সময়ে দক্ষিণ এশিয়ায় চীনকে ঠেকাবার কৌশল হিসাবে পরিচালিত মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি—এটি এখন আগাগোড়াই ভারত ঘেঁষা। পাকিস্তানের চীনপন্থী নীতি এবং আরও নানাবিধ কারণে পাকিস্তানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের অতীতের সখ্যতা এখন তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে।

যুক্তরাষ্ট্র চায় বাংলাদেশ চীনের বলয়ে না থেকে ভারতমুখী হোক। এছাড়া ঐতিহাসিকভাবেই রিপাবলিকানদের চেয়ে ডেমোক্র্যাটদের অধিক ভারতঘেঁষা মনে করা হয়। কিন্তু এখানে বিএনপির ভারত বিরোধীতার রাজনীতি অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক কারণের চেয়েও সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতি থেকে ভারত বিরোধীতা—এ ধারার অনুসারীদের একটা বড় অংশ হচ্ছে বিএনপির সমর্থক।

বিএনপি নেতৃত্ব ভয় পাচ্ছেন, ভারত বিরোধীতার রাজনীতির যে ধারাবাহিকতা, সেখান থেকে যদি সরে আসতে হয়, সেটি তাদের সমর্থনের ভিত্তিকে ধাক্কা দেবে কিনা। বস্তুত এ কারণেই বিএনপি সমর্থক কিছু বুদ্ধিজীবীকে বলতে শোনা গেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন ভারতের চোখে বাংলাদেশকে দেখছে না।

দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা সম্পর্কে নূন্যতম ধারণা থাকলে খুব সহজেই এটা অনুমেয় যে, গণচীনকে ঠেকাবার জন্য ‘ভারতের চোখে’ বাংলাদেশকে দেখা ছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামনে অন্য বিকল্প নেই।

বিশ্ব রাজনীতিতে মার্কিন ভূমিকা নিয়েও বিএনপির কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে রয়েছে দৈত অবস্থান। তারা ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া, আফগানিস্তান, ফিলিস্তিনে মার্কিন ভূমিকা নিয়ে একদিকে যেমন ক্ষুব্ধ, আবার আরেকদিকে তালেবানদের হাতে মার্কিনিদের পরাজয়ে উল্লসিত। ইমরান খানের মতোই তারা মনে করেন পিটিআই সরকার পতনে মার্কিনিরা ভূমিকা পালন করেছে।

‘ইসলামপন্থীদের’ মতো বেশিরভাগ বিএনপির সমর্থকই মনে করেন মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি সার্বিকভাবে মুসলিমদের এবং মুসলিমপ্রধান দেশগুলোর স্বার্থের পরিপন্থী। সেই তারাই যখন আরেকটি মুসলিমপ্রধান দেশ, বাংলাদেশের সরকার পরিবর্তনে মার্কিন ভূমিকা আশা করেন অথবা দক্ষিণ এবং মধ্য এশীয় বিষয়ক আমেরিকার সহকারী পররাষ্ট্র সচিব ডোনাল্ড লুর সফরে বা র‍্যাবের কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞায় উল্লসিত হন—তখন সাধারণ জনগণের অনেকের কাছেই তাদের রাজনৈতিক অবস্থানের সমীকরণ মেলানো জটিল হয়ে পড়ে।

যে র‍্যাবের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে বিএনপি আজকে সরব, সেই বিএনপি কিন্তু আজও পরিষ্কার করে বলতে পারে নাই তারা কেন র‍্যাব গঠন করেছিল। র‍্যাব গঠনের দায়ভার নিজেদের কাঁধে না নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর চাপিয়ে দিয়ে তারা বলতে চায় মার্কিন পরামর্শেই র‍্যাব গঠন করা হয়েছিল।

বিএনপি নিজেদের জাতীয়তাবাদী আদর্শের দল হিসেবে উপস্থাপন করে। জাতীয়তাবাদের আদর্শের দাবিদার একটি দল কী করে বিদেশী রাষ্ট্রের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী বাহিনী গঠন করতে পারে—এ প্রশ্ন অনেকের মাঝে জাগা স্বাভাবিক। এ ধরনের বক্তব্য যে তাদের জাতীয়তাবাদের আদর্শের সাথে সাংঘর্ষিক, সেটা বিএনপির অনেক নেতাকর্মীই বুঝে উঠতে পারেন না।

বাংলাদেশে প্রতিটি সরকারের আমলেই কমবেশি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয় বিএনপি ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’ পরিচলানা করবার পর ইনডেমনিটি দেবার মাধ্যমে। পরবর্তীতে তাদের আমলে র‍্যাব গঠিত হবার পর বেশকিছু বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।

এ বিষয়গুলি নিয়ে আত্মমূল্যায়ন করবার সৎসাহস বিএনপি দেখাতে পারেনি। ক্ষমতায় থাকাকালীন তাদের এ ধরনের কার্যকলাপ সঠিক না বেঠিক ছিল অথবা প্রয়োজন থাকলে কেন প্রয়োজন ছিল, তার কোনোটাই তারা ব্যাখ্যা করতে পারেনি।

আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে জোরালোভাবে সোচ্চার হবার জন্য নিজেদের অতীতের এ বিষয়গুলো নিয়ে যে দলের একটা পরিষ্কার অবস্থান নেয়া দরকার, সেটা হয়ত তাদের অনেকে বুঝতে পারছেন না। আর এ না পারবার ফলেই জনমানসে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, বিএনপি ক্ষমতায় আসলে আবার তারা বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ডের সেই পুরানো পথেই হাঁটবে কিনা।

নিজেরা ক্ষমতায় থাকার সময়ে বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে যেমন কোনো বক্তব্য নেই তাদের, তেমনি বক্তব্য নেই কেন তারা দুই-দুইবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে পাশ কাটিয়ে নির্বাচন করতে চেয়েছিল সে বিষয়েও। তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেবার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ঠিক কী কারণে তারা সেটি করেনি—তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলনে জনগণকে সম্পৃক্ত করবার জন্য এ বিষয়ে তাদের স্পষ্ট বক্তব্য জরুরি। পাশাপাশি যে বিষয়টা তাদের স্পষ্ট করা উচিৎ তা হলো, বিএনপি আজকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে কি শুধুই ক্ষমতায় যাবার মাধ্যম হিসেবে দেখছে, নাকি ভবিষ্যতে ক্ষমতায় এলেও তারা এ ব্যবস্থা চালু রাখবে।

জনগণের বিশ্বাস অর্জনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে কঠিন যে চ্যালেঞ্জের মুখে আজ বিএনপি সেটি হলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রশ্ন। বাস্তবতা হচ্ছে, সাধারণ জনগণ তো দূরের কথা, পূর্বের অভিজ্ঞতা থেকে বিএনপির মাঠ পর্যায়ের অনেক নেতাকর্মীই বিশ্বাস করে না যে, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেবে। একটি দলের নেতাকর্মীদের যখন তাদের দলের ঘোষিত লক্ষ্যের প্রতি পূর্ণ আস্থা থাকে না, তখন তাদেরকে ওই লক্ষ্য অর্জনে নিবেদিতরূপে যুক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে।

স্বাধীনতা অর্জিত হবার পর পঞ্চাশ বছরের অধিক সময় পার হলেও বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলো আজ পর্যন্ত কেন সব মহলের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে পারল না—সাবেক ক্ষমতাসীন দল হিসেবে বিএনপির নিজেরও এর কোনো দায়ভার আছে কিনা—এ বিষয়টিও নতুন প্রজন্মের কাছে খোলাসা করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

এ নতুন প্রজন্ম হচ্ছে আন্দোলনের মূল শক্তি। রাজনৈতিকভাবে তারা আগের প্রজন্মের চেয়ে অধিক সচেতন। চিরাচরিত রাজনৈতিক ভাষায় অন্তত তাদের সচেতন অংশটি রাজনীতি বুঝতে আগ্রহী নয়। এখন তারা যদি প্রশ্ন তোলে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অনির্বাচিত সরকারের ভূমিকা পালন করবার কোনো সুযোগ আছে কিনা? অথবা, পাশের ভারতসহ প্রতিষ্ঠিত কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই যখন নির্বাচন করবার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন পড়ছে না, সেখানে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো এখনো কেন সে পরিপক্কতা (maturity) অর্জন করতে পারেনি—ক্ষমতাসীনদের পাশাপাশি বিরোধী দল হিসেবে বিএনপির কাছেও এর কোনো স্পষ্ট জবাব আছে কি? (চলবে)