ন্যূনতম আন্তর্জাতিকতাবোধ থাকলে সে বলত নজরুল উপমহাদেশের তো বটেই, বিশ্বের প্রথম র্যাপ মিউজিকের স্রষ্টা। প্রথম র্যাপার। প্রকৃতই গারদভাঙার গান লিখেছেন তিনি।
Published : 12 Nov 2023, 06:26 PM
বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিপ্লবী সংগীত ‘কারার ঐ লৌহকপাট’ নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশে চলছে তোলপাড়। অবিস্মরণীয় এই গানটি সম্প্রতি নতুন করে সুরারোপ করেছেন ভারতের বিখ্যাত সুরকার এ আর রহমান। নতুন এই সুরের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছে উভয়বঙ্গে সাধারণ বাঙালি থেকে শুরু করে বুদ্ধিবৃত্তিক গোটা সমাজ। ইতিমধ্যেই রহমানের বিরুদ্ধে মামলার হুমকিও শুনা যাচ্ছে। বিপ্লবী এই গানটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাঙালিসহ অবিভক্ত ভারতীয়দের বিপ্লবী আবেগ। স্বয়ং নজরুলের আরোপিত সুরের বাইরে রহমানের সুরকে মেনে নিতে অনিচ্ছুক নজরুল-অনুরাগীরা। অন্যদিকে, শিল্প বিনির্মাণের মধ্য দিয়ে কালান্তরের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। পূর্ববর্তী শিল্পকে পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমেই গড়ে ওঠে নতুন আরেক শিল্প। কিন্তু নজরুলের এই গানের ক্ষেত্রে আসলে কী ঘটেছে? শিল্পের এই শর্ত কতটা লঙ্ঘিত হয়েছে? এই গানের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটই বা কী ছিল? এটি কি শুধুই এক বিপ্লবী গান? গানের জগতে এর কি আরও অন্য কোনো বৈশিষ্ট্য ছিল যা অভিনব এবং প্রবর্তকের ভূমিকা পালন করেছে? বিডিনিউজটোয়েন্টিফোর ডটকমের সাথে সাম্প্রতিক এক আলাপে এসব প্রশ্নেরই উত্তর দিয়েছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিভাগের অতিথি অধ্যাপক এবং ব্লুমসবেরি থেকে প্রকাশিত কাজী নজরুল ইসলাম'স জার্নালিজম, এ ক্রিটিক নামক গবেষণাগ্রন্থের রচয়িতা নজরুল-গবেষক অর্ক দেব। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক রাজু আলাউদ্দিন।
পরিচিতি
অর্ক দেব-এর জন্ম ১৯৯০ সালের অক্টোবর মাসে কোলকাতায়। পেশায় সাংবাদিক। বর্তমানে ইনস্ক্রিপ্ট নামক একটি গণমাধ্যমে সম্পাদক হিসেবে কর্মরত। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিভাগের অতিথি অধ্যাপক তিনি। অতীতে কাজ করেছেন আনন্দবাজার পত্রিকা, নেটওয়ার্ক ১৮, এশিয়ানেট-এর মতো সংস্থায়। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক প্রকাশনা ব্লুমসবেরি থেকে প্রকাশিত হয়েছে অর্ক'র গবেষণাগ্রন্থ- কাজী নজরুল ইসলাম'স জার্নালিজম, এ ক্রিটিক৷ সাংবাদিক পরঞ্জয় গুহঠাকুরতার সঙ্গে জুটি বেঁধে অর্ক লিখেছেন- ফেসবুক: মুখ ও মুখোশ নামের একটি অন্তর্তদন্তমূলক গ্রন্থ। মান্দাস থেকে প্রকাশিত অর্কর উপন্যাস- দিয়েগো থেকে মারাদোনা পাঠকমহলে বিপুলভাবে সমাদৃত। করোনাকালে ‘তবুও প্রয়াস’ থেকে প্রকাশিত হয় অর্কর প্রবন্ধগ্রন্থ- অসুখী সময়ের বৃত্তান্ত। ষাট দশকের উল্লেখযোগ্য বাঙালি কবি তুষার রায়ের সামগ্রিক লেখালেখি এক জায়গায় করে অর্ক গড়ে তুলেছেন তুষার। তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থ কথাবার্তা ধরে রেখেছে বাঙালির ১০০ বছরের উল্লেখযোগ্য কথপোকথন। অর্ক সম্পাদিত আরেকটি গ্রন্থ গণিকাসম্বাদ, পশ্চিমবঙ্গের তামাম যৌনপল্লির ইতিহাস ও বর্তমানের দলিল। বলিউড পরিচালক তিগমাংশু ধুলিয়ার দলে গবেষক হিসেবে কাজ করেন অর্ক। ইদানিং পডকাস্ট করছেন।
অর্ক দেব, কারার এই লৌহ কপাট গানটির ইতিহাসটা সম্পর্কে কিছু বলুন।
নজরুল সেনবাহিনী থেকে কলকাতায় ফেরেন ১৯২০ সালের মার্চে। ১৯২০ সালের জুলাই মাস থেকে ‘নবযুগ’ নামে একটি সান্ধ্য দৈনিক পত্রিকা সম্পাদনা করতেন নজরুল ইসলাম ও মুজফফর আহমেদ। ১৯২১ সালের ডিসেম্বরে স্বদেশী কাজকর্মের জন্য দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন গ্রেফতার হন। তাঁর স্ত্রী বাসন্তী দেবী তখন চিত্তরঞ্জনের কাগজের দায়িত্ব নেন। তাঁর অনুরোধেই এই কবিতাটি লেখেন নজরুল। 'ভাঙার গান' শিরোনামে 'বাঙ্গলার কথা' পত্রিকায় এটি প্রকাশিত হয় ২০ জানুয়ারি ১৯২২ সালে। অর্থাৎ ধরে নেওয়া যায় গানটি লেখা ১৯২১ সালের ১০ ডিসেম্বর-১৯২২ সালের ২০ জানুয়ারির মধ্যে কোনো একদিনে। মুজাফফর আহমেদের বর্ণনা অনুযায়ী খুব অল্প সময়ের মধ্যে এটি লেখা। গানটি খুব অল্প সময়ে সুর দেওয়া, বোঝা যায়। কারণ চিত্তরঞ্জন-সহ বহু স্বাধীনতাসংগ্রামী জেলে গানটি গাইতেন। ১৯২৪ সালের অগাস্ট মাসে ভাঙার গান নামে নজরুলের কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। বিষের বাঁশী, প্রলয়শিখা, যুগবাণীর মতো ভাঙার গান-ও বাজেয়াপ্ত করে ব্রিটিশ পুলিশ। ২৫ বছর গানটি স্রেফ বাঙালির স্মৃতিতে ছিল। বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ বের হয় ১৯৪৯ সালে, ন্যাশানাল বুক এজেন্সি থেকে। ওই বছরই গিরীন চক্রবর্তী গানটি রেকর্ড করেন কলম্বিয়া থেকে। জুন মাসে এই রেকর্ড হয়। সে বছর নভেম্বরে মুক্তি পাওয়া সিনেমা ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন’-এ এই গানটি ব্যবহৃত হয়। অনেকে প্রশ্ন করছেন এই গানটি নজরুলের সুর দেওয়া, তার প্রমাণ কী? আমি দুটো উত্তর দেব, সমরবাদ্যের মেজাজ রেখে, দ্রুত দাদরা বা ঝুমুরে এই একটি গানই নয়, বেশ কিছু গান রচনা করেছেন নজরুল। দ্বিতীয়ত, কলম্বিয়ার রেকর্ডে বা ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন’ ছবিটির বুকলেটে অন্য কোনো সুরকারের নাম নেই। কলম্বিয়ার রেকর্ডে সুরকার হিসেবে জ্বলজ্বল করছে নজরুলের নাম।
যেকোনো শিল্পই বিনির্মাণে বাঁচে। তাই যদি হয় তাহলে এ আর রহমানও তাই করেছেন। তারপরেরও কেন এ নিয়ে আপত্তি?
দেখুন, আমি বিশ্বাস করি যে কোনো শিল্প বাঁচে আবিষ্কারে, অনুসন্ধানে। ধরে নেওয়া যাক, একজন মানুষ একটি নতুন অনুভূতির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। তা প্রেম হতে পারে, বিরহও হতে পারে। সেই মুহূর্তে তার মনে আসছে রবীন্দ্রনাথের একটা গান। অথবা একজন শিল্পী রবীন্দ্রনাথের গান গাওয়ার সময় প্রতিটি শব্দ অনুভব করছেন। আসলে কিন্তু দুজনেই গানের আয়ু বাড়িয়ে দিচ্ছেন। গানটিকে নতুন করে আবিষ্কার করছে। আর বিনির্মাণ অনুসন্ধানের কৌশল মাত্র। ধরুন, মাইকেল মধুসূদন দত্ত মেঘনাদবধ কাব্য গ্রন্থে রামায়ণ বিনির্মাণ করেছেন। এতে গল্পটিকে বোঝার নতুন দৃষ্টিকোণ পাওয়া গেল। ভেবে দেখলে ‘কারার ওই লৌহ কপাট’ গানটি রহমান বিনির্মাণ করেননি। কারণ এই নতুন নির্মাণটি আদি নির্মাণের ইতিহাসটিকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে। মনে হয় কেউ যেন সস্তার রবারে মূল দাগটিকে ঘষে ঘষে মুছে ফেলছে। এই নতুন নির্মাণটির জন্য পুরনো নির্মাণটির আয়ু ক্ষয় হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যাচ্ছে। মেঘনাদবধ কাব্য কিন্তু রামায়ণকে মুছে ফেলতে পারবে না, চাইবেও না। যদি কোন ডেথ মেটাল ব্যান্ড ‘কারার ওই লৌহ কপাট’ গানটি গাইত, গারদ ভাঙার অভিব্যক্তি বোঝাতে, রণভেরীর ব্যঞ্জনাকে তুলে আনতে যদি নানা অত্যাধুনিক যন্ত্রানুষঙ্গ (তালবাদ্য) ব্যবহার হতো, আমি খুশি হতাম। কোনো অভিযোগ থাকত না।
এই গানটা নজরুলের অন্য গান থেকে কোথায় আলাদা বলে মনে করেন?
আপনি যদি পশ্চিমের ইতিহাস দেখেন, তাহলে দেখবেন সত্তর দশক থেকে হিপহপ বা র্যাপ মিউজিক ব্যবহৃত হয়েছে রাজনৈতিক শিল্প হিসেবে। বর্ণবাদ বিরোধিতার হাতিয়ার হয়েছে এই ধরনের গান। কল্পনাপ্রবণতা, হৃদয়ের সূক্ষ্ম অনুভূতি এক্ষেত্রে তত বড় নয়। বরং এই ধারা ব্যবহার করা হয়েছে সত্তা প্রতিষ্ঠা করতে। শরীরের সঙ্গে এই গান মিশে আছে। আমি কালো, আমাকে তুমি মোষের সঙ্গে তুলনা করো। কিন্তু আমি আছি, আমি থাকব, তুমি টিটকিরি দিয়ে, মেরে, দাসের মতো খাটিয়ে আমাকে নিশ্চিহ্ন করতে পারবে না-- নিগ্রো শব্দটি তুমি আমায় অপমান করতে বলছ, কিন্তু ওটাই আমার মাথার মণি- বারবার এই ধরনের 'ক্রাই' ( চিৎকার অর্থে) দেখা যায় র্যাপে। যে গাইছে শরীরে সে গানের ধাক্কাটা অনুভব করবে। অনুপ্রাস, দ্রুত লয় মিশিয়ে একধরনের ধাক্কা তৈরি করা হয় এ ধরনের গানে।
এবার নজরুলের ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ চালিয়ে শুনুন। দেখবেন অ্যাড্রিনালিন ছুটছে। পেশি ফেটে যেতে চাইছে। বাঙালি এই ব্যাপারটাকে একসময় ছোট করত। আসলে সে মায়োপিক। ন্যূনতম আন্তর্জাতিকতাবোধ থাকলে সে বলত নজরুল উপমহাদেশের তো বটেই, বিশ্বের প্রথম র্যাপ মিউজিকের স্রষ্টা। প্রথম র্যাপার। প্রকৃতই গারদভাঙার গান লিখেছেন তিনি।
এক সময় বিশ্বভারতী দেবব্রত বিশ্বাসের কন্ঠ রোধ করেছিল, আপনারা কি আবারও সে রকম আরেকটি দৃষ্টান্ত তৈরি করছেন?
যেভাবে রহমানের শাস্তি চাইছেন একদল শিল্পী, তাতে এমনটা মনে হওয়ার কারণ থাকছে। আসলে এগুলি এক ধরনের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া। মাথা কাটার অভ্যেসটা বজায় রাখা, দক্ষিণপন্থারই নামান্তর। যারা শাস্তির কথা বলছেন তারা নজরুলের জন্য কী করেছেন? কলকাতায় যে বাড়িতে নজরুল বিদ্রোহী কবিতাটি লিখেছেন, সেই বাড়ি একজন মারোয়াড়ি লাল টাইলসে মুড়ে দিয়েছেন, ভেঙেগড়ে নিয়েছেন রহমানের মতো করে। সে বাড়ি দেখলে চোখে ব্যথা করবে আপনার। ইতিহাসটা জানলে লজ্জায় মাথাকাটা যাবে, কই কেউ প্রতিবাদ করেছেন? ক'টা প্রতিবেদন দেখেছেন? নজরুল রচনাসমগ্র ভয়াবহ অসম্পাদিত, সম্পাদনার যুক্তি অতি দুর্বল, বানানসাম্য প্রতিষ্ঠা হয়নি বহুক্ষেত্রে, বহু রচনা অগ্রন্থিত থেকে গিয়েছে, ফ্যাকসিমিলি পাওয়া যায়নি, টীকাটিপ্পনী ভ্রান্তিতে ভরা, ডিজিটাল পরিসরেও যথাযথ সংরক্ষণ নেই। ক'জন এগিয়ে এসেছেন? যারা শাস্তি প্রার্থনা করছেন এ ব্যাপারে তাদের কন্ট্রিবিউশন কী! আসলে বুঝতে হবে এটা শাস্তির বিষয়ই নয়। এটা নীতির প্রশ্ন, ইতিহাসবোধের প্রশ্ন। শাস্তি দিয়ে যদি ইতিহাসবোধ তৈরি করা যেত তবে বিশ্বের চেহারাট আজ অন্যরকম হতো।
রহমান সম্ভবত বাংলা জানেন না। কিন্তু এই সুরে যারা এই গানটি গেয়েছেন তারা তো বাঙালি। তাদের কি দায়িত্ব ছিল না এই গানটির ইতিহাস, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং আদি সুর সম্পর্কে রহমানকে অবহিত করার?
বাঙালি দায়িত্ব নিতে ভালবাসে না। চরিত্রগত ভাবেই সে সংরক্ষণবিমুখ। তথ্যজোগাড়কে সে ছোট চোখেই দেখে। ধরুন আমাদের ভাষাটাকে গড়তে যে মানুষটা প্রাণ দিল, আমরা যদি সেই বিদ্যাসাগরের লেখার কিছু ফ্যাকসিমিলি দেখতে চাই, এক ক্লিকে, পাব? অথচ কাজটা তো কঠিন না। রবীন্দ্রনাথের যে গানটা আমি গাইছি, তার মর্ম বুঝে, তা সম্পর্কে জেনে গাওয়াটা তো কঠিন নয়, ক'জন করেন? দেখবেন একটা বিষাদের গান হেসে হেসে গাইছেন শিল্পী। আপনি গানটায় প্রবেশই করতে পারবেন না। নজরুলের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। যে বাঙালিরা এ কাজে জড়িত ছিলেন, নজরুল তো তাদেরই আত্মার আত্মীয়। একজন মালয়ালি কবির অপমান হলে একজন মালায়লম ভাষাভাষী ছেড়ে দেবে না। বাঙালি সেক্ষেত্রে হেসেহেসে দাসখত দিয়ে আসে অর্থ-যশের লোভে। আসলে আমাদের ইতিহাসটাই তো বিট্রেয়ালের। আমরা রবার্ট ক্লাইভের চরবৃত্তি করেছি। সিরাজের পতন হলে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠার আনন্দে উৎসব করেছি।
এই একটা গান দিয়ে কি নজরুল সংস্কৃতি বাঁচানো বা পুনরুদ্ধার করা যাবে?
না, যাবে না। এমনকী জাতীয় কবির তকমাও তাকে বাঁচাবে না। তাছাড়া সোশ্যাল মিডিয়ায় যারা সরব নজরুল সংস্কৃতি নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। এটা তাদের টাইমপাস। যে কোনো শিল্পীর মতোই নজরুলের থাকা না থাকা নির্ভর করে সিরিয়াস চর্চার উপর। তকমা, গর্জন, মুণ্ডপাতের সঙ্গে তাঁর অস্তিত্বের কোনো সম্পর্ক নেই। আর সিরিয়াস চর্চার জায়গা থেকেই রহমানের কাজটা আপত্তিকর। এটা কন্টেক্সচুয়াল গান। কন্টেক্সটের বাইরে তাকে ফুলগাছ হিসেবে পথের ধারে বসিয়ে রাখা যায় না।
নজরুলের গান নিয়ে অভিযোগটা কেবল সুরকার এ আর রহমানের বিরুদ্ধেই তোলা হচ্ছে। কিন্তু যে-সিনেমায় এই গানটি ব্যবহৃত হলো সেই সিনেমার প্রযোজক ও পরিচালক এবং গায়করাও কি অভিযুক্ত হতে পারেন না?
আমি আপনার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত। আসলে সংশ্লিষ্ট সকলেই এই বিকৃতির জন্য দায়ী। কিন্তু ঘটনা হলো বাকিদের কেউ চেনে না। রহমান আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিল্পী। ফলে তিনি সহজ টার্গেট। নজরুলের পরিবারের কেউ যদি এই গানটি গাওয়ার অনুমতি দেন, গানটির এই ভার্সনটি শুনেও যদি সেই অনুমতি ফিরিয়ে না নেয়, তবে দায় তাদেরও।
বরেণ্য লেখক অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও অনুবাদক চিন্ময় গুহ সাম্প্রতিক নজরুল-ঝড় বয়ে প্রসঙ্গে বলেছেন: “সাম্প্রতিক কালে যে নজরুলগীতিটি বিশেষ গায় নি কেউ, মৌলবাদী দক্ষিণপন্থী, বামপন্থী তথা যাবতীয় শাসক ক্ষুব্ধ হবে বলে, হঠাৎ এক খড়কুটো পেয়েছে আপন বিস্মৃত বাঙালিত্ব যদি ফিরে পাওয়া যায়। নজরুল এক উপলক্ষ মাত্র। ” এ তো ঠিকই যে নজরুলের প্রতি যে-মনোযোগ দেয়া উচিত ছিল, তাকে আমাদের লড়াইয়ের প্রধান হাতিয়ার করে নেয়া উচিত ছিল মৌলবাদ, সামাজিক অবিচার, নিপীড়ক শাসকদের বিরুদ্ধে, আমরা তা করিনি। এ বিষয়ে আপনার কী অভিমত?
শ্রদ্ধেয় চিন্ময় গুহর সঙ্গে আমি সহমত। তবে বাঙালি বাঙালিত্ব ফিরে পেতে চাইছে- এই কথাটাও তাঁর ওভারএস্টিমেট। আমাদের সময়ের বাঙালি বাঙালিত্ব ফিরে পেতে চায় না৷ এ বিষয়ে তার ভাসাভাসা আবেগ আছে, কিন্তু কোনো বুঝে নেওয়া নেই। কলকাতা শহরে, শিয়ালদহ বা স্টেশনে যে কটা দোকানের সাইনবোর্ড দেখবেন তার ৯৫ ভাগই ইংরেজি হরফে। ঢাকাতেও তাই। ভাষা নিয়ে যারা টেলিভিশনে বা সংবাদমাধ্যমে জ্ঞান দেন তাদের সবার ছেলেমেয়ে ইংরেজি স্কুলে পড়ে। কেউ বলতে পারে দেশি স্কুলের পরিকাঠামো খারাপ। কিন্তু পরিকাঠামো ভালো করার জন্যে কি আমরা কোনো আন্দোলন করেছি? চ্যারিটি বিগিনস অ্যাট হোম। বাংলা ভাষাকে, বাঙালিয়ানাকে বেশির ভাগ মানুষ করুণা করে। ভাষাটা জোরালো ভাবে শেখার চেষ্টা করে না। দাড়ি কমা সেমিকোলনের প্রয়োগ, বানান, ব্যকরণ, ভাষার চলন শেখা কঠিন সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া। এটা ব্যাড ইনভেস্টমেন্ট, কেউ জড়ায় না এতে। ভাষাটাকে আর্থিক কাঠামো দেওয়ার কথা কেউ ভাবে না। দেখবেন, একজন লেখার লোক কেউ লেখা চাইছে দেখলেই খুশি, সে লিখে টাকা চায় না। কেন চায় না? কারণ সে জানে অর্থলাভের জন্য যে স্কিল দরকার তা তার নেই, এত সময় ভাষাটাকে দেবেন না। সম্পাদক ছেপে দয়া করছে তাকে। সম্পাদকও জানে এই ব্যাপারটা। এখন দয়া তো ভালবাসা নয়। দয়া চিরকালীনও নয়। এখন নজরুলকে নিয়ে যা দেখছেন, তা কুম্ভীরাশ্রু, চিন্ময় গুহ ঠিকই বলেছেন। এই নুডল রান্না জাতের আবেগের কোনো গভীরতা নেই। নজরুলের লেখায় আরবি-ফারসির ব্যবহার, তার গানে সুরের বিরল প্রয়োগ নিয়ে কার মাথাব্যথা আছে!
সঞ্চিতা সান্যাল নামে একজন মন্তব্য করেছেন “বাঙালি বেছে বেছে প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে। যেখানে মুখ খুললে তার মাথা যাবার ভয় নেই, সেখানে তার মতো মুখর আর কাউকেই পাওয়া যাবে না।” আপনিও কি তাই মনে করেন?
এই ব্যাপারটায় আমার একটু বিরোধাভাস থাকবে। প্রতিটি বিষয়ের অভিঘাত একজন মানুষের উপর সমান ভাবে পড়বে--এমনটা ভেবে নেওয়া একটু জোর করে চাপিয়ে দেওয়া নয় কি? এটাকে ইংরেজি পরিভাষায় হোয়াটঅ্যাবাউটরি বলে। ধরা যাক, একজন লেখক তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠানবিরোধী বলেন। এমনিতে তিনি গৃহী, স্ত্রী সন্তান চাকরি নিয়ে সুখের সংসার। তার মানে কী? তিনি লেখার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের সাহায্য নেননি, কিন্তু চাকরি, সংসারের মতো প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করেছেন। এটা তার সচেতন চয়েস। এক্ষেত্রে কি তিনি ৩৬০ ডিগ্রি প্রতিষ্ঠানবিরোধী হয়ে উঠলেন? সন্ত ছাড়া কেউই কি তা পারে? সাধারণ মানুষের থেকে সাধুর দৃষ্টি কেন আশা করব? আঁতে ঘা লাগলে শব্দ বেশি হবে সেটাই কি স্বাভাবিক নয়? তবে একথাও ঠিক, বেঁচে থাকাটা ক্রিটিকাল হলে ব্রেন পুষ্টি পায়, ব্রেন কিছু কাজ পায়। সোশ্যাল মিডিয়ায় অধিকাংশ মানুষই আক্রমণ শানায়, চোর পেটানোর সুখে। পাশাপাশি এটাও ভাবতে হবে, রেজিস্ট্যান্স একটা বায়োলজিকাল ব্যাপার। কাউকে দুষে, কারও উপর চাপিয়ে দিয়ে এটা তৈরি করা যায় না।
আপনি দীর্ঘদিন ধরে নজরুল নিয়ে গবেষণা করে আসছেন। নজরুলকে নিয়ে ইংরেজিতে আপনার অসামান্য একটি গ্রন্থ বেরিয়েছে সম্প্রতি। আপনি নজরুল বিষয়ক এক সাম্প্রতিক লেখায় কোলকাতায় নজরুলস্মৃতির বিলোপ নিয়ে একটা লেখা লিখেছিলেন। কোলকাতায় কিংবা আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক বৃত্তে, এমনকি পাঠক শ্রোতাদের মধ্যেও তার পুনর্বাসনের সম্ভাবনা বা প্রয়োজন কতটুকু বলে আপনি মনে করেন?
আমি সম্প্রতি জেনেছি, ওরহান পামুক নজরুল-ভক্ত। তাঁর লেখা থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছেন। এ কথা পামুক নিজেই বলেছেন। বুঝতেই পারছেন, সোনা চেনে জহুরি। আমি একাধারে পামুক-ভক্ত, আবার নজরুলের কাজের প্রতিও অনুরক্ত। হঠাৎ এই তথ্য পেয়ে তাই স্মম্ভিত হয়ে গেলাম। আমার বইটিতে আমি দেখিয়েছি কী ভাবে আন্তর্জাতিক পরিবেশ ভাবনা, বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলন, শ্রমিক-কৃষকের অধিকার রক্ষা, ধর্মনিরপেক্ষতার ভাবনার সঙ্গে নজরুল সম্পৃক্ত। এই বইটিতে নজরুলের এমন বহু লেখা আছে যা আমরাই প্রথম ইংরেজিতে অনুবাদ করেছি। কিন্তু নজরুল নিয়ে বহু মানুষের একজীবনের কাজের পরিসর পড়ে আছে। সেই কাজ অনুদান, গ্রান্ট, অনেকের সদিচ্ছা ছাড়া করা সম্ভব নয়। একদিকে তাঁকে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে নতুন নতুন আঙ্গিকে। অন্য দিকে আন্তর্জাতিক স্তরে ক্রমে তাকে নতুন সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করতে হবে। একেই তো বিনির্মাণ বলে। পাওয়ার পোয়েট্রির ভাটিয়ালি হয়ে যাওয়াটা বিনির্মাণ নয়। লেখার দিক থেকে যদি বলি, নজরুলচর্চার ক্ষেত্রে দু'দিকেই এক ধরনের ঔদাসীন্য দেখা যায়। পাঠক জন্মদিনের ফিচার পড়েই খুশি। লেখকও প্রতিবছর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে একই কথা লেখেন। এত কোটি বাংলাভাষী, প্রতি বছর পাঁচটি মৌলিক কাজ না হলে, সেই কাজ দু'বাংলা জুড়ে এক লক্ষ পাঠক চর্চা না করলে, থাকা না থাকা সমান নয় কি?