বিভেদের রেখা মুছে

মায়ের কোলে সন্তান যেমন নিরাপদ, তেমন নিরাপদ এক শান্তিময় বিশ্বের আকাঙ্ক্ষায় বৈশাখের প্রথম সকালে ঢাকার পথে নামল মঙ্গল শোভাযাত্রা। ডোরা কাটা বাঘ, মেটে রঙা ভেড়া, কালো হাতি, নীল গাই আর সাদা ময়ূর এল মিছিল করে; শিশু কোলে সঙ্গী হলেন টেপা পুতুল মা। মায়ের কোলে সন্তান যেমন নিরাপদ থাকে, তেমনটাই থাকতে চাই আমি, আমরা সবাই।

জেবউননেছাজেবউননেছা
Published : 14 April 2023, 09:05 AM
Updated : 14 April 2023, 09:05 AM

গত শতাব্দীর আশির দশকের শেষের দিককার এবং নব্বুইয়ের দশকের গোড়ার কথা। নেহায়েত কম দিন আগের কথা নয়। তবু মনে হয়, এই তো সেদিনের কথা। ছোট্ট আমি নারায়ণগঞ্জে আমাদের বাসার কাছে দেওভোগ এলাকায় লক্ষ্মীনারায়ণ আখড়া প্রাঙ্গনে বৈশাখী মেলায় যাবার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম। মেলা কবে বসবে এই ভেবে অধীর থাকতাম। আব্বুর হাত ধরে যেতাম। ফিরতাম নানা রকমের খেলনা আর খাবার-দাবার কিনে।

স্মৃতিটা আমার একার নয়। আমি যেমন আব্বুর হাত ধরে যেতাম, শুনেছি একইভাবে আমার আব্বু পঞ্চাশের দশকে তার বাবা মানে আমার দাদুভাইয়ের সঙ্গে এই মেলাতেই যেতেন। আব্বুকে নানান রকমের খেলনা কিনে দিতেন দাদুভাই।  

পহেলা বৈশাখের দিনটি ছিল আমার মতো ছোটদের অপেক্ষার দিন। এখনও অপেক্ষা করি। তবে সঙ্গে যুক্ত হয় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, আতঙ্ক বাড়ে ধর্মের দোহাই দিয়ে ছায়ানটের নববর্ষ বরণ এবং চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা– এসব বন্ধের দাবি ওঠে যখন। গ্রাম-জনপদেও এখন আর আগের মতো মেলা-বান্নি বসে না।

ছোটবেলায় পহেলা বৈশাখের জন্য অপেক্ষা করতাম। কারণ দিনটি ছিল নানা রকমের বাহারি মিষ্টি খাওয়ার দিন। আমার নানা ভাইয়ের নানান রকমের ব্যবসা ছিল। এই দিনকে ঘিরে তিনি কার্ড তৈরি করতেন, কার্ডে লেখা থাকত, শুভ হালখাতা। সকাল সকাল নানা রকমের রঙিন কাগজ দিয়ে সাজানো হতো নারায়ণগঞ্জের নিতাইগঞ্জ এলাকার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো। ভাবতাম কি ‘কোন বা পথে নিতাইগঞ্জ যাই’? নিতাইগঞ্জ নিয়ে ওই গানটার আরও অনেক গূঢ় অর্থ আছে, আমার কাছে এটা এখন ছোটবেলার অনুভূতি হয়ে আসছে। নিতাইগঞ্জের হালখাতায় আমাদের যাওয়া হতো না। আব্বু যেতেন। ফেরার সময় মিষ্টি নিয়ে আসতেন। কী দারুণ ছিল সেই সময়টি। এখনো সেই ধারাবাহিকতা আছে হালখাতা অনুষ্ঠানে।

আমি যে স্কুলটিতে পড়তাম সেখানে আমার বেশিরভাগ সহপাঠী ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বী। তাদের কাছে হালখাতা উদযাপনের গল্প শুনতাম। অনেক সময় সহপাঠীদের বাসায় গিয়ে মিষ্টি খেয়ে আসতাম। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো নারায়ণগঞ্জের যে এলাকাটিতে আমি বড় হয়েছি, সেখানে মাগরিবের আজানের পর পরই কানে ভেসে আসত শাঁখের আওয়াজ, উলু আর ঘণ্টাধ্বনি। এতে আমাদের এলাকার কারোরই কোনো সমস্যা হয়েছে বলে মনে হয়নি, এখনও হয় না। দুর্গাপূজায় বাসার কাছেই নানা রকমের মণ্ডপে রাতব্যাপী গান বেজেছে। আলোকমালার আলোকিত হয়েছি আমরা সবাই। সবই ছিল উৎসবের মতো। এখনো তাই।  

পহেলা বৈশাখ এলেই আমাদের বাসায় রান্না করা হতো নানা রকমের দেশীয় খাবার। এই সংস্কৃতি ধারণ করে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসি। সেখানে দেখতে পাই, মঙ্গল শোভাযাত্রা, রমনা বটমূলে ছায়ানটের গান। মজার ব্যাপার এই যে, এই দিনটিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে বাইরের এত এত মানুষের সমাগমে আমাদের হতো হাসফাঁস অবস্থা। আমরা চাইতাম সবার অংশগ্রহণে পরিপূর্ণতা পাক পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান।

গত কয়দিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখছি পহেলা বৈশাখকে কেউ কেউ হিন্দুয়ানি সংস্কৃতি বলে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালাচ্ছে। কেউ কেউ মঙ্গল শোভাযাত্রায় অমঙ্গলের আশঙ্কা দেখছেন। এই কথাগুলো নিয়ে আলোচনার আগে একটু দেখে নিই মঙ্গল শোভাযাত্রার ইতিকথা। এটা খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, মঙ্গল শোভাযাত্রার গোড়াপত্তন হয় যশোর থেকে, ১৩৯৩ বঙ্গাব্দ অর্থাৎ ১৯৮৫ সালে। চারুপীঠের এই আয়োজনের উদ্যোক্তা ছিলেন শামীম ও হিরন্ময়সহ অনেকে। তাদের মূল থিম ছিল শিল্পী এস এম সুলতানের ছবি এবং কবি আজীজুল হকের কবিতা। তখন স্বৈরশাসন এবং আগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদী সংস্কৃতির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে মঙ্গল শোভাযাত্রা ছিলো প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধ।

পরবর্তীকালে ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউট থেকে যশোরের ওই শোভাযাত্রার মতো শোভাযাত্রা শুরু হয়। যদিও এখন মঙ্গল শোভাযাত্রা সবকিছুকে ছাপিয়ে দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। ১৯৮৯ (১৩৯৬ বাংলা) সালে চারুকলার শিক্ষার্থীরা বর্ষবরণের শোভাযাত্রা বের করার পর পরের বছর তা কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও বরিশালে হয় বলে জানা যায়।

এরপর সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। যদিও প্রথমে আয়োজনটিকে আনন্দ শোভাযাত্রা বলা হতো, ১৯৯০ সালে সঙ্গীতজ্ঞ ছায়ানটের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ওয়াহিদুল হক এর নাম দেন মঙ্গল শোভাযাত্রা। ভাষাসংগ্রামী ও চারুশিল্পী ইমদাদ হোসেনও ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’র সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন নিবিড়ভাবে। এই ইতিহাস যখন রচিত হয়েছিল তখন কিন্তু এসব নিয়ে কেউ মাথা ঘামায়নি। সবচেয়ে বড় কথা তখন তো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অনাচার শুরু হয়নি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রয়োজন আছে, আবার হিংসা-বিদ্বেষ ছড়াবার কাজেও এর ব্যবহার হচ্ছে।  

কয়দিন আগে দেশের বরেণ্য চিত্রশিল্পী হাশেম খানের সঙ্গে নানান বিষয়ে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। হাশেম স্যার এক পর্যায়ে বলেছিলেন, একদিন পান্তাভাত খেলেই বাঙালি হয়ে যাওয়া হয় না। আমাদের যে চিরাচরিত সংস্কৃতি আছে, সেটি পালন করাই হোক আমাদের উদ্দেশ্য। কথাটি আমাকে ভাবিয়েছে ভীষণ। ধরা যাক, বৈশাখী অনুষ্ঠানের গানের আসরে আমরা যদি পশ্চিমা গান শুনি, তাহলে কি বাঙালিয়ানা হলো? 

রাজধানী ঢাকার পাঁচতারা হোটেলে বৈশাখের আয়োজন-অনুষ্ঠান উপভোগ করার সুযোগ হয়েছে কয়েকবার। সেখানে উপভোগ করেছি চিরাচরিত বাংলা গান। খাবারের আয়োজনেও ছিল বাঙালিয়ানা। কিন্তু এই আয়োজন তো সব সময়ের জন্য নয়। একদিনের জন্যই আয়োজিত হয়।

মোদ্দা কথা হলো, আমাদের চোখে যখন যা পড়ছে,আমরা তাই নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ি। কিন্তু অলক্ষ্যে বদলে যাচ্ছে অনেক কিছু।  

ষাটের দশকে রবীন্দ্র সংগীত বন্ধের খড়্গ এসেছিল। তখনকার সময় এক ঝাঁক তরুণ এর বিরুদ্ধে রুখে দাড়িয়েছেন,সাংস্কৃতিক জাগরণ করেছেন। সেই জাগরণেরই অন্যতম প্রধান দৃষ্টান্ত আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ ছিল আমাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং মনস্তাত্ত্বিক জাগরণের ফসল। এই জাগরণের ছিটেফোটা দেখতে পাই না কোথাও এখন। রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনে রাষ্ট্রীয়পর্যায় থেকে বাধ সাধা হয়েছিল। আমরা জানি এরপরের ইতিহাস। রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করা হয়েছিল যথাযোগ্য মর্যাদায়। রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনকে ঘিরে জন্ম হয় ছায়ানটের। কবি সুফিয়া কামাল ছিলেন তাঁর নেতৃত্বে। ওয়াহিদুল হক ও সন্‌জীদা খাতুনরা হয়েছিলেন কাণ্ডারি। রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি এই সাংস্কৃতিক আন্দোলনের স্রোতোধারায় ছিল বাঙালির আত্মানুসন্ধান ও বাঙালির সংস্কৃতির জন্য অব্যাহত সংগ্রাম।

সন্‌জীদা খাতুন আসতে পারেননি এবারের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে। ছায়ানট রমনার বটমূলে বাংলা নববর্ষের প্রভাতে সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করে আসছে সেই ১৯৬৭ সাল থেকে, এর মধ্যে কেবল মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৯৭১ সালে আর করোনা মহামারির কারণে ২০২০ ও ২০২১ সালে রমনা বটমূলে এ অনুষ্ঠান হতে পারেনি। ২০০১ সালে ছায়ানটে অনুষ্ঠানে জঙ্গিরা ভয়াবহ বোমা হামলা করলেও রুদ্ধ করা যায়নি অনুষ্ঠানটিকে। বরং পরের বছর থেকে মানুষের অংশগ্রহণ আরও স্বতস্ফূর্ত হয়েছে। ১৯৬৭ সাল থেকে বর্ষবরণের উৎসবে সন্‌জীদা খাতুন উপস্থিত থাকেননি, এমন হয়নি। নবতিপর সন্‌জীদা খাতুন কয়েক দিন আগে নিজের জন্মদিনের আয়োজনেও থাকতে পারেননি অসুস্থতার কারণে। ছায়ানটের বর্ষবরণের এই উৎসব-আয়োজন, যা আদতে বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনাকে শাণিত করে, তার উদ্যোক্তাদের অনেকেই বিদায় নিয়েছেন।

ছায়ানটের পক্ষ থেকে সমবেত সবাইকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানান রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী লাইসা আহমদ লিসা। বরাবর যে কাজটি করেছেন সন্‌জীদা খাতুন। লিসার কণ্ঠে উচ্চারিত হলো ‘শুভ কর্মপথে ধর নির্ভয় গান। সব দুর্বল সংশয় হোক অবসান। ’

শুরু করেছিলাম, আমার শৈশবের পহেলা বৈশাখের স্মৃতি দিয়ে। এজন্য করেছিলাম যে, দেশে মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে খুব আলোচনা হচ্ছিল, হচ্ছে আজও। মায়ের কোলে সন্তান যেমন নিরাপদ, তেমন নিরাপদ এক শান্তিময় বিশ্বের আকাঙ্ক্ষায় বৈশাখের প্রথম সকালে ঢাকার পথে নামল মঙ্গল শোভাযাত্রা। ডোরা কাটা বাঘ, মেটে রঙা ভেড়া, কালো হাতি, নীল গাই আর সাদা ময়ূর এল মিছিল করে; শিশু কোলে সঙ্গী হলেন টেপা পুতুল মা। মায়ের কোলে সন্তান যেমন নিরাপদ থাকে, তেমনটাই থাকতে চাই আমি, আমরা সবাই। কারণ ব্যক্তিগতভাবে যে সংস্কৃতি ধারণ করে বড় হয়েছি, আমি সেই সংস্কৃতি লালনের পক্ষে। আমার দেশের নাম বাংলাদেশ। এই দেশে সগৌরবে বাংলা নববর্ষ উদযাপিত হবে এটাই স্বাভাবিক। এই উদযাপন নিয়ে যারা প্রশ্ন তুলছেন, তারা নিশ্চয়ই এই বাংলাদেশকে ভালবাসেন না। এই বাংলাদেশ ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তে ভেজা। এই বাংলাদেশ কোন কূপমণ্ডূকতাকে প্রশ্রয় না দেওয়া দেশ। সুতরাং পহেলা বৈশাখ হোক সবার,সার্বজনীন। অথচ এক শ্রেণির মানুষেরা বাংলাদেশের দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাওয়াকে পছন্দ করেন না, ঈর্ষা করেন। যারা পানি পান করেন এই দেশের। কিন্ত কুলি ছিটান অন্য দেশের, এই ধরনের প্রেতাত্মারা একসময় কালের আবর্তে হারিয়ে যাবে। ১৯৭১ এ এসব প্রেতাত্মারা পরাজিত হয়েছিল। এরা হারিয়ে যাবে, রয়ে যাবে আমার লাল সবুজের পতাকা। আসুন দেশকে ভালোবাসি। এই ভালোবাসাই হোক আমাদের শক্তি। আর যারা অনুপ্রবেশকারী, তাদের চিহ্নিত করে, এড়িয়ে চলি, প্রশ্রয় না দেই।

শেষ করব সব্যসাচী কবি সৈয়দ শামসুল হকের লেখা ‘আমার পরিচয়’ কবিতার কয়েকটি চরণ দিয়ে,যে কবিতা আমাকে বারে বারে মনে করিয়ে দেয় আমি বাঙালি; ‘আমি যে এসেছি জয়বাংলার বজ্রকণ্ঠ থেকে/ আমি যে এসেছি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে/ এসেছি আমার পেছনে হাজার চরণচিহ্ন ফেলে/ শুধাও আমাকে ‘এতদূর তুমি কোন প্রেরণায় এলে?’ সৈয়দ হক তার কবিতায় মনে করিয়ে দিয়েছেন, ‘তবে তুমি বুঝি বাঙালি জাতির ইতিহাস শোনো নাই-’। তিনি আমাদের আরও মনে করিয়ে দিয়েছেন বাংলার মধ্যযুগের এক কবি বড়ু চণ্ডীদাসের কথা ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই। ’ তারপর ঘোষণা করেছেন, ‘একসাথে আছি, একসাথে বাঁচি, আজো একসাথে থাকবোই/ সব বিভেদের রেখা মুছে দিয়ে সাম্যের ছবি আঁকবোই।’