বসন্ত বন্দনার সাথে সাথে আমরা কি শুনতে পাচ্ছি বিভিন্ন দেশে সুস্থ সুন্দরের পথ রোধ করে দাঁড়ানো স্বৈরশাসকের রণহুঙ্কার? ভয়ঙ্কর বিপদের পদধ্বনি?
Published : 19 Feb 2023, 04:27 PM
বসন্তের একটা আলাদা আবেদন আছে। হোক না তা রুক্ষ-শুস্ক, ধুলাধূসরিত। তাই তো মানুষ এখনও গুনগুন করে আহা আজি এ বসন্তে। নানা সমস্যা-সংকট, মূল্যস্ফীতি, যানজট, দূষণের মধ্যেও শোনা যায় ‘বসন্ত এসে গেছে’। বসন্তের জন্য একটা আকূলতা তো থাকেই। বসন্ত মানে তো জীবন। কিন্তু বসন্ত বন্দনার সাথে সাথে আমরা কি শুনতে পাচ্ছি বিভিন্ন দেশে সুস্থ সুন্দরের পথ রোধ করে দাঁড়ানো স্বৈরশাসকের রণহুঙ্কার? ভয়ঙ্কর বিপদের পদধ্বনি?
অশান্ত, অস্থির ইউক্রেইন গোটা পৃথিবীর জন্যই মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেখানে জেলনস্কির নেতৃত্বে নাৎসিবাদী উগ্রদক্ষিণপন্থী এক ভয়ঙ্কর শক্তির উত্থান ঘটেছে। ইউক্রেইন পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নের শস্যভাণ্ডার, খনি-সম্পদেও ধনী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে, হিটলারের বিধ্বংসী বাহিনীর মুখ ক্রেমলিন থেকে ঘুরিয়ে দিতে ছিল ইউক্রেইনবাসীরও ভূমিকা। পুতিনের রাশিয়ার সাথে ইউক্রেইনের মিশে যাওয়া চায়নি রাজধানী কিয়েভ– তাই কিয়েভের চোখে, ‘সার্বভৌম গণতন্ত্রে’র আওয়াজ তোলা রাশিয়ার সমর্থকদের ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ ছাপ দিয়ে স্তব্ধ করে দেওয়া প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ বলে বিবেচিত হয়েছে। আর কিয়েভের এই ভূমিকাকে শাণিত করেছে ওয়াশিংটন। ইউরো-মার্কিন ভাবাদর্শের চাপে ও আদরে ইউক্রেইন যখন হিটলারের ফ্যাসিস্ট বাহিনীর দরদি-সহযোগীদের নিয়ে গড়া জেলনস্কির সরকার ন্যাটো জোটে যোগদানের ব্যাপারে মরিয়া হয়ে উঠল, তখন পুতিন নিজের অস্তিত্ব বাঁচাতে আক্রমণ করে বসলেন। আর এতে সুবিধা হলো যুদ্ধপ্রেমি ওয়াশিংটন ও তার মিত্রদের। তারা এখন জেলনস্কিকে সামনে রেখে রাশিয়াকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার কাজটি চালিয়ে যাচ্ছে।
শুধু ইউক্রেইনেই নয়, নাৎসিবাদীরা মাথা তুলেছে ইতালিতে। জার্মানিতেও ডানপন্থীরাই রাজনীতির নিয়ন্ত্রক। আসলে দেশে দেশে এখন নাৎসীবাদীরা আবারও নতুন উদ্যমে ফিরে আসছে। হিটলার-মুসোলিনির পরাজয়ের সাথে সাথে ফ্যাসিবাদ পৃথিবী থেকে নির্মূল হয়নি– কারণ পুঁজিবাদ নির্মূল হয়নি। ১৯৪৫-এর ৯ মে বার্লিনে লালফৌজ তার বিজয় নিশান ওড়ালে ফ্যাসিস্ট শক্তি তার উদ্যত ফণা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু তার বিষের থলিটা থেকেই যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেমে যাবার পর, সাবেক পশ্চিম জার্মানি বা ফেডারেল রিপাবলিক অফ জার্মানি গড়ে ওঠার সময় থেকেই জার্মানিতে নয়া ফ্যাসিবাদ মাথাচাড়া দিতে থাকে। ইউরোপে ষাটের দশক থেকে এবং আমেরিকায় সম্ভবত তারও আগে নতুন করে ফ্যাসিবাদ তার শিকড় ছড়াতে থাকে নানান নতুন নতুন সংগঠনে এবং স্নায়ুযুদ্ধের বিশ্বপরিস্থিতিতে, প্রতিক্রিয়াশীলদের কমিউনিস্টবিরোধী জিগির এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি বিদ্বেষ ওইসব নয়া ফ্যাসিবাদী সংগঠনগুলিকে পুষ্টি জুগিয়েছে।
সাতের দশকের পুঁজিবাদের সঙ্কট, ইউরোপীয় রাজনীতিতে নয়া ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলির উত্থানের সহায়ক হয়ে ওঠে। ইতালি-ফ্রান্স-অস্ট্রিয়াতেও এই শক্তির ক্রমশ আত্মপ্রকাশ ঘটে। ইতালিতে তো মুসোলিনির প্রশংসা এবং তার সরকারকে সমর্থন করেই প্রকাশ্যে সগর্বে প্রচার করতে থাকে এম এস আই, সোশ্যাল মুভমেন্টের নামে। এই নয়া ফ্যাসিস্ট জোট, এতটাই শক্তিশালী হয়ে ওঠে, যে পরে নিজেদের নাম পরিবর্তন করে অন্যান্য দক্ষিণপন্থী দলকে সাথে করে ১৯৯৪ সালে সরকার গঠন করে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর এই প্রথম নয়া ফ্যাসিবাদীরা একটা গুরুত্বপূর্ণ দেশে সরকারের ক্ষমতায় আসতে পারল নির্বাচনের মাধ্যমে। সাতের দশকের আগে নয়া ফ্যাসিবাদী দল বা সংগঠন কোনো দেশেই তেমন জনসমর্থন পায়নি। এই নয়া নাৎসিরা আমেরিকার আশ্রয়ে ও প্রশ্রয়ে জার্মানি থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে দেশে ক্রমশ আগ্রাসী হয়ে ওঠে। বেঁচে যাওয়া পুরানো নাৎসিদের জার্মানি, আমেরিকার সাহায্যে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছে, কখনও কখনও শাসকগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তও করেছে। ফলে নাজিবাদীরা হিটলারের ফ্যাসিবাদীদের মতোই ক্রমশ আক্রমণাত্মক এবং উগ্র হয়ে ওঠে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সমাজতন্ত্রের পতাকার তলায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ এলেও পুঁজিবাদ ধ্বংস হয়নি। তার অবক্ষয় হয়েছে, সঙ্কটে সঙ্কটে জর্জরিত হয়েছে। আর যত সঙ্কট ততই বেড়েছে বেকারত্ব, বেড়েছে বেঁচে থাকার আবশ্যিক জিনিসগুলোর দাম। এই প্রেক্ষিতে দেশে দেশে দক্ষিণপন্থী শাসকগোষ্ঠী শ্রমজীবী মানুষের উপার্জনের ওপর আক্রমণ নামিয়ে আনে, সামাজিক নিরাপত্তার সুযোগগুলিকে একটু একটু করে সঙ্কুচিত করে তোলে। কর্মহীনতা, কর্মচ্যুতি, অস্বাভাবিক দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, বুর্জোয়া থেকে শুরু করে মধ্যবিত্ত ও শ্রমজীবী মানুষকে ঘিরে ধরে এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতার ভয়। অতীতে হিটলার মুসোলিনির ফ্যাসিবাদের মতোই নয়া ফ্যাসিবাদও মানুষের এই ভীতিকেই পুঁজি করে নিজেকে বিস্তৃত করেছে। দক্ষিণপন্থী, রক্ষণশীল শক্তিগুলি তাদের হিংস্র নখ-দাঁতগুলিকে ধারালো করে তোলে, বেকারত্ব-মুদ্রস্ফীতি এবং নানান জনকল্যাণ-বিরোধী অর্থনৈতিক নীতির কষ্টিপাথরে।
নয়ের দশকের আগের থেকেই বিশ্ব অর্থনীতির অভিমুখ তীব্রতর শোষণ এবং মুনাফার দিকে চলেছে বিশ্বায়নের নামে। আমাদের দেশেও আটের দশক থেকে আইএমএফ-বিশ্ব ব্যাংক নির্দেশিত তথাকথিত উদার অর্থনীতিকে ধ্যান-জ্ঞান করে প্রয়োগ চলছে। দিন যত যাচ্ছে ততই এখানকার অর্থনীতি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মুখ গহ্বরে ঢুকে পড়ছে। ফলে কৃষি-শিল্প-বাণিজ্য ধ্বংস হচ্ছে, বাড়ছে বেকারত্ব। নিত্যপ্রয়োজনের বাজারের আগুন হচ্ছে আরও লেলিহান। বেকারত্বের সাথে সাথে বাড়ছে কর্মচ্যুত মানুষের সংখ্যা। দেশের পাটকলগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। চিনিকলগুলো ধুকছে। আইএলও-এর ওয়ার্ল্ড ওয়ার্ক রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, বিশ্বের ৩১৩ মিলিয়ন নতুন শ্রমিকের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশেরই ২০০ মিলিয়ন– যার মধ্যে আছে বাংলাদেশ। পনেরো থেকে ঊনত্রিশ বছরের ৩ কোটি যুবার প্রায় ১৫ শতাংশই বেকার।
দেশের টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। নতুন শিল্প গড়ে উঠছে না। বৈদেশিক রপ্তানিও বাড়ছে না। দুর্নীতির কারণে বড় বড় প্রকল্পগুলোও ঠিকঠাকমতো হচ্ছে না। গ্যাস-বিদ্যুতে সংকট বাড়ছে। শ্রমিক-কৃষক-কর্মচারী সকলের জীবিকায় প্রভাব পড়েছে। গুটিকয় সুবিধাবাদী ধনপতি ছাড়া কোটি কোটি মানুষের জীবন দুর্দিনের ঝড়ে বিধ্বস্ত হয়ে পড়ছে। ফলে সেই হিটলার-মুসোলিনির ক্ল্যাসিকাল ফ্যাসিজমের মতোই শ্রমিক-কৃষক-মধ্যবিত্তের অসহায়তা এবং নিরাপত্তাহীনতা সার-জল পাচ্ছে। আর এই সুযোগে দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি ফ্যাসিবাদের উর্বর জমি তৈরি করছে। অতিরিক্ত আলো-বাতাস দিচ্ছে ধর্মের রাজনীতি যা হিটলার-মুসোলিনী পায়নি।
হিটলার আর্যজাতির শ্রেষ্ঠত্ব এবং আর্যরক্তের শুদ্ধতা নিয়ে একটা গোটা দেশে উন্মাদনা সৃষ্টি করে তার ফ্যাসিস্ট বাহিনী সৃষ্টি করতে পেরেছিল, পেরেছিল ইহুদী বিদ্বেষকে এক চরম মাত্রায় পৌঁছে দিতে– ইতিহাসের সেই কুৎসিত অন্ধকারের মধ্যে আমাদের দেশের একটা বিশেষ শ্রেণি তাদের ভবিষ্যতের পথের সন্ধান পেয়েছে। দেশে গোপনে ধর্মের রাজনীতি ও মৌলবাদ তাদের রসদ সংগ্রহ করে বিধর্মী-বিদ্বেষ ছড়িয়ে সাম্প্রদায়িকতায় তা দিচ্ছে। জার্মানিতে ইহুদিদের নাগরিকত্বও ছিল বিপন্ন– আমাদের দেশেও অমুসলিমদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করা হয়েছে। আর রাষ্ট্র ও নাগরিকের ধর্মীয় পরিচয় সৃষ্টির পেটেন্টের অধিকারে যাতে তরুণ প্রজন্ম সমৃদ্ধ হতে পারে তার জন্য ইতিহাস বিকৃতি থেকে শুরু করে শিক্ষা-সংস্কৃতির সৎকার করা হচ্ছে। পাঠ্যপুস্তক থেকে বিবর্তনবাদকে তুলে নেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে কুসংস্কারবিরোধী মুক্তমনাদের ‘নাস্তিক’ আখ্যা দিয়ে ছুরি-চাপাতির তলায় নিঃশেষ করে দেওয়া হয়েছে। মৌলবাদীরা কেড়ে নিয়েছে অভিজিৎ রায়, ওয়াসিকুর, রাজীব হায়দার, অনন্ত বিজয়ের প্রাণ। আফগানিস্তান, পাকিস্তানসহ মধ্যপ্রাচ্যের সন্ত্রাসবাদীদের অক্সিজেন জোগান দিচ্ছে ফ্যাসিবাদী শক্তি।
ফ্যাসিবাদ তার পথ করে ধর্মীয় বিদ্বেষকে জীবন-জীবিকার সাথে যুক্ত করে। পুঁজিবাদের নির্মম আক্রমণে, তাদের সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে যে সাধারণ জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়– তারাই শিকার হয় ফ্যাসিবাদেরও। নয়া ফ্যাসিবাদ এই সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে আক্রান্ত জনসাধারণকে শেখায়, বিদেশিরা বা অভিবাসীরাই যাবতীয় সঙ্কটের জন্য দায়ী– তারাই আসল শত্রু। বিগত শতাব্দীর শেষের দিকে ফ্রান্সের লি-পেনের নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল ফ্রন্ট, বহিরাগত এবং অশ্বেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়িয়ে ক্রমশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব, বর্ণবিদ্বেষ-জাতিবিদ্বেষ অনুপ্রবেশের জিগির তুলে নয়া ফ্যাসিবাদের কাছে শুধু ইহুদি আর কমিউনিস্টরাই নয়, শোষিত-নিপীড়িত শ্রেণির মানুষও শত্রুতে পর্যবসিত হয়েছে।
আমাদের দেশও নয়া ফ্যাসিবাদের বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে আছে। হিটলার তার জাতি বিদ্বেষকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করেছে। আমাদের দেশে রাজনৈতিক মতাদর্শ ও ধর্মবিদ্বেষকে নানাভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে। ক্ষমতাবান দাম্ভিক শক্তি সমাজবিরোধী আর লুটেরা ধনীকদের ওপর ভর করে নিজের স্বার্থসিদ্ধির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সমাজে অবক্ষয়, নীতিহীনতা, অসহিষ্ণুতা বাড়ছে। এমনকি প্রতিবাদ-সমালোচনাও অগ্রহণযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। ফলে নয়া ফ্যাসিবাদী মানসিকতা ও সংগঠনগুলো শক্তিশালী হয়ে উঠছে।
যদিও মৌলবাদ, শোষণ ও ধনিকগোষ্ঠীর লুটপাট ইতিহাসের শেষ কথা নয়। লাতিন আমেরিকার দেশে দেশে পরাস্ত হচ্ছে দক্ষিণপন্থী শক্তিগুলো। ওয়ালস্ট্রিটের ১%-এর বিরুদ্ধে ৯৯ শতাংশের লড়াই বিশ্বজুড়েই অব্যাহত। ইতিহাসে যেমন হিটলার আর তার ফ্যাসিস্ট বাহিনী আছে, তেমনি ইতিহাসে আছে লেনিন, মাও, হো-চি মিন। ষাট লক্ষ ইহুদি হত্যা করে মানব সভ্যতার ইতিহাসে পৈশাচিকতার নির্মম দৃষ্টান্ত যারা তৈরি করেছে– সেই ফ্যাসিবাদীদের পরাস্ত করেছে দু-কোটি মানুষের প্রাণের বিনিময়ে সোভিয়েত বীরেরা, পৃথিবীকে করেছে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা।
মানুষের ইতিহাস তো সামনে এগিয়ে চলার ইতিহাস। যারা অধিকার নিয়ে বাঁচতে ভালোবাসে, তারা মাথা তুলবেই। মৌলবাদ, ফ্যাসিবাদ, হিংস্রতা আর পাশবিকতার পথ জুড়ে দাঁড়ায় গণতন্ত্রের পতাকা হাতে নিয়ে। প্রাণ দেয় গণতন্ত্রের জন্য। আজকের লড়াই গণতন্ত্রের জন্য। লড়াই বসন্তের জন্য। ক্ষণিকের ‘আরব বসন্ত’ নয়, বিশ্বব্যাপী চিরকালীন বসন্ত। গণতান্ত্রিক শক্তিই আজ ফ্যাসিবাদের সামনে চ্যালেঞ্জ। হিংস্র পিশাচেরা কোপ মারতে পারে– কিন্তু কণ্ঠস্বর স্তব্ধ করতে পারে না।