বলুহর বাওড়ের জেলেরা কেন ঢাকার রাস্তায়

প্রভাবশালীদের ইজারা বাতিল করে বাওড়ে নিজেদের অধিকারের দাবিতে সংগঠিত হয়েছেন বঞ্চিত জেলেরা। কিন্তু জনপ্রতিনিধি থেকে নাগরিক সমাজ কিংবা গণমাধ্যম— সকলেই এক্ষেত্রে বিস্ময়করভাবে নিশ্চুপ। তাই তারা ঢাকায় এসেছিলেন দাবি জানাতে।

পাভেল পার্থপাভেল পার্থ
Published : 1 June 2023, 12:05 PM
Updated : 1 June 2023, 12:05 PM

বাংলাদেশের এক অনন্য বৃহত্তম বাওড় বলুহর। ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরের বলুহর ইউনিয়নজুড়ে এর বিস্তৃতি। ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরে বলুহর ও জয়দিয়া বাওড়, কালীগঞ্জে মরজাত, মহেশপুরে ফতেপুর ও কাঠগড়া এবং যশোরের চৌগাছায় বেড়গোবিন্দপুর বাওড়। আর এই ছয়টি বাওড় নিয়ে গড়ে উঠেছে ‘বলুহর কেন্দ্রীয় হ্যাচারী কমপ্লেক্স’। ছয়টি বাওড়ের মোট জলাকার প্রায় ১১৩৭ হেক্টর।

‘জাল যার জলা তার’ নীতি প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় বলুহরসহ প্রায় সকল বাওড়েই প্রবেশাধিকার হারিয়েছেন বাওড়পাড়ের জেলেরা। ক্ষমতার গণিত আর ইজারাপ্রথার প্রবলপ্রতাপে ছয়টি বাওড়ের প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ আজ দিশেহারা। দীর্ঘ চল্লিশ বছর ধরে একতরফাভাবে বলুহর বাওড় নিজেদের মতো ভোগদখল করে সরকারি রাজস্ব লোকসান করছে দখলকারীরা। দখলকারীদের দুর্নীতি ও লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ায় ভূমি মন্ত্রণালয় বলুহর বাওড়টি মৎস্য বিভাগের কাছে নবায়ন না করে উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে ইজারা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ২০২২ সালের ২০ মার্চ। চল্লিশ বছরের প্রশ্নহীন বঞ্চনাকে প্রশ্ন করে আবারও জেগেছে বলুহর বাওড়— ঠিক যেমন উপনিবেশকতার জুলুমের বিরুদ্ধে জেগেছিল নীলবিদ্রোহের সময়।

প্রভাবশালীদের ইজারা বাতিল করে বাওড়ে নিজেদের অধিকারের দাবিতে সংগঠিত হয়েছেন বঞ্চিত জেলেরা। কিন্তু কেউ জেলেদের কথা শুনছে না। জনপ্রতিনিধি থেকে নাগরিক সমাজ কিংবা গণমাধ্যম— সকলেই এক্ষেত্রে বিস্ময়করভাবে নিশ্চুপ।

ক্ষুধা আর ক্ষোভ নিয়ে বাওড় থেকে জেলেরা পরিবার পরিজন নিয়ে তাই ঢাকায় এসেছেন। জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে তপ্ত রাস্তায় যেন ভিড় জমেছে একটুকরো দলিত ‘পদ্মা নদীর মাঝি’। খসখসে শিশু, উদভ্রান্ত তরুণ, ক্ষুব্ধ বিধবা কিংবা বিবর্ণ পৌঢ়দের ছায়াগুলোও প্রখর তাপে চুরমার হয়ে যাচ্ছিল। যেন ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ কিংবা ‘তিস্তাপাড়ের বৃত্তান্ত’ থেকে উঠে আসা শত বঞ্চনার দাগ নিয়ে দাঁড়ানো খণ্ডবিখণ্ড মানুষেরা।

বহু ঘটনায় আমরা মিডিয়াকে বেশ তৎপর ও জোরালো হতে দেখি। কিন্তু নিদারুণভাবে ২৮ মে প্রেসক্লাবের সামনে উপচে পড়েনি মিডিয়া। ক্যামেরার ঝিলিক নিয়ে দাঁড়ায়নি কোনো বিশ্বজয় করা আলোকচিত্রী। কিংবা কোনো মানবাধিকারকর্মী, পরিবেশকর্মী বা কোনো প্রগতিশীল নাগরিক প্রতিক্রিয়া জেলেদের ডাকে বুক পাতেনি।

শিশু-প্রবীণদের নিয়ে নানাবয়সী নারীরা প্রেসক্লাবের সামনে বসেছিলেন। তরুণ-পৌঢ় পুরুষেরা দিগ্বিদিক ছুটছেন, কতক জটলা করেছেন নির্মাণাধীন মেট্রোরেলের তলায়। যদিও তাদের মাথায় ওপর থেকে ছিটকে পড়েনি কোনো খণ্ড কিংবা ঢুকে যায়নি লোহার শিক। কিন্তু অনিশ্চয়তা আর হতাশার দশাসই সব ধাক্কায় সকলেই কাহিল হয়ে পড়েছিলেন। কাগজের বাক্সের মোড়কে হাতে লেখা ‘একটাই দাবি, বাওড় চাই বাওড় চাই’ কিংবা ‘বাণিজ্যিক মৎস্য খামার বাতিল কর, দেশীয় মাছের আবাদ কর’ শ্লোগানগুলোও লুটিয়ে গেছিল তপ্ত ঢাকায়।

ঘামের দাগ শুকিয়ে যাওয়া ক্লান্ত শীর্ণ চেহারাগুলো জানান দিচ্ছিল, তাদের সাথে অন্যায় করা হচ্ছে। দীর্ঘদিনের জেলেজীবন থেকে তাদের জোর করে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। প্রভাবশালীরা বাওড় ইজারা নিয়ে বাণিজ্যিক মাছ চাষ করছেন বলে গরিব জেলেরা প্রতিদিন প্রতারিত হচ্ছেন। জয়দিয়া, বলুহর ও বেড়গোবিন্দপুর বাওড় থেকে জেলে পরিবারের নানাবয়েসী প্রায় পাঁচশত মানুষ বিশ্বাস করেছিলেন ঢাকায় এসে দাবি জানালে রাষ্ট্র শুনবে। জেলেদের কাছে ফিরবে বাওড়ের অধিকার। চলতি আলাপখানি বলুহর বাওড়ের জেলেদের সপক্ষে দাঁড়িয়ে বাওড়ের ন্যায়বিচার দাবি করছে। রাষ্ট্র দ্রুত তৎপর হোক এবং বলুহরসহ সকল বাওড়ে জেলেদের প্রথাগত অধিকার নিশ্চত করুক।

জলাভূমি-আলাপে প্রান্তিক বাওড়

জলের দেশ বাংলাদেশে নদী-বিল-খাল-ছড়া-ঝিরি-হাওর জলাভূমি হিসেবে পরিচিত হলেও বাওড়ের বিষয়টি মূলধারার জলাভূমি-আলাপে খুব একটা দেখা যায় না। বাওড় যেন জলাভূমির ভেতর নিদারুণ প্রান্তিক। এমনকি বাওড়ের ওপর নির্ভরশীল জেলেজীবনের গল্পও আড়ালেই থেকে যায়। বাংলাপিডিয়া বাওড়কে নদীর পরিত্যক্ত বাহু হিসেবে বর্ণনা করে এগুলোকে অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ বলেছে। নদীর গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে কোনো অংশের উৎসমুখে পলি জমে নদীর মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাওড় সৃষ্টি হয়। বাওড় বিলের চেয়ে স্থিতিশীল এবং বছরব্যাপী পানি থাকে। তবে বাওড়ের পাশের উঁচু চকজমিনে ধান আবাদ হয়। বাওড়গুলো দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ঝিনাইদহ, যশোর, চুয়াডাঙ্গা, ফরিদপুর ও কুষ্টিয়াতে বিস্তৃত। এখনো পর্যন্ত বাওড়ের কোনো পূর্ণাঙ্গ খতিয়ান ও পাবলিক নথি আমাদের হাতে নেই। বাংলাপিডিয়া সাগরখালি, জালেশ্বর, ক্ষেদাপাড়া, রামপুর, পাঠানপাড়া, কাঠগড়া, যোগীনি, ভাগীনি, ইছামতি, জয়দিয়া, মারজাত, হরিণা এবং আরিয়লকে দেশের প্রধান বাওড় হিসেবে উল্লেখ করেছে। ‘বাংলাদেশের হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তর’ তাদের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে ২৩টি বাওড়ের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। উক্ত তালিকায় ঝিনাইদহের নাস্তি, সাসতার, পোড়াপাড়া, সারজাত, কায়েতপাড়া ও সাগান্যা বাওড়ের নাম আছে। এছাড়া চুয়াডাঙ্গার বেনীপুর, বন্দরদহ, উজালপুর, মারুফদিয়া; যশোরের কালখালি, বকভরা, হামিদপুর, ঝামপা, কাটোয়ার, ক্ষেদাপাড়া, হরিহরনগর, বাকরা, বাহাদুরপুর, কন্যাদহ; কুষ্টিয়ার কালীগঙ্গা বাদলবাসা এবং ফরিদপুরের চৈতরকোল ও মরিহরনগর বাওড়ের নাম আছে। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া ও সদরের মাঝামাঝি অবস্থিত বর্ণি বাওড়কে অনেকে গুরুত্বপূর্ণ বাওড় হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আবার জাতীয় তথ্যবাতায়নে যশোরের অভয়নগরের পুড়াখালী ও চৌগাছিয়ার খড়িঞ্চা বাওড়ের উল্লেখ আছে। বলুহর বাওড়ের আন্দোলনকারী জেলেরা বলুহর, মরজাত, জয়দিয়া, বেড়গোবিন্দপুর, ফতেপুর ও কাঠগড়া বাওড়কে দেশের বিশেষ মৎস্যবৈচিত্র্যের অঞ্চল হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

বাওড়ের তালিকা ও বিবরণ নিয়ে বিচ্ছিন্ন কিছু নথি থাকলেও পূর্ণাঙ্গ পাবলিক নথির অভাব আছে। এমনকি বাওড়ের সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞায়ন ও বৈশিষ্ট্যসমূহও এখনো পর্যন্ত কোনো রাষ্ট্রীয় নীতিতে সুস্পষ্টভাবে বিবৃত হয়। দেখা যায় রাষ্ট্রীয় নীতি ও নথিগুলো জলাভূমি বোঝাতে কী বলে। জাতীয় পানি নীতি (১৯৯৯) এর ৪.১৩ নং অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে, হাওড়, বাওড় ও বিল জাতীয় জলাভূমিগুলো বাংলাদেশের আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যর ধারক এবং এক অনন্য প্রাকৃতিক সম্পদ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছাড়াও অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত দিক থেকে এগুলোর গুরুত্ব অসীম। হাওড় এবং বাওড়গুলিতে শুষ্ক মওসুমেও যথেষ্ট গভীরতায় পানি থাকে তবে ছোট বিলগুলি সাধারণত: চূড়ান্ত পর্যায়ে আর্দ্রভূমিতে পরিণত হয়। এই বিলগুলি প্লাবনভুমির নিম্নতম অংশ। এই জলাশয়গুলো আমাদের প্রাকৃতিক মৎস্য-সম্পদের সিংহভাগের উৎস এবং নানা ধরণের জলজ সবজি ও পাখীর আবাসস্থল। তাছাড়াও শীত মওসুমে উত্তর গোলার্ধ থেকে আগত অতিথি পাখীদের নির্ভরযোগ্য আশ্রয়। হাওড় এবং বিলগুলো খালের মাধ্যমে নদীর সাথে সংযুক্ত। অতীতে প্রকৌশলগত হস্তক্ষেপের মাধ্যমে অনেক বিলকে তাৎক্ষণিক ফসল লাভের জন্য নিষ্কাশিত আবাদী জমিতে পরিণত করা হয়েছে। কিন্তু কিছুদিন পরেই এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া প্রকট আকার ধারণ করে। প্রথমেই মাছ এবং গ্রামীণ জনগণের খাদ্যের উৎস কচু, শাপলা, কলমী জাতীয় জলজ সবজির বিলুপ্তি ঘটে। বর্ষা মওসুমে প্লাবনভূমির বর্জ্য প্রবাহমান খালের মাধ্যমে বাহিত ও শোধিত হয়ে নিষ্কাশিত হত। কিন্তু নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় সেই প্রাকৃতিক শোধনক্রিয়া ব্যাহত হয়ে পরিবেশের মারাত্মক সংকট সৃষ্টি করেছে।’

অপরদিকে ‘বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ড’ ২০০০ সনের প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করেছে, `হাওর ও জলাভূমি এলাকা অর্থ নীচু প্লাবিত অঞ্চল যাহা সাধারণত হাওর এবং বাওর বলিয়া পরিচিত।’ ভূমি ব্যবস্থাপনা ম্যানুয়াল ১৯৯০-এর ১৮৭ নং অনুচ্ছেদে আছে, ‘বদ্ধ জলমহাল বলিতে এরূপ জলমহাল বুঝাইবে যাহার চতু:র্সীমা নির্দিষ্ট অর্থাৎ স্থলাবেষ্টিত এবং যাহাতে মৎস্যসমূহের পূর্ণতা প্রাপ্তির জন্য বৎসরের নির্দিষ্ট সময়ে মৎস্য ধরার উপযোগী। সাধারণত: হাওর, বিল, ঝিল, হ্রদ, দীঘি, পুকুর ও ডোবা ইত্যাদি নামে পরিচিত জলমহালকে বদ্ধ জলমহাল বলিয়া গণ্য করা হয়’। জাতীয় পানি নীতিতে আরও উল্লেখ আছে, ‘...হাওড়, বাওড় ও বিল জাতীয় জলাভূমিগুলো বাংলাদেশের আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যর ধারক এবং এক অনন্য প্রাকৃতিক সম্পদ।’ রাষ্ট্রীয় নীতি অনুযায়ী জলাভূমি হিসেবে হাওর ও বাওড়কে এক করেই দেখা হয়েছে। কিন্তু বাওড়ের প্রতিবেশগত, সামাজিক, প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এবং বৈশিষ্ট্য হাওর বা অন্য জলাভূমির মতো নয়। বাস্তুতন্ত্র, প্রাকৃতিক এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য সবকিছু মিলিয়ে বাওড়ের বহুমুখী বৈশিষ্ট্য ও বিবরণ নথিভুক্ত হওয়া জরুরি।

কী ঘটছে বলুহর বাওড়ে?

ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরের বলুহর বাওড় এক ঐতিহাসিক প্রাচীন জলাভূমি। এই অঞ্চলেই গড়ে উঠেছিল উপনিবেশবিরোধী নীলবিদ্রাহ। কাছেই মহেশপুরের স্বরূপপুরে ১৯৪০ সনে গড়ে ওঠে এশিয়ার বৃহত্তম দত্তনগর কৃষিখামার। বলুহর বাওড়ের চারপাশে বলুহর, কাগমারী, পারলা, মুরুটিয়া, এড়ান্দহ, বিদ্যাধরপুর, জগন্নাথপুর, সিংগীয়া, ফুলবাড়ী, রহমতপুরের জীবনজীবিকা মূলত গড়ে উঠেছে বাওড়ের প্রাকৃতিক সম্পদ ও বাস্তুতন্ত্রের ওপর। বাওড়পাড়ের জনগণ মৌসুমী কৃষিকাজ করলেও গরিষ্ঠভাগই জেলে। হালদার পদবীধারী এই জেলেরাই বাওড়পাড়ের আদিবাসিন্দা। জাল যার জলা তার নীতি এখনো দেশের জলাভূমিতে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ১৯৭৯ সালে বিশ্ব ব্যাংকের সহায়তায় বলুহর বাওড়কে কেন্দ্র করে নির্মাণ করা হয় মৎস্য হ্যাচারী কমপ্লেক্স। প্রকল্পে প্রায় ২৯টি পুকুরে রাখা হয় রেণুপোনাসহ মা মাছ। আর এসব বাওড়কে কেন্দ্র করেই কার্প জাতীয় মাছের রেণুপোনার এক বিশাল বাজার গড়ে ওঠে। প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে বাওড়কে একতরফাভাবে করে তোলা হয় বাণিজ্যিক মাছের ক্ষেত্র। বাওড় ঘিরে ক্ষমতাকাঠামো, শ্রেণিবিভাজিত সমাজের দ্বন্দ্ব এবং কাঠামোগত বৈষম্য আরও জটিল হয়ে ওঠে। প্রথাগত অধিকার বনাম মুনাফা ও মালিকানার তর্ক প্রবল হয়ে ওঠে।

কেবল বাওড় নয়; দেশের সকল প্রাকৃতিক জলাভূমির মালিকানা ও ব্যবস্থাপনা নিয়েই এই বৈষম্য ও দ্বন্দ্ব প্রকট হয়েছে। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের হাওর কিংবা উত্তরাঞ্চলের বিল ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও এমনি ঘটেছে। পরবর্তীতে ১৯৮৬ সালের দিকে বাওড়টি রাষ্ট্রীয় খাতে নেয়া হয় এবং মৎস্যজীবীদের দলভিত্তিক ইজারা দিয়ে মাছ চাষ প্রকল্প আরেক ভিন্ন বাঁক নেয়। ক্ষমতাকাঠামো আর নয়াউদারবাদী বাজারের বাহাদুরিতে জেলেরা ‘মৎস্যজীবী’ হিসেবে সরকারি ইজারায় অংশগ্রহণের অধিকার ক্রমাগত হারাতে থাকেন। বরং মৎস্যব্যবসায়ী কিংবা প্রভাবশালীরা ‘মৎস্যজীবী সংগঠনের’ নামে এসব বাওড় ইজারা নেয়া শুরু করেন।

কেবল বাওড় ব্যবস্থাপনা নয়, এর মাধ্যমে বাওড়ের প্রাকৃতিক সম্পদ এবং মাছের বৈচিত্র্যেও ভয়াবহ ধস দেখা যায়। প্রভাবশালীদের কাছে বাওড় কোনো মুক্ত জীবিত জলাভূমি সত্তা নয়। তাদের কাছে এর কোনো সাংস্কৃতিক বা সামাজিক মর্ম নেই। ক্ষমতা আর অর্থের প্রতাপে ইজারা নেয়া বাওড়গুলো তাই কেবল বাণিজ্যিক মাছের খামার হিসেবেই ব্যবহৃত হতে থাকে। বাণিজ্যিক মৎস্য উৎপাদনের নামে এসব প্রাকৃতিক জলাভূমিতে রাসায়নিক বিষ এবং বিদেশি মাছের প্রজাতি ব্যবহৃত হয়। বাওড়গুলো তার নিজস্ব চেহারা ও প্রাণ-প্রজাতি হারাতে থাকে। হারিয়ে যায় বাওড়ের বহু দেশীয় মাছের প্রজাতি ও জলজপ্রাণ। প্রবেশাধিকার হারিয়ে বাধ্য হয়ে বদলে যেতে থাকে বাওড়পাড়ের জেলেজীবন।

প্রভাবশালীদের জলাভূমি দখল ও লুটতরাজের নমুনা এত প্রকট হয়ে ওঠে যে, মৎস্যজীবী পরিচয়ের আগে ‘প্রকৃত’ এবং ‘অপ্রকৃত’ বিশেষণ বসাতে বাধ্য হয় রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের সামগ্রিক বিবেচনায় ঐতিহাসিকভাবে বাওড়পাড়ের জেলেরা ‘প্রকৃত মৎস্যজীবী’ হয়েও আজ জলাভূমি থেকে উদ্বাস্তু। এমনকি যখন জেলেদের বাওড়ের ডাক নিতে পারতেন তখন বাওড় থেকে আহরিত মাছের থেকে রাষ্ট্র প্রতিবছর ভাল রাজস্ব পেত।

প্রভাবশালীদের দখলদারিত্বের কারণে মাছের উৎপাদন এবং রাজস্ব উভয়ই ক্রম হ্রাসমান। ভূমি মন্ত্রণালয় বাওড়ের পূর্বতন ইজারা বাতিল করে উন্মুক্ত দরপত্র আহবান করলে কোটচাঁদপুর মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি, বাজেবামনদাহ মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি এবং বলুহর মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি ইজারায় অংশ নেয়। দুই কোটি ৩৭ লাখ টাকা সর্বোচ্চ দরদাতা হিসেবে কাগজপত্র জমা দেয়ায় ছয় বছরের জন্য তাদেরকে বলুহর বাওড়টি ইজারা দিতে সুপারিশ করে মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে জেলা প্রশাসন।

বাড়ছে সংঘাত, কমছে বৈচিত্র্য

বলুহর বাওড় থেকে উদ্বাস্তু জেলেরা প্রভাবশালীদের দখল থেকে বাওড়ের ইজারা বাতিলের দাবিতে সংগঠিত হয়েছেন। এ নিয়ে বাওড়ে নিত্য দ্বন্দ্ব-সংঘাত বাড়ছে। গরিব অসহায় জেলেরা প্রতিনিয়ত নানা মামলা-হামলার নিশানায় পরিণত হচ্ছেন। ক্ষতিগ্রস্থ জেলেরা ২৮ মে ঢাকায় মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করে জানান, ...প্রকৃত মৎস্যজীবীদের বঞ্চিত করে অসাধু ও কালো টাকার মালিকগণ অসৎ কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ইজারা পান। ভুক্তভোগী জেলে সম্প্রদায় ইজারা বাতিলের দাবিতে রিট পিটিশন করলে আদালত ৬ সপ্তাহের জন্য স্থগিতাদেশ দেয় কিন্তু ইজারাদাররা গত ১৬ এপ্রিল ৬ সপ্তাহ স্থগিতাদেশের বিরুদ্ধে ৮ সপ্তাহের স্থগিতাদেশ পায় এবং পরবর্তী শুনানি ধার্য হয় আগামী ২৯ মে (সূত্র: আন্দোলনকারীদের প্রেসবিজ্ঞপ্তি)।

বাওড়ের অধিকারহারা জেলেরা জানান, বাওড় থেকে উৎপাদিত ও আহরিত মাছের ৬০ ভাগ সরকার পেত এবং ৪০ ভাগ জেলেরা নিত কিন্তু প্রভাবশালীদের ইজারার কারণে কেবল জেলে নয় সরকারও বিপুল পরিমাণে রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। একতরফাভাবে বাওড় দখল নিয়ে বাণিজ্যিক মাছের চাষের কারণে প্রতিনিয়ত বহু প্রাণ-প্রজাতির বিলুপ্তি ঘটেছে বলুহরে। ইতোমধ্যেই রাইগ, বোয়াল, দেশি পুঁটি মাছ বিলুপ্ত হয়েছে। কাছিম, সুন্ধিকচ্ছপ, কুচে বিলুপ্ত হয়েছে। বলুহরের বিখ্যাত কৈ, সরপুঁটি, বাটা, পাবদা, টেংরা মাছেদের বৈচিত্র্য এবং প্রাপ্যতাও দিনে দিনে হ্রাস পেয়েছে। একসময় বাওড়ের উঁচু চকে চাষ হতো খাসকানি সুগন্ধি ধান। খইয়ামটর, মধুমালতী, মেঘনাল, বিরবল, সুরথা, খরচামুড়ি, ঘৃত্যকলা, ভইশদল, ননীকাজলের মতো ধানেরও আবাদ হতো বাওড়ের চকজুড়ে। কিন্তু সেসব এখন কেবলই স্মৃতি। বাণিজ্যিক কৃষি আর বাণিজ্যিক মৎস্যচাষের বিস্তার প্রবলভাবে খণ্ডবিখণ্ড করেছে বলুহরের প্রাণ-প্রকৃতি ও বাস্তুতন্ত্র। এমনকি এর সঙ্গে হারিয়ে গেছে বাওড়পাড়ের জেলেজীবনের বহু লোকজ্ঞান, কৃত্য-রীতি এবং লোকায়ত ব্যবস্থাপনাগত সম্পর্ক।

রাষ্ট্র কি কমলা হালদারের দিকে তাকাবে?

বলুহরেই জন্ম ও বিয়ে যুদ্ধবিধবা কমলা হালদারের। বাবা শরৎ হালদার, মা জগমায়া হালদার কী স্বামী নিত্য হালদার সকলকেই বাওড় থেকে মাছ ধরতে দেখেছেন। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন নিত্য হালদার। যুদ্ধ করেই বড় করেছেন পাঁচ সন্তান। আর এর ভেতরেই দেখেছেন বলুহরের বেদখল আর বঞ্চনা। বাওড়ের সবচেয়ে গভীর শীতলতম স্থানকে স্থানীয়ভাবে ‘গভীরতা’ বলে। এটি মা মাছের আশ্রয়স্থল। শীতের আগে হিজল, আম ও বাঁশের ডালপালা দিয়ে এখানে তারা কাটা দিতেন। এভাবেই বাঁচিয়ে রাখা হতো মা মাছ। গঙ্গা পূজা দিয়ে জলে নামার অনুমতি নিয়ে মাছ ধরা হতো বাওড়ে। বেশ কিছু ডোয়া ছিল বাওড়ে। সামাজিক বিশ্বাসে সুরক্ষিত গভীরতম স্থান। বিচ্ছিরিসব গাড়ির হর্নের আওয়াজ আর ঝুঁকে পড়া রোদের আলোয় কমলা হালদার জানান, আগের দিনের প্রবীণেরা বিশ্বাস করত এসব ডোয়ায় দেও-দানো থাকে, এখানে কেউ কোনোদিন নামেনি, কিন্তু বাওড় লিজ নিয়া কোনো নিয়ম আর কেউ মানে না, সব তারা একটানে শুষে খেয়ে নেয়, জল আর মাছের জন্য কোনো মায়া নাই মানুষের মনে।

প্রেসক্লাবের সামনে সারাদিন কথা বলতে বলতে গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল সবার। কমলার পেছনে পান নিয়ে দাঁড়ালেন জয়দিয়া বাওড়ের আরেক প্রবীণ জেলে শ্রীরাম হালদার। তার বাবা মুরালী হালদার এবং দাদু রায়চরণ হালদার সকলেই জয়দিয়া বাওড়ে মাছ ধরেছেন। বিখ্যাত জেলে ভীম হালদার আর খোকা হালদারের গল্পও শোনালেন অনেকে। রায়পুর, জয়দিয়া, বলুহার, দইতারকুটি, লক্ষীকুন্ড, নারায়ণপুর, বলরামপুর গ্রাম থেকে আসা কালু হালদার, চিত্ত বিশ্বাস, যমুনা হালদার, রাম হালদার, হারু হালদার, রসিক হালদার, জগন্নাথ হালদারসহ বহুজনে শোনালেন চন্ডী, পদ্ম, পুষখালী বিলের হারানো স্মৃতিকথা। বলুহর থেকে দ্বিতীয় শ্রেণি পড়ুয়া প্রলয় হালদারও অধিকারের দাবিতে এসেছে ঢাকায়। রাষ্ট্র কি কমলা বা প্রলয় হালদারদের জীবনকে উপলব্ধি করতে পারে?

পৃথিবীজুড়ে বর্তমান সময়ে অবশিষ্ট মোট ৫৪ লাখ বর্গ কিমি থেকে ৫৭ লাখ বর্গ কিমি জলাভূমির ভেতর বলুহর বাওড়ও আছে। প্রমাণিত হয়েছে সমাজভিত্তিক জলাভূমি ব্যবস্থাপনাই জলাভূমি সুরক্ষার মৌলিক ভিত্তি। আর জলাভূমিতে জেলেদের প্রথাগত অধিকার নিশ্চিতকরণের ভেতর দিয়েই কেবল তা সম্ভব। ভূমি মন্ত্রণালয়, মৎস্যবিভাগ, স্থানীয় সরকার ও প্রশাসন এবং কর্তৃপক্ষকে বলুহর বাওড়ের জীবনযন্ত্রণাকে বুঝতে হবে। প্রভাবশালী নয়, বলুহর বাওড়ে জেলেদের প্রথাগত অধিকার প্রতিষ্ঠায় সকল পক্ষের অঙ্গীকার ও সক্রিয়তা জোরালো করতে হবে।