সবাই সরকারের সর্বাত্মক সহায়তায় এমপি হতে চান। এটা যে কেবল জোটসঙ্গী দলগুলো চাইছে, তা নয়। কিংস পার্টি এবং সংসদের বিরোধী দল জাপারও চাওয়া এমনটাই।
Published : 13 Dec 2023, 10:54 AM
নির্বাচনে বিএনপির না আসাটা চূড়ান্ত হয়ে যাওয়ার পর এক বন্ধুর সঙ্গে কথা হচ্ছিল নির্বাচনটা এবার শেষতক কেমন হবে, তা নিয়ে। প্রতিপক্ষ না থাকলেও আসছে নির্বাচনে ‘নতুন বৈশিষ্ট্য’ যোগ হবে, এমনটা আগে থেকেই শোনা যাচ্ছিল। সেটা ধরেই আমার প্রশ্ন ছিল, কী সেই বৈশিষ্ট্য? তার জবাব– সরকার ও তার সহযোগীদের মধ্যে ‘ফেয়ার ইলেকশন’ হবে এবার। দলগুলো যে যার মতো আসবে; তাদের মধ্যে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ও থাকবে এবং আওয়ামী লীগের যেহেতু সাংগঠনিক সক্ষমতা অনেক বেশি, তাই তারা সিংহভাগ আসনে ‘ফেয়ারলি’ জিতে যাবে। ভোটের হারও খারাপ হবে না। তার মতে, নির্বাচন আসতে আসতে আন্দোলনও যথেষ্ট শিথিল হয়ে যাবে। সেটা আর হুমকি হয়ে থাকবে না।
আমাদের আলাপ হয়েছিল তফসিল ঘোষণার সময়টায়। তাকে বলছিলাম, এভাবে গুছিয়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনটা সারতে পারলে তো সরকারের জন্য ভালো। কিন্তু এক্ষেত্রে কিছু শর্ত রয়েছে। যেমন, জাতীয় পার্টিকে (জাপা) নির্বাচনে অংশ নিতে হবে। মাঠের বিরোধী দল বিএনপি তো নেই, সংসদের বিরোধী দলটিও নির্বাচনে না থাকলে কেমন হয়? তার জবাব ছিল– জাপা আসবে। ২০০৮ সাল থেকে রাষ্ট্রক্ষমতার সঙ্গে তার সম্পর্কটা গভীর থেকে গভীরতর। আছে এবার একাধিক ‘কিংস পার্টি’ও। তারা তো নির্বাচনে আসার জন্যই গঠিত হয়েছে। এরা চেষ্টা করবে বিএনপির যতখানি পারা যায়– ভেঙে আনতে। আর আছে জোটসঙ্গী। নেতাসর্বস্ব এদের কোনো উপায় নেই নির্বাচনে আসা ছাড়া।
আমাদের আলাপটা পরিবেশগত কারণেই আর এগোয়নি। তাই আলাপ করতে পারিনি– সরকারের সহযোগী দলগুলোর অন্তত নেতাদের জিতিয়ে আনার একটা নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা থাকবে কিনা? এ প্রশ্নে সেই বন্ধুর জবাব বোধহয় হতো, অতি অল্পসংখ্যক আসনে তাদের ধরে রাখার ব্যবস্থা হবে। সংসদে গোটাকতক দলের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের উপস্থিতি তো প্রয়োজন। সঙ্গে তাদের যারা জিতে আসতে পারেন, আসবেন।
এবার আগে থেকে এমন কথাবার্তাও হচ্ছিল যে, বিএনপি শেষতক নির্বাচনে না এলে অন্তত এক-তৃতীয়াংশ আসনে ক্ষমতাসীনরা দলীয় প্রতীক দেবে না। দলের যারা প্রার্থী হতে চান, মুক্তভাবে হবেন। তাদেরকে নিজ ও অন্যান্য দলের প্রার্থীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেই জিততে হবে। এতে দলীয় ভোট ভাগ হয়ে অন্য প্রার্থী জিতে গেলেও সমস্যা নেই। তারাও সরকারের সহযোগী। এর ভেতর দিয়ে নির্বাচনটাকে ‘প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ’ দেখানো যাবে। তাতে এসব আসনে অন্তত ভোটের হার হবে উল্লেখযোগ্য। সেটা প্রভাব রাখবে সারা দেশের ভোটের হারে।
এখন দেখা যাচ্ছে, প্রায় সারা দেশেই আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী আছেন। আছেন ‘ডামি প্রার্থী’ও। আগে কেউ দল থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হলে তাকে ‘বিদ্রোহী’ গণ্য করা হতো; করা হতো বহিস্কার। দলের গঠনতন্ত্রেও এমন বিধান রয়েছে। কিন্তু এবার দল থেকেই বলা হয়েছে, স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া যাবে। এমনকি ডামি প্রার্থী রাখা হবে, যাতে অন্য সবাই মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করলেও কেউ ২০১৪ সালের মতো বিনাভোটে জিততে না পারেন। এ অবস্থায় ডামি প্রার্থী কতজন আছেন, কে জানে! তবে স্বতন্ত্রদের অনেকেই উৎসাহের সঙ্গে আছেন নির্বাচনে।
সারা দেশে ক্ষমতাসীন দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা এবারকার নির্বাচনের ‘নতুন বৈশিষ্ট্য’ বৈকি। সরকারের সহযোগী দলগুলোর নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে আলাপের মধ্যেও অবধারিতভাবে আসছেন তারা। কারণ ওইসব দলের প্রার্থীদের জিতে আসার পথে তারা এক অর্থে সবচেয়ে বড় বাধা। নৌকার প্রার্থীদের চাইলে দল বসিয়ে দিতে পারবে; কিন্তু স্বতন্ত্রদের ক্ষেত্রে কী করা? তারা তো মনোনয়নবঞ্চিত হয়ে নিজ ক্ষমতাবলে প্রার্থী হয়েছেন। এদের অনেকে বর্তমান এমপি; অনেকে পুরনো জনপ্রিয় নেতা। এমপি হওয়ার জন্য দীর্ঘদিন অপেক্ষমাণ অনেকে। কেন তারা সহযোগী দলের কারও জন্য ইচ্ছা বিসর্জন দেবেন?
এসব প্রশ্ন উঠতো না– সরকারের সহযোগী দলগুলোর নেতারা নিজ পায়ে দাঁড়িয়ে ভোট করতে এলে। বাস্তবে তারা বলতে গেলে সবাই সরকারের সর্বাত্মক সহায়তায় এমপি হতে চান। এটা যে কেবল জোটসঙ্গী দলগুলো চাইছে, তা নয়। কিংস পার্টি এবং সংসদের বিরোধী দল জাপারও চাওয়া এমনটাই। জোটসঙ্গীরা এমনকি নৌকা প্রতীকেই ভোট করতে চায়, যাতে কোনো ‘বিভ্রান্তি’ না থাকে। সবাই চাইছেন বিজয়ের শতভাগ নিশ্চয়তা। আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীর অপসারণও তারা চাইছেন। কেননা কমপক্ষে ৯০ শতাংশই জানেন, স্বতন্ত্রদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে জিতে আসার সামর্থ্যও তাদের নেই। যাদের তেমন সামর্থ্য আছে বলে ভাবেন, তারা হয়তো মনে করছেন– সরকারের সবুজ সংকেত না পেলে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড পাবেন না। এতে বিজয় হয়ে থাকবে অনিশ্চিত!
বিরোধী দলবিহীন নির্বাচনে এমপি হওয়ার সুযোগ ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরাও চান নিশ্চয়ই। কিন্তু ‘নিজেরা নিজেরা’ ভোটেও যাদের অবধারিতভাবে হেরে যাওয়ার কথা, তারাও এটা আর কতদিন পাবেন? ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে তাদের সিংহভাগকে এ সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এবারও তারা সেটা চাইবেন কেন, এ প্রশ্ন উঠতেই পারে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডে। তৃণমূল থেকে প্রশ্নটি আরও বেশি করে উঠবে। তাদের অনেকে বলছেন, সরকারের সহযোগী ‘ছোট দলের বড় নেতা’ অনেকেরই তো সুষ্ঠু ভোট হলে জামানতও থাকবে না। তাদের কেন তৃতীয়বারও জিতিয়ে আনতে হবে? বন্ধুর সঙ্গে আলাপে সরকারপক্ষীয়দের মধ্যেকার ‘ফেয়ার ইলেকশনে’র জন্য কিছু শর্তের কথা তুলেছিলাম। এক্ষেত্রে কথা হলো, উল্লেখযোগ্য ভোট না থাকলে সরকারের সহযোগী দলগুলো কি ১৫টি আসনেও জিততে পারবে? তাহলে তো বাকি আসনগুলোয় তারা নির্বাচনই করবে না।
মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের সময় যখন সন্নিকটে– তখন এ কারণেই সংসদের বিরোধী দল জাপা আদৌ নির্বাচনে থাকবে কিনা, সে প্রশ্ন উঠে গেছে। তারা নাকি চায় ৩০-৩৫টি আসনে নির্বিঘ্নে জেতার ব্যবস্থা। ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জাপা পেয়েছিল ৩৫টি আসন। সদ্য ক্ষমতাচ্যুত দল হিসেবে তারা তখন স্বাভাবিকভাবে নির্বাচনে অংশ নিতে পারেনি। তা সত্ত্বেও উত্তরাঞ্চলসহ বিভিন্ন স্থানে তাদের বিজয় ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। সেই জাপার আজ কী অবস্থা! রংপুরেও তাদের জনসমর্থন বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে। বন্ধুর বর্ণনা অনুযায়ী ‘ফেয়ার ইলেকশন' হলে সেখানে নাকি তারা শুধু এরশাদ সাহেবের আসন বলে পরিচিত আসনটিই শুধু পাবেন। এর মধ্যে দলটিতে আবার বিভক্তি সৃষ্টি হয়েছে মনোনয়ন নিয়ে। জয়ের নিশ্চয়তা না পেলে কিংস পার্টি, এমনকি জোটসঙ্গীরাও শেষতক কী করবে কে জানে। সত্যি বলতে, সরকারের সহযোগী কেউই সীমিত পরিসরেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নির্বাচনে থাকার লাইনে নেই। ‘নিজেদের মধ্যে’ নির্বাচনটাও তাহলে ‘ফেয়ার’ হবে কীভাবে?
এ অবস্থায় আওয়ামী লীগ হাইকমান্ডের ওপরই নির্ভর করছে– নির্বাচনটা শেষতক কেমন হবে। তাদের দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভর করছে সহযোগী দলগুলোর সিদ্ধান্তও। নির্বাচনে আসা সব দলকেই যে এ প্রক্রিয়ায় ধরে রাখতে হবে, এমন বাধ্যবাধ্যকতা নেই। যেমন, কিংস পার্টিগুলো আশানুরূপ ভূমিকা রাখতে পারেনি বলে তাদের দিকে আর না তাকালেও চলবে। জাপা যেহেতু দল হিসেবে চূড়ান্ত অবক্ষয়ের মধ্যে রয়েছে, তাই তাকেও আগের মতো গুরুত্ব না দিলে চলবে। জোটসঙ্গীরাও নেতাসর্বস্ব। বাম মহলেও তাদের প্রভাব আর নেই। ‘সমাজতান্ত্রিক’ চীন আর পুতিনের রাশিয়ার সঙ্গেও আওয়ামী লীগের নিজস্ব সম্পর্ক এখন জোরদার। কথিত বাম নেতাদের বিশেষ সহায়তা ও সেবার প্রয়োজন ফুরিয়েছে।
এ অবস্থায় নিজেদের মধ্যেকার ‘ফেয়ার ইলেকশনে’ জিতে আসতে সক্ষম দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের অন্তত এক-তৃতীয়াংশ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ রাখতে পারে সরকার। এতে দলীয় মনোনয়ন কতখানি সঠিক হয়েছে, তারও একটা পরীক্ষা হয়ে যাবে। নৌকা ও নিজ দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্রতিযোগিতায় ভোটের হারও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এমনি ধারার ভোটে অন্তত ৮০ শতাংশ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত কিংবা তার স্বতন্ত্র প্রার্থী জিতবেন বলেই ধারণা। ১৫ বছরের টানা শাসনে তাদের ভোট কমলেও খুব কমেছে বলে মনে হয় না। নিজেদের মধ্যে ‘ফেয়ার ইলেকশনের’ ব্যবস্থা করতে পারলে অন্তত ওই এক-তৃতীয়াংশ আসনে ‘সুইং ভোটারদের’ একাংশকেও কেন্দ্রে আকর্ষণ করা যেতে পারে।
সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছিল, এবারের নির্বাচন আগের দুটির মতো হবে না। এখন বিএনপির অনুপস্থিতিতে আসছে নির্বাচনটাও আগের মতো হবে– সহযোগী দলগুলোকে কোলে করে জিতিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হলে। এসব করে নির্বাচনকে ‘অংশগ্রহণমূলক’ দেখানোরও কোনো মানে হয় কি? ক্ষমতাসীনরা ক্রমে ‘নতুন ধরনের গণতন্ত্র চর্চা’র মডেলে চলে যাচ্ছেন বলে অনেকে মনে করছেন। এর ঝুঁকির দিক নিয়েও কম আলোচনা হচ্ছে না। এ অবস্থায় সংসদে বিরোধী দল হিসেবে কাদের উপস্থাপন করা হবে, সেটাও প্রশ্ন। এবারকার নির্বাচনে নিজ দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বিপুল উপস্থিতি ও শক্তিশালী অংশগ্রহণ এক্ষেত্রে নতুন ভাবনার সুযোগ করে দিচ্ছে কিনা, সেটা দেখার জন্যও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। এর মধ্যে পরিস্থিতি স্পষ্ট হবে নিশ্চয়ই।