বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩০ বছর ও কর্মমুখী শিক্ষার বাস্তবায়ন

প্রবাসী বাংলাদেশি রেমিটেন্স যোদ্ধাদের জন্যও বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় দেশের বাইরে শিক্ষা প্রোগ্রাম চালু করেছে।

সৈয়দ হুমায়ুন আখতারসৈয়দ হুমায়ুন আখতার
Published : 20 Oct 2022, 03:48 PM
Updated : 20 Oct 2022, 03:48 PM

বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ৩০ বছর হয়ে গেল। শিক্ষার সাথে কর্মসংস্থানের যোগসাজশ তৈরির লক্ষ্যে ১৯৯২ সালের ২১ অক্টোবর জাতীয় সংসদে ১৯৯২ সনের ৩৮ নং আইন অনুযায়ী প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়। ভৌগোলিক সীমারেখা ছাড়িয়ে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম দেশে ও বিদেশে ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করেছে।

বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নে প্রয়োজন কর্মমূখী শিক্ষা এবং কর্মক্ষেত্রে প্রয়োজন শিক্ষিত ও দক্ষ জনশক্তি। বাউবি-র ৩০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে সবার জন্য উন্মুক্ত কর্মমুখী, গণমুখী ও জীবনব্যাপী শিক্ষা বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছে।

সমাজের অবহেলিত নর-নারী, গৃহবধু, বেকার যুবক-যুবতী, ঝরে পড়া শিক্ষার্থী, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠী, কর্মজীবী, শিক্ষা সুযোগ বঞ্চিত, শিক্ষা লাভে আগ্রহী বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত এবং প্রান্তিক ও দুর্গম অঞ্চলের জনগোষ্ঠীকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সাহায্যে হাতের নাগালে শিক্ষার সুযোগ করে দেয়ার লক্ষ্যে বাউবিতে নানামুখী কর্মকাণ্ড গ্রহণ করা হয়েছে।

উদ্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর মাঝে বাউবি-র শিক্ষা সেবা পৌঁছে দিয়ে কর্মমুখী শিক্ষায় দক্ষতা বৃদ্ধি করে জনসংখ্যাকে জনসম্পদে রূপান্তরের মাধ্যমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রূপকল্প ২০৪১ বাস্তবায়নে বাউবি অঙ্গীকারাবদ্ধ। বঙ্গবন্ধুর সার্বজনীন শিক্ষানীতির আলোকে শিক্ষাকে গণমুখী করণ এবং দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে বাউবি কর্মমুখী শিক্ষা নিয়ে নিরলস কাজ করছে। তিনি বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের সেবা প্রদানে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন।

দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা বিবেচনা করে বাউবিতে নিডবেইজ প্রোগ্রাম চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এবং পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য কর্মসংস্থান তৈরিতে চাকরি, ব্যবসা এবং উদ্যোক্তা তৈরি বাউবি-র শিক্ষা প্রোগ্রামের অন্যতম লক্ষ্য। সময়ের চাহিদার সাথে মিল রেখে চলমান শিক্ষা প্রোগ্রামগুলোকে বিশ্বমানের করতে নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই বাউবি এগিয়ে যাচ্ছে। প্রয়োজনে অ্যাকাডেমিক প্রোগ্রামগুলোকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনাও রয়েছে।

প্রবাসী বাংলাদেশি রেমিটেন্স যোদ্ধারা বাউবি-র মাধ্যমে শিক্ষা লাভ করে যাতে সেখানে আত্মমর্যাদা নিয়ে বাঁচতে পারেন এবং পারিবারিক ও সামাজিকভাবে উন্নত জীবন-যাপন করতে পারেন, এজন্য বাউবি দেশের বাইরে শিক্ষা প্রোগ্রাম চালু করেছে। ইতোমধ্যে দক্ষিণ কোরিয়া, কাতার ও সৌদি আরবে বাউবি-র শিক্ষা প্রোগ্রাম চলমান রয়েছে। রেমিটেন্স যোদ্ধাদের বাউবি-র শিক্ষায় দক্ষ করে দেশের জিডিপি বৃদ্ধি করা সম্ভব।

বুদ্ধিমত্তার প্রভাবে আমাদের জীবনযাত্রা এবং ধ্যান ধারণা প্রতিনিয়ত পাল্টে যাচ্ছে। আমাদের চ্যালেঞ্জ এখন অনেক বেশি, স্মার্ট ফোনের কারণে সারা বিশ্ব এখন হাতের মুঠোয়। তবে আকাশ সংস্কৃতি এবং স্মার্টফোনের নানাবিধ উপাদানের কারণে আমাদের শিশু ও যুব সমাজের অনেকেই বিপথে চলে যাচ্ছে। ফলে তাদের সুকুমারবৃত্তি চর্চা, খেলাধূলা, সংস্কৃতিচর্চা, বইপড়া, ধর্মীয় শিক্ষা, পারিবারের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ ও মূল্যবোধ তৈরিসহ নানাবিধ বিষয় নিয়ে বাউবি বিভিন্ন অ্যাপস তৈরির চিন্তা ভাবনাও করছে। তথ্য প্রযুক্তি যে গতি ও প্রযুক্তিতে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদেরকেও সেই গতিতে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণে শিক্ষার মান উন্নয়নের মাধ্যমে এগিয়ে যেতে হবে। এর জন্য ভালো টিম ওয়ার্ক ও গতি নিয়ে কাজ করতে হবে।

প্রযুক্তির দ্রুত বিস্তারের সাথে সাথে প্রয়োজন মানসম্মত কর্মমুখী শিক্ষা। কর্মমুখী শিক্ষার মাধ্যমে জনশক্তিকে জনসম্পদে রূপান্তর করে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও দর্শনকে মনেপ্রাণে ধারণ করে ব্যক্তিস্বার্থের উর্ধ্বে থেকে সততা ও নিষ্ঠার সাথে ঐক্যবদ্ধভাবে নিজ নিজ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনের মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর রূপকল্প ২০৪১ বাস্তবায়ন সম্ভব।

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের এই যুগে বিশ্বসমাজের সকলেই জ্ঞানভিত্তিক সমাজের অংশ। জ্ঞান সৃজন, সংরক্ষণ ও বিতরণে উৎকর্ষ ব্যবস্থাপনায় আমাদের সকলকে সম্পৃক্ত হতে হবে। ২০৪১ সালে উন্নত বাংলাদেশ সৃজনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অঙ্গীকার বাস্তবায়নে শিক্ষায় ‘কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স’ একটি চ্যালেঞ্জ। সরকারের রূপকল্প ২০৪১ ও এসডিজি ২০৩০ অর্জনের লক্ষ্যকে সামনে রেখে এবং প্রযুক্তি র্নিভর চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের উপযোগী একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার জন্য বাউবি-কে জরুরি ভিত্তিতে সম্পূর্ণ অটোমেশনের আওতায় আনা অপরিহার্য এবং বাউবি সেই লক্ষ্যেও কাজ করে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম উদ্দেশ্য সবার জন্য মানসম্মত শিক্ষা, বিশেষ করে আর্থিক অস্বচ্ছলতাসহ আরও বিভিন্ন কারণে যারা দেশের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার সুযোগ গ্রহণ করতে পারেননি অথবা সুবিধা বঞ্চিত হয়েছেন তাদের জন্য শিক্ষার অবারিত সুযোগ করে দেওয়া। উন্মুক্ত ও দূরশিক্ষণ শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে যে কোন শ্রেণি, পেশা ও বয়সের মানুষ নিজ-নিজ অবস্থান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন।

বাউবি নিজস্ব প্রণীত সহজবোধ্য পাঠ্যপুস্তক, ইলেকট্রনিক ও অনলাইন মিডিয়ায় এবং ব্লেডেড পদ্ধতিতে এসএসসি থেকে এমফিল, পিএইচডি পর্যন্ত বিভিন্ন প্রোগ্রাম পরিচালনা করে আসছে। বাউবি দেশের একমাত্র পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যেটি উন্মুক্ত ও দূরশিক্ষণ পদ্ধতিতে দেশের আপামর জনগোষ্ঠিকে শিক্ষিত করার গুরুদায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে।

জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলাসহ সক্ষমতা অর্জনের মধ্য দিয়ে সুখি সমৃদ্ধ জাতি ও উন্নত দেশ গঠনে আমাদেরকে কর্মমুখী শিক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি কর্মমুখী শিক্ষা অধিক গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বে যেসব দেশ দ্রুত উন্নতি করেছে তারা সবাই বাস্তবমুখি শিক্ষা ব্যবস্থায় গুরুত্ব দিয়েছে।

জীবনের চাহিদার প্রয়োজনে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় চালু করেছে কর্মমুখী নানা শিক্ষা, যা এখন জনপ্রিয়তার শীর্ষে। বাউবি-র অনলাইন ও ইলেকট্রনিক শিক্ষা উন্মুক্ত শিক্ষাব্যবস্থায় প্রযুক্তি বান্ধব পরিবেশ সৃজনে সরকারের ডিজিটাল শিক্ষার বাস্তবায়ন ঘটিয়েছে। বাউবি দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিমলে ডিজিটাল শিক্ষার রোল মডেল হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।

বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় এখন তথ্য ও প্রযুক্তিতে স্বয়ংসম্পন্ন একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বাউবি-র শিক্ষার্থীরা অনলাইন সার্ভিস অ্যান্ড পেমেন্ট সিস্টেম (ওসএসএপিএস) এর মাধ্যমে ঘরে বসে কাজের ফাঁকে বিভিন্ন প্রোগ্রামে ভর্তি হতে পারছে। ওয়েব সাইটে পাওয়া যাচ্ছে ই-বুক ও স্টাডি গাইড। বাউবি টিউব, ওপেন টিভি, ওয়েব টিভি, ওয়েব রেডিও, ইউটিউব, টুইটার ও ফেইসবুকের মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসে অডিও-ভিডিও লেকচার দেখতে এবং শুনতে পাচ্ছে। অনলাইনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা নির্দিষ্ট স্থানে বসে শিক্ষককের কাছ থেকে প্রশ্নের উত্তর ও তথ্যের আদান-প্রদান করতে পারছে। স্কাইপ ও ভিডিরেন- এর মাধ্যমে ভিডিও কনফারেন্সিং এবং ভিডিও স্ট্রিমিং এর মাধ্যমে অন লাইন ক্লাশের সুযোগ রয়েছে। শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী সকলের নিকট দ্রুত তথ্য দিতে রয়েছে মোবাইল এসএমএস কমিউনিকেশন সিস্টেম।

বাউবি-র ইনোভেটিভ সফটওয়্যারের মাধ্যমে পরীক্ষার ফল প্রকাশ করে তা অনলাইনে দেওয়া হয়। ঘরে বসেই ফলাফলের ওপর অনলাইনে অভিযোগেরও সুযোগ রয়েছে।

সময়ের চাহিদার সাথে মিল রেখে বাউবিতে চালু করা হয়েছে মাস্টার অব ডিজঅ্যাবিলিটি ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন, মাস্টার্স ইন পাবলিক হেলথ, মাস্টার অব সায়েন্স ইন এগ্রিকালচারাল সায়েন্স, পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিপ্লোমা এই মেডিকেল আলট্রাসাউন্ড, এমপিএইচ এবং বিভিন্ন বিষয়ের ওপর অনার্স, মাস্টার্স, এম ফিল ও পিএইচ ডি প্রোগ্রাম। এছাড়া রয়েছে সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্যদের জন্য অনলাইন কার্যক্রমের মাধ্যমে পৃথক এসএসসি ও এইচএসসি প্রোগ্রাম। বিদেশে বাংলাদেশি কর্মমুখী জনগোষ্ঠী যাতে দক্ষমানব সম্পদ হিসেবে আন্তর্জাতিক বাজারে টিকে থাকতে পারে সে লক্ষ্যে বাউবি চালু করেছে ‘বহিঃবাংলাদেশ একাডেমিক প্রোগ্রাম’।

বাউবি-র শিক্ষায় তৈরি হচ্ছে মানব সম্পদ। সমাজের সুযোগ বঞ্চিত প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এবং দূর্গম এলাকায় বসবাসকারীগণ বাউবি-র অনলাইন শিক্ষার মাধ্যমে নিজ নিজ এলাকায় বসবাস করেও নিজেদেরকে কর্মমুখী করে তুলতে পারছে।